রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : দশম পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৭/১২/২০১১ - ৭:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

রামমোহন রায় : ঠাকুরদের বদলে দেওয়ার মানুষ------------------

রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে দ্বারকানাথের পরিচয় ঘটে ১৮১৫ সালে। এই পরিচয় ঠাকুরপরিবারের জন্য একটি বদলে যাওয়ার ঘটনা।

কুলদা রায়

এমএমআর জালাল

রামমোহন রায় : ঠাকুরদের বদলে দেওয়ার মানুষ------------------

রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে দ্বারকানাথের পরিচয় ঘটে ১৮১৫ সালে। এই পরিচয় ঠাকুরপরিবারের জন্য একটি বদলে যাওয়ার ঘটনা।

১৭৭২ সালে রামমোহন রায় হুগলীর এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা পারিবারিক প্রথাঅনুযায়ী ছেলেকে সংস্কৃত শিক্ষাটা খুব ভালো ভাবে দেন। তবে তিনি জানতেন—সংস্কৃত শিক্ষা পণ্ডিতের উপযুক্ত হতে পারে, কিন্তু জীবিকার জন্য সেটা লাভজনক নয়। জীবিকার জন্য তাকে পাঠানো হল পাটনায়। সেখানে ভালো করে আয়ত্ব করেছেন ফার্সি ও আরবী ভাষা। এদুটো ভাষা তখনকার রাজভাষা। এ দুটো ভাষা ছাড়া বিত্ত অর্জন অসম্ভব।

সে সময় সবে কোম্পানীর শাসন চলছে। দেশে জীবনবিনাশী সত্তরের মন্বন্তর শুরু হয়েছে। দেশে মানুষ মরে-ছেড়ে যাচ্ছে। সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বাংলায় সংসারবিহীন হিন্দুকে সন্নাসী বলে। আর সংসারবিহীন মুসলমানকে ফকির বলে। সুবা বাংলার ভাগলপুর-পূর্ণিয়া থেকে শুরু করে রংপুর-বগুড়া পর্যন্ত এই সন্নাসী-ফকিরদের আন্দোলন হয়। হেস্টিংস এদেরকে ‘the gypsies of Hindustan’, বঙ্কিমচন্দ্র ডাকাইত আর যামিনীমোহন গাঙ্গুলি Raiders বলেছেন। প্রাবন্ধিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেছেন, আকাশেবাতাসে তখন মন্বন্তরের হাহাকার, অন্যদিকে খাজনা আদায়কারীদের হুঙ্কার এবং সেই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে উত্থিত হয়েছে সন্যাসী-ফকিরদের ইংরেজ কোম্পানী ও বাহিনীর বিরুদ্ধে রণধ্বনি। সেই সময়টাতে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ, বাঁকুড়ার প্রজা বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহ ইত্যাদি একের পর এক ফেটে পড়েছিল। সুবে বাংলা তখন নরক। সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহের নেতার নাম মজনু শাহ। রামমোহন পরবর্তীতে যখন জন ডিগবির দেওয়ান হিসবে রংপুরে কাজ করেছেন—তখন তিনি প্রায়ই রংপুর থেকে তিন মাইল দূরে ফুলচৌকির রংমহলে আসতেন। মজনু শাহের অনুসারীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন।

সুফিবাদ--------------------

পাটনার পড়াশুনা করার সময়ে রামমোহন জীবিকার ভাষা শিখতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ পান। পরিচিতি হলেন সুফি সাধক ও যুক্তিবাদি মুতাজিলদের চিন্তাধারার সঙ্গে। সুফিরা মনে করেন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো ফারাক নেই—তারা অভেদ। মানুষই সরাসরিভাবেই ব্যক্তিগতভাবে অদ্বৈতবাদের সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। সুফিরা এই স্রষ্টাকে বললেন তওহীদ।

রক্ষণশীল মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মানুষের কর্ম-অকর্ম, এমনকি প্রতিটি পদক্ষেপ, সমস্তই সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর ইচ্ছায় সংগঠিত হয়। কি হবে না হবে, কে কি করবে না করবে—সবই পূর্ব নির্ধারিত। আল্লাহ সব ঠিক করে রেখেছেন। আল কোরআন চিরন্তন গ্রন্থ। কোনো মানুষ কর্তৃক রচিত হয়নি। এটা ঐশী গ্রন্থ। অভ্রান্ত।

মুতাজিলাবাদ--------------------

মুতাজিলারা ছিলেন গ্রীক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। তারা বললেন, মানুষের জন্য কুকর্ম বরাদ্দ করে সৃষ্টিকর্তা আবার তারই জন্য মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। সৃষ্টিকর্তা স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের অধিকার দিয়েছেন মানুষকে। নিজের স্বাধীনতাঅনুসারে ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করার যে কোনোটাই সে বেছে নিতে পারে। সুতরাং মানুষের দোষগুণ বলে কোনো ব্যাপার থাকতে পারে না। মুতাজিলারা বললেন, একমাত্র ঈশ্বরই চিরন্তন । তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি। তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুফি ও মুতাজিলাদের চিন্তাধারাটা বে-শরা বা শাস্ত্রবহির্ভূত। রামমোহন দেখলেন, সুফিদের চিন্তার সঙ্গে ভারতীয় চিন্তার একটা মিল পাওয়া যায়।

রামমোহনের ধর্মঅভিযান--------------------

রামমোহন ভারতীয় দর্শন, সুফিবাদ ও মুতাজিলদের চিন্তাধারা থেকে সিদ্ধান্তে এলেন, ঈশ্বর এক ও নিরাকার। তিনি সর্বত্র আছেন। ঈশ্বর এক বলে তাঁর সৃষ্টিও এক। মানুষ, স্রষ্টা ও মানবসমাজও এক। কোনো ভেদ নেই। মানুষ স্রষ্টার দেওয়ার অধিকার ভোগ করে। চিন্তায় ও কর্মে মানুষ স্বাধীন। মানুষ কোন কাজটি করবে তার জন্য ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহিতা করার দরকার নেই। রামমোহনের এই চিন্তা লোকাচারবিরোধি। ফলে গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ বাবা ছেলের উপর ক্ষেপে গেলেন। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

এরপর রামমোহন কিছুকাল দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ালেন। সে সময়ে বৌদ্ধ অধ্যূষিত হিমালয় অঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বৌদ্ধ ও তন্ত্র সাধনায় বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। এই দেশ ভ্রমণের সময়ে তিনি খুব গভীরভাবে খুব কাছ থেকে দেশের সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জীবনযাত্র দেখার সুযোগ পান। তাঁর আত্মজীবনীমূলক পত্রে জানা যায় ইংরেজ শাসিত দেশে জনসাধারণের দুর্দশা ও দুরবস্থা দেখে সে সময় তিনি ইংরেজদের সম্বন্ধে প্রবল বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছিলেন তিনি।

এরপরে বারাণসীতে সংস্কৃত শিক্ষা করতে চলে যান। এখান থেকে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও শাস্ত্রের আদি তথা মূল রূপ, উচ্চ ও শুদ্ধ সার জানার চেষ্টা করেন।

তিনি জীবনের এই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন একই সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতীর সাধনা করবেন। তাঁর ভাবনাকে প্রকাশিত করতে গেলে রক্ষণশীলদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখিন হতে হবে। তাঁকে প্রতিরোধ করতে হলে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হতে হবে। তিনি ১৮০৩ সালে মার্চ মাসে ফরিদপুরের কালেক্টর টমাস উডফোর্ডের অধীনে দেওয়ান পদে দুমাসের জন্য চাকরি নিলেন। প্রায় বছর খানেক পরে রামমোহন আবার মুর্শিদাবাদে উডফোর্ডের অধীনে কাজ করলেন। এরপর তিনি চাকরি নিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে। ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ইংরেজি ভাষাটা শিখে নিলেন খুব ভালোভাবে। ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় জ্ঞানবিদ্যা চিন্তাভাবনাও আয়ত্ত করে নিলেন।

বই লেখা--------------------

তিনি প্রথম লিখলেন একটি পুস্তিকা। নাম তুহফৎ-উল-মুওয়াহিদদিন। অর্থ একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। বইটির ভূমিকা আরবিতে লিখেছেন। মূল লেখা ফার্সিতে। নিজের পয়সায় প্রকাশ করে বিতরণ করলেন। দ্বিতীয় বই লিখলেন মনজারৎ-উল-আদিয়ান বা বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা। বেদান্ত, লোকাচারসিদ্ধ হিন্দুধর্ম, বা-শরা বা শাস্ত্রীয় ইসলাম, সুফীবাদ বা বে-শরা ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে একটি তুলনামুলক আলোচনা করেছেন এই বইতে। তিনি এ সময়ে খুঁজছেন ভারতে প্রচলিত ধর্মসমূহের সঙ্গে সারাবিশ্বের ধর্মেরসমূহের একটি যোগসূত্র।

১৮০৫ সালে তৃতীয়বার রামমোহন চাকরি নিলেন কোম্পানীতে। কর্মস্থল রাঁচিতে। জেলা আদালতের নিবন্ধক ও জেলা শাসকের সহকারী জন ডিগবির অধীনে কাজ করতে করতে প্রচুর ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বই-পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ পেলেন। ১৮১৫ সালে তিনি ভুটানে যান কোম্পানীর দূত হিসাবে। ডিগবি লিখেছেন, ফরাসি বিপ্লবের কাহিনী রামমোহনের বিশেষ প্রিয় ছিল এবং এই বিপ্লবের আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

প্রথম যৌবন থেকেই তিনি তেজারতি বা সুদে টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসার শুরু করেন। তার এই ব্যবসায়ের পার্টনার ছিলেন অ্যান্ডরু র‍্যামজে, টমাস উডফোর্ড প্রমুখ। এই ইংরেজরা কোম্পানীতে চাকরী করতেন। সে সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছাড়া আর কেউ ব্যবসা বানিজ্য করতে পারবে না। রামমোহনের অংশীদারটি গোপনে এই তেজারতির কারবারটি করতেন। সুদের টাকা দিতেন মূলত ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরকেই। রামমোহন এই কারবারের সঙ্গে ধীরে ধীরে গোবিন্দপুর, রামেশ্বর, বীরলুক, শ্রীরামপুর ও কৃষ্ণনগর তালুকগুলি কেনেন। এই তালুক থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল এগার হাজার টাকা। এইভাবে জ্ঞানী রামমোহন সেকালে বিত্তবান হয়েছিলেন।

১৮১২ সালের আগে থেকেই রামমোহন কোলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করলেও আন্তর্জাতিকভাবে তার ভাবনা বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। ১৮১২ সালে স্পেনের প্রগতিশীল লোকেরা একটি বিকল্প সংবিধান প্রণয়ন করেন। সেটি তারা উৎসর্গ করেন রামমোহন রায়ের নামে। শুধু ইউরোপ নয় আমেরিকার ভাবুকরাও তার ভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

১৮১৪ সালে রামমোহন রায় রংপুর থেকে এসে কোলাকাতায় বসবাস করতে শুরু করেছেন। তখন তিনি আত্মীয়সভা স্থাপন করেছেন। আত্মীয় সভার বৈঠক বসত তাঁর মানিকতলার বাগান-বাড়িতে। পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর, টাকীর কালীনাথ ঠাকুর ও বৈকুণ্ঠনাথ মুনশি, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পিতামহ বৃন্দাবন মিত্র, বিচারপতি অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের পিতামহ বৈদ্যনাথ মুখেপাধ্যায়, ভূকৈলাসের কালীশঙ্কর ঘোষাল, তেলেনিপাড়ার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশোর বসু প্রমুখ আত্মীয়সভায় নিয়মিত যেতেন। জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ সেখানে যেতে শুরু করেছেন। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাদের দুজনের মধ্যে। সেখানে ধর্ম, দেশের পরিস্থিতি, শিক্ষা ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত।

বদলে দেওয়ার ভাবনা--------------------

সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন—সে সময়ে রাজা রামমোহন রায় প্রচলিত দেশী ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। শুরু করলেন ধর্মসংস্কারের আন্দোলন। ইসলাম ও খ্রীস্টান ধর্মের প্রভাবে তিনি একেশ্বরবাদের প্রচারে নেমে পড়লেন। দ্বিতীয় কাজটি করলেন—সমাজসংস্কারণ আন্দোলন। সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য আন্দোলন। তৃতীয় কাজটি করলেন, দেশীয় আইন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। মেয়েদের জন্য পৈত্রিক সম্পত্তিতে অংশ দাবী করলেন। অতঃপর তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের কাছে তিনি দেশবাসীর জন্য দাবি করলেন প্রকৃত আধুনিক শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে অই শিক্ষার সংজ্ঞা ও পাঠক্রমও তিনি দিয়ে দিলেন।

হিন্দু কলেজ : পরিবর্তনের সুতিকাগার--------------------

১৮১৭ সালে ২০ জানুয়ারী কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানী এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি। কোলকাতার ধনী বাবুরা অর্থ সাহায্য দিয়ে কলেজটি স্থাপন করেন। রামমোহন কলেজের উদ্যোক্তা হলেও তৎকালীন গোড়া হিন্দুরা তার ভাবনাকে পছন্দ করত না। তিনি থাকলে এই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে আশঙ্কায় তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়। নামে হিন্দু কলেজ হলেও সেখানে বাংলা ভাষার কোনো স্থান ছিল না। সেখানে পড়ানো হত ইংরেজি, ফার্সি, আরবি ইত্যাদি। ছাত্ররা ইংরেজী ভাষা জানলেও বাংলাতে খুবই দুর্বল ছিলেন। জন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের প্রস্তাবে ১৮৫৩ সালে সেখানে একজন বাংলার অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। । হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যুক্তিবাদ, উদারনৈতিকতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পাঠও নিয়েছিল তখন।

হিন্দু কলেজে মিশ্র পর্তুগীজ বংশোদ্ভুত শিক্ষক ডিরোজরিওর ছাত্ররা যুক্তির আলোকে ধর্মকে দেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কোনো কিছুকেই আপ্তবাক্য হিসাবে গ্রহণ না করে প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে সত্যসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আদর্শ তাঁর কাছ থেকে ছাত্ররা শিখেছিলেন। এই কলেজের ছাত্ররাই পরবর্তী সময়ে উনিশ শতকের রেনেসাঁ বা পূনর্জাগরণের নায়ক। হিন্দু কলেজ স্থাপিত হওয়ার পনেরো বছরের মধ্যেই এই ছাত্ররা তাঁদের পোষাক আশাক, খাবার অভ্যাস, বক্তব্য এবং জীবনযাত্রা দিয়ে রক্ষণশীলতার উপর প্রবরভাবে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। শুরুতে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের এই কলেজে প্রবেশাধিকার থাকলেও ১৮৫৩ সালে হিন্দু কলেজটি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৮৫৫ সালে নাম পাল্টে প্রেসিডেন্সি রাখা হয়।

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরে একটি মিশনারী কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮২১ সালে নিজের সম্পাদিক সম্বাদ কৌমদী পত্রিকায় রামমোহন দেশের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে আধুনিক শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানীর সরকারের কাছে আবেদন জানান। কোম্পানী এটা বাস্তবায়ন না করলে তিনি নিজেই ১৮২২ সালে আপন ব্যয়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল নামে একটি ছোটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। দ্বারকানাথ তাঁর ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে এই স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এই বিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য তিনি সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় প্রাথমিক বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা প্রকাশ করতে শুরু করেন।

সংবাদপত্রে স্বাধীনতা--------------------

ইতিমধ্যে ১৮১৮ সালে রেগুলেশন নামে একটি বিধি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই বিধির বলে সরকারি নীতির সমালোচনা বা বিরুদ্ধতার অপরাধে যে-কোনও ব্যক্তিকে—তা ইউরোপীয়ই হোন বা ভারতীয়ই হোন—কারণ দর্শাবার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারাগারে আটক করা যেত। রামমোহন এই বিধির বিরোধিতা করে কোম্পানীর সরকারকে চিঠি দিলেন। ১৮২৩ সালে প্রেস অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন জারি করা হয়। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—বিনা সরকারি অনুমোদনে সরকারি নীতি সংক্রান্ত কোনও সংবাদ বা আলোচনা সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। এটা স্পষ্টতই ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। সে সময়ে তিনি লিখছেন—রাষ্ট্রশাসনের ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত দেওয়ার এবং সমালোচনা করার অধিকার আছে। জনসাধারণের মতামত ও বিবেচনা অনুসারে শাসককে রাষ্ট্রশাসন করতে হবে। এবং তিনি আরও বললেন—অবস্থাবিশেষে জনসাধারণ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। ১৮৩৫ সালে অই কালো আইন উঠে যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর এই আইন বাতিলে রামমোহনের ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে জানপরাণ দিয়ে লড়েন। পাশাপাশি সতীদাহ প্রথা বাতিলের আন্দোলনেও তিনি সব সময়ই রামমোহনের সহকারী হয়ে উঠেছিলেন।

ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণার সূত্রপাত--------------------

রামমোহন জমিদারেরসঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি এই প্রথা বাতিলের দাবী তুলেছিলেন। বলেছিলেন চিরম্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারকে নয়—দিতে হবে কৃষককে। তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি এনেছিলেন। বলেছিলেন, ব্যক্তিস্বাধীনতার শুরুতে আছে ক্ষুদ্রতম এককের যিনি কর্তা, তাকে সমালোচনা করার অধিকার থাকতে হবে। পরিবারের প্রধানকে সমালোচনা করবেন স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সবাই। বৃহত্তর এককের কর্তা হলেন জমিদার। তাকে সমালোচনা করার অধিকার থাকবে প্রজাদের। তিনি দাবী তুললেন নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে। কৃষককে জমির মালিকানা দিতে হবে। এই বস্তুগত অধিকার দিলেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তন থেকেই আসবে ব্যক্তিস্বাধীনতা।

রাজনীতির উন্মেষ--------------------

এর আগে এদেশের মানুষ জানতেন না দেশের শাসন ব্যবস্থায় প্রজারও একটি স্থান আছে—আধিকার আছে। কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সে বিষয়ে প্রজার মতামত থাকতে নেই। প্রজারা জানে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার রাজা-বাদশা-জমিদারদের। প্রজাদের ভালোমন্দ ভাবনা ভাববেন শুধু এই শাসক সম্প্রদায়। রাজনীতি নিয়ে শুধু সেই অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্তরাই মাথা ঘামাত যারা কোনো না কোনোভাবে শাসন-ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। প্রজারা রাজনীতি জানত না। সে সময়ে যে সব প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল সেখানে প্রজারা নিজেদের ক্ষমতায়নের কথা কখনো ভাবতে পারেনি। তারা কেবল সচেতন ছিল ধর্ম সম্বন্ধে। আর ধর্ম সকলকালেই শাসিতদের পক্ষে থেকেছে। সে সময়ে রামমোহন রায় লিখেছেন—রাজনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আধ্যাত্মিক ধর্মের সংস্কার দরকার। তিনি লিখেছেন, যাহা শিক্ষা দেয় যে, সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুর কোনো যথার্থ অস্তিত্ব নাই, পিতা-ভ্রাতা প্রভৃতির কোনো প্রকৃত সত্তা নাই, সুতরাং তাহাদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক স্নেহের সম্পর্ক নাই এবং সেইজন্য যত শীঘ্র পারি তাহাদের ও এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে পারিলেই মঙ্গল, সেই ধর্মের সঙ্গে কোনো যোগ থাকার কোনো দরকার নাই।

রাজা রামমোহনের এই ভাবনাগুলো তখন বঙ্গে বাংলার গণজাগরণের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। দ্বারকানাথ রামমোহনের প্রতিটি কাজের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। নিজেদের ব্যবসামনোবৃত্তিটার বদলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিত্তের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। রামমোহন ধর্মীয় বাঁধা অমান্য করে বিলেতে গিয়েছিলেন। দ্বারকানাথও তাই।

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তিকালে লিখেছেন একদা পিতৃদেবের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, বাল্যকালে অনেক সময়ে রামমোহন রায় তাঁহাকে গাড়ি করিয়া স্কুলে লইয়া যাইতেন; তিনি রামমোহন রায়ের সম্মুখবর্তী আসনে বসিয়া সেই মহাপুরুষের মুখ হইতে মুগ্ধদৃষ্টি ফিরাইতে পারিতেন না, তাঁহার মুখচ্ছবিতে এমন একটি সুগভীর সুগম্ভীর সুমহৎ বিষাদচ্ছায়া সর্বদা বিরাজমান ছিল।

----------------------

নবম পর্বের লিংক


মন্তব্য

তানভীর এর ছবি

হিন্দু কলেজে পর্তুগীজ শিক্ষক ডি রোজরিওর...

ডি রোজরিও নয়, ডিরোজিও। মিশ্র পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত এংলো-ইন্ডিয়ান হলেও ডিরোজিওর জন্ম কলকাতায় এবং তিনি অনেক বাঙালির চেয়ে বেশি বাঙালি, অনেক ভারতীয়ের চেয়ে বেশি ভারতীয় ছিলেন এবং এই দেশকে তাঁর নিজের দেশ মনে করতেন। পর্তুগীজ শিক্ষক হিসেবে ডিরোজিওর পরিচয় দেয়াটা তাই বেশ অসম্মানজনক।

মুতাজিল -> মুতাজিলা
সন্যাসী -> সন্ন্যাসী
gipsies -> gypsies

কুলদা রায় এর ছবি

আমার বানান জ্ঞান যাচ্ছেতাই। ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আর পড়ার জন্যও ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

আশরাফুল কবীর এর ছবি

## অনেক অনেক ভাল লাগা রইল এবং থাকবে পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য (যদি লিখেন)।

## ভাল থাকুন সবসময়, এ সুন্দর কামনায় উত্তম জাঝা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।