পুরনো জমাট বাঁধা রোজনামচা

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: সোম, ০১/১০/২০০৭ - ৩:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


দো'তলা বাসের উপর তলার একদম সামনের সীটটা পেয়েছি আজকে। আমাদের প্রিয় সীট। এখানে বসলেই কেমন যেন মনে হয় টুরিস্ট বাসে করে শহর দেখতে বের হয়েছি। বেশ একটা মজার অনুভূতি। যাক, ভালই হল!

বাসটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

অবশ্য যাবারই কথা। লাস্ট স্টপ সেই হাউগাং। আমাদেরই নেমে পড়ার কথা ছিল বুগিস এর কাছে কোথাও। কিন্তু নামা হল না। এখন বাসের এরকম অবিরাম চলতে থাকা নিয়ে ভাবনাটাই অবান্তর। ইদানীং সবকিছুতেই বেশ একটা ফিলোসফিকাল ভাব চলে আসে। তাই মনে হয় এমন মনে হল।

'কি রে, কি ভাবছিস?' - তোর হঠাৎ প্রশ্নে ঘোর কাটল।

'বাসটা কেমন চলছে তো চলছেই, দেখলি?' - আমি বেশ একটা ভাব নিয়ে বলি।

'বাস তো চলবেই! আর একনাগাড়ে কই চলল? মাঝে-মাঝেই তো থামছে আর রোবটের মত মানুষ উঠছে-নামছে। তুই ঠিক আছিস?'

'কি জানি!'

তুই আর কথা বাড়ালি না। আমার ঠিক থাকার ঠিক কথা না। হাতে সময় কমে আসছে খুব দ্রুত। ঠিক থাকলে বুগিস ছাড়িয়ে এখন ল্যাভেন্ডার ক্রস করে এতদূর চলে আসতাম না হয়তো কোন কারণ ছাড়া। যেখানে নামার কথা ছিল, সেখানে বাসের বেল বাজানোর আগে আগে হয় তো বলে বসতাম না, 'চল না আজকে হাউগাং পর্যন্ত চলে যাই!' তুই-ও কি ঠিক আছিস? মনে হচ্ছে না। ঠিক থাকলে তখনই বাসের বেল বাজিয়ে দিতি। আমরা তাহলে আর এখন হাউগাঙের পথে থাকতাম না। হয়তো এতক্ষণে বুগিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতাম বা উঠে যেতাম অন্য কোন অচেনা বাসে।

হাতে সময় কমে আসতে থাকলেই বোধ হয় এরকম পাগলামী মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে হুট করে। আমার এক বন্ধুর একটা লাইন মনে পড়ে গেল - 'পাগলামী, ঘুরে ফিরে'।

যা হোক, গল্প করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না। সেটা আমার 'বকরবাজ' স্বভাববিরুদ্ধ। রেপুটেশান বলে কথা! আমার তাই পুরনো-নতুন নানান গল্প মনে পড়ে যেতে থাকে, মুখ নিশপিশ করতে থাকে, যেন এগুলো এই বাসযাত্রায় না শেয়ার করলেই না! তাছাড়া হাতে সময়ও খুব কম। আবার কবে দেখা হয়!

'জানিস, এক দিন কি হয়েছে? আমরা পুরনো বন্ধুরা সব আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ আমার ইয়া লম্বা পাগলাটে বন্ধু তূর্য এসে কখন যে পিছন থেকে আমার মাথায় সিগারেটের ছাই ফেলে চলে গেছে, আমি টেরই পাইনি! আশে-পাশের সবার হাসি শুনে পরে টের পেলাম। এই রকম বাটু হওয়াই বিপদ! কি একটা বেইজ্জতি, বল!'

'হুমমম...এইটা এর আগেও একবার বলেছিস।' - তোর গলায় স্পষ্ট বিরক্তি আর হাল ছেড়ে দেবার সুর।

'মাত্র একবার শুনেছিস? গুড। তাহলে আরো কয়েকবার বলা যাবে এখনো।' - আমার উৎসাহে কোন ভাটা পড়ে না।

তোর একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম। কিন্তু সেটায় বিচলিত হবার প্রশ্নই আসেনা। না শোনার ভান করে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম।

'জানিস, আরেকবার কি হয়েছিল? ক্যান্টিনের সামনে বসে আছি আমি আর আমার দুই পুরনো বন্ধু। তিনজনে বসে খুব আয়েশ করে চটপটি খাচ্ছিলাম। আহা! শহীদ ভাইয়ের হাত ছিল মাশ'আল্লাহ একখান! ঢাকার বেস্ট চটপটি বানাতেন। তো সেদিন কি হল শোন -'

'আচ্ছা, তোর সেই বন্ধুগুলো তখনো কি 'পুরনো' ছিল?' - আমাকে মাঝপথে থামিয়ে হঠাৎ তোর প্রশ্ন।

মুহূর্তের জন্য মনে হল বাসটা যেন দুলে উঠল। আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। খুব কম সময়ই আমার মত কোন চ্যাটারবক্স বাকরুদ্ধ হয়ে যায় এমনভাবে। আজকে দিনটাই কেমন যেন। সবকিছুতেই অন্য রকম একটা ভাবের ভাব।

'না, ছিল না। তখন ওরাই শুধু বন্ধু ছিল। ওদের ঘিরেই ছিল গোটা দুনিয়া।' - একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলাম।

'এই এখন যেমন আমরা বন্ধু? আমাদের নিয়েই আমাদের পৃথিবী? এরকম ছিল?' - তুই হঠাৎ কেমন যেন ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেলি।

এর উত্তর আমি কী দেব? হুট করে তুই কেন এসব বাজে বকা শুরু করলি? কী লাভ? কিন্তু আজকে দিনটাই পাগলাটে আর সময়টাও বিটকেলে ভাবে তাড়াতাড়ি করে কই যেন চলে যাচ্ছে। এরকম সময়ে এরকমই হয় হয়তো।

'আচ্ছা, তুই এই যে সারাদিন তোর পুরনো বন্ধুদের গল্প করিস, ক'দিন পরে আমাকে নিয়েও এমন গল্প করবি, না? তোর অন্য কোন 'নতুন' বন্ধুর কাছে? তখন আমিও তোর 'পুরনো' বন্ধু হয়ে যাব, না?'

বাসটা চলতেই থাকে। মাঝখানে শুধু হঠাৎ হঠাৎ করে কারো কারো নেমে যাবার প্রয়োজন পড়ে। বেল বেজে ওঠে, সাথে স্ক্রীনে লেখা ওঠে 'BUS STOPPING'। আমাদের পাশ কাটিয়ে কেউ কেউ নেমে চলে যায় তাদের গন্তব্যে। আবার দূর থেকে হাত বাড়িয়ে থাকা কেউ কেউ তড়িঘড়ি বাসে উঠে পড়ে আমাদের পাশ কাটিয়েই বসে পড়ে কোথাও বা দাঁড়িয়ে যায়, যেমন আমরাও করি প্রতিদিন। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ সময় নেই একদম। আরো একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়। তাই সময়টাকে ধরে রাখার যাবতীয় চেষ্টা চলতে থাকে ক্রমাগত। হঠাৎ করেই বুকের জমাট বাঁধা উথাল-পাথাল কষ্ট বের হয়ে আসতে চায়। আর সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসে। তবে হাউগাং এখনো অনেক দূর।

[প্রিয় নজমুল আলবাব ভাইয়ের ছোট গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে।]


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।