লজ্জা

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: মঙ্গল, ০৯/০৯/২০০৮ - ১১:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাস্তার ঐপারে তাকান। ঐ ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছেন ? ঐ যে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরনে, মুখে মস্ত একটা গোঁফ। দেখে বেশ রাগি মানুষ বলে মনে হয়, কিন্তু দৃষ্টিটা কেমন উদাস উদাস। এলোমেলো চুলগুলো দেখলে মনে হবে যেন একটু আগেই দমকা হাওয়া দিয়েছিল, তাতেই সব উল্টেপাল্টে গিয়েছে। বয়স কত হবে--পঞ্চাশের ওপরে তো নিশ্চয়। কেমন অসহায়ের মতো ভঙ্গি করে রাস্তার ঐপারে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন রাস্তা পার হতে চান, কিন্তু কী করে পার হতে হয় জানা নেই। ঐ ভদ্রলোককে নিয়েই আমাদের গল্প।
আজকে উনি সাঙ্ঘাতিক একটা লজ্জা পেয়েছেন, তাঁর জীবনে এরকম ঘটনা আর ঘটে নি। লজ্জা তিনি মাঝেমধ্যেই পান বটে, তাঁকে পেতেই হয়, না পেয়ে কোনো উপায় থাকে না। ভীষণ ভুলোমন যে তিনি, প্রায় সময়েই বাইরে গিয়ে এটাসেটা হারিয়ে ফিরে আসেন। বর্ষার দিনে ছাতা, শীতের দিনে শাল, এছাড়াও চশমা, রুমাল, টুপি, কলম, পানের ডিবে, এমন কি পায়ের জুতো পর্যন্ত ভুলে রেখে খালি পায়ে হাঁটতে বাড়ি চলে আসেন। বাড়ি আসার পর তাঁর গিন্নি যখন হইহই-রইরই কাণ্ড লাগিয়ে দেন, তখন তাঁর খেয়াল হয়, তাই তো, ওটা যে ভুলে ফেলে এলাম ! তখন ভীষণ লজ্জা পান তিনি, লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করতে থাকে।
গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে গিন্নি যখন বলেন--তবু ভালো যে নিজে ফিরে এসেছ, ভুল করে নিজেকে ফেলে আস নি... তখন আরো লজ্জা পান তিনি, পারলে মাটির সাথে মিশে যান।
অথচ তিনি একজন জাঁদরেল হেডমাস্টার। বাঁদর দিয়ে ঠাসা আবুল কালাম স্মৃতি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব তিনি গত সাত বছর ধরে পালন করছেন এবং তাঁর দাপটে এক বছরের মধ্যেই সব বাঁদরগুলো লেজ খসে মানুষ হয়ে গিয়েছে।
অবশ্য স্কুলেও ভুলোমন নিয়ে তাঁকে বিব্রত হতে হয়, একেকদিন এরকম হয়--অঙ্কের টিচার তিনি, ঢুকে পড়লেন বাংলা ক্লাসে। দেখা গেল এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করছেন, আজকে তোদের কী যেন পড়া ছিল। ছাত্রটি ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার, এটা তো বাংলা ক্লাস ! সেটা শুনে তিনি খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন, তারপর অস্বস্তিভরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইয়ে, আমি তোদের যেন কোন সাবজেক্ট পড়াই !
এই ভুলোমনের জন্যই আজকে তাঁকে বাইরের লোকের কাছে ভীষণ লজ্জা পেতে হল। নিজের জিনিস ভুলে ফেলে এলে তবু ঘরের ভেতর সেই লজ্জা পেতে হয়, কিন্তু যখন অন্য লোকের জিনিস নিজের মনে করে নিয়ে আসতে গিয়ে লজ্জা পেতে হয়--তখন?
স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা হোটেলে চা খেতে ঢুকেছিলেন। চা খেয়েটেয়ে যখন হাতের ছাতাটা নিয়ে উঠতে যাবেন, তখন টেবিলে তাঁর সামনে বসা ফাজিল চেহারার লোকটা বলে উঠল, কিছু মনে করবেন না জনাব আপনি কি বগুড়ার আসাদগঞ্জের নুরুল্লাহ মিয়ার পুত্র সফিউল্লা খন্দকার?
তিনি হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কেন?
লোকটা একটা ফাজিল হাসি হেসে বলল, জনাব, আমিই হচ্ছি বগুড়ার আসাদগঞ্জের নুরুল্লাহ মিয়ার পুত্র সফিউল্লা খন্দকার। আপনি আমার ছাতাটা নিজের মনে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন দেখে ভাবলাম, আমারই ভুল হল কিনা। ভুল হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়, মানুষমাত্রই ভুল করে।
হোটেলের আর দুই-তিনজন যারা লোকটার কথা শুনছিল, তারা ফিচফিচ করে হাসতে লাগল।
তিনি খুব লজ্জা পেলেন, রেগেও গেলেন খুব--ছাতা আপনার সেটা সোজাসুজি বললেই হয়, এত ভণিতা করার দরকার কী?
রেগেমেগে পয়সা মিটিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে এলেন তিনি। ইস, ভুলোমন... এই ভুলোমন নিয়ে তিনি যে কোথায় যাবেন ! কতদিন কত জায়গায় কত কিছু হারিয়ে এসেছেন, আর আজ কিনা আরেকজনের জিনিস নিয়ে কী অবস্থা! ভুলোমন আর কাকে বলে--ছাতাটার দিকে তাকাতেই তাঁর মনে হল, আরে, আজকে সকালে না তাঁর মেয়ে নীরা এই ছাতিটাই হাতে গুঁজে দিয়ে বলছিল, বাবা, আজকে যেন ভুল করে ছাতি হারিয়ে এস না ! অথচ তাঁর তো মনে রাখা উচিত ছিল, ইদানিং তাঁর হাতে আর কিছু দেয়া হয় না হারাবেন বলে।
তাঁর রাগ হচ্ছিল খুব নিজের ওপর, লজ্জাও পাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন রাস্তার ঐপারে। তারপর রাস্তা পার হলেন, বাড়ি ফিরলেন। গিন্নিকে ডেকে বললেন, ভুলোমনের জন্য আজ কি লজ্জাটাই না পেলাম ! আরেক লোকের ছাতা নিয়ে চলে আসছিলাম, সে ডেকে বলল, আপনি কি বগুড়ার আসাদগঞ্জের নুরুল্লাহ মিয়ার পুত্র সফিউল্লা খন্দকার? মানে সে ব্যাটা নিজেই সফিউল্লা খন্দকার, আমার সঙ্গে মশকরা করল আর কি!
গিন্নি চোখ বড় বড় করে কথা শুনছিলেন, কথা শেষ হতে না হতে সেখানেই মেঝের ওপর বসে পড়ে মড়াকান্না শুরু করলেন, ও গো, আমার কী হবে গো? এ কোন মিনসে নিয়ে আমি পড়লাম গো! আরে সফিউল্লা খন্দকার আবার কে, সে তো তুমিই গো! নিজের মাথা নিজেই খেয়ে বসে আছ, হায়, হায়, আমার কী হবে গো!
তখন তাঁর মনে পড়ল, আরে, তাই তো, তিনিই তো সফিউল্লা খন্দকার, তাঁর বাবার নাম নুরুল্লাহ মিয়া। তাঁদের বাড়ি বগুড়ার আসাদগঞ্জ। ইশ, লোকটা কী ঠকিয়েছে!
গিন্নি গলা ফাটিয়ে কান্নাকাটি করছেন, তার মধ্যে মেয়ে নীরা এসে হতাশ গলায় বলল, ইশ, বাবা, আবার ছাতি হারিয়ে আসলে, কী বলে দিলাম আজকে সকালে...
তখন, বগুড়ার আসাদগঞ্জনিবাসী নুরুল্লাহ মিয়ার পুত্র সফিউল্লা খন্দকার আবার ভীষণ লজ্জা পেলেন, লজ্জায় তাঁর ইচ্ছা করল মাটির সঙ্গে মিশে যেতে।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই চমৎকার হয়েছে । এরকম গল্প মাঝে মাঝে পড়তে পারলে মন খুলে হাসা যায় । আর এই হাসি উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ ।
নিবিড়

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ। বহুদিন পর লিখলাম। ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কিন্তু ঐ লোক, মানে যে মাষ্টারসাহেবকে ঠকাল সে কি করে তার নাম,বাপের নাম, বাড়ী জানলো?

গল্পকারের কাছে নিশ্চয়ই সেই সুত্র আছে । নাকি আমি কিছু মিস করলাম?
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ভুলোমনা মাস্টারমশাইকে সে অতি ভালো করে চেনে বলেই এভাবে ছাতি হাতিয়ে নিতে পেরেছে... পরিচিত ঠগ আর কি! দেঁতো হাসি
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হাহাহাহা আহারে বেচারা!, দারুন মজা লাগল চলুক
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

কীর্তিনাশা এর ছবি

অনেক দিন পর মৃদুল ভাইর গল্প। অতিব চমৎকার গল্প।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

গোপাল ভাঁড় এর ছবি

ঠিকাছে
--------------------------------------------
ইয়ান্না রাস্কালা, মাইন্ড ইট

--------------------------------------------
বানান ভুল হইতেই পারে........

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভুলোমনের যে কি বিপদ !
দারুণ লাগলো, মৃদুল ভাই।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

গৌতম এর ছবি

আপনি এতো দিন পর লিখলেন কেন? জরিমানা হিসেবে আরেকটি গল্প দেন।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হাহাহা। দারুন লিখেছেন মৃদুল ভাই। চলুক
আচ্ছা, আপনার নিজের আবার ভুলোমন নয় তো? চিন্তিত
মাঝে মাঝে আমাদের জন্য গল্প লিখতে ভুলে যান! দেঁতো হাসি
_____________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি:
ভুলোমনা মাস্টারমশাইকে সে অতি ভালো করে চেনে বলেই এভাবে ছাতি হাতিয়ে নিতে পেরেছে...

অনেকের ছাতার ভেতরের দিকে নাম-ঠিকানা লেখা থাকে সূতো দিয়ে নয়তো সাদা রঙ দিয়ে। ভেবেছিলাম তেমনই একটা কিছু।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

স্নিগ্ধা এর ছবি

হুমমম - মৃদুল, আরো মজার একটা গল্প চাই হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।