অন্য আলোয় দেখা –পর্ব ৪ : প্রিয়পুত্র শমী এবং প্লানচেট

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৯/২০১০ - ১০:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে স্থাপন করেছেন ব্রহ্মবিদ্যালয়। সেখানে বাসাও করেছেন। রথীন্দ্রনাথ ছিলেন ছাত্র। শমীর তখন মাত্র চার বছর বয়স। দিদি মীরার সঙ্গে ছবি আঁকতে যেতেন।

এরমধ্যে তার মা মৃণালিনী দেবী ও মেঝদিদি রেণুকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৭ সেপ্টেম্ব ১৯০২ তাঁদেরকে কোলকাতায় আনা হল। রোগতাপে বিভ্রান্ত রবীন্দ্রনাথ শমীকে তাঁর শিক্ষক সুবোধ মজুমদারের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ সুবোধ চন্দ্র মজুমদারকে লিখেছেন—
শমীর প্রতি দৃষ্টি রাখিয়ো। উহার আহারাদির সময় তোমরা একজন কেহ উপস্থিত থাকিলেই শরীরের অবস্থা কতকটা বুঝিতে পারিবে। যেদিন ক্ষুধা নাই বলিয়া খাইবে না সেইদিন সাবধান হইবে। বিদ্যালয় হইতে বাড়িতে যাতায়াতের সময় অথবা খেলার সময় অধিকক্ষণ রৌদ্র যেন না লাগায়। উমাচরণকে কাছাকাছি সর্বদা হাজির রাখিবে।...কুঠিবাড়িতে দোতলাতেই রথীর সঙ্গে শমী শুইবে—তুমিও যদি সেখানে শুইতে পার ত ভাল হয়।

শমীর মা যখন মৃত্যু শয্যায়—শিয়রে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন তাঁর কবি স্বামী রবীন্দ্রনাথ। বলছেন, একটু ঘুমাও। একটু ঘুমাও। আর মা চেঁচিয়ে উঠছেন, আমি ঘুমাই কী করে—আমার ছোট ছেলেটি রয়েছে দুরে। তিনি চোখ মুদলেন।

১৯০৭ সালের পূজার ছুটি। কনিষ্ঠা কন্যা মীরার অসুস্থতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশ বিব্রত। ছুটিতে শমীকে কোথায় রাখবেন সেই চিন্তায় ব্যাকুল। ভেবেছিলেন আশ্রমের শিক্ষক সুবোধচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে তাকেঁ দিল্লী পাঠাবেন।- কিন্তু সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কথা শুনে পিছিয়ে গেলেন। শরণ নিলেন বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের। তাঁকে লিখলেন শমী কোলকাতা পছন্দ করে না, সেখানে যেতেও চায় না- অথচ ছুটিতে শান্তিনিকেতনে তাঁর একলা ঠেকে। তাই তিনি শমীকে শ্রীশচন্দ্রের শ্বশুরালয় মুঙ্গেরে পাঠাতে ইচ্ছুক-- কেন না শ্রীশচন্দ্রের পরিবারবর্গ তখন সেখানেই। তা ছাড়া- 'শমী এত অল্প জায়গা জোড়ে এবং এত নিরুপদ্রব যে তার আগমনে তোমাদের মুঙ্গের সহরের শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা নেই।'

শেষ পর্যন্ত ১৬ অক্টোবর বিজয়াদশমীর দিন শমীন্দ্রনাথ বন্ধু ভোলার সঙ্গে তাঁর মামার বাড়ি মুঙ্গের যাত্রা করেন। ছুটি-শেষে বিদ্যালয় খোলার মুখে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের কাছে দুঃসংবাদ পৌঁছল শমীর কলেরা হয়েছে। তক্ষুণি (১৭ নভেম্বর) তিনি ডাক্তারসহ ছুটলেন মুঙ্গের- বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে সেখানে যেতে অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রামও পাঠালেন। সকলের প্রচেষ্টা নিষ্ফল করে ৭ অগ্রহায়ণ ( ২৪ নভেম্বর) মাত্র এগারো বৎসর ন'মাস বয়সে শমী শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। ঠিক পাঁচ বছর আগে এমনই এক সাতই অগ্রহায়ণ শমীর মা মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু ঘটেছিল। কী আশ্চর্য যোগ।

পুত্রশোকাতুর রবীন্দ্রনাথ রাত্রে ট্রেনে আসতে আসতে দেখলেন জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথা কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। তাঁর মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনওখানে কোনও সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়- যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।

autoএই সংকল্প নিয়ে শোকাহত শান্তি নিকেতনে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলছেন আশ্রমিকদের সঙ্গে। তাঁর শান্ত সংযম ব্যবহারে সকলে স্তম্ভিত। কেবল তাঁর বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ যখন দেখা করতে এলেন, রবীন্দ্রনাথের চোখে দেখা গেছে জলের রেখা। বড়দাদাও শোকবিমূঢ়, কেবল ছোটভাইয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বারবার অস্ফুট স্বরে বলছেন 'রবি! রবি!' এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠালেন অধ্যাপক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে- যাঁর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ভুবনডাঙায় বেড়াতে যেতেন বালক শমী। একটি পুঁটলি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, শমীর এই কাপড়-জামাগুলো ভুবনডাঙার ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ো।

শমীর একটি নোটবুক ছিল। এই নোটবুকটি হল শমীর গানের খাতা। সে সময়ে তার বাবা যেসব গান রচনা করেছেন সেগুলিই শমী লিখে রেখেছেন। …দশটি পুরো গান আর একটি গানের প্রথম চরণ লেখা আছে। প্রত্যেকটি গানের শেষে ‘শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ –স্বাক্ষর আছে। তার বাবার অনুকরণে সেই স্বাক্ষর। একাদশ সংখ্যক গানের উপরে লেখা আছে ‘বাউল’ : ‘’যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক/ আমি তোমায় ছাড়ব না মা।‘’ গানগুলির পরে ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পটির প্রতিলিপি লেখা। তারপর আর কিছু নেই। সাদা পাতা। খসখস করে ওড়ে। শমীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন--ঠিক যেদিন শমী মারা গেছে, সেদিন পর্যন্ত ডাইরীতে তারিখ আছে।তারপরে আর নেই।

এর পরে শমীর বড় দিদি বেলীদিদি মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সবে তার সঙ্গে দেখা করতে সিঁড়ির মাঝ বরাবর পা রেখেছেন। তখন শুনলেন—বেলী চলে গেছে। তিনি পাগলের মত চলে গেলেন রানুর কাছে। এই মেয়েটি ছিল বেলীর মত। সেখানে তিনি হাহাকার করে উঠছেন।

আর কন্যা মীরার একমাত্র পুত্র নীতিন্দ্রনাথ মারা গেলেন ইংলন্ডে।
রবীন্দ্রনাথের দেখা এই মৃত্যুর মিছিলে ছিলেন—ভাই, বোন, মা, বাবা, ঠাকুরদা, অনেক প্রিয়জন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ই মেষ হয়ে এসেছে তার বংশধারা। তাঁর মৃত্যুর পরে ছোট মেয়ে মীরা যখন মারা গেলেন রবি ঠাকুরের নিজের বলে আর কেউ রইল না পৃথিবীতে। শোকে তাপে তিনি দীর্ণ হয়েছেন। প্রকাশ করেন নি। প্রকাশিত হয়েছে তার লেখায়।
তিনি লেখেন ডাকঘর নাটকটি। সেখানে অমল হয়ে তারার আলোয় ঘুমোতে চেয়েছে রবীন্দ্রনাথের শমী।

একজন বাবা রবীন্দ্রনাথ তার নিজের মগ্নতার মধ্যেই শমীকে পেতে চেয়েছেন। যখন ব্যাকুল হয়েছেন প্লানচেটে শমীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন তার প্রিয়জন নতুন বৌঠানের সঙ্গেও। কথা বলেছেন-জ্যেষ্ঠ কন্যার সঙ্গে—শমীর মায়ের সঙ্গে। বারবার শমীর আত্মাকেই এনেছেন।
শমী জানান, শমী পরলোকে গড়ে তুলেছে একটা নতুন পৃথিবী। বাবাকে বলছে, ‘’শমীর পৃথিবী’ নাম দিয়ে তিনি যেন একটি রচনা লেখেন। রবীন্দ্রনাথ জানান, তিনি যখন পরলোকে যাবেন, তখন সেই পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহায্য করবেন। এই ‘শমীর পৃথিবী’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহলের অন্ত নেই। অন্য আত্মাদের জিজ্ঞেস করছেন, সেই পৃথিবীটা কী রকম।
শমীকে বলেন, তাঁর চরিত্র কবির নিজের মত, দুজনেই ভাবুক। শমী সব সময় বলে, তার অনেক কাজ। রবীন্দ্রনাথ তাতে বিস্মিত হন, প্রশ্ন করেন, কী তোর এত কাজ’? আবার পরক্ষণেই এমনভাবে কথা বলেন, যেন ছাড়তে চাইছেন না, যতক্ষণ কাছে থাকেন, ততক্ষণই তৃপ্তি, ততক্ষন আনন্দ। অল্প বয়সে শমীর মৃত্যু তার স্বাভাবিক চারিত্রিক দৃঢ়তায় সহ্য করেছিলেন বটে, কিন্তু পুত্র শোকাতুর পিতার ভিতরে দুঃখের আগুন সেই বৃদ্ধ বয়সেও যে জ্বলছিল, সব স্নেহ ভালবাসা যে প্রিয়তম কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য জমা হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় শমীন্দ্রনাথের আত্মার সঙ্গে কথাবার্তায়।

একটি দিনে প্লানচেটের রেকর্ড।
৬ নভেম্বর সকাল। ঘরে এল শমী। শমীর আত্মা । রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি। বললেন, শমী, তুই?
--বল না কে?
--শমীর মা?
--না, শমী শমী শমী।
--কেমন আছিস?
--আছি, ছুটে এসেছি। খুব দূরে ছিলাম। যেন আর একটা জগতে। কে যেন ডাকল।
--আমাদের সঙ্গে তোর যোগ আছে?
--ভুলে যাই মাঝে মাঝে। কিন্তু যখন মনে পড়ে, সে এক মজা।
--তোর মা তোর কাছে থাকেন?
--ইচ্ছে করলেই ছুটে আসি। কিন্তু দূরে থাকলে বড় ভাল লাগে।
--বেলাদিদি, রানীদিদি তাদের দেখতে পাস?
--বেলাদিদি আর আমি অনকক্ষণ থাকি।
--বেলাদিদির সঙ্গে তোর ভালবাসা আছে?
--খুব। কিন্তু আমি ভারি চঞ্চল, তাই তিনি রাগ করেন।
--এখানকার দাদাকে (রথীন্দ্রনাথ) মনে আছে?
--সব মনে আছে। মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যেদিন মনে পড়ে, সেদিন আমার ছুটির বেলা।…

বাবা ছেলের গল্প। কিভাবে প্লানচেটটি হচ্ছে? কলমে লিখে লিখে। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করছেন, আর কলমে উত্তরগুলো অক্ষর হয়ে ফুটে উঠছে।
একবার শমীকে অনুরোধ করছেন একটি ছবি এঁকে দিতে বলেছেন। শমী বলছে তার সময় নেই। কবির কথা। বাবার কথা। ছেলের কথা।
ঘটনার সাক্ষীবর্গের মধ্যে ছিলেন আহূত আত্মাসমূহের সঙ্গেকার আলাপচারীর লিপিকার, অমিয় চক্রবর্তী ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ প্রমুখ মহারথীবৃন্দ। কবি অমিয় চক্রবর্তি এই প্লানচেটকে ‘মহাপৌরুষের ছেলেমানুষী’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। শোকাতুর একজন মানুষের ইচ্ছেপূরনের খেলা। তিনি তো পাষাণ দেবতা নন। মানুষ।

অভিজিৎ রায় এই প্লানচেটকে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার দাসত্ব হিসেবে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন—
‘’চিন্তার দাসত্ব'-এর ক্ষেত্রে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমণ্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুরে কুরে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় ব.ড় নামগুলো ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না।‘’

অভিজিৎ রায় যুক্তিবাদি। যুক্তিবাদের দৃষ্টিতেএইসব পরলোকচর্চাকে দুয়ো দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না--রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক জীবনেই হারাচ্ছেন তার অনেকগুলো ভাইবোনকে, নিজের স্ত্রীকে, পুত্রকন্যাকে, নাতিকে-প্রিয়জনকে। এই এদের জন্য তাঁর যে অনন্ত পীড়ন সেটা ভুলতে যদি তিনি কখনো প্লানচেটের নামে কোন শোকভোলানোর আশ্রয় নেন--যদি তিনি আনন্দ বোধ করেন---যদি তার মানসিক স্ট্রেস কমাতে হেল্প করে--তাহলে আপত্তি কেন? তিনি কিন্তু প্লানচেটকে মৃতআত্মার সঙ্গে কথোপকথন হিসাবে সকলের জন্য কোনো অমোঘ দাওয়াই বলে প্রচার করেন নি।

রবীন্দ্রনাথকে তার সকল সীমাদ্ধতাসহ ভাবতে হবে। তিনি যে দেবতা নন--তারও যে সকল মানুষের মত ব্যক্তিগত ব্যাথা বেদনা, ক্লান্তি ক্ষোভ থাকতে পারে এটা ভুললে চলবে না। যারা এটা ভুলে তাকে বিচার করবেন--তাদের বিচার হয়ে উঠবে যান্ত্রিক, একপেশে--মুল্যহীন।
তবে তার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরণের পথ ধরেছেন। তাঁর এই পথচলা কখনো--কার্ল মার্কস থেকে আল মার্কসে পৌঁছে নি। ব্রহ্মতত্ব থেকে তিনি মাকালীতে ফিরে যান নি। তিনি ব্রহ্মতত্ত্ব থেকে মানবধর্মে পৌঁছে গেছেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথ অনন্য।

....................................................................
অন্য আলোয় দেখা--পর্ব ৩


মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

মুক্তমনার সংকলন গ্রন্থ"স্বতন্ত্র ভাবনা "সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ (অভিজিতের লেখা ) আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি অভির অনুমতি সাপেক্ষে । আপনার সাথে অভিজিতের সেখানে আলোচনাও হয়েছে, ঠিকাছে । কিন্তু আমার কোটকৃত টেক্সটের কিছু অংশ সচলে কোট করে "অভিজিৎ রায় এই প্লানচেটকে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার দাসত্ব হিসেবে দেখেছেন।" রায় ঘোষণা করাকে সমর্থন করছি না । আমার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ারকৃত অভির টেক্সটি নিচে দিলাম , অভি রবীন্দ্রনাথ নাকি তার স্তাবকদের চিন্তার দাস বলেছেন সেই সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম । আপনার এই লেখাটি নোটাকারে ফেসবুকে দিয়েছেন , সেখানেও না হয় আলোচনা চলুক, এখানে নয় । হাসান ভাইয়ের পোষ্টে সচলের আলাপ ফেসবুকে এবং ফেসবুকের আলোচনা সচলে আনার ব্যাপারে কথা উঠেছে । মেটাব্লগিংও এখানে নিরোৎসাহিত করা হয় বলে জানি ।

‘চিন্তার দাসত্ব'-এর ক্ষেত্রে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় ব...ড় নামগুলো ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রক্ষ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রক্ষ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’। এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।"(অভিজিৎ রায় )

ভাল থাকুন ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

কুলদা রায় এর ছবি

আপনার অই উদ্ধৃতি থেকেই তো লেখাটা মাথায় এলো। রবীন্দ্র বিষয়ে প্রচলিত মীথ, অপপ্রচার নিয়ে অন্য আলোয় দেখা সিরিজটি হচ্ছে। এটা অনন্তকাল চলতেই থাকবে যদি মডুবৃন্দ বাঁধা না দেন।
লেখার স্টাইলটাও চেঞ্জ করার কোসেস করতেছি।
তবে বস, অই উদ্ধৃতি ব্যবহার করায় আপনার অসন্তোষের কারণটা কি? বুঝিয়ে বলুন তো। উনি এটা লিখেছেন--গ্রন্থে প্রকাশিতও হয়েছে। সেটা কিছু অংশ আলোচনায় গেলে মাইন্ড করার কি আছে? বোঝা মুশকিল। ঘটনাটি বলেন তো মানিক।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অভিজিৎ এর ছবি

ধন্যবাদ মানিক ব্যাপারটি পরিস্কার করার জন্য। তবে এরপর থেকে আমার লেখার কোন অংশ কোথাও অযাচিতভাবে কোট না করাই ভাল হবে। অযথা বিতর্ক আর ক্যাচাল বাড়ে। আমার বক্তব্য হিসেবে যে অংশটি কোট করা হয়ছে সেটা আমার একটা বইয়ের ছোট অংশ, তার আগে পিছে অনেক কথা ছিলো। আর বইয়ের বিষয় রবীন্দ্রনাথও ছিলো না। সেগুলো বাদ দিয়ে কেবল এই খণ্ডিত অংশ দেখলে মনে হবে আমি বোধ হয় চরম রবীন্দ্রবিদ্বেষী ফরহাদ মজহার জাতীয় কেউ। হাসি

আমার লেখার উদ্দেশ্য রবীন্দ্র বিরোধিতা ছিল না। বরং এটিই বলা উদ্দেশ্য ছিলো যে, ব্যক্তিপূজায় ভেসে গিয়ে আমরা অনেক সময় সব কিছুই ভুলে যাই। আমি রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করাকে সঠিক মনে করি না, তা তিনি যতই প্রিয়জন হারানোর শোকে করে থাকুন না কেন (বলা বাহুল্য এরকম প্রিয়জন আমরা সকলেই হারাই)। আমি সমর্থন করতে পারি না রবীন্দ্রনাথ রমা বাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে প্রবন্ধে যেভাবে মেয়েদের ছোট করে বলেছেন - ' যেমন করেই দেখো প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’' এটা বলা কি রবীন্দ্রবিদ্বেষ? আমি তো শেখ মুজিব যে চাকমাদের বলেছিলেন "তোরা সব বাঙ্গালি হইয়া যা' - সেই মনোভাবও সমর্থন করতে পারি না। তবে কি আমি মুজিব বিদ্বেষী হয়ে গেলাম? আসলে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভিঙ্গি আমাদের সংস্কৃতিতে একটু বিরলই বটে। হয় দেবতা, নইলে রাজাকার। এই ধরণের বিভাজন অনেক সময় খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেকটা বুশের মতোই - 'আইদার উইথ মি, অর উইথ দেম'!

আমি সচলায়তনেই একবার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে লিখাছিলাম - রবীন্দ্রে বিজ্ঞান। কোন সিদ্ধান্তে পৌছুনোর আগে সেটা পড়ার অনুরোধ করছি পাঠকদের।

আরো একটা কথা । কুলদা রায় নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার বিরোধিতা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন কিনা তার একটি তথ্যসূত্র চান আমার কাছে। আমি তাঁকে যথা সাধ্য সাহায্য করেছিলাম বলেই মনে পড়ে। আমি তাকে বলেছিলাম - আমি যতদূর জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মন্ত্রী প্রভাষচন্দ্র মিত্র, রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ড রাশবিহারী ঘোষ প্রমুখ। প্রফেসর রফিকুল ইসলামের একটা বইয়ে এর উল্লেখ করেছিলাম বলেছিলাম সে বইয়ে রবীন্দ্রনাথের কোন উল্লেখ সেখানে ছিলো না। এই গুজবটি পরবর্তীতে মাজহার গংদের বানানো বলেই মনে হয়।

যা হোক আশা করব, কুলদা রায় আমার অবস্থানটি বুঝতে পারবেন।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

অভি,

বানী চিরন্তনী গ্রন্থ যেমন বাজারে প্রচুর আছে তেমনি অন্তর্জালেও প্রচুর কোটেশন ভিত্তিক সাইট আছে । সেইসব বানীও তো মনীষিদের কোনো রচনা বা বক্তৃতা থেকে নেয়া হয়েছে । আগে পিছের পুরো টেক্সট ছাড়া বানী প্রচারনা তাহলে তো নিষিদ্ধ করতে হয় । তাছাড়া, বিতর্ক/ ক্যাচাল বাড়বে -এই বিবেচনায় কি আপনি লেখালেখিই বন্ধ করে দিবেন ?

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মুক্তমনার আয়োজন-Tagore without Illusion

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অভিজিৎ এর ছবি

আসলে ক্রিটিকাল থিঙ্কিং সভ্যতার চাবিকাঠি, আমরা এটি ভুলে যাই। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে যুগশ্রেষ্ঠ প্রতিভা ছিলেন, কিন্তু তিনি সমালোচনার একেবারেই উর্ধ্বে ছিলেন কি? হুমায়ুন আজাদ তার নারী গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। সেটা কিন্তু আমরা দেখেছি। আহমদ শরীফ তার বইয়ে কাঙ্গাল হরিনাথের উপর ঠাকুর বাড়ির প্রবল আক্রোশের কথা সুনিপুন শিল্পীর মতো তুলে ধরেছেন। প্রবীর ঘোষ তার অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে অনুকূল চন্দ্র সহ ভারত বর্ষের সব সম্মানিত পুরুষদের অযৌক্তিক ধ্যান ধারনার উল্লেখ করেছেন। ক্রিস্টোফার হিচেন্স মাদার টেরেসার অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে (কিভাবে তিনি কালোবাজারিদের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে দারিদ্র-ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতেন ইত্যাদি) বই লিখেছেন। তারা সেগুলো করেছেন তাদের দায়িত্ব থেকেই। কিন্তু তারপরেও রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের জায়গাতেই আছেন, মাদার তেরেসা তার জায়গায়। কিন্তু এ সব গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা থেকেই কিন্তু পাঠকেরা খুঁজে পেয়েছেন নতুন মাত্রা।

চিন্তা করুন - এরিস্টটল এক সময় কত বড় প্রতিভা ছিলেন। নবী পয়গম্বরের মতোই ছিলো তার অনুসারীদের সংখ্যা। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে আমরা জেনেছি যে এরিস্টটল যা বলেছিলেন, সবই নির্ভুল ছিলো না। আসলে জ্ঞান বিজ্ঞান যত এগিয়েছে ততই কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে প্লেটো এবং এরিষ্টটলকে নতুন করে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়েছিলো। বার্ট্রান্ড রাসেল তার হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘ almost every serious intellectual advance has had to begin with an attack on some Aristotelian doctrine; in logic, this is still true at the present day”। অর্থাৎ, সহজভাবে বললে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস আসলে এরিস্টটলকে হটানোরই ইতিহাস। আরেকজন সমালোচক চাছাছোলা ভাবেই বলেছিলেন - 'এরিস্টটল যা শিখিয়েছিলেন, তা সবই ভুল'। এতবড় সমালোচনা করেছিলেন পাশ্চাত্যের সমালোচকরা এরিস্টটলকে নিয়ে। তো তারা কি সব রাজাকার হয়ে গেছেন? না তা নয়, বরং তাদের সমালোচনাগুলোই উন্মুক্ত করেছিলো তখন নতুন জ্ঞানের ক্ষেত্র। এ ব্যাপারটিই আমাদের মধ্যে একেবারে নেই। আমরা সবাইকে দেবতা বানিয়ে রাখি, নয়তো ছাগু। এরকম করে আমরা আসলে আমাদের দীনতাই তুলে ধরি, তাই না? একটু অন্যরকমভাবে চিন্তা করলে ক্ষতি কী?

যাক এই থ্রেডে এটাই আমার শেষ উত্তর। আমি আর বিতর্ক বাড়াবো না।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

ক্রিটিকাল থিঙ্কিং সভ্যতার চাবিকাঠি

সেটাই । মনে পড়ে গেল, ২০০৮-০১-০১ তারিখে সচলে প্রকাশিত আমার "চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে" লেখার ইতি টেনেছিলাম-

এসব কারণেই আমি আমার শ্রদ্বেয় লেখক ,গবেষক অভিজিত রায়কে বলেছিলাম মুক্তচিন্তা অন্তজার্লে সম্ভব কিন্তু বাস্তবে দিল্লী বহু দূর ।
আমি অবশ্য আশাবাদী । আঁকাশ যতই মেঘাচ্ছন্ন থাকুক সুর্য উঠবেই।তবে ,সেই সুর্যোদয়ের প্রতিক্ষায় এই আমি নুরুজ্জামান মানিক থাকবে আর কতকাল?

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

কাজী মামুন এর ছবি

রবীন্দ্রনাথকে তার সকল সীমাদ্ধতাসহ ভাবতে হবে। তিনি যে দেবতা নন--তারও যে সকল মানুষের মত ব্যক্তিগত ব্যাথা বেদনা, ক্লান্তি ক্ষোভ থাকতে পারে এটা ভুললে চলবে না। যারা এটা ভুলে তাকে বিচার করবেন--তাদের বিচার হয়ে উঠবে যান্ত্রিক, একপেশে--মুল্যহীন।

এরপর আর কোনো কথা থাকে না আসলে। অভিজিৎ রায় এর বইটি পড়ে দেখার আগ্রহ তৈরী হলো।

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

মুস্তাফিজ এর ছবি

একবার শমীকে অনুরোধ করছেন একটি ছবি এঁকে দিতে বলেছেন। শমী বলছে তার সময় নেই।

প্লানচেটে তো আর সত্যিই কেউ আসেনা। তাদের হয়ে অন্য কেউ উত্তর দেয় বা লিখে দেয়। এখানে যিনি শমী হয়ে লিখছিলেন তিনি হয়তো ছবি আঁকতেই জানতেন না।

...........................
Every Picture Tells a Story

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আপনার উপসংহারটা অনেক আদর গোছের হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করতে এতো রয়েসয়ে কেনো? গত শতাব্দীর মহামানবের সাক্ষাৎ ভুলকে কঠোরভাবে সমালোচনা করতে না শিখলে এগুবে কিভাবে?

আজকে একজন যদুমধু "অনেকগুলো ভাইবোনকে, নিজের স্ত্রীকে, পুত্রকন্যাকে, নাতিকে-প্রিয়জনকে হারানোর অনন্ত পীড়ন ভুলতে যদি প্লানচেটের নামে কোন শোকভোলানোর আশ্রয় নেন" তবে কি আপনি এই অনাপত্তি-টোন বহাল রাখতেন?

এখানটায় রবীন্দ্রনাথকে শক্তভাবে সমালোচনা করাটাই বেশি জরুরি, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে একটি প্রভাবশালী অস্তিত্ব। তার ভুলগুলো জানাটা, জানানোটা, স্পষ্ট সমালোচনা করাটা তাই বেশি জরুরি। উপসংহারে আপনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে রবীন্দ্র-অ‍্যাপোলোজেটিক বনলেন।

অভিজিৎ রায়কে রিপিট করি


সমালোচনামূলক দৃষ্টিভিঙ্গি আমাদের সংস্কৃতিতে একটু বিরলই বটে। হয় দেবতা, নইলে রাজাকার। এই ধরণের বিভাজন অনেক সময় খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেকটা বুশের মতোই - 'আইদার উইথ মি, অর উইথ দেম'!

একদম সত্য কথা! আমরা ভালবাসার মানুষকে সমালোচনা করতে শিখি নি। ভুল তো বাতিল।

সাথে অভিজিৎ রায়েরও একটু সমালোচনা করি। আপনার উদ্ধৃতিটা অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এরপর

সেগুলো বাদ দিয়ে কেবল এই খণ্ডিত অংশ দেখলে মনে হবে আমি বোধ হয় চরম রবীন্দ্রবিদ্বেষী ফরহাদ মজহার জাতীয় কেউ।

এটা বলে বরং আপনার সমালোচনাটার কাঠিন্য একটু কমে গেল।

কুলদা রায়ের বিশ্লেষণ চলতে থাকুক।

স্বাধীন এর ছবি

এই সিরিজটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানছি তাই লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

রবীন্দ্রনাথকে তার সকল সীমাদ্ধতাসহ ভাবতে হবে। তিনি যে দেবতা নন--তারও যে সকল মানুষের মত ব্যক্তিগত ব্যাথা বেদনা, ক্লান্তি ক্ষোভ থাকতে পারে এটা ভুললে চলবে না। যারা এটা ভুলে তাকে বিচার করবেন--তাদের বিচার হয়ে উঠবে যান্ত্রিক, একপেশে--মুল্যহীন।

আপনার সাথে দ্বিমত নেই। পূর্বকার সকল দার্শনিক, সাহিত্যিক, ধর্মগুরু, রাজনৈতিক গুরু সবাইকেই তাঁদের সময়কার সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই বিচার করতে হবে।

লেখকের কাছে একটি ক্ষুদ্র প্রশ্ন ছিল, এখানে অভিজিৎ রায়, উনার লেখার যে কোট দিলেন আপনার বক্তব্যের সাথে সেটা কতটুকু বিরোধ পূর্ণ? আমি তো অভিজিৎ রায়ের কোটকৃত অংশের সাথে আপনার মূল লেখার যে অংশ কোট করেছি তার সাথে তেমন কোন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছিনে। অভিজিৎ রায়ও তো বলছেন যে তাঁদেরকে দেবতা বানিয়ে পুঁজো না করতে। আপনিও একই কথা বলছেন।

আপনাদের মতভেদ রয়েছে এক জায়গায়, তা হচ্ছে প্ল্যানচেট নিয়ে। অভিজিৎ রায় লিখেছেন

রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না।

আর আপনি লিখেছেন

এই এদের জন্য তাঁর যে অনন্ত পীড়ন সেটা ভুলতে যদি তিনি কখনো প্লানচেটের নামে কোন শোকভোলানোর আশ্রয় নেন--যদি তিনি আনন্দ বোধ করেন---যদি তার মানসিক স্ট্রেস কমাতে হেল্প করে--তাহলে আপত্তি কেন?

আমি কিন্তু অভিজিৎ রায়ের প্লানচেটে আপত্তি দেখতে পারছি না। উনার বক্তব্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্লানচেট বিশ্বাসে প্রমানিত হয় না যে আত্মা বলে কিছু আছে। এখানে মূলত উনি আত্মার অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব নিয়ে যুক্তি দেখাচ্ছেন। উনি তো লেখার কোথাও উল্লেখ করেননি যে রবীন্দ্রনাথের প্লানচেট করাটা আপত্তিকর। প্লানচেট করাটা যদি কারোর শোক ভোলানোতে সাহায্য করে আপত্তি থাকবে কেন? ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস থাকার কারণে যদি কারোর মনে শান্তি আসতে সাহায্য করে আপত্তি করা হবে কেন?

কিন্তু প্ল্যানচেটে যে মৃত আত্মা আসে না সেটা বিশ্বাস করেন তো? সেখানে যে উপস্থিত ব্যক্তিরাই প্রশ্নের জবাব দেয় সেটা বিশ্বাস করেন তো? উপরে মুস্তাফিজ ভাইয়ের মন্তব্যটা দেখতে পারেন। তাই লেখাটাতে অভিজিৎ রায়ের বক্তব্য খন্ডনের যে চেষ্টা করলেন সেটা লেখাটিকে কিছুটা দুর্বল করে দেয়। আপনার এই সিরিজের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পারবো সেই প্রত্যশা করি। সিরিজে নিয়মিত হলাম। ভাল থাকুন।

কুলদা রায় এর ছবি

আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে লেখাটি তৈরি হয় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্লানচেটের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক যুক্তিবাদি নামধারী অথবা চিনাবাদাম গ্রুপ যেসব অপপ্রচার করে থাকেন সে সম্পর্কে কেচো খুড়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। লক্ষ করুন স্বাধীন, নোটে কবির ব্যক্তিগত সচিব অমিয় চক্রবর্তী কী বলছেন--'

কবি অমিয় চক্রবর্তি এই প্লানচেটকে ‘মহাপৌরুষের ছেলেমানুষী’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।'

অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটের আসরের রেকর্ড কিপার ছিলেন। কবির ঘনিষ্টজনও ছিলেন। তাঁর বক্তব্যটি আমলে নিতে পারতেন।

রবীন্দ্রনাথ জীবনের বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। সে কাজগুলোর পরিপ্রেক্ষিতটাও বোঝা দরকার। নাহলে বিচারটা যান্ত্রিকতায় পর্যবশিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

কেশব অধিকারী এর ছবি

কুলদা রায়,

লেখার গাঁথুনী নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। চমৎকার এই উপস্থাপনা সত্ত্বেও একটু বলার ছিলো। যা বলেছেন কিংবা বলতে চেয়েছেন তাকেই বরং মনে হয়েছে সাধারন ভাবে বলা কিংবা কবি রবি সংক্রান্ত সাধারন অভিব্যক্তি, আর অভিজিৎ রায়ের উদ্ধৃতি পড়ে মনে হলো আপনার শিরঃনাম! তবে রবির আকাশে আষাঢ়ের ঘনঘটা হৃদয় ছুঁয়েছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।