নিঃশ্বাসের কণিকা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৪/২০১২ - ২:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(পূর্বাংশের পর)

কিংবা প্রবাসী বিনোদ মণ্ডলের শ্যামলা মেয়েটা যেদিন আপত্তির মুখে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, আপনে আমার আসল কাকা তো না। কেউ কিচ্ছু জানবো না! সেদিনও সে চোখের ওপর ল্যাপটানো দৃষ্টিতে মেলে ধরেছিলো অদ্ভুত এক দৃষ্টি। যাতে কামনা বা ভিন্ন কোনো তীক্ষ্ণতা থাকলেও তা মোশেদার দৃষ্টির ধারে কাছেও ছিলো না, বরং বারনারী কাঞ্চন বুড়ির চাহনির সমপর্যায়ের বলেই মনে হয়েছিলো।

ধুরো! আমার কথা বুঝেন না নাকি?

রুষ্ট কণ্ঠে কথাগুলো বলার সঙ্গে মোশেদার হতাশা মণ্ডিত একটি দীর্ঘশ্বাসের ঝাপটা যেন তাকে উদ্বেলিত করে তোলে আরো। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে এগিয়ে গিয়ে শরিক হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা দলটির পেছনে। নাজমার বর কায়েসের কোলে চড়া শুক্কুর আলি দু হাতে তার গলা পেঁচিয়ে রেখেছিলো আর ক্ষীণ কণ্ঠে একটু পরপর বলছিলো, ফুফা আমারে বাঁচান। ফুফা গো, আমার বুকের ভিতরডা কেমন জানি জ্বইল্যা যাইতাছে!

গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা দলটির প্রত্যেকেই হাসপাতালে যাবে কিনা বা কতজন যাবে, তা জানা নেই মোস্তাক মিয়ার। বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় অনেকেই যার যার বাড়ির কাছাকাছি আসার পর ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তখনই তার মনে পড়ে, কবর আর শ্মশানের সঙ্গী থাকে দুর্ভাগারা।

গাড়ির রাস্তায় পৌঁছুতে আর বেশি পথ বাকি নেই। সাকুল্যে তারা তিনজন আছে কেবল। অন্য সময় হলে সে নিজে ইচ্ছে করে শুক্কুর আলির সঙ্গী হতো কি না জোর দিয়ে বলতে পারে না। কিন্তু কিছুতেই মোশেদার কথা উপেক্ষা করতে মন সায় দিচ্ছিলো না তার। তার মনে হচ্ছিলো ফের কখনো যদি মোশেদার সঙ্গে দেখা হয় নিশ্চয় সেই দেখাটা হয়তো বিগত কালের নির্বাক সময়গুলোর মতো হবে না। মেয়েদের চোখ সে চিনতে পারে ভালো মতোই। যারা ঘরে পেট পুরে খেলেও বাইরের দু চার টাকার চটকদার খাবারের জন্য মুখিয়ে থাকে।

এ জীবনে বড় রাস্তার দিকে অনেক বারই সে গেছে নানা প্রয়োজনে। কিন্তু আজকের দিনটির মতো আর কোনো দিনকেই এমন ফুরফুরে মনে হয়নি তার। যদিও শুক্কুর আলির কায়েসের কোলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর কোলে। আর হাসপাতালের ঘটনা বা শুক্কুর আলির অবস্থা জানতে অবশ্যই আগ্রহ থাকবে মোশেদার। আর সেই সময়টাতেই সে জানিয়ে দিতে পারবে যে, সেও ইজারা নিতে চায় মোশেদার আপাতত সুরক্ষিত জমিটার।

হঠাৎ তার তলপেটে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে সে। মূত্র থলি যেন আর ভার সামলাতে পারবে না এমন অবস্থা। হয়তো ভিন্ন ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকার ফলে এতক্ষণ ব্যাপারটা অনুভব করতে পারেনি সে। হঠাৎ পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে সে কায়েসের উদ্দেশ্যে বলে, তোমরা আউগাও, আমি পাতলা হইয়া আইতাছি!

বলতে বলতে মোস্তাক মিয়া গ্রামের কাঁচা সড়কের ঢাল বেয়ে নেমে যায় ধান ক্ষেতের দিকে। তাড়াহুড়োয় লুঙ্গি উঁচিয়ে বসতে বসতেই মূত্র ত্যাগ করতে আরম্ভ করে। পুরো দেহের অস্বস্তি কাটিয়ে আরামে চোখ বোজে সে। আর তখনই ঠিক লিঙ্গের গোঁড়ায় অকস্মাৎ আগুনের ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে ধানক্ষেতের ভেতর। সে অবস্থাতেই সে লিঙ্গের অবস্থা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কাত হয়ে পড়ে থেকে লিঙ্গের গোঁড়ায় দুটো রক্তাক্ত বিন্দু আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার পুরো দেহ বিবশ হতে আরম্ভ করে।

দূর থেকে কায়েস আর নজিরের ডাক ভেসে আসে, মোস্তাক! মোস্তাইক্যারে!

কিন্তু তার কণ্ঠ ফুড়ে কোনো শব্দ বের হয় না অথবা সাড়া দিতে ইচ্ছে হয় না। যেন সহস্র কালের নিদ্রার ভার চেপে বসেছে তার চোখের পাতায়। সেই সঙ্গে তার সমস্ত ভাবনা জুড়ে ভেসে বেড়াতে থাকে দুটি শাণিত দৃষ্টির পিঙ্গল ছায়া আর প্রকম্পিত দুটি গোলাপি ঠোঁটের মায়াবী মূর্ছনা।

মোস্তাক মিয়া এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো নাকে নল আর হাতে স্যালাইনের সূঁচ। একই হাসপাতালে। পাশাপাশি দুটো লোহার খাটে শুয়েছিলো সে আর শুক্কুর আলি। কিন্তু শুক্কুর আলির পুরো দেহ ঢাকা ছিলো সাদা চাদরে। পাশেই উদ্বিগ্ন মুখে পাশাপাশি বসেছিলো স্ত্রী আলেয়া আর বয়রা সোবানের স্ত্রী মোশেদা। শুক্কুর আলির কথা সে জানতে পেরেছিলো মোশেদার মুখেই। আলেয়া যখন তার জন্যে দুধ গরম করতে গিয়েছিলো, সেই অবসরে সেলাইন লাগানো হাতটির একটি আঙুল মুঠিতে ধরে মোশেদা বলেছিলো, আপনের বিপদ কাটছে। কিন্তুক শুক্কুর আলি নাই। ওই যে দেখেন, সাদা চাদরের নিচে পইড়া আছে!

মোশেদার মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না তার। তবু সে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিলো শুক্কুর আলির লাশের দিকে। পাশে কান্না রত কবিরুদ্দিনকে দেখে কষে দুটো লাথি দিতে ইচ্ছে করছিলো তার। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় জেনেই হয়তো বিড়বিড় করে বলে উঠেছিলো- শুয়োরের বাচ্চা!

দূর থেকে হয়তো দেখতে পেয়েছিলো আলেয়া মোশেদা ধরে রেখেছে তার স্বামীর আঙুল। হয়তো নারীসুলভ ঈর্ষা থেকেই বলে উঠেছিলো- নডিরা নিজের আর পরের ব্যাডার সোয়াদ না দেখলে মন ভরে না?

মোশেদা তখনই মোস্তাকের হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে বলেছিলো, যাই। শুক্কুর আলির লাশের লগে বাইত্যে যাইগা। আপনের বউ তো আছে। আমার আর কাম নাই!

হয়তো সেদিনের আক্ষেপ বা মনোবেদনার বাষ্প উপচে উঠতে চেয়েছিলো মোশেদার চোখে। যা সে আড়াল করতে চেয়েছিলো দ্রুত সরে গিয়ে। পরে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে আলেয়া। কিন্তু মোশেদা প্রসঙ্গে সব সময়ই চুপ থেকেছে মোস্তাক। কিন্তু মোশেদা আর কখনোই তাকে ধরা দেওয়া তো দূরের কথা মুখোমুখি হওয়ারও সুযোগ দেয়নি। আজ দীর্ঘকাল পর গ্রামের পরিচিতি থেকে অনেক দূরে এই আত্মীয়-স্বজনহীন নির্বান্ধব পরিবেশে সদ্য বিধবা মোশেদার কাছে মোস্তাকই যেন বড্ড আপন আর কাছের মানুষ বলে মনে হয়েছিলো। যে কারণে তাকে দেখেই বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেনি সে। কান্নারত মোশেদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এতক্ষণ অতীতের ছায়া টপকে মনে মনে ভাবনার পথে ঘুরে দেখে এসেছে তখনকার মুহূর্তগুলোকে।

কিছুক্ষণ পর ধাতস্ত হলে সহসা নিজেকে মোস্তাকের বাহুপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলে উঠেছিলো মোশেদা, তোমার বউ দেখলে আবার অশান্তি করবো!

কিন্তু মোস্তাক বছর দুয়েক ধরে বিপত্নীক হলেও কথাটা জানাতে পারে না মোশেদাকে। কোনোক্রমে শুধু বলতে পারে, মানুষের বিপদ বেশিদিন থাকে না।
তারপরই সে দ্রুত পায়ে অপেক্ষমান লোকজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠানে রাখা সোবানের মুর্দাফরাশের একটি হাতল চেপে ধরে দুহাতে।

(শেষ)


মন্তব্য

cresida এর ছবি

আপনার গল্পের শুরুটা মোহনীয়, পুরোটা জুড়েই সেটা ছিল। কিন্তু শেষ টা কেমন জেন মনঃপুত হোল না। লেখকের ইচ্ছে হয়তো। পাঠক হিসেবে বলবো- একটা ভালো লেখাকে শেষে এসে গলা টিপে মারলেন।

ক্রেসিডা

সুপ্রিয় দেব শান্ত এর ছবি

শেষটা কোনভাবেই ভালো লাগলো না।

লেখককে অনুরোধ করবো শেষটা নিয়ে আবার চিন্তা করতে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমার তেমন ইচ্ছা ছিলো না। আপনাদের দুইজনের কথা প্রায় একই রকম শোনাইলো। তবে আপনার কথাটা অবশ্যই রাখতে চেষ্টা করবো।

এবং আজ ২০ এপ্রিল আপডেট করে দিলাম। ধন্যবাদ।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

cresida এর ছবি

আগের থেকে বেটার। তবু আর একটু সময় দিলে আপনি হয়তো আরো ভালো কোন সমাপ্তি এনে দিতে পারতেন। মোস্তাক আর শুক্কুর আলী এর পাশাপাশি খাটে শুয়ে থাকাটা অনেক বেশি সিনেমাটিক! ব্যাপার টা এড়ানো যেত। কিছু প্রশ্ন ও উঠে সেখানে, মোস্তাক যখন হুশ ফিরলো তখন শুক্কুর আলীর লাশ দেখাটা তার পাশে? শুক্কুর আলী বিষাক্রান্ত একজন, হসপিটালে যাবার পর তার পেট ওয়াস করা হবে ( প্রান থাকা অবস্থায় করতে পারলে) , বেঁচে যাবে; অথবা করার পর ICU তে থাকবে অবস্থা সঙ্গিন হলে! আবার মোস্তাকের ব্যপাটাও গুরুতর হলে তাকে ও খোনে নেয়া হতে পারে। তবু ব্যাপারটা ম্যাচ খায় না, অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে! আবার হতে পারে গ্রাম্য বা মফস্বলে ততো সুবিধা নেই বলে সিরিয়াস ও সাধারন রুগী পাশাপাশি থাকে! কিন্তু মোস্তাক যখন প্রখম খেকেই একটু পিছিয়ে ছিল, এবং প্রাকৃতিক কাজ সমাধা এর লক্ষ্যে ক্ষেতে নেমে আরো দেরী করেছিল, স্বভাবতোই তার অবস্থান আরো পরে আবিস্কৃত হবার কথা।

যাক সেসব কথা, ভালো লাগলো লেখা। আশা করি মাইন্ড করেন নি। লেখার শুরুটা খুব বেশি ভালো আর বর্ননা মোহনীয় বলেই শেষটায় আমার(পাঠকের) এক্সপেকটেশন একটু বেশী ছিল আর কি।

ক্রেসিডা

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

দূর থেকে কায়েস আর নজিরের ডাক ভেসে আসে, মোস্তাক! মোস্তাইক্যারে!

-হয়তো কায়েস বা নজির কোনো পদক্ষেপ নিয়ছিলো। হতে পারে একই সময় ওরা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক সময় দেখা যায় যে, হাসপাতালের সিঁড়িতেই এমন ধরনের রোগী মারা যায়। যার শিকার শুক্কুর আলি। বিষে আক্রান্ত হওয়ার সময়টাও দেখা প্রয়োজন। অনেক ধরনের সাপ আছে ততটা বিষাক্ত নয়। তা ছাড়া এমনটা কোথাও পড়েছি যে, সাপ বিষাক্ত হলেও সব ছোবলে সে বিষ ত্যাগ করে না।

উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ICU থাকে কিনা আমার জানা নেই, অন্তত আমার চোখে পড়ে নাই।

আপনার পাঠ ও প্রতিক্রিয়া খুব ভালো লাগলো। তবে, আমি কিন্তু গল্প শেষ করে দিয়েছি ধান ক্ষেতেই। বাকিটা ছেড়ে দিয়েছি পাঠকের ওপর। আপনার জন্যই কলেবর বাড়ালাম। খসড়া গল্প তো। পুরোপুরি দাঁড় করাবো আস্তে-ধীরে।

ভালো থাকুন সব সময়।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।