রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : অষ্টম পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ৩০/১১/২০১১ - ২:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

অষ্টম পর্ব

কুশারী থেকে ঠাকুর : ঠাকুর থেকে টেগোর ----------------------
পঞ্চানন কুশারী ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কোলকাতায় এলেন। সঙ্গে ছোটো ভাই শুকদেব। বসতি স্থাপন করলেন কোলকাতা গ্রামের দক্ষিণে, গোবিন্দপুর আদিগঙ্গার ধারে। তখন এখানে জেলেদের বাস ছিল। অছ্যুত জেলেদের মধ্যে দুভাই ব্রাহ্মণ এসে পড়ায় তারা বেশ খুশী হল। তাদের পূজাপার্বনের দুশ্চিন্তা কাটল। তাদের বসবাসের বন্দোবস্ত করে দিল। তাদের পূজাপার্বনের দায়িত্ব পালন করে দিতেন। দুভাই শিব পূজার জোগাড় যন্ত্র করে তাদের পুরুতঠাকুর হয়ে বসলেন।

এখানে তখন অনেক বিদেশী জাহাজ আসত। এইসব জাহাজে তারা নানাবিধ মালামাল সরবরাহ করা শুরু করলেন। এভাবে কিছু টাকা পয়সাও জমে গেল। পঞ্চানন ও শুকদেব গোবিন্দপুরে গঙ্গার ধারে কিছু জমি কিনে ফেললেন। বসতবাটি আর শিবমন্দির স্থাপন করলেন। জেলেদের দেখাদেখি সাহেবরাও এই দুইভাইকে ঠাকুর বলে ডাকা শুরু করল। তারা ঠাকুর বলতে পারত না। তারা বলত টেগোর। এই পঞ্চানন থেকেই কোলকাতার পাথুরীঘাটা, জোঁড়াসাঁকোতে পঞ্চানন ঠাকুরের বংশধারা এবং চোরাবাগানে শুকদেবের বংশাধারা ঠাকুর পরিবার হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে সংযোগ ----------------------------
পঞ্চানন কুশারীর দুছেলে জয়রাম কুশারী ও রামসন্তোষ কুশারী কিছু কিছু ইংরেজী ও ফারসী শিখেছিলেন। ভাষার জোরে তারা সহজের বিদেশী বনিকদের নেক নজরে পড়ে গেলেন। এই দুই ভাষা জানার কারণে তারা অন্যদের চেয়ে বেশি মালামাল সরবরাহের কাজ পেতে লাগলেন। করিৎকর্মা পঞ্চাননকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মাস্টারের প্রধান সহকারী হিসাবে কাজ দিল।

ইংরেজদের অধীনে কোলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর আসার পরে ১৭৪২ সালে এই অঞ্চলে প্রথম জরীপ কাজ শুরু হয়। কোলকাতার কালেক্টর র‍্যালফ সেলডন পঞ্চানন ও শুকদেবকে আমিন হিসাবে নিয়োগ দেয়। এই কাজে দুভাই বেশ বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে ছিল কোলকাতার আশেপাশের জমি । তিনি দুভাইকে দিয়ে এই জমিগুলোর জরীপ করান। এইভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জয়রাম তার বাড়িতে রাধাকান্তর বিগ্রহ স্থাপন করেন। কৃষ্ণচন্দ্র খুশী হয়ে দেবসেবার জন্য ৩৩ বিঘা জমি জয়রামকে দান করেন।

বর্গী এলো দেশে ---------------------------
সেসময়ে বাংলায় প্রতিবছরই মারাঠা বগীর্দের খুব হামলা হত। তারা ঘোড়ায় চড়ে আকস্মিকভাবে আসত। আক্রমণ করে সব লুটেপুটে কেটে পড়ত। নওয়াবের সেপাইরা তাদের ঘোড়ার পিছনে ছুটে ধরতে পারত না। তাদের দমন করতে নবাবকে খুব ঝামেলা পোহাতে হত। মানুষের জন‍্য সেটা ছিল এক দুর্বিসহ অবস্থা। একটা ছড়া এই মারাঠা বর্গীদের অত্যাচার বিষয়ে মানুষের মুখে মুখে আজও ফেরে—

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।

বর্গীদের হামলা আর নওয়াব-জমিদারদের খাজনা-প্রাকৃতিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত মানুষের হাহকারের সামাজিক ইতিহাসটা এই ছড়ায় আছে।

গঙ্গা আর ভাগীরথী নদী একটা বাঁধা হিসাবে কাজ করত। এটা পাড়ি দিয়ে তাদের অনুপ্রবেশ করারটা অত সহজ ছিল না। তাই এই দিক দিয়ে তারা খুবই কম আসা যাওয়া করত। ১৭৫১ সালে নবাব ও মারাঠাদের একটি সন্ধি হয়। তারপর থেকে আর বাংলায় বর্গি আক্রমণ হয়নি। বর্গীদের স্থলপথের আক্রমণ ঠেকাতে কোলকাতার উত্তর দিকে নালা কাটা হয়।

বর্গিদের আক্রমণের সময়কালে নবাব খুব প্রতাপশালী ছিলেন। আর ইংরেজরা তখন তাদের ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত। এদের হামলা রুখতে কোলকাতাকে রক্ষা করার জন্য চারিদিকে মারাঠা ডিচ চ্যানেল বা নালা খনন করে ইংরেজরা। মূলত তাদের বানিজ্যের সম্পদাদি রক্ষা করার জন্যই নবাবের অনুমতি নিয়ে মারাঠা ডিচ তৈরি করেছিল। কিন্তু বর্গীদের আক্রমণ আশঙ্কা থেমে গেল তখন অবশিষ্ট নালা আর খনন করা হয়নি। উত্তর কোলকাতার একমাত্র পথটিকে কেটে নালার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। সরাসরি ঘোড়া নিয়ে কোলকাতায় ঢোকা যেত না। নালাটি পার হওয়ার দরকার হত। নালাটি সাত মাইল লম্বা করার পরিকল্পনা ছিল। ছয় মাসে মাত্র তিন মাইল কাটা হয়েছিল। এই নালা খননের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা এদেশীয় লোকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছিল।

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা যখন কোলকাতা আক্রমণ করেছিলেন, তার সঙ্গে ছিল ৩০, ০০০ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র। অধিকাংশ সৈন্যই এই নালাটি পার হয়ে কোলকাতায় প্রবেশ করেছিল। সেই যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলা জয়লাভ করেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরে আবর্জনার ভরে উঠেছিল নালাটিটি। এটার কোনো দরকারই ছিল না। ১৭৯৯ সালে এই মারাঠা নালাটি ভরে দেওয়া হয়। ওখানে সার্কুলার রোড তৈরী করা হয়। এই মারাঠা পনালা খননের কাজটিতে জয়রাম কুশারী একজন ইন্সপেক্টর হিসাবে কাজ করেছিলেন। ধান সায়রে তিনি জমি কিনে রাতারাতি বসতবাড়ি স্থাপন করেন। ধানসায়রের বর্তমান কোলকাতার ধর্মতলা।

জয়রাম ঠাকুরের বড় ছেলে আনন্দীরাম খুব ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে সে সময়ে তার চেয়ে ভালো ইংরেজি আর কেউ জানতেন। তবে বাবা জয়রামের কোনো অপ্রিয় কাজ করার ফলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। জয়রাম বেঁচে থাকতেই তিনি মারা যান।

নীলমণি ঠাকুর : জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পত্তন--------------------------
জয়রাম ঠাকুরের মেজো ছেলে নীলমণি ও সেজো ছেলে দর্পনারায়ণ ধানসায়রের জমি সম্পত্তি বেঁচে দেন। তাদের বাড়িটি ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের সময় মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কোলকাতা আক্রমণ করে ফোর্ট ইউলিয়াম দুর্গে গোলা বর্ষণ করেন, তখন নীলমণি ঠাকুরদের বাড়িও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তী নবাব মীর জাফরের কাছ থেকে ইংরেজরা তাদের নিজেদের জন্য এবং তাদের মিত্রদের জন্য ক্ষতিপুরণ আদায় করেন। জয়রাম ঠাকুরও সে সময় ১৩,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পান। এই টাকার একটি অংশ দিয়ে কোলকাতা তিনি কোলকাতা গ্রামের পাথুরিয়া ঘাটা পাড়ায় জমি কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। ইংরেজদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে জয়রাম ঠাকুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শেয়ার বা কাগজও কিনেছিলেন। শেয়ার তাদের গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জিইয়ের নামে করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট কোম্পানী বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। তখন তারা জয়রাম ঠাকুরকে উড়িষ্যার কালেক্টরের দেওয়ান বা সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। এই কাজে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন।

জয়রামের তৃতীয় ছেলে দর্পনারায়ণ হুইলার কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ করেন। সে সময়ে ইংরেজরা জাহাজ থেকে জলের মধ্য লবণ ফেলে দিত। পরে তুখোড় ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন ইংরেজরা সেই লবণ ফেলে না দিয়ে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করত। এজন্য স্থানীয় লবণ শিল্পকে তারা ধ্বংস করে দেয়। এদেশীয়দের বাধ্য করে ইংরেজদের লবণ কিনতে। দর্পনারায়ণ এই লবণের ব্যবসা শুরু করেন। এখান থেকে তিনি বিস্তর লাভ করতে থাকেন। তিনি স্থানীয় লবণ বাজারের ইজারাদারী করেন। এ ছাড়াও জমিদারির পত্তনিদারি ও অন্যান্য ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক হন। নীলমণি ঠাকুর উড়িষ্যা থেকে দেওয়ানী থেকে আয়কৃত টাকা দর্পনারায়ণের কাছে কোলকাতায় পাঠাতে থাকেন।

এই সময়কালে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দ্বিতীয় বর্ষে করাল মূর্তি ধারণ করে। না খেতে পেয়ে, রোগে ভুগে বাংলায় তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায়। একভাগ লোক পালিয়ে বনে জঙ্গলে চলে যায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ সমযকালেই বাংলায় রেকর্ড পরিমাণ খাজনা আদায় করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রেজা খানের পরিচালনায়। এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জমিদার তালুকদার, পত্তনীদাররা খাজনা আদায়ে মুল ভূমিকা পালন করে। পুরনো জমিদারদের চেয়ে ব্যবসা থেকে আসা নুতন জমিদাররা খাজনা আদায়ে বেশী দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন। ফলে কোম্পানীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। পুরনো নরম আলস দুর্বল জমিদারদের অনেকেই খাজনার আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়ে জমিদারী হারায়। এইসব জমিদারীই এইসব নব্য ব্যবসায়ী ও জমিদাররা কোম্পানীর কাছ থেকে ইজারা নেন। তারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। এরা সবাই ছিলেন অনুপস্থিত জমিদার। তারা নায়েব গোমস্তাদের মাধ্যমেই জমিদারী পরিচালনা করতেন।

নীলমণি ও দর্পনারায়ণের ছোটো ভাই গোবিন্দরাম নিঃসন্তান ছিলেন। ১৭৭১ সালে তার মৃত্যু হয়। এই বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী ঠাকুর পরিবারে নীলমণি ও দর্পনারায়ণের সঙ্গে গোবিন্দরামের বিধবা স্ত্রীর এই সময় গৃহবিবাদ শুরু হয়। বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়া দেবী ১৭৮২ সালে সুপ্রীয় কোর্টে মামলা করেন। এই মামলার ফলে সম্পত্তি তিনভাগে ভাগে হয়। রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে দুটি বাড়ি পান। দর্পনারায়ণ পাথুরিয়া ঘাটের বাড়ি ও অপর গৃহদেবতা রাধাকান্ত জিউর সেবার ভার পান। তার বংশধারা পাথুরিয়া ঘাটের ঠাকুর বংশ নামে পরিচিত হন। আর নীলমণি তার নিজস্ব উপার্জিত বিপুল অর্থ, এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণসহ গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলার ভার নেন। জোড়া বাগানের বৈষ্ণব শেঠের কাছ থেকে লক্ষ্মীজনার্দন শিলার নামে মেছুয়াবাজার এলাকায় এক বিঘা জমি কেনেন। সেখানে আটচালা বেঁধে বসবাসকরতে শুরু করেন। মেছুয়া বাজারের নামই পরে জোড়াসাঁকো হয়। এইভাবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পত্তন করেন নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ সালে। নীলমণি ঠাকুর ১৭৯১ সালে মারা যান।

লেখাসূত্র----------------------------------------------------------------------------
১. রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ : ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায়
২. রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তম পর্ব : কুলদা রায় ও এমএমআর জালাল


মন্তব্য

মঈনুল এর ছবি

পড়ছি সিরিজটা।ভালো লাগছে খুব।

তানভীর এর ছবি

পরবর্তী নবাব মীর জাফরের কাছ থেকে ইংরেজরা তাদের নিজেদের জন্য এবং তাদের মিত্রদের জন্য ক্ষতিপুরণ আদায় করেন। জয়রাম ঠাকুরও সে সময় ১৩,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পান।

ইন্টারেস্টিং। সাধারণ মানুষের কাছে জমিজমা দিলে তারা ইংরেজদের কাছ থেকে রক্ষা করতে পারবে না- এই যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ চিরকাল জমিদারী প্রথা সমর্থন করে গেছেন। জমিদারী না থেকে যদি তাঁকে সাধারণ মানুষের মতো ছোটবেলা থেকে প্রতিনিয়ত জীবিকার অন্বেষণ করতে হতো, তবে হয়তো এত সহজে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হতো না- এ সত্যটা মনে হয় তিনিও জানতেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।