“একাত্তরে ঘাতক দালালরা কে কোথায়” গ্রন্থের প্রনেতা শফিক আহমদের সাথে এক সন্ধ্যা!

এস্কিমো এর ছবি
লিখেছেন এস্কিমো (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৭/২০০৭ - ৯:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যদিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায় - কিন্তু পরাজিতরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে। কিছুটা তখনকার শাসকদলের অর্বাচীনতা কিছুটা উদারতার কারনে ওদের নির্মূল করার পদক্ষেপগুলো তেমন কাজে লাগেনি। তারপর ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ হত্যাকান্ড দেশের গতিপথকে বদলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিভক্ত হয়ে পড়ে - সেই সুযোগে চলে আসে ঘাতক দালালরা সামনের সারিতে। সামরিক শাসকের পদলেহী হয়ে এরা সমাজে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অন্যদিকে পরিকল্পিত ভাবে ইতিহাস বিকৃতি এবং ইতিহাসের সত্যতাকে আড়ালে করে এরা হয়ে উঠে সমাজের এবং রাষ্ট্রের কর্নধার। যেমন একজন দালাল বিচারপতি নুরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট, আব্দুর রহমান বিশ্বাস ষ্পীকার এবং পরে প্রেসিডেন্ট, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী হয়ে যান মন্ত্রী - যিনি নিজ হাতে মানুষ খুন করে কুখ্যাতি লাভ করেছিলে ১৯৭১ এ, আনোয়ার জাহিদ - যিনি ৭১ এ সামরিক বাহিনীর সাথে ব্যবসায়িক সহায়তা করেছিলেন, মাওলানা মান্নান ধর্ম মন্ত্রী। এরই রকমের আরো অনেক ঘাতক দালাল সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও যথাযথ প্রচারের অভাবে তাদের ১৯৭১ এর ভুমিকা যখন মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছিল - তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক শাহরিয়ার কবিরে উদ্যেগে শফিক আহমদ একটা এসাইনমেন্ট নেন। সেই এসাইনমেন্টের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধাদের অবস্থা নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরী করা। আর সেখান থেকেই শুরু হয় এই বইএর শুরু।

এভাবেই শুরু করলেন টরন্টো সফররত শফিক আহমদ ডেনফোর্তের ট্রিলিয়াম স্কুলের এক সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। গত ২৯ শে জুন বিকালে বসা এই আড্ডায় শ্রোতারা অবাক হয়ে শুনছিলেন তখনকার স্রোতের বিরুদ্ধের লেখা ঘাতকদের মুখোশ উন্মোচনকারী এই বইটির লেখকের স্মৃতি কথা।

শফিক আহমদ বলেন - একসময় একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধার সাথে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল তার মেরুদন্ডে আটকে থাকা বোমার টুকরা অপসারনের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে সরকারী উদ্যেগে তাকে পূর্ব ইউরোপের এক দেশে পাঠানো হয়। আগস্টের শেষের দিকে ছিল তার অপারেশনের তারিখ। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর তাকে মোসতাক সরকারের নির্দেশে অপারেশনের একদিন আগে দেশে ফেরত আনা হয়। আরেকজন বুকে বুলেট নিয়ে বসবাস করছিলেন - কিন্তু ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর সরকারী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ায় তার আর কোন পথ খোলা থাকেনি।

এই সব দেখে তরুন শফিক আহমেদ অবাক হয়ে যান। উনি ভাবেন কারা দেশের বীর সন্তানদের এভাবে শাস্তি দিচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে তখনকার ক্ষমতাশীনদের অতীতের খোঁজ নিতে গিয়ে হতভম্ভ হয়ে যান।

এরপর শুরু হয় তার তথ্যানুসন্ধানের কঠিন কাজ। ধীরে ধীরে এবং সতর্কতার সাথে যখন ১০৮ পৃষ্টার এক প্রতিবেদন তৈরী করে ছাপানোর জন্যে সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে নিয়ে যান - তখন শুনতে পান তখনকার তথ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদ এই প্রতিবেদন ছাপাতে নিষেধ করেছেন। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব:) কাজী নুরুজ্জামানানের পরামর্শে এবং সহায়তায় এটাকে হেন্ডবিল হিসাবে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে পটুয়া কামরুল হাসানের প্রচ্ছদ নিয়ে এটাকে বই আকারে প্রকাশিত হয় বই মেলায়। পরবর্তীতে অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র পরবর্তী সংকলন গুলো প্রকাশ করেন।

জনাব শফিক আহমেদ তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন - ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী কর্তৃক যে ধর্ষন করা হয়েছে তার সাথে একমাত্র তুলনা চলে নানজিং এ জাপানীদের ধর্ষনের ঘটনার সাথে। এই বিষয়ে তিনি সুজান ব্রাইনমিলারের “Against Our Will” বইএর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন - ইতিহাসের এই বর্বর এবং কুৎসিত ঘটনার বিচার যদিও এখনও হয়নি - কিন্তু হবে। এই বিষয়ের উপর অনেক কাজ হচ্ছে। তবে উনি আমাদের সবাইকে ইতিহাস সচেতন হবার অধিক ইতিহাস চর্চার কথা বলেন।

একটা বিশেষ বিষয়ে শফিক আহমদে স্রোতাদের সতর্ক করে বলেন - মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক দালালদের ভয়াবহ নির্মমতার সাথে যেন আর কোন বিষয়ে তুলনা না করা হয়। উদাহরন হিসাবে কোন রাজনৈতিক সমাবেশে পুলিশের হামলার পর অনেকে "একাত্তরের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে বলে" বক্তব্য দেন। এই ধরনের উক্তি পক্ষান্তরে একাত্তরে বর্বরতাকে ছোট করা হয়। এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

এ লেখাটা পড়লাম সামহোয়্যারে। কমেন্ট করতে পারতেছিলাম না। ভাল লাগল। ধন্যবাদ আপনাকে।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

আড্ডাবাজ এর ছবি

ভাল লাগল পড়ে। ধন্যবাদ।

অচেনা এর ছবি

ধন্যবাদ পোস্টের জন্যে।

উদাহরন হিসাবে কোন রাজনৈতিক সমাবেশে পুলিশের হামলার পর অনেকে "একাত্তরের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে বলে" বক্তব্য দেন। এই ধরনের উক্তি পক্ষান্তরে একাত্তরে বর্বরতাকে ছোট করা হয়। এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।

একেবারে একশত ভাগ ঠিক।


-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত।

এস্কিমো এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে...
ওদিকে একটু ব্যস্ত আছি...পরে দেখা হবে।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।