চক্র

খেকশিয়াল এর ছবি
লিখেছেন খেকশিয়াল (তারিখ: বুধ, ২৫/০২/২০০৯ - ২:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
রাস্তাটা পাশাপাশি এক মানুষ লম্বা হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ বড়ই হবে। ভাঙ্গা চাঁদের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতে তাই মনে হল পরিতোষের দেখে।
‘ধ্যাত শালা! আবারও হারিয়েছি!’
ছুটিতে গ্রামের বাড়ি এসেছিল ও কদিন বেড়াবার জন্য। এমনিতেই করে এক বিরক্তিকর চাকরী, আর এ কবছরের খাটুনিতে অস্থির হয়েই ও ঠিক করেছিল যে নাহ, গ্রামের দিকে এবার একটা ঢু মারতেই হবে, অনেকদিন যাওয়া হয় না। তিনদিন কাটিয়ে আজকে রাতের গাড়িতে উঠার কথা।
‘ধুর বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, সুধীরকে সাথে নিয়ে আসলেই হত’ মনে মনে ভাবল ও। জায়গাটা বড়ই অদ্ভুত। এদিকটায় আগে এসেছে বলে ওর মনে পরে না। এইখানে এত বড় একটা সুরঙ্গের মত রাস্তা থাকলে ওর ঠিকই মনে পড়ত। এই কদিনে গ্রামটাও এত তাড়াতাড়ি বদলে গেছে, চেনা রাস্তাগুলোও ভেঙ্গেচুরে যে অবস্থা হয়েছে যে চলতে ফিরতে বেশ কষ্টই হয়েছে ওর। তবে মন ভরে গিয়েছিল এতদিন পরে গ্রামে আসতে পেরে, যেতে কষ্টই হোক।
‘ধুর আজকে যাবই না, পরশু অফিস গিয়ে ঈমন ভাইকে কিছু একটা বানিয়ে বলে দিলেই হবে।’ ভেবে ঘুরে দাঁড়াল ও, হাঁটতে যাবে এসময় কে জানি ডাক দিল দূর থেকে, --
‘ও ভাই, আছেন নাকি।’ একটু দৌড়েই এলো যেন লোকটা, ‘ভাই আপনি কি বাস স্টেশন থেকে এসেছেন? কোনদিক ধরে গেলে পৌছতে পারব বলতে পারেন? ..অনেকদিন পরে এসেছিতো এদিকে, একদমই ভুলে গেছি!’
পরিতোষ হেসে ফেলল, বলল, ‘আরে ভাই আমারও একই অবস্থা, আমিতো ভাবছিলাম আজকে ফিরে যাব, কালকে রওনা দেব আবার।’
‘তাই?’ মুখটা যেন চুপসে গেল লোকটার। ‘এখন কি করি বলুনতো, আমার যে আজকে ফিরতেই হবে, বস যে ঠেটা স্বভাবের লোক!’
লোকটাকে দেখে খুব পরিচিত লাগল ওর, বলল,
‘আচ্ছা আপনি কোথায় থাকেন? ঢাকায় চাকরী করেন?’
‘হ্যাঁ, আছি একটা ব্যাঙ্কে। বন্ধে এসেছিলাম ঘুরতে। আমার নাম কামাল, আপনি?’
‘আমি পরিতোষ’ বলে হাত মিলাল ও, ‘তো.. কি মুস্কিলে পড়লাম বলুন তো!’
‘আমি যতদূর জানি এখানে কোন গলি দেখিনি...’ বলল পরিতোষ।
‘আমি ভাই গলি টলি কিছুই জানি না। শেষ এসেছিলাম তাও চার বছর আগে, কিচ্ছু মনে নাই।’

লোকটাকে দেখে বেশ মায়াই লাগল পরিতোষের।
‘আপনার কাছে মোবাইল আছে? আমারটায় চার্জ শেষ হয়ে গেছে, থাকলে বড়ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানা যেত..’ করুণ মুখে বলল কামাল।
মোবাইল এগিয়ে দিতে দিতে একবার আকাশে তাকালো পরিতোষ, নাহ একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না এখন, বেশ মেঘ করেছে।

২।
বাশবনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে জোনাকি দেখতে দেখতে চলছিল পরিতোষ। সামনেই টর্চ ধরে কামাল। কামালের বড়ভাই ফোনে ওকে যা বলল তাতে বোঝা গেল ওরা অনেক ঘুরে এসেছে আসল রাস্তা থেকে। সামনে যে বাশবনের গলি আছে এদিয়েও যাওয়া যাবে তবে এইদিকে কোন সাঁকো নাই, নৌকায় পার হতে হবে ওদের। ঠিক কামালের পীড়াপিড়িতে না, অনেকটা নৌকার কথা শুনেই রাজী হয়েছিল পরিতোষ ওর সাথে আসতে। তবে কামাল ভদ্রলোক বেশ ভীতুই বলতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে যখন বাশঝাড় হালকা হয়ে আসতে শুরু করল পরিতোষই প্রথম দেখল নদীর পারটা। এট্টুক চাঁদের আলোতেও চকচক করছিল পারদের মত। পারেই একটা নৌকা।
পরিতোষই ডাক দিল, ‘কি মাঝি, ওপার যাবে?’
‘চলেন..’ চোখ না মিলিয়েই বলল বুড়ো মাঝি।
পরিতোষের কেমন জানি লাগল হঠাৎ, মনে হল এই ব্যাপারগুলো যেন আগেও ঘটেছে, এই যে এভাবে পথ হারানো একজনের সাথে দেখা হওয়া, নৌকায় চেপে বসা। ‘মজা তো!’ ভাবল ও। ততক্ষনে মাঝি নৌকা ছেড়ে দিয়েছে।
কামাল খালি ইতিউতি তাকাচ্ছিল, আলো খুঁজছিল ওর চোখ। বলল,
‘আচ্ছা মাঝি ভাই, ওইপারে নাইমা কতখন হাটা লাগব বাস টার্মিনাল যাইতে?’
‘টার্মিনালো নি যাইবেন?... তা লাগব মনে করেন পাঁচ দশ মিনিট। পারের থে এট্টু দুরেই দেখবেন ডিসির বিল্ডিং, ওইহান থিকা রিশকা পাওয়া যায়’
রিকশার কথায় কামালকে যেন বেশ আশস্ত মনে হল। পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনল গোল্ড লীফ।
‘সিগারেট চলবে?’ প্যাকেট বাড়িয়ে রেখে বলল কামাল।
‘না ধন্যবাদ, আমি খাই না’ পরিতোষ হেসে বলল, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একবার মাঝিকে। বুড়ো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
‘আচ্ছা আমি কি আপনাকে চিনি?’ বলে উঠল পরিতোষ, ‘মানে আগে কি কোথাও দেখা হয়েছিল?’ বুড়ো মাঝিকে জিজ্ঞেস করল ও।
‘কি জানি বাবা, আপ্নেরেও মনে হয় আমি দেখছি কোনানো.. কি জানি বাবা, বুড়া হইয়া গেছি, কিছু ঠাহর ও করতাম পারি না মনেও থাহে না।’
‘আচ্ছা চাচা ঝড় বৃষ্টি নামব নাকি ?’ বলে উঠে পরিতোষ, চারদিকে ভালই বাতাস হচ্ছিল শো শো করে।
‘আরে ডরান ক্যা আপ্নেরা! ছইয়ের নিচে বন গা, এইতো আর মাত্র পাঁচ মিনিট।’
কিন্তু আর পাঁচ মিনিট কোন আলাই বালাই দেখল না পরিতোষ। এখনো কোন পার বা দূরের বন-বাদাড়ি চোখে পড়ে নি, বেশ ঘুম পাচ্ছিল ওর।

৩।
পরিতোষের মনে হচ্ছিল ও যেন ডুবে যাচ্ছে, মনে হচ্ছিল কোন স্বপ্ন দেখছিল ও। খুব ভয়ের স্বপ্ন দেখলে যেমন হয়, মানুষ যেমন হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে, ওভাবেই উঠতে গেল ও, আর তখনই পানির ঝাপ্টায় ধড়মড় করে জেগে উঠল ও। ওর বুঝতে সময় লাগল কি হচ্ছে.., চারদিকে বাতাস আর বৃষ্টিতে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। নৌকা প্রায় ডুবে গেছিল। কামালের গলার শব্দ শুনতে পেলো ও তখন, দূর থেকে আসছিলো যেন, ‘ভাই আপনি সাঁতার জানেন? ভাই আপনি সাঁতার জানেন?’
পরিতোষ সাঁতার জানে না! হঠাৎ দেখল বুড়ো মাঝি লাফ দিয়ে পানিতে পড়ছে! পড়ার সাথে সাথেই উঠে গেল নৌকাটা একদম খাড়া হয়ে, আর পড়ল সজোরে বুড়োর মাথার উপরেই। ভোঁতা একটা শব্দে শিউড়ে উঠল ও।
‘অসম্ভব! এতো মিল কি করে হয়? কিন্তু কোথায় ছিল এইসব স্মৃতি?’ প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে ভাবতে লাগল ও, ঝড়ের ঝাপ্টা খেতে খেতে...

পারে উঠতে কামালের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পরিতোষকে পিঠে নিয়ে অনেকদূর আসার পর যখন আর পারছিল না তখন হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছিল ও পরিতোষের। আর পারছিল না ও, হাত পা ছেড়ে দিচ্ছিল ওর। কিন্তু পরিতোষ যেন কাঁকড়া, শক্ত করে ধরে রেখেছিল ওর গলা। কিন্তু পারল না শেষ পর্যন্ত, কামাল ছাড়িয়ে নিয়েই পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছিল ওকে দূরে। ফোঁপাচ্ছিল কামাল । পরিতোষ তখন একেবারে নিস্তেজ, শ্বাস নিতে পারছিল না আর। আস্তে আস্তে ডুবছিল ও পানিতে। ঝড় তখন থেমে এসেছে, ভাঙ্গা চাঁদের আলোয় ও তখনো দেখছিল কামালের সাঁতরে যাওয়া শ্যাওলা ঘোলাটে পা, কোথায় যেন ও দেখেছে সবকিছু, কিন্তু মনেই করতে পারল না ও আর।

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি হাঁটতে হাঁটতে! ..এটাই বাকি ছিল!’ চোখ কচলাতে কচলাতে ভাবছিল ও, সামনের রাস্তা দেখেই থেমে গেল। রাস্তাটা পাশাপাশি এক মানুষ লম্বা হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ বড়ই হবে। ভাঙ্গা চাঁদের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতে তাই মনে হল পরিতোষের দেখে। ...

কোন এক গ্রামের এক নদীর পারে এক ঝড়ের রাতে নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছিল মাঝি সহ এক যাত্রী। ঐ নৌকাতে এক তৃতীয় ব্যক্তিও ছিল যে কিনা সাঁতরে বেঁচেছিল। কিন্তু এরপর আরো অনেক তৃতীয় ব্যাক্তিকেও নাকি সাঁতরে পার হতে হয়েছিল সেই নদী। ডুবেও মরেছিল নাকি অনেক, কোন কোন বিশেষ রাতে।


মন্তব্য

এনকিদু এর ছবি

ওরে বাবা রে ... ভয় পেয়েছি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

গল্পের নাম হিসেবে "চক্র" খুব হিট যাচ্ছে, মনে হয় চোখ টিপি
২২ তারিখেই তো একটা গল্প দেখলাম এই নামে!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

কীর্তিনাশা এর ছবি

গল্পতো চরম হইছে ! চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

চক্রটা কি দেজাভুঁ'র-ই?
ব্যাপারটা বেশ হৈছে।
বড়ই চিন্তাযুক্ত। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

অবনীল এর ছবি

লা জবাব। চরম কন্সেপ্ট। আসাধারন ডেলিভারি। ক্যারি ওন ওইয়েইও্যার্ড সন চোখ টিপি

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

খেকশিয়াল এর ছবি

হগলরে ধন্যবাদ।

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।