নয়া ছুপান্যাস : মিস প্রভা অথবা পিপ্পলকুমারী বালা

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৯/০৫/২০১১ - ৯:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বগুলোর লিংক--
প্রথমপর্ব :
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
-----------------------------

পঞ্চম পর্ব
এলাচ দেওয়া পায়েস
.............................................

ঘুমোবার আগে মেয়েটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। আয়না জুড়ে তার ছায়া—আয়না জুড়ে তার ছবি। ঠোঁট কাপছে। কাঁপতে কাঁপতে বলছে, অ আয়না, কওতো দেহি, এ জগতে সবচাইয়া অসুখী কেডা?

আয়না চুপ করে থাকে। এই মেয়ের আঁখিতে কাজল। ভ্রুতে জোড়া। এই মেয়ের গালেতে গোলাপী পুষ্প —ঠোঁটে তিল। এই মেয়ের কেশেতে চাচর—বেনীতে সাপ। সাপ ঝামটি মেরে অপাঙ্গে বলে, উহু, আমি সাপ নহি। মেরে লাল, বল--সর্প। সর্পকুমারী রানী অথবা পুরো শঙ্খিনী। বাতাসে হাওয়া ওঠে। এ হাওয়ায় হিসহিস ফিসফিস ভিসভিস।

মেয়ে বলে, আমার ঘরেতে নাই ঘরেরও সুখ/ বাইরেতে ধায় বাইরেরও দুঃখ/ আমার পরানজুড়ে কেবলি ভুক—তোমরা কে বুঝিতে পার, কও হে, কে বুঝিতে পার!

শুনে আয়নাটি কাঁপে। আয়নার মধ্যে কোন এক পুরনো বিদ্যুৎ চমকে যায়। পুক পুক করে একবারমাত্র জ্বলে আবার ফস করে নিভে যায়। নিভে যেতে যেতে দোল পূর্ণিমা থেকে ঝর ঝর করে স্নিগ্ধ জল ঝরঝরিয়ে নামে। বাঁশবনে, কাশবনে, হাঁসবনে, ফাঁসবনে কারা কারা নাইতে নামে। তাদের দেখা মেলে না বটে, তবে তাদের গাত্রঘ্রাণ ভেসে আসে। কাঁচের চুড়ির শব্দ পাওয়া যায়। নতুন বসন ভূষন পরিধান প্রস্তুতি ঠাহর পাওয়া যায়। ঝনঝন করে তাদের নূপুর নিক্কন শোনা যায়। আর কারা কারা ঘোড়া থেকে নামে আসে। ঘোড়াগুলো রি রি করে শব্দ করে। কে একজন বলে, ওলো রাধারানী, দেরী কইরো না। আইজ কুঞ্জবনে কিসনো ঠাকুর আসিবেন। তাহার আসনের কাল দেরী হইয়া যায়। আর দেরী কইরো না সখি। ত্বরা কইরা চল। আইজ মনে বনে খেলে হরি।

রাধারানী বলে, ত্বরা কইরা বাইরামু কী প্রকারে? এক ছড়া নূপুর যে পাইতিছি না। নূপূর বিনা কি কিসনো সঙ্গ হয়?
--নেলো কেডা?
--পিপ্পলকুমারী বালা। পিপ্পলকুমারী বালা।
--হ্যার কাছে চাও।
--হ্যারে পাইমু কই? হ্যায় কি আছে এ ভবে?

শুনে প্রভার গান থেমে যায়। গানের সুরগুলো শিমুল তুলো হয়ে ঘরের মধ্যে ওড়ে। মনের মধ্যে পোড়ে। জোড়া ভুরু জোড়া কথা কয়ে ওঠে। বলে, অ, আয়না, কইলা না, এ জগতে সবচাইয়া অসুখী কেডা?
আয়না কথা বলে না। আয়নার আলো আরও নিভে যায়। ডুবে যেতে থাকে আরও ছায়ার গভীরে—মায়ার অন্ধকারে। আয়নাকে নির্বাক দেখে প্রভার রাগ হয়। বালিশের নিজে থাকা নূপুর ছড়াটি ছুড়ে মারে। আয়নার গায়ে ঝুন ঝুন করে। নিচে গড়িয়ে পড়ে।

আয়না নিরুত্তর বলে কাজলদানিটি ছুড়ে মারে। আয়নার গায়ে সামান্য কালির চিহ্ণ লাগে। ঘষা খেয়ে কাজলদানিটি পাশের দেওয়ালে থুবড়ে পড়ে।

আয়না চুপচুপ বলে পামরোজ পাউডারেরর কৌটাটা ছুড়ে মারে। আয়নার গায়ে সাদা পাউডার ছড়িয়ে পড়ে। আয়নার কাঁচ ভেঙে হ্যাচোপ্যাচো হয়ে যায়। ভাঙা কাচগুলো আয়নার গায়ে মাকড়ার জালের মতো লটকে থাকে।
প্রভার ততক্ষণে হেঁচকী ওঠে। হেঁচকি দিতে দিতে আয়নার দিকে ছুটে যায়। ভাঙা কাঁচে হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে বলে –কথা কইস না ক্যান আয়না। কথা কইস না ক্যান আয়না।
বলতে বলতে হেঁচকি দিতে দিতে দেখতে পায় আয়নার গা বেয়ে নামছে লাল রঙের ধারা। আকাশে এই রঙের ধারা নিয়ে সূর্য উঁকি ঝুঁকি মারার ধান্ধা করছে। আর প্রভার হাতে তরল আবীর। এ আবীর দেখে তার মনে পড়ে—আজ দোল। আজ মনে বনে হরি। আজ তার রাধাভাব। আর তার কৃষ্ণসনে রঙ খেলিবার কথা। আজ প্রাণে প্রাণে প্রাণকথা কওয়ার কথা। তরল আবীর তার নিজের মুখে মেখে দিতে দিতে বলে, রাধা, রাধা, রাধা।

তখন আশ শেওড়ার ডালে দিপালীবালা শিউরে উঠছে। হাত নেড়ে নেড়ে বলছে, না। না। না। প্রভা না।
সূর্যের লাল তখন একটা ডিমের কুসুম ভেঙে বেরিয়ে আসছে। চূর্ণ চূর্ণ কুসুমে কোমলে দিপালীবালাও হারিয়ে যেতে যেতে নীল বর্ণ হয়ে কোনো কোনো গাছে অপরাজিতা হয়ে ফুটে যাচ্ছে।

এই ফুল ফুটতে না ফুটতে দশোরথ সিঁড়ির তালা খুলে চিলেকোঠায় উঠে এল। হাতে থালা। পিছনে ফালিয়ে ফালিয়ে আসছে এ বাড়ির কাজলি বিড়াল। হৈমবতী নিজ হাতে রেঁধেছেন এই দোল পূর্ণমার পায়েস। এই ভোরে পায়েস খেতে হবে মিস প্রভার। তাহলে দোলের পূর্ণিমা গায়ে থিতু হবে। এই বিধি এই বাড়িতে অবশ্য মান্য। দশোরথ দরোজা বন্ধ দেখে ঠেলা দিল। ভিতর থেকে আড়কাঠি দেওয়া। বন্ধ দেখে দরোজার পাশে বাইরে পায়েসের বাটিটা রেখে সড় সড় করে নেমে এল। বিড়বিড় করে বলল, মাইয়া, ঘুম থিকা উইঠ্যা খাইয়া নিও। সোর কইরো না। দোলের বাড়ি। আমরা কামের মানুষ-- মেলা কাজ। পুতপুতানির টাইম নাই।

দশোরথের সঙ্গে কাজলি বিড়ালটি চিলেকোঠায় এলেও তার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার গা করল না। ছাঁদের চারিদিকে লেজ উঁচিয়ে ঘুরতে লাগল। আর বারে বারে প্রভার বন্ধ দরোজার দিকে তাকাতে লাগল। ম্যাও ম্যাও করতে লাগল। কখন দরোজাটি খুলবে সে তর নাই বলে কাজলী বিড়ালটি থালার পায়েসে মুখ দিয়ে চেটে চেটে খেতে শুরু করল। খেতে খেতে একবার আকাশের দিকেও তাকাল। দূরের মাঠটির দিকে তাকাল। রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। তারপর ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে ছাঁদের উপরে পাক খেতে লাগল। ছাঁদের কানায় এসে ছপাৎ করে পা ফসকে নিচে পড়ে গেল। দোতলার কার্নিশে একবার বাড়ি খেল। এর পাশে একটা চিটকি ঝোঁপে আটকে গেল। উপর থেকে পড়েছে বলে ভোরের হাওয়ায় ঝোঁপের উপর বেশ ঘটা করে দুলতে লাগল। দোলন কর্মটা থেমে গেলে কাজলি বিড়ালটার চোখ দুটোয় ভরা বিস্ময় ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার লেজের হাঁকপাকানি থেমে গেল। ঝোঁপের চারিদিকে দুটো ডুমো মাছি ভোম ভোম করে উড়ছিল। হাওয়া আরেকটু ফুরফুরে হয়ে এলে কাজলি বিড়ালটির চোখের উপর কায়দা করে বসল। বুঝতে পারল মাছি জীবনটা বেশ। চেটে চেটে চোখের তারা খেতে লাগল। এইভাবে তাদেরও ঘুম পেল।

চোখের উপরে বসে ঘুম ঘুম ভাবে মাছি দুটো দেখতে পেল—এ বাড়ির পথের মুখে একদল নৃত্য করতে করতে ঢুকতে লেগেছে। তাদের কারো হাতে পিচকারি। কারো হাতে দেবদারু। কারো হাতে থরো থরো রঙ্গন তোড়া অথবা গাদা ফুলের মালা। কারো কাঁধে মৃদঙ্গ। কারো গলায় ঢোলডগর। কারো আবার তা না না না না। কে একজন হেঁকে বলছে, লিটু দাদাগো, আর ঘুমাইও না। আমরা আইসা পড়ছি। আমরা হাইসা পড়ছি। আমরা ভাইসা পড়ছিগো লিটু দাদা।
কারা কারা বাদ্যি বাজায়---তা না না না না। তা না না না না। ধেড়ে নাগ। কেড়ে নাগ। কা না না না না।

হৈমবতী সারারাত ঘুমোননি। গোপাল ঘুমিয়েছে। গোপালের ভাল ঘুম দরকার। এ কারণে হৈমবতী সারারাত গোপালের শিওরে বসে বসে পাখার বাতাস করেছে। এক ফাঁকে দশোরথ এসেছিল কালোজিরা চাল নিয়ে। তাকে ইঙ্গিতে বলে দিয়েছে পায়েস চড়ানোর কথা। যখন রাত্রি দুপহরে ঢলেছে—তখন গোপালের শ্বাস ঘন হয়ে পড়েছে। তারপাশে ঢুলছে লেজতোলা ইঁদুরটি। ইঁদুরটির গায়ে ঠেলা দিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে বলেছে, বাপুরে, ঝামেলা করিসনা। গোপাল সোনারে দেইখা রাখ। হ্যায় কাইল কিসনো হৈবে। এখন টানা ঘুম লাগে। আমি যাইতেছি পায়েস রানতি। এ পায়েস আমি ছাড়া আর কেডায় রানবে ক। এই চল যে দোল পূর্ণিমার চল।
ইঁদুরটি ঢুলতে ঢুলতে মাথা নাড়ে। বলে, ঠিকাছে বড় মা। গোপাল দাদারে দেইখা রাখতেছি। হ্যার আগে কও, আমারেও পায়েস দেবানে?
--দেব দেব দেব। তরেও দেব। অই টিকটিকিডারেও দেব। পিঁপড়েডারেও দেব। ঝামটি গাছডারেও দেব। বুজলি বাপা, অই বাঁশ বাগানডারেও দেব। কাক পক্ষীডারেও দেবানে।
ইঁদুরটি কাকপক্ষীটির কথায় একটু ভিত হয়ে। গোপার দাদার বালিশের আড়াল নেয়। আরেকটু আড়াল নেওয়া দরকার কি দরকার না ভাবতে ভাবতে শুনছে, বড়মা বলছে, মধুমতি নদীডারেও দেব। বটপাতারে দেব। ধলী গাইরে দেব। লক্ষ্মীছাড়িরেও দেব। কাজলি বিড়ালডারেও দেব।
কাজলি বিড়ালডার কথা শুনে কান গরম হয়ে যায় ইঁদুরটির। তার দাঁতে দাঁতে ঠকঠকি লাগে। চোখে চকমকি জাগে। ফাল দিয়ে নামে বিছানা থেকে। দৌঁড়ে আসে হৈমবতীর কাছে।
হৈমবতী তখন বড় ডেকচিতে পায়েসে হালকা করে সামান্য কর্পূর আর এলাচ দানা মিশাচ্ছেন। দশোরথ কাছে এসে বলছে, ইকটু জ্বাল বাড়াইয়া দেব?

হৈমবতী জ্বাল বাড়ানো নিয়ে ভাবছেন না। তিনি তার রূপার কৌটা থেকে জাফরান বের করে আনছেন। জলে গুলে জাফরান ছিটিয়ে দিচ্ছেন পাযেসের উপর। পায়েসের গায়ে রং ধরতে লেগেছে। বাসনা বেরিয়েছে। দশোরথের পাশে রাঁধুনী মেয়েটি আরক্ত চোখে দাঁড়িয়ে ঢুলছে। তার থেকে থেকে গরম পায়। বুক জামাটার ভিতরটা চুলকায়। জামাটা খুলে ফেলতে পারলে বেশ হত। এখন খোলা যাবে না। কাজলি বিড়ালটি তার বুকে মুখ গুঁজে দহন করছে। তাকে বিরক্ত করা নিষেধ।
এইসব দেখে বিড়ালটি আরও বিচলিত হয়ে পড়ছে। লেজ তুলে হৈমবতীর পায়ে ধরে। বলে, না, মা, না। তুমি কাজলিরে পায়েস দিও নি।

হৈমবতী কয়েকটা তেজপাতা টগবগে পায়েসে ছেড়ে দিলেন। তিনি জানেন, তেজপাতার ঘ্রাণ বহুদূর অব্দি যাবে। দোল খোলার চৌহদ্দিতে যাবে। সেখানে কুঞ্জবন। কুঞ্জবনে যাবে। সেখানে রাধামাই। রাধামাইয়ের ধারে যাবে। সেখানে অষ্টসখী। অষ্টসখীর লগে যাবে। সেখানে কৃষ্ণসখা। কৃষ্ণসখার প্রাণে যাবে। সেখানে মনে বেন লাগে হরি। হরিরও ভাবে যাবে।
ইঁদুরটি একবার বামপায়ে পড়ে। আরেকবার ডানপায়ে পড়ে। মাথা ঠুকে বলে, দিওনি, দিওনি কাজলিরে মা। পায়েস দিওনি কাজলিরে।

কাজলি তখন রাঁধুনি মেয়েটির বুকের গভীরে আরেকটু সেঁধিয়ে যায়। তার কান তুলতুল। তার নাক ঝুলঝুল। ঘুমের মধ্যে খিরের পায়েস খেতে খেতে উড়বুড়ি ছাড়ে। আর ফুলফুল রাঁধুনি মেয়েটির বক্ষপরে আনাচানা লাগে। গরমে হাসফাস করতে করতে বুক জামা খুলতে পারে না। আনাচানা লাগে। দশোরথ তাকে আড়চোখে দেখে। চোখের ইঙ্গিতে কড়া না করে। কাজলি বিড়ালটি ঘোরের ভিতরে বলে ওঠে, ম্যাও।

ম্যাও শব্দটি শুনে ইঁদুরটি রান্নাঘরে আর দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলে। দৌঁড়ে গোপালদাদার ঘরে ঢোকে। ফাল দিয়ে খাটে ওঠে। বালিশের নিচে লুকোতে লুকোতে দেখতে পায়—গোপালদাদা চক্ষু খুলে চেয়ে আছে। ওকে দেখে বলে ওঠে, কনে গিছিলি?
--কনেও না।
--তাইলে আইলি কন থিকা?
--আসি নাই তো।
--তাইলে হাচ্ছিস ক্যান?
--হাপাচ্ছি নাতো।
--মাকে কবি, আরেক ছড়া নূপুর নাই। হ্যায় পায়ে দেবে কি?
বলে গোপালকৃষ্ণ কাদা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই দেখে ইঁদুরটিরও ঘুম পায়। কালো ইঁদুরটি সাদা হয়ে চিৎপাত হয়ে গোপালকৃষ্ণের কাছে নিন্দ যায়।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।