চাক নরিস নেভার র‍্যান আ ম্যারাথন

গামা মামা এর ছবি
লিখেছেন গামা মামা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৪/১২/২০১৪ - ১০:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার বন্ধু মাহমুদ আমার প্রথম ম্যারাথনের দিন আমার ফেসবুক পেজে লিখেছিল “দৌড়া মোটা দৌড়া! কেন দৌড়াচ্ছিস, বা কোথা থেকে দৌড়াচ্ছিস জানি না, কিন্তু দৌড়া তুই!” তিন বছর আগেকার কথা। সেই থেকে শুরু – এখনও দৌড়ে যাচ্ছি। বর্তমান ট্যালি – ৪ টা হাফ ম্যরাথন, ৯ টা ম্যরাথন, ৬ টা শহর, ৫ টা স্টেট। শেষটা ছিল দশ দিন আগে – ড্যালাস, টেক্সাসে – একজন পঞ্চাশোর্দ্ধ ভারতীয় ভদ্রলোকের সাথে দেখা হল – সেদিন রিলে ম্যারাথন দৌড়াচ্ছিল (৪-৬ জন মিলে পুরো ২৬.২ মাইল শেষ করে)। নিজের অংশটুকু দৌড়ে তখন বাকি সবাইকে সঙ্গ দিচ্ছে। জানুয়ারিতে তার ৭০তম ম্যারথন দৌড়াবে – ইতিমধ্যেই আমেরিকার ৫০টি স্টেটে দৌড়ে ফেলেছে , ভারতে গিয়েছিল সম্প্রতি আরেকটি দৌড়ে অংশগ্রহণ করতে। আমাকে বলল – ১২ বছর ধরে দৌড়াচ্ছে সে। ৫০ স্টেট, ৭০ ম্যরাথন এর পরও তার পরবর্তী লক্ষ্য – বোস্টন ম্যরাথন – ম্যারাথনারদের মক্কা। ক্রিকেটারদের কাছে লর্ডস যেমন, ফুটবলারদের কাছে ক্যাম্প ন্যু, টেনিস খেলোয়াড়দের কাছে উইম্বেলডন – ম্যারাথনারদের কাছে বোস্টন ঠিক তাই। তারপর – হয়তো ৬টি মহাদেশ, আর মোটে ৪টেই তো বাকি। আমি যে কজন ম্যারাথনারের কথা শুনেছি, লেখা পড়েছি – সবাই একই রকম – প্রত্যেকে পরের দৌড়, পরবর্তী বছরের চিন্তা করছে। এটা একটা নেশার মত – একবার ধরে বসলে ছেড়ে দেয়া বেশ কষ্ট।

ভিন্ন ভিন্ন শহরে ম্যারাথনের একটা ব্যাপার হল প্রতিটা শহরের কিছু বিখ্যাত মনুমেন্টের পাশ দিয়ে যাওয়া হয় – মেম্ফিসে সেন্ট জুডস হাস্পাতালের ভেতর দিয়ে দৌড়ানোর সময় ৪-১২ বছর বয়সী ক্যান্সার রোগীদের মাঝ দিয়ে, শিকাগোতে লেকের পাশে অথবা ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে, লিটল রকের ব্রিজের উপরে কিংবা সেগ্রেগেশন যুগের লিটল রক হাই স্কুলের পাশ দিয়ে, ইন্ডিয়ানাপলিসে বাটলার ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে, অথবা আমার নিজের শহর ফেয়েটভিলে ডিকসন স্ট্রিট কিংবা লেক ফেয়েটভিলের পাশ দিয়ে দৌড়ানো। কিন্তু যে কোন দৌড়ের শ্রেষ্ঠ অংশ – রাস্তার পাশে ঠান্ডা, বৃষ্টি, বাতাসের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা মানুষের সাড়ি। কেউ কেউ বন্ধু বা প্রিয়জন কারো জন্য দাড়িয়েছে, কেউ কেউ হয়তো বা দেখতে বের হয়েছে ‘এরা কোন আজীব চিজ, ৪-৫ ঘন্টা টানা দৌড়াবে?’ – বেশির ভাগই দাঁড়িয়ে আছে যারা দৌড়াচ্ছে তাদেরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য। সবাই বিরামহীন ভাবে তালি দিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ ‘হাই ফাইভ’ দিচ্ছে, তারস্বরে চিৎকার দিচ্ছে, অনেকের হাতেই প্ল্যাকার্ড অথবা সাইন। বেশ কিছু কমন সাইন ও আছে – “ওয়্যাট! আই থট ইট ওয়াজ ২.৬২ মাইল!”, “ডব্লিউ টি এফ!! – হোয়্যার’স দ্যা ফিনিশ?”, “টো নেইলস আর ফর সিসিস”, আর আমার ফেভেরিট “চাক নরিস নেভার র‍্যান আ ম্যারাথন” । চাক নরিসকে যদি কেউ না চিনে থাকেন – তাহলে সংক্ষেপে বলা যায় সে হল আমেরিকার রজনীকান্ত – তার নামে অনেক ‘আর্বান লেজেন্ড’ আছে - হেনো কিছু নেই নরিস করতে পারে না, বা করেনি। কিন্তু চাক দাদা (তার নাতি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলা শোনা যায়) কখনও ম্যরাথন দোড়িয়েছে বলে কারো জানা নেই। যতদূর জানি রজনীকান্ত, কিংবা আমাদের আপন অনন্ত জলিল ভাইও দৌড়ায়নি – অন্তত সে দিক দিয়ে তো এগিয়ে আছি আমি।

ম্যারাথনের জন্য প্রস্তুতি সম্ভবত খোদ দৌড়ের চাইতেও বেশি কষ্টের। প্রতিদিন সকাল ৬ টার সময় উঠে বের হও, রোদ বৃষ্টি এমনকি বরফের মধ্যেও ট্রেনিং করতে হয়। কারন যদি ঠিকভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে ম্যারাথনে যাই, বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে দৌড়ের মাঝে ক্র্যাম্প বা মাসেল পুল করবে – আর এগুলো থেকে খুব সহজেই মাঝারি গোছের ইঞ্জুরি হয়ে যেতে পারে – যার জন্য ডাক্তার হাটাহাটিও কমিয়ে দিতে বলে । যতদিন যায় তত সয়ে যায়, মাঝে মাঝে আলসেমি লাগে । কিন্তু আমার মত অনেকের কাছেই ম্যারাথন বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব – না দৌড়াতে পারলে হাঁসফাঁশ করতে থাকে ভেতরে । দশ দিন আগে শেষ ম্যারাথনের দিন দুই হ্যামস্ট্রিংয়েই খুব বাজে ক্র্যাম্প হয়েছিল, এখনো তার মাশুল গুনছি । জোরে হাটলেই হাঁটুর পিছে টান লাগছে, তাই আগামী উইকেন্ড পর্যন্ত বিশ্রাম, তারপরে আবার দৌড় । ততদিনে হয়তো বরফ পড়া শুরু হয়ে যেতে পারে, তাই আগে থেকেই বরফে দৌড়ানোর জন্য ট্র্যাকশন ক্লিটস কিনে রেখেছি, সাথে ফেইস মাস্ক আর মোটা রানিং গ্লাভস ।

আমার মনে হয় না যারা ম্যারাথন দৌড়ায় তাদের কেউ দাবি করবে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা করে তারা। সবাই শখের বশেই দৌড়ায় – জীবিকার তাড়নায় এই কাজ করতে হলে তা নিতান্তই দুঃখজনক হবে । কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে চিন্তা করলে এটা অনেকের জীবনেরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শারীরিক যতটা না, তার চেয়েও মানসিক অনেক বেশি। প্রায় সব ম্যারাথনের সাথেই হাফ ম্যারাথনও থাকে। দুই দল এক সাথেই শুরু করে দৌড়, ১০ মাইলের দিকে আলাদা হয়ে যায় সাধারনত, প্রতিবারই আমার মনে হয় ওদের সাথে চলে যাওয়াই মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হতো – এখন পর্যন্ত একবারও যাই নি। আমার ম্যারাথন দৌড়ানো হয়তো আমার নিজের সাদামাটা জীবনে অ্যাড্রেনালিন রাশ, আর বিক্ষিপ্ত মনে কিছু শান্তি ছাড়া তেমন কিছু দেয় না বিশ্ব বা সমাজকে ( আমার বাবা, মা হয়তো গর্ব করে মাঝে মাঝে বলতে পারে তাদের ছেলে ম্যারাথন দৌড়ায় )। বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে আমার দৌড়ের কোন অবদান নেই, ইবোলা দমন বা চাইল্ড হাংগার ফাইটেও আমার ম্যারাথন কোন কাজে আসবে না – সে সবের জন্য অন্য কিছু করতে হবে আমাকে। কিন্তু তারপরও আমি বেশ গর্বের সাথে এটা ত বলতে পারি “চাক নরিস নেভার র‍্যান আ ম্যারাথন” – কজনই বা সেটা পারে?

পুনশ্চ – এটা আমার প্রথম পোস্ট, নিতান্ত বড় ভাইয়ের কাছের মার খেতে চাইনি বলে দেয়া। আমি কোন বিশারদ না, ভালো লেখকও না – বানান/ব্যাকরণ ভুল আর ইংরেজি শব্দের যথেচ্ছা ব্যবহার ক্ষমা করবেন। কারো যদি দৌড়ানোর বিষয়ে শখ বা প্রশ্ন থাকে রানার্স-ওয়্যার্ল্ড বলে একটা বেশ ভালো সাইট আছে। দেখতে পারেন। আর ওহ, যদি সময় পান গুগলে চাক নরিস জোক্স / ফান ফ্যাক্টস স্যার্চ দিয়ে দেখতে পারেন।


মন্তব্য

ধ্রুব আলম এর ছবি

চমৎকার লেখা। সঙ্গে দুয়েকটা দৌড়াদৌড়ির ছবি দিয়ে দিলে বেশ হতো। হাসি

গামা মামা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি ছবিটা লেখার মান আরও নামিয়ে দিবে, এই ভয়ে আর দেয়া হয় নাই ।

সত্যপীর এর ছবি

চাক নরিসকে যদি কেউ না চিনে থাকেন – তাহলে সংক্ষেপে বলা যায় সে হল আমেরিকার রজনীকান্ত – তার নামে অনেক ‘আর্বান লেজেন্ড’ আছে - হেনো কিছু নেই নরিস করতে পারে না, বা করেনি।

হ এই দেখেনঃ

..................................................................
#Banshibir.

ধ্রুব আলম এর ছবি

চাক নরিসরে না চিনলে কিন্তু খবর আছে খাইছে

সবজান্তা এর ছবি

আরে ব্রাদার! স্বাগতম... আপনারে এইখানে দেইখা খুব ভালো লাগতেছে!

ম্যারাথনের গল্প পড়ে বেশ ভালো লাগলো। আমি সব সময়ই ভাবতাম, ম্যারাথনের মতো একটা কষ্টসাধ্য দৌড়, যেখানে টাইমিং-ই শুধু না, টিকে থাকার ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ কেন দৌড়ায়? একটা পয়েন্ট জানা গেলো- টু বিট দ্য চাক নরিস!

সিনেমা, বই, খেলা, লর্ড অভ দ্য রিংস থেকে শুরু করে আরো অসংখ্য বিষয়ে আপনার পক্ষে লেখালিখি করা সম্ভব। আশা করি সচলায়তনে ব্লগিং চালায় যাবেন। বেস্ট অভ লাক!

মরুদ্যান এর ছবি

আপনার ব্লগ খালি ক্যাঁ? আগের সব লেখা মুইছা দিসেন?

সবজান্তার কমেন্ট পইড়া মনে হ‌্ইতাসে সচলে পরথম লিখা [?] ইয়ে, মানে...

কিপ দৌড়াইং!

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।