মাছি

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: শুক্র, ১৮/০৭/২০০৮ - ৪:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকক্ষণ থেকেই ভোঁ ভোঁ করছিল মাছিটা।
দরজা-জানালা সব আটকানো। বাইরের শব্দ ভালো লাগে না আমার, খোলা বাতাসও না। বদ্ধ সেই ঘরে মাছির শব্দটাই অনেক বড় শোনাচ্ছিল। অশেষ বিরক্তি। ছোট্ট একটা মাছিও কেমন বিগড়ে দিতে পারে পরিবেশ! অথচ এক টিপেই কিন্তু পিষে দেয়া যায় প্রাণীটাকে!
আমি অন্ধকার ঘরে নরম গদির বিছানায় শুয়ে থেকেই গলা বড় করে ডাকলাম, চুপ কর মাছি!
সাথে সাথে মাছির শব্দটা থেমে গেল। খুব হালকা অস্পষ্ট একটা আওয়াজ শোনা গেল, চুপ করলাম!
বাঃ... আমার হাসি পেয়ে গেল, কথা বলা মাছি? আবার বেশ আদবলেহাজ অলা তো!
বললাম, হচ্ছেটা কী?
মাছিটা একটু চুপ করে থেকে বলল, কী আবার হবে?
গলায় একটু ঝাঁঝ এনে বললাম, শব্দ করছ কেন?
কই? শব্দ করছি না তো? আমি তো চুপচাপ উড়ছি! খাবার খুঁজছি!
তোমার ওড়াতেই তো শব্দ হচ্ছে!
কী করব বলেন! আপনার কাছে যেটা বিরক্তিকর শব্দ, আমার কাছে সেটা খাবার খোঁজা...
ভালোই তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা জানো...
বেয়াদবি নিয়েন না, কিন্তু পেটের খিদে খুব খারাপ জিনিস জানেন... মুখ দিয়ে কোনো নরম কথা বেরোয় না, যা বেরোয়, সবই চাঁছাছোলা!
পেটে খিদে আছে ভালো কথা, আমার ঘরে এসেছ কেন?
আপনার ঘর? এটা আপনার ঘর? ...মাছিটা মনে হয় থমকে গেল।
কেন, তোমার কি সন্দেহ আছে?
একটা হালকা হাসির আওয়াজ পেলাম। মাছিটা হাসছে। খুব চাপা একটা হাসি।
চড়া গলায় বললাম, হাসছ কেন?
মাছিটা হাসতে হাসতেই বলল, রাগ করবেন না... আপনার এই বাড়িতে আরো অনেক প্রাণী আছে, যারা মনে করে বাড়িটা তাদের...
মানে?
সবার আগে বলতে পারি আপনার বাড়িঅলার কথা। আপনি যাকে মাস মাস ভাড়া দিয়ে বাসাটা নিজের মনে করছেন। তার বিশ্বাস, এই বাড়িটা তার। বাড়িঅলার একমাত্র ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে, সেও মনে করে এই বাড়িটা তার, বাপ মারা গেলেই... সেই ছেলের প্রেম তার খালাতো বোনের সঙ্গে, যে বোন প্রায় সময়েই গ্রাম থেকে এসে এই বাড়িতে থাকে... সেই মেয়েটাও মনে করে এই বাড়ি তার, বিয়ের পর ছেলেটাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে মালিকানা তার নামে লিখিয়ে নেবে, তারপর...
তারপরও আবার আছে?
জ্বি। আপনার এই বাসাতেই দুটো ইঁদুর, শখানেক পিঁপড়া আর পাঁচটা টিকটিকি আছে, যারা মনে করে এই বাড়িটা তাদের।
কী সাঙ্ঘাতিক!
সাঙ্ঘাতিকের কিছুই নেই। পিঁপড়ারা পড়ে থাকা ময়লা খেয়ে সাফ করে, টিকটিকি পাঁচজন আমার মতো অবাঞ্ছিত পোকামাকড় খেয়ে শেষ করে... ইঁদুরগুলো বাইরের কোনো ক্ষুধার্ত ইঁদুরকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না, কারণ তারা বিশ্বাস করে এটা তাদেরই বাসা, এখানেই তারা খায়, ঘুমায়, স্বপ্ন দেখে, নিজের বাসাটাকে নিরাপদ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আপনি যেমন আপনার বিশ্বাস নিয়ে বাঁচেন, তারা বাঁচে তাদের বিশ্বাস নিয়ে... কারো বিশ্বাসই ছোট বা বড় না...
বাঃ! তুমি তো দেখছি রীতিমতো দার্শনিক মাছি!
হাঃ হাঃ! আমি কিন্তু খুব সাধারণ কথাই বলছিলাম...
তা তুমিও কি এটা নিজের বাড়ি বলে মনে করছ নাকি?
নাঃ! সেরকম কিছু না! তবে আপনার এই বাসাটাকে যদি আমি ভালোবেসে ফেলতাম, তাহলে নিজের বাড়ি মনে করতাম!
ভালোবাসলেই নিজের বাড়ি?
ভালোবাসা দিয়েই তো সবকিছু নিজের হয়। দেখেন না, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলে, তুমি শুধু আমার! কেন বলে?
তুমি তো সবজান্তা মাছি দেখছি! ...পাঁউরুটি খাবে?
পাঁউরুটি? কোথায়?
ঐ যে, টেবিলের ওপরে...
মাছিটি গিয়ে বসল টেবিলের ওপর। এবার দেখতে পারলাম তাকে। ছোট্ট নীল একটা মাছি। একটা আঙ্গুল দিয়েই পিষে দেয়া যায়। অথচ কথা তার কত বড় বড়।
আমি পাঁউরুটি খুঁজে পাচ্ছি না...
আমি দেখিয়ে দিচ্ছি দাঁড়াও...
আমি উঠে এলাম বিছানা থেকে।
এই যে...
ঠপাত করে একটা আওয়াজ হল!
আমার ডান হাতে পাকানো ম্যাগাজিনটার গায়ে ছোট্ট একটা লালচে হলুদ দাগ। রক্তাক্ত মাছিটা এখন পড়ে আছে টেবিলের ওপর। শালার সবজান্তা মাছি!
রাতেরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে লাইট নিভিয়ে ঘুমোতে গেলাম। আবার সেই ভোঁ ভোঁ আওয়াজ।
আমার দুই চোখে তখন মাত্র ঘুম লেগে এসেছে। ঘুমের ঘোরেই বললাম, চুপ কর মাছি!
স্পষ্ট গলায় উত্তর শুনলাম, চুপ করলাম!
সাথে সাথে আমার ঘুম চটে গেল! চোখ খুলে বললাম, তুমি?
হ্যাঁ... আমি!
কিন্তু তোমার তো দফারফা সেরে দিয়েছি আজ দুপুরেই!
তাতে কী? আমি তো তখন পাঁউরুটির স্বপ্ন দেখছিলাম, নরম নরম পাঁউরুটি, তাতে ডিমের গন্ধ, ময়দার গন্ধ...
স্বপ্ন দেখছিলে তো কী হয়েছে?
আপনি জানেন না? স্বপ্নরা কখনো মারা যায় না! এজন্যই তো আপনি আমাকে স্বপ্নে দেখছেন, আমার স্বপ্ন ট্রান্সফার হয়েছে আপনার মাথায়... আপনি এখন আমার আওয়াজ পাবেন, আমাকে দেখতে পাবেন, কথা বলবেন আমার সাথে... আমি বেঁচে থাকব আপনার স্বপ্নে...
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। চেঁচিয়ে বললাম, বিশ্বাস করি না আমি... তুমি শয়তান মাছি! তুমি মিথ্যা!
তাই কী হয়? স্বপ্ন কখনো মিথ্যা হয় না। স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকে না। স্বপ্ন একদিন সত্য হবে বিশ্বাস করি বলেই তো আমরা অসহনীয় বর্তমানটাকে সহ্য করতে পারি! অ্যাকুরিয়ামের যে ছোট্ট বোবা একটা মাছ, সেও স্বপ্ন দেখে আর বিশ্বাস করে একদিন আবার মুক্ত জলাশয়ে ফেরত যেতে পারবে...
চুপ! একদম চুপ!
মাছিটা চুপ করল। কিন্তু আমি টের পেলাম, সে আছে। আশেপাশেই ঘুরফির করছে। একটু দাঁড়িয়ে আবার সামনের দুপায়ে ঘষাঘষি করছে। উড়ে উড়ে খাবার খুঁজছে। তার ওড়ার শব্দ হচ্ছে ভোঁ ভোঁ।
যত রাত বাড়তে থাকল আমি তত ছটফট করতে লাগলাম কাটা মুরগির মতো। মাথার ভেতরে শব্দটা বাড়ছেই। ভোঁ ভোঁ... ভোঁ ভোঁ...
আমি দু-কান চেপে অস্থির হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছি। কিন্তু সেই শব্দ ক্রমাগত বেড়েই চলছে...আর পারছি না... আমি কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বললাম, ক্ষমা চাই, আমি ক্ষমা চাই মাছি... আমি পাপী, আমি খুনি...

ভোররাতের দিকে সব ঠাণ্ডা হয়ে এল। সেই ভোঁ ভোঁ আওয়াজ এখন আর শুনতে পাচ্ছি না। কারণ এখন আমি আরেকটা স্বপ্ন দেখছি। কী সুন্দর একটা স্বপ্ন! আমি উড়ছি আর উড়ছি... আর কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছি... অবশেষে পেলাম সেটা, এক টুকরো পাঁউরুটি... আঃ কী চমৎকার তার আঘ্রাণ, কী মিষ্টি সেটা, কী নরম... আমার মনে হল, শুয়ে ঘুমিয়ে থাকি সেখানে... আঃ কী মধুর স্বাদ... পাঁউরুটি এত মধুর হয়?... কী আশ্চর্য সুন্দর একটা জীবন...
স্বপ্ন এত সুন্দর হয়? হতে পারে? এত সুন্দর বলেই তো স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে না, স্বপ্ন ছড়িয়ে যায়... এক থেকে আরেকে, আরেক থেকে অনেকে...
আমি মনে মনে কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম মাছিটার কাছে। তার স্বপ্নের জন্য।
যেটা সে আমাকে মৃত্যুর আগে দিয়ে গিয়েছে।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকে না। স্বপ্ন একদিন সত্য হবে বিশ্বাস করি বলেই তো আমরা অসহনীয় বর্তমানটাকে সহ্য করতে পারি!

-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মাঝ রাতের বর্ষণ এর ছবি

অদ্ভুত । মালিকানার হায়ারআরকি বিশ্লেষন, অতঃপর বলে দেয়া স্বপ্নের গুরুত্ব ! মাছিটা যেন থাকে আমাদের সবার অন্তরে । অসাধারন ।

সৌন্দর্য্যে কাতর হয়ে পরার পরপরই হতাশ হয়ে পরি, তাঁর নশ্বরতায় ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

খুব ভাল, একটু অন্য রকম লাগল হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

স্নিগ্ধা এর ছবি

মৃদুল - চমৎকার এবং চমৎকার!

লেখার ভঙ্গি ছাড়াও, লেখায় প্রকাশিত আপনার জীবনদর্শনও আমার বড়ই পছন্দ ... হাসি

জিজ্ঞাসু এর ছবি

আশা আর স্বপ্ন নিয়েই অসহনীয় বর্তমান কাটাই আমরা। এটা কিন্তু মৃত্যুর একমুহূর্ত আগেও আমাদের ছেড়ে যায় না। যদিবা ছেড়ে যায় কাউকে, সে নিজেই নিজেকে আর সহ্য করতে পারে না...
খুব সুন্দর লেখা। ধন্যবাদ।

-------------------------------------
সহজ করে বলতে মোরে কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাছি দর্শনটা ভালো
কিন্তু মাছির জায়গা কুকুর হলে কিন্তু স্বপ্নের খবর ছিল

উদাস এর ছবি

দুর্দান্ত একটা গল্প। অনেক ধন্যবাদ মৃদুলদা।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

অসাধারণ-মোক্ষম এবং তীব্র। আমাদের সবার কথা। আমরাও ভাবি বাড়িটা আমাদের।

অভিবাদন মৃদুল।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সবজান্তা এর ছবি

বস সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু ২ টা অংশের তীব্র পেরতিবাদ জানাই।

তুমি তো সবজান্তা মাছি দেখছি

এইটা কইলেও প্রব্লেম অত হয় নাই, কিন্তু এইটা কী কইলেন ,

শালার সবজান্তা মাছি!

এখন কন, আমি কি আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুম :@


অলমিতি বিস্তারেণ

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍খুবই অনবদ্য গল্প।

অ্যাকুরিয়ামের যে ছোট্ট বোবা একটা মাছ, সেও স্বপ্ন দেখে আর বিশ্বাস করে একদিন আবার মুক্ত জলাশয়ে ফেরত যেতে পারবে...

শখের গৃহপালিত জীবজন্তু, পাখি-মাছের মালিকেরা, বোধ হয়, এভাবে চিন্তা করেন না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অনিন্দিতা এর ছবি

অসাধারন!
আপনার বই বেরিয়েছে?
না হলে সামনের বই মেলায় দেখতে চাই।

স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকে না। স্বপ্ন একদিন সত্য হবে বিশ্বাস করি বলেই তো আমরা অসহনীয় বর্তমানটাকে সহ্য করতে পারি!

সত্যিই তো!এভাবে ভাবি নি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।