কাইদান দুই : ইউরেই-দাকির গল্প

খেকশিয়াল এর ছবি
লিখেছেন খেকশিয়াল (তারিখ: শনি, ৩১/০৫/২০০৮ - ৪:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
হোকি প্রদেশের কুরোসাকা গ্রামের ধারে ইউরেই-দাকি নামে একটা পাহাড়ী ঝর্না আছে । ইউরেই-দাকি মানে ভুতেদের ঝর্না । এমন অদ্ভুতনামী ঝর্নাটির ঠিক নীচেই আছে একটা ছোট শিন্তো মন্দির ( লৌকিক দেব-দেবীর মন্দির ), দেবতা টাকি-দাইমিয়োজিনের মন্দির । বিশ্বাসীদের প্রণামী নেবার জন্য মন্দিরের সামনেই আছে কাঠের তৈরী একটি টাকার বাক্স । আর বাক্সটিকে ঘিরে আছে একটি গল্প ।

হাড়কাঁপানো শীতের সন্ধ্যা । কুরোসাকার এক কারখানায় কাজ শেষে আড্ডা দিচ্ছিল সব মেয়েরা । সারাদিন গাঁজার আঁশ পাকানোর পর বসেছিল ওরা বড় কয়লাদানিটাকে ঘিরে । গল্প করছিল সবাই, ভুতের গল্প । নানাবয়সী মেয়েগুলো মেতে উঠেছিল নানারকম অদ্ভুত ভুতের গল্পে । যখন মোটামুটি ডজনখানেক গল্প বলা শেষ, ছমছমে পরিবেশে যখন উসখুস করছিল বেশীরভাগ মেয়ে, ঠিক তখন, কয়লা উস্কে দেবার জন্যই যেন বলে উঠল ছুঁড়িটা, “শুধু ভাবো ! এমন রাতে তুমি একা একা গেছ ইউরেই-দাকির ধারে !”
“হো-ও-ও-ও... ! ’ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, হেসে উঠল পরক্ষণেই ।
“ আমি যতগুলো গাঁজা আজ পাকিয়েছি সব দিয়ে দেব তাকে, যদি সে যেতে পারে ! ” বলে উঠল একজন ।
“ আমিও ” সায় দিল আরেকজন , “আমিও দেব” বলে উঠল তৃতীয়জন ।“মনে হয় আমাদের সবাই দেবে” হেসে বলে উঠল চতুর্থজন । বসে বসে সব দেখছিল মেয়েটি । ইয়াসুমোতো ও-কাতসু বলেই ডাকত সবাই । স্বামী ভাল ছুতার মিস্ত্রী । ওদের কথা থামতেই উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে, পিঠে বাঁধা দু-বছরের ছেলেটাকে নিয়ে । ছেলেটা তখন ঘুমে বিভোর ।
“শোন মেয়েরা .. তোমরা যদি আসলেই রাজী হও যে তোমাদের আজকের করা সব কাজ আমার নামে দেবে, আমি ইউরেই-দাকির ধারে যাব । ” বলে উঠল ও-কাতসু । সবাই চেঁচামেচি জুড়ে দিল আবার । মুখ বাঁকিয়ে হাসছিল কেউ, কেউ বা করছিল ঠাট্টা । ও-কাতসু কিন্তু শক্তমুখে একই কথা বলে যেতে লাগল বারবার । একটু পরে সবাই যখন বুঝলো ও আসলে মজা করছে না, চুপ হয়ে গেল একদম । রাজী হয়ে গেল এই শর্তে, যে ও যদি আসলেই ওখানে যেতে পারে তো সবাই তাদের ভাগের পাকানো আঁশ ওকে দিয়ে দেবে ।
“ কিন্তু কি করে বুঝবো যে তুমি ওখানে গেছো ? ” বলে উঠল একজন । “ কেন.. ওকে বল মন্দিরের টাকার বাক্সটা সাথে করে নিয়ে আসতে!” খনখনে গলায় বলে উঠে বুড়ী, যাকে দাদী বলেই ডাকত সবাই .. “ওতেই বোঝা যাবে ও গেছে, কি না”
“ নিয়ে আসবো আমি তোমাদের টাকার বাক্স ” বলল ও-কাতসু আর বেরিয়ে পড়ল সেই শীতের রাতে, পিঠে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে বেঁধে ।

সেদিন রাতে বাইরে ঠান্ডা ছিল ঠিকই কিন্তু কুয়াশা ছিল না মোটেও । দেখা যাচ্ছিল সব পরিষ্কার । ফাঁকা রাস্তা দিয়ে জোর পা চালাতে চালাতে ও-কাতসু ফেলে গেল আশেপাশের বাড়িগুলো, শীতের উপদ্রবে শক্ত দোর দেয়া সব। গ্রাম থেকে বেরিয়ে খোলা রাস্তায় নেমে প্রায় দৌড়াতে শুরু করল ও । ছুটল জমাটবরফ যত ধানের জমি দুধারে ফেলে, তারাদের আলোয় পথ দেখে । প্রায় আধ-ঘন্টা এ ভাবে চলার পর উঠল চূড়ার তলের সরু রাস্তায়টায়, বাতাস বইছিল জোর । যতই এগুচ্ছিল ও, বাড়ছিল অন্ধকার, পথের রুক্ষতা । জানত ও সবই, তাই একটু পরেই শুনতে পেল ঝর্নাটির গুমগুম শব্দ । যখন রাস্তা মিশলো উপত্যকায়, গুমুগুমে ঝর্না তখন কোরাসে চেঁচাচ্ছে । সামনে তাকাল ও-কাতসু, দেখল ঝর্নাটাকে । শুভ্র সাদা পড়ছিল প্রবলবেগে, চারপাশের গুমোট আধাঁর কেঁটে । আস্তে আস্তে এগুল ও মন্দিরের দিকে, টাকার বাক্সটা দেখতে পেল । হাত বাড়াল, আর ...
“ওই! ও-কাতসু ! ” গমগমে গলায় বারণ করে উঠল যেন কেউ, ঝর্নার উপর থেকে । জমে পাথর হয়ে গেল ও ভয়ে, দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতন ।
“ওই ও-কাতসু ! ” আবারও, এবার যেন বকা দিয়ে উঠল, বেশ জোরে ।
কিন্তু ও-কাতসু আসলেই ছিল বেশ শক্ত ধাঁচের মেয়ে । হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দম নিল ও বুক ভরে, বাক্সটা বাগালো.. আর দিল দৌড় । এক ছুটে এসে থামল একেবারে বড় রাস্তায়। এতক্ষন শুনছিল দেখছিল না কিছুই । দমটা নিয়েই আবার ছোটা শুরু করল ও, এবার থামল কারখানার দরজায় ।

হুড়মুড় করে ঢুকলে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, চোখ কপালে তুলল টাকার বাক্সটা দেখে, টাকি-দাইমিয়োজিনের বাক্স ! ছেকে ধরল সব ওকে, শুনতে লাগল গল্প । ও-কাতসুও বলতে লাগল, কিভাবে গেল ও, কিভাবে ওর নাম ধরে ডাকছিল কন্ঠস্বরটা, তাও একবার নয়, দুবার । “কি মেয়েরে বাবা ! কি সাহস ! ” বলে উঠল সবাই, “এই, সব পাকানো আশ ওকে দিয়ে দে এখুনি !”
“কিন্তু তোমার ছেলেটার নিশ্চয়ই বেশ ঠান্ডা লেগেছে” বলে উঠল বুড়ী দাদী, “ওকে নিয়ে এসো আগুনের ধারে ।”
“আহারে কতক্ষন খায়নি, ওর মনে হয় খিদেও লেগেছে, আগে দুধ দেই একটু ” বলল ও-কাতসু
“ বেচারী ও-কাতসু ..” ...পিঠের বোঁচকাটা খুলছিল বুড়ী ... “কিন্তু তোমার পিছনে এত ভেজা কেন !”
“ একি !! এ তো রক্ত ! ” চিৎকার করে উঠল বুড়ী.. হাত লাগালো তাড়াতাড়ি !
আর তখন, বোঁচকা খুলে বেরিয়ে এলো জামাকাপড়ের একটা দলা.. রক্তে ভেজা । ভিতরে চারখানা ছোট ছোট হাত পা ছাড়া ছিল না কিছুই, মাথাটিও না ।

Lafcadio Hearn এর The Legend of Yurei-Daki গল্প অবলম্বনে


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কী ভুতুরে!!!!! ভয়ানক!

জিজ্ঞাসু

খেকশিয়াল এর ছবি

মূল গল্পটা পড়ে আমিও ভয় পেয়েছিলাম রে ভাই !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

শাহীন হাসান এর ছবি

পড়লাম রূপকথার ভাঙাবাড়ি, হররগহ্বর!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

খেকশিয়াল এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ শাহীন ভাই

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

খুব ভাল অনুবাদ। গা ছমছম ভাবটা শেষ অবধি ধরে রেখেছে।

খেকশিয়াল এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

জাপানে এতদিন থেকেও জাপানের এইসব কাহিনী জানা হয়নি। আপনার কল্যাণে পড়তে পারছি। ধন্যবাদ।
ভাইয়া আপনি কি জাপানে থাকেন?
-উলুম্বুশ

খেকশিয়াল এর ছবি

না ভাই আমি জাপানে থাকি না, তবে যাবার ইচছা অনেকদিনের । ধন্যবাদ আপনাকে ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

রণদীপম বসু এর ছবি

ধাক্কা খাইলাম !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

খেকশিয়াল এর ছবি

গল্পগুলা আসলেই ধাক্কাদায়ক !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

গুরু, সাব্বাস! দারুণ হয়েছে! পুরো পাঁচ তারা! গল্পটা পড়ে শুধু গা-ই শিরশির করছে না... মনের মধ্যে একটা হাহাকারও জেগে উঠেছে... কেমন যেন মন খারাপ করা গল্পও, আমার নিজের একটা ছোট বাচ্চা আছে তো... তাই! মেয়েটির মোটেই উচিত হয় নি বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

খেকশিয়াল এর ছবি

মৃদুলদা গল্পটা লিখতে আমার কষ্ট হয়েছে বেশ, বাচ্চার কথাটা যে কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না । ধন্যবাদ আপনাকে ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

রায়হান আবীর এর ছবি

দারুন অনুবাদ হৈছে।
---------------------------------

খেকশিয়াল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ।
ওই মিয়া অই সাইন্স ফিকশনটা আবার চালু করো, মজা লইও না !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সবজান্তা এর ছবি

নাহ ! আপনি আসলেই সচলের জি এইচ হাবীব। খাইছে

বেশ গা ছমছম হয়েছে ভূতের গল্পটা। আসলে ট্র্যাডিশনাল ভূতের গল্প যেমন, এমন লোকের সাথে সময় কাটানো যে মারা গেছে আগেই কিংবা হঠাৎ করে পথচারী সংগীর উধাও হয়ে যাওয়া বেশ একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। এ ধরণের গল্পের মধ্যে একটা নতুনত্ব ( যদিও আজ থেকে কত বছর আগের গল্প এটা কে জানে !! ) আছে, যেটাকে খুব উপভোগ করেছি।

দারুন কমরেড, চালিয়ে যান । চলুক


অলমিতি বিস্তারেণ

খেকশিয়াল এর ছবি

ধন্যবাদ কমরেড ।
একেবারে অন্য ধরনের গল্পগুলি । কয়াইদান নামেই একটা মুভি আছে ৬৮ সালের দিকে বানানো, ওইখানে চারটা গল্প আছে , সবগুলাই বেশি জোস, নিস আমার থেকে ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি পাঠক আর দর্শক হিসেবে খুবই খারাপ। গল্পের কষ্টেও কাঁদি। সিনেমা নাটকের কষ্টেও কাঁদি। এখন বাচ্চাটার জন্য কষ্ট পাইতাসি!
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হু... ভালো হইছে... চলুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

স্পর্শ এর ছবি

দারুণ অনুবাদ!! হাসি

কিন্তু বাচ্চাটার জন্য খারাপ লাগছে মন খারাপ
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

দ্রোহী এর ছবি

ডরাইছি.........


কি মাঝি? ডরাইলা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।