পার্কের ভিতরে ছায়া : ফ্লাই উইদাউট উইং : পর্ব-এক

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২১/১১/২০১০ - ১:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

পাতা বলল, এদিকে আয়। পাতা বলল বলেই এদিকে আসতে হল। রোদ একটু খাড়া হয়েছে। ছায়া ছোট হয়ে এসেছে।
পরী বলল, এলি কেন?
--পাতা বলল যে।
--পাতা বললেই আসবি?
--এলে কি হয়?
--কষ্ট হয়।
--কষ্ট কী রে?
--জানি না।
-তাইলে কি জানিস?
--কিছুই জানি না। ছায়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—কষ্ট নেবে গো কষ্ট।
--কে লিখেছে?
--হেলাল হাফিজ। কবি। বাড়ি নেত্রকোণা। বাংলাদেশ। থার্ডওয়ার্ল্ড। লাল কষ্ট। নীল কষ্ট। সাদা কষ্ট। হরেক রকম কষ্ট আছে।
পরী বলল, ও কিছুই জানে না।
--তাহলে কে জানে।
--কেউ না।
পরীর মুখ ভার হয়ে গেছে। একহাতে ম্যাপল পাতার মুকুট। আরেক হাতে পাখির লম্বা পালক। টান টান দাঁড়িয়ে যেতে গিয়ে পিঠটা সামান্য বেঁকে গেছে।

এখন সকাল। গোল পার্কটির চারিদিকে স্ট্রিট আর এভিনিউ। সাই সাই করে গাড়ি চলে যায়। বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে গোল চক্কর। চারিদিকে হাতলওয়ালা কাঠের বেঞ্চি। ঠিক মাঝখানে একটি উঁচু বেদীতে ডানা মেলে পরী দাড়িয়ে আছে। কয়েকটি কবুতর ডাল থেকে উড়ে এসেছে। গোল চক্করে খুটে খুটে দানা খাচ্ছে।

একটি লোক চুপ করে বসে আছে পশ্চিমের বেঞ্চিতে। বেঞ্চির হাতলে মাথাটা সামান্য হেলানো। তার কোনো ছায়া নেই। মুখ ভর্তি দাড়ি। সাদা। চশমা ছিল কিনা বোঝা মুশকিল।

ল্যাংলি বহুক্ষণ ধরে কু কু করছিল। কয়েকটা কুকি চিবিয়েছে। খেয়েছে পানি। গভীর আগ্রহে জেনিফারের পা চেটেছে। জেনিফারের বাম হাটুর নিচে একটা কাটা দাগ। কৈশোরে পড়ে গিয়েছিল।সে এক মজার কাহিনী। ল্যাংলি এটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেটেছে। শিরশির করে ওঠে জেনিফারের। জেনিফার আহ্লাদে বলে, নো ল্যাংলি। নো মোর ডার্লিং। ইউ নটি বয়। হুউম। চুক চুক।
ল্যাংলি থাবার মধ্যে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখে জেনিফার মাথা নাড়ল। হালকা করে হেসেও উঠল। ল্যাংলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, দুষ্টু বালক। কাটা দাগটি ছাড়া সাধ মেটে না।

কাটা দাগটির উপরে একটি বড়োসড়ো লাল জড়ুল আছে। ওটা হট পয়েন্ট। মাঝে মাঝে টের পায় জড়ুল বলছে—আর না। আর না। দুটি মাত্র শব্দ। শুনে সামর্থ্য ঠোঁট দুটি বলছে—উহু। উহু। চুপ চুপ চুপ। আশ্লেষে জড়ুলটি কোনো এক চাঁদের আলোতে পুড়ে গেছে। সে এক গভীর আগ্রাসী চাঁদ। চাঁদের আহ্লাদে তাকে একবার পড়ে যেতে হয়েছিল। হাঁটুর উপরে সে চিহ্ন আছে। চিহ্ণ কিছু থেকে যায়। মোছে না। ল্যাংলি তুই কি এসব জানিস? জানিস ল্যাংলি?

এ সময় জেনিফার দেখতে পেল, ওপাশে বুড়োটা এক দৃষ্টিতে জড়ুলটাকে জুল জুল করে দেখছে। আর হালকা হাওয়ায় তিরতির করে নড়ছে তার ফিনফিনে গোফটি। ফ্যাল ফ্যাল চোখ। জেনিফার বাম হাতটি দিয়ে উরুদেশের জড়ুলটি ঢেকে ফেলল। বুড়োটি তখনো একইভাবে চেয়ে আছে। জেনিফার হাঁটুর উপরে হাঁটু রাখল। বুড়োটি তবু একইভাবে চেয়েই আছে। নড়ন চড়ন নট। বিড়বিড় করে গালি দিল জেনিফার, স্টুপিড বুড়ো।

পরী বলল, দেখেছিস?
ছায়া একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। থমথম খেয়ে বলল, কী?
--জেনিফার আধবুড়িটাকে।
-হাঁটু মুড়ে বসে আছে। রাগে গজগজ করছে।
--উহুরে গাধা। মোটেই রাগ নয়। মজাও পাচ্ছে। বুড়োটা ওর জড়ুলটাকে দেখছে। তবুও কেউ দেখছে। কে আর দেখে এই বুড়িকে!

এ সময় একজোড়া ছেলেমেয়ে ঢুকল পার্কের ভিতরে। কাঁধে ব্যাগ। পরী বলল, চিনতে পারিস?
--স্কুলের ছেলে মেয়ে।
--স্কুলের পথে একটু লাভ করছে।
--তাইলে তো মুশকিল। লেটমার্ক পাবে স্কুলে।
--হু কেয়ারস। পাক না।
গাছের পাতা সড় সড় করে। ফিসফিস করে বলে, আয় না। আয় না।

একটা বেঞ্চিতে ছেলেটা ধপ করে বসেছে। আর মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ছেলেটার গলা ধরে ঝুলে পড়ল। ছেলেটা দুহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। দুজনেই টগবগ করে ফুটছে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলে ছেলেটা দেখতে পেল খুব বুড়ো একজন লোক ওদের তাকিয়ে দেখছে। ফ্যাল ফ্যাল চোখের দৃষ্টি। পুরু ভ্রু। সাদা। ছেলেটা মেয়েটাকে এক ঝাটকায় সরিয়ে দিল। মেয়েটা তখনো ঝুলে আছে। বেনী দুলিয়ে ছটফটিয়ে উঠছে—না। না। না। ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, বুড়ো শয়তানটা লক্ষ করছে। পুলিশ কল করতে পারে। চল, পালাই।
দুজনে যেভাবে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসেছিল, সেভাবে ছুটে পালাল পার্ক থেকে—স্কুলের দিকে। মেয়েটা একবার পিছন ফিরে তাকাল। ভেংচি কেটে বলল, ও বুড়ো--তুমি গুড়ো গুড়ো। ভ্যা।

বুড়োটা তখনো চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে একইভাবে। ছেলেমেয়ে দুটোর পিঠে স্কুল ব্যাগ-- ঝকর ঝকর করে দুলছে।

এ সময় লোপেজের মনে পড়ে ডিজাইনটায় যে ব্যালকনির কথা ভেবেছে সেখানে কী লতা দেবে—এই লতাটির নাম স্মরণে আসে নি কাল সারাদিন। ব্যালকনির গায়ে নানা কায়দায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছে পাতার আকার আর একে বেঁকে যাওয়া লতাটির দেহ। কখনো হলুদ রঙের ফোটা দিচ্ছে। কখনো গাঢ় সবুজের উপরে হালকা কমলা দিতে দিতে সখ করছে দুটো বাজপাখির মূর্তি খেড়ে দিতে। বাজপাখির রঙ কী হবে? সাদা? –না, ধুসর? ধূসর—না, সাদা? খসখস করে পাতার উপরে, লতার উপরে ব্যালকনির উপরে সাদা অথবা ধুসর রঙ চাপাতে চাপাতে মাথা এদিক ওদিক নাড়ছে। আর বিড় বিড় করে বলছে—সাদা—না, ধুসর? ধুসর-না, সাদা? বলতে বলতে আড় চোখে দেখে নিচ্ছে বুড়োটা নির্বিকার চোখে তার রঙের আচড়টির দিকে চোখ পেতে রেখেছে। নড়ন চড়ন নট। বুড়োটাকে দেখতে দেখে আরও জোরে খসখস করে রঙ চাপায়। আর তাড়াতাড়ি বলে, সাদা—না, ধুসর। ধুসর—না, সাদা? বুড়োটার চোখের সামনে লোপেজের কপাল বেয়ে ঘাম বেরিয়ে এসেছে। আর মিডিয়াম স্ট্রলারে তার কয়েকটি সোয়েটার, জুসের ক্যান এবং পুরনো একটি রেডিও ঝুলছে। রেডিওর ভলিউম বাড়ানো। কদিন ধরে ভলিউমটি বাড়ানোই আছে। বন্ধ করতে মনে নেই। শুধু মনের মধ্যে থাকে, সাদা—না, ধুসর? ধুসর---না, সাদা?

পরী লোপেজকে পছন্দ করে। লোপেজের ঘনঘন মাথা নাড়া দেখে মনে হল—একটুকু আড়মোড়া ভাঙা যেতে পারে। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখুক না অঙ্গ মহিমা। আঁকুক না তার তণুরেখাটি। বলুক না, কেউ এসে—ওহে পরী, তুমি সুন্দর।
ছায়া বলে, ও পরী, তুমি কী করো?
--কাঁদছি।
--কাঁদছ কেন?
--লোকটি ছবি আঁকছে—কিন্তু পেন্সিলে শিস নাই। রঙ নাই।
--তাহলে কাগজে কী করছে?
খস খস করে দাগ কাটছে। দাগ পড়ছে না। ভান করছে রঙ দেওয়ার। রঙ পড়ছে না। কোনো এক লতার জন্য প্রাণ উজাড় করে দিচ্ছে। কিন্তু লতাটিকে মনেই আনতে পারছে না। ওটা কী নলিমণি লতা, না, ব্লিডিং হার্ট?
বলতে বলতে পরীটি হু হু করে কাঁদছে। কিন্তু জল পড়ছে না চোখ থেকে। মাথার উপরে পাতা সড় সড় করছে, আর না। আর না। ছায়া বলছে, কাঁদে না সোনা। কাঁদে না সোনা।

পরীটির ডানার পিছনদিকটিতে গীটার বাজিয়ে জোসেফ ততক্ষণে গান ধরেছে
ও আমার হাওয়া
তোমার তরে এই কী আমার যাওয়া
তবুও তুমি বলতো নাতো—পাওয়া

সন্ধ্যে হলে আঁধার আসবে ঘিরে
তখন তুমি দেখবে কী আর ফিরে
তোমার তরে শেষ করেছি নাওয়া
ও আমার হাওয়া

পরের বেঞ্চিতে জারমিনা দুবার হাই তুলছে। হাতে আধখানা সিগারেট ধরা আছে। খেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু লাইটার নেই। হারিয়ে ফেলেছে। হাই তুলতে তুলতে জারমিনা দেখতে পেল দূরে বুড়োটার পকেটে একটা লাইটার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু বুড়োটার কোনো সিগারেট নেই। কী এক বিস্ময়ে তাই ওর ডান হাতের সিগারেটটি বুড়ো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জারমিনার চাপা কলির মত আঙুল। সিগারেটের তাপে দুআঙুলে সামান্য পোড়া দাগ পড়েছে।এখন সিগারেটটির জন্য দাগটিতে চুরবুর করছে। লাইটারটি পেলে বেশ হত। বুড়োর পকেটের লাইটারটির দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে জারমিনা দুএকবার চোখ রেখে দেখতে দেখতে হাই তুলল। মনে মনে বলল, ও বুড়ো তোমার তোমার লাইটারটা দাওতো দেখি। কষে সুখ টান দেই। তুমিও না হয় দিবা দুয়েকটা টান।
বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। আর জারমিনার সিগারেটটি অপলক দেখছে।

বুড়ো তাকানো দেখে জারমিনা হেসে ফেলল। খিলখিল করে হাসল। আবার বুড়োকে অপাঙ্গে দেখে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসল। দাঁড়িয়ে দুপাক ঘুরে নানা কায়দায় সর্বাঙ্গের দোলা লাগা দেখাল। এই দুলতে দুলতে আর হাসতে হাসতে তার দুআঙুলে ফাঁক থেকে আধপোড়া সিগারেটটি পড়ে গেল ঘাসের ভিতরে। নিচু হয়ে চাপা কলির মত আঙুল দিয়ে ঘাসের ভিতর সিগারেটটি খুঁজতে থাকে। দেখে বুড়োটা তখনো তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুঝতে পারছে জারমিনার দুআঙুলের ফাঁকে সিগারটেটি নেই। ঘাসের মধ্যে পড়ে গেছে। হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছে না। তবু চেয়ে আছে। জারমিনার মুখ থমথমে হয়ে গেছে। ঘাসের মধ্যে আঙূল ডুবিয়ে সিগারেটটি খুঁজতে খুঁজতে জারমিনার মনে হল—বুড়ো লোকটি তার আঙুলের পোড়া দাগটিও দেখতে পাচ্ছে। জারমিনার নরম স্তন হাওয়ায় হালকা দুলছে। রাগে গজ গজ করতে করতে বলছে, হতচ্ছাড়া বুড়ো। তুই মর। তুই মরগে যা। এত দেখার কী আছে রে?
জারমিনার পিছনটার মিনি স্কাটটা একটু সরে গেছে।

(*গল্পটি একটু বড়ো হয়ে গেছে। সেজন্য দুটো পর্বে দেওয়া হবে।)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পড়ছি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আঁকাইন এর ছবি

অপুর্ব লাগে আপনার লেখা। হাসি
============================
শুধু ভালোবাসা, সংগ্রাম আর শিল্প চাই।

============================
শুধু ভালোবাসা, সংগ্রাম আর শিল্প চাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুকনো পাতার ঝিরিঝিরি গান
বাতাসে জুড়েছে অলীক তান।

--দারুন লাগল। সত্যিই অপূর্ব।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম! ভাল লাগছে। আগামী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।