রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : একবিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৫/০১/২০১২ - ৬:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

ছোটো গল্পের শুরু------------

ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তারিখটি উল্লেখ নেই। ছিন্নপত্রে লেখা আছে ফেব্রুয়ারি ১৮৯১। .স্থান শাহাজাদপুর।

ঘটনার চরিত্র বেদে-পুলিশ ও একটি দরিদ্র শিশু। তিনি বসে আছেন জানালার পাশে—বোটে। খালের ওপারে দেখতে পাচ্ছেন একদল বেদেকে। তারা বাখারির উপর দরমা ও কাপড় টানিয়ে আশ্রয় বানিয়েছে। মাঘ মাসের শীতকাল। বেলার আট-নটার সময় তারা দরমার চালের উপর রোদে দিয়েছে রাতে শোবার কাঁথা ও ছেড়া নেকড়াগুলো। কাছাকাছি তাদের শুয়োরপাল গুটি শুটি হয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। এই বেদেদের জীবন ভাসমান। তাদের কোথাও বাড়ি-ঘর নেই। কোনো জমিদারকে খাজনা দেওয়া লাগে না। একদল শুয়োর, গোটা দুয়েক কুকুর ও কতকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।

রবীন্দ্রনাথ জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, পুরুষটি রান্না চড়িয়েছে। বসে বসে বাঁশ চিরে চিরে ধামা চাঙারি কুলো তৈরি করছে। আর কালো বউটি আয়না নিয়ে ভেজা গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিয়েছে। তারপর পুরুষটির সঙ্গে কাজ করছে। কেউ বসে নেই। মাঝে মাঝে এক মেয়ে আরেক মেয়ের উঁকুন বাঁছছে। ঘরকন্নার গল্প জুড়ছে।

এই বেদেদের সম্পর্কে পুলিশের ধারণা সন্দেহজনক। সেদিন এক পুলিশ এসে ঐ বেদে পুরুষটিকে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গালমন্দ করছে। শুনে মেয়েটি বাখারি ছোলা বাদ দিয়ে পুলিশকে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গালমন্দের জবাব দিচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, দেখতে দেখতে দারোগার তেজ প্রায় বারো-আনা পরিমাণ কমে গেল—অত্যন্ত মৃদুভাবে দু-একটা কথা বলবার চেষ্টা করলে—কিন্তু একটুও অবসরও পেলে না। যেভাবে এসেছিল সে ভাব অনেকটা পরিবর্তন করে ধীর ধীরে চলে যেতে হল। অনেকটা দূরে গিয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘আমি এই বলে গেলাম—তোমাদের এখান হৎকে যাবার লাগবে’।

রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, পুলিশের হুমকীকে বেদেরা থোড়াই কেয়ার করল।

এদিনই তিনি জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন, এক মেয়ে তার উলঙ্গ শীর্ণ শিশুটিকে মাঘ মাসের ঠাণ্ডা জলের মধ্যে স্নান করাচ্ছে। ছেলেটা শীতে কাঁপছে। ভয়ানক ভাবে কাশছে। মেয়েটা ছেলেটার গালে চড় কশিয়েছে। ‘ছেলেটা বেঁকে পড়ে পড়ে হাঁটুর উপর হাত দিয়ে ফুল ফুলে কাঁদতে লাগল, কাশিতে তার কান্না বেধে যাচ্ছিল।

এই ঘটনাটিকে কোমল কবির কাছে পৈশাচিক মনে হয়েছে। অসহায় শিশুটির কান্না তাকে বিচলিত করেছে।
৪ ঠা ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ তারিখে প্রমথনাথ চৌধুরীকে একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, শাহাজাদপুরে সেদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় ডান কাঁধে বাতের ব্যাথা অনুভব করছেন। মাথা ও হাত নাড়াতে পারছেন না।

৯ ফেব্রুয়ারি তিনি শাহজাদপুর ছেড়ে শিলাইদহে চলে এসেছেন। শিলাইদহে বোটে এসে তাঁর ভালো লাগছে। কাঁধের ব্যাথা দূর হয়ে গেছে। ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে পোস্ট মাস্টারের কথা বলেছেন।

পোস্ট মাস্টার -------------
সন্ধ্যার সময় শাহাজাদপুরের পোস্ট মাস্টার কবির সঙ্গে এক-একদিন দেখা করতে আসেন। তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। বিষয় চিঠির যাতায়াত।
পোস্টাফিসটি কুঠিবাড়ির একতলাতেই। ফলে চিঠি আসা মাত্রই চিঠি পাওয়া যায়। কথক হিসাবে পোস্ট মাস্টার ভালোই। কবির ভালোই লাগে এই নির্জনে তার বলা গল্পগুলো। তিনি অসম্ভব কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কাল বলছিলেন, এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমনি ভক্তি যে, তাদের কোনো আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুড়ো করে রেখে দেয়। কোনো কালে গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাহলে তাকে পানের সঙ্গে সেই হাড়-গুড়ো খাইয়ে দেয়, আর মনে করে তার আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গা লাভ হল। আমি হাসতে হাসতে বললুম, ‘এটা বোধ হয় গল্প?’।. তিনি খুব গম্ভীর ভাবে চিন্তা করে স্বীকার করলেন, ‘তা হতে পারে।‘

এই পোস্ট মাস্টারকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পরে তাঁর সেই বিখ্যাত পোস্ট মাস্টার গল্পটি। গল্পটির শেষ স্তবকে বলেছেন সেই হৃদয় কাঁপানো বাক্য--এই পৃথিবীকে কে কাহার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছোট গল্পের বিষয়বস্তু বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পোস্ট মাস্টারটি বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি—আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি-- কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।

বাংলার নদীতীরবর্তী এইসব মানুষের চরিত্র ক্ষণে ক্ষণে যতটুকু গোচরে এসেছিল তার চেয়ে অনেকখানি প্রবেশ করেছিল তাঁর মনের অন্দর মহলে আপন বিচিত্র রূপ নিয়ে। এই দেখা না দেখার মেশা জগৎই গল্পগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে প্রাণ পেয়েছিল। তিনি যখন স্থায়ীভাবে শান্তি নিকেতনে চলে গিয়েছিলেন তখন কিন্তু এই ছোটো গল্প রচনার ধারাটি অক্ষুণ্ন থাকে নি। তিনি দুঃখ করে স্বীকার করেছিলেন পরবর্তীকালে—গল্প রচনার সে ধারা অব্যাহত থাকতো, যদি কর্তব্যের টানে তাকে চলে না আসতে হতো বীরভূমের শুষ্কপ্রান্তরের ক্ষেত্রে। এই গল্পগুলো সাধনা ও হিতবাদী পত্রিকার তাগিদে লেখা হয়েছে। এটা হয়েছে পূর্ববঙ্গের মাটি ও মানুষের কারণে।

এর পরের চিঠিতে ইন্দিরাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই অসম্ভব কথার মতই—
কাছারির পরপারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। দিনটা এবং চারিদিকটা এমনি সুন্দর ঠেকেছে সে আর কী বলব। অনেক দিন পরে আবার এই বড়ো পৃথিবীর সঙ্গে যেন দেখা-সাক্ষাৎ হল। সেও বললে, ‘এই-যে।‘ আমিও বললুম, ‘এই-যে’। .তার পরে দুজনে বসে আছি—আর কোনো কথাবার্তা নেই, জল ছল ছল করছে এবং তার উপরে রোদ্দুর চিকচিক করছে, বালির চর ধূ ধূ করছে, তার উপরে ছোট বনঝাউ উঠেছে। জলের শব্দ, দুপুর-বেলাকার নিস্তদ্ধতার ঝাঁ ঝাঁ এবং ঝাউঝোপ থেকে দুটো-একটা পাখির চিক চিক শব্দ, সবসুদ্ধ মিলে খুব একটা স্বপ্নাবিষ্ট ভাব। খুব লিখে যেতে ইচ্ছে করছে—কিন্তু আর কিছু নিয়ে নয়, এই জলের শব্দ এবং রোদ্দুরের দিন, এই বালির চর। মনে হচ্ছে রোজই ঘুরে ফিরে এই কথাই লিখতে হবে—কেননা, একই নেশা, আমি বারবার এই এক কথা নিয়েই বকি—

বড়ো বড়ো নদী কাটিয়ে আমাদের বোটটা একটা ছোটো নদীর মুখে প্রবেশ করছে। দুই ধারে মেয়েরা স্নান করছে, কাপড় কাঁচছে এবং ভিজে কাপড়ে এক-মাথা ঘোমটা টেনে জলের কলসী নিয়ে ডান হাত দুলিয়ে ঘরে চলেছে—ছেলেরা কাদা মেখে জল ছুড়ে মাতামাতি করছে এবং একটা ছেলে বিনা সুরে গান গাচ্ছে ‘ একবার দাদা বলে ডাকরে লক্ষ্মণ।‘ উঁচু পাড়ের উপর দিয়ে অদূরবর্তী গ্রামের খড়ের চাল এবং বাঁশবনের ডগা দেখা যাচ্ছে। ...পৃথিবীর সকালবেলাকার কাজকর্ম খানিকক্ষণের জন্যে বন্ধ হয়ে আছে।

ছোটো গল্পের হদিস—------------------
১৮৯১ সালের ৩০ মে একটি নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকা হিতবাদী প্রকাশিত হয়েছিল। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পাদক। মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় রাজনৈতিক সম্পাদক নিযুক্ত হন। হিতবাদী নামটি রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। তিনি পত্রিকার উদ্দেশ্যও লিখে দেন—হিতং মনোহারি চ দুলর্ভং বচঃ। পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় একটি করে গল্প প্রকাশিত করার নীতি নেওয়া হয়েছিল। পত্রিকাটিতে লেখকদের স্মানী দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি গল্প লেখেন হিতবাদীতে।

এর আগে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ভিখারিনী ও ঘাটের কথা এবং নবজীবনের রাজপথের কথা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো ঠিক গল্প নয়। গল্পের আভাষ মাত্র। রবিজীবনীকার প্রশান্ত পাল জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের সূচনা সূচনা হিতবাদীতেই—পরে তা সাধনা পত্রিকায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। বস্তুত সুখদুঃখবিরহমিলনপূর্ণ মানবজীবনের সঙ্গে যে অন্তরঙ্গ পরিচয় ছোটো গল্পের প্রাণ, সেই বাস্ত অভিজ্ঞতার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন শিলাইদহ-শাহাজাদপুর-পতিসরে জমিদারী-পরিদর্শনের সময়। তাই মাঝে মাঝে রোমাঞ্চের উর্দ্ধলোকে প্রয়াণ করলেও রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের ছোট গল্পের প্রধান বিষয় মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন।

‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘গিন্নি’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’, ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’ ও ‘খাতা’ গল্পগুলি হিতবাদীতে প্রকাশিত হয়। পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, সাধনা বাহির হইবার পুর্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। সেই পত্রে আমি প্রতি সপ্তাহেই ছোট গল্প সমালোচনা ও সাহিত্যপ্রবন্ধ লিখিতাম। আমার ছোটো গল্প লেখার সূচনা ঐখানেই। ছয় সপ্তাহকাল লিখিয়াছিলাম।

হিতবাদীতে সাতটি গল্প প্রকাশিত হওয়ার পরে সম্পাদক কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গল্পগুলো সাধারণের পক্ষে গুরুপাক হচ্ছে। লঘুপাকের গল্প লেখা আবশ্যক। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে হিতবাদীতে লেখা ছেড়ে দেন। সম্পাদকের মতকে তিনি সঙ্গত মনে করেন নি। এরপরে ঠাকুরবাড়ি থেকে সাধনা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে ছোট গল্প লেখেন।

১৮৯১ সালের জুন মাসে আষাঢ়ের বৃষ্টির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শাহাজাদপুরে চলে যান। পাল তুলে তার বোট চলেছে যমুনা নদীর মধ্য দিয়ে। নদীটি প্রকাণ্ড। তীব্র স্রোতে পাড় ভাঙছে—নদী ভাঙছে। আর বাতাসের হুহু ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বোটটি ছাড়া আর কোনো নৌকা দেখা যাচ্ছে না যমুনায়। সন্ধ্যাসন্ধি বড় নদী থেকে যমুনার ছোটো একটা শাখা নদীতে প্রবেশ করেছে। একটা চরে বোটটি বাঁধা হয়েছে। চরটি বড়। ধূ ধূ বালি। কিন্তু কোনো জনমানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যপারে সবুজ শস্যক্ষেত। আর দূরে একটি গ্রাম। ইন্দিরাকে চিঠিতে লিখেছেন—এই নদীর উপরে, মাঠের উপরে, গ্রামের উপরে সন্ধ্যেটা কী চমৎকার, কী প্রকাণ্ড, কী অগাধ সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভব করা যায়। কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়। ক্রমে যখন অন্ধকারে সমস্ত অস্পষ্ট হয়ে এল, কেবল জলের রেখা এবং তটের রেখায় একটা প্রভেদ দেখা যাচ্ছিল, এবং গাছপালা কুটির সমস্ত একাকার হয়ে একটা ঝাপসা জগৎ চোখের সামনে বিস্তৃত পড়ে ছিল তখন ঠিক মনে হচ্ছিল এ-সমস্ত যেন ছেলেবেলার রূপকথার অপরূপ জগৎ।

এই জগতে রবীন্দ্রনাথের নিজেকে মনে হয়েছে একজন রাজপুত্র—তার জন্য ঘুমিয়ে আছে একজন রাজকন্যা। এই ভাবনা নিয়েই তিনি লিখেছেন শৈশব সন্ধ্যা কবিতাটি।

১১ জুন একটি ঝড়ের বিবরণ দিয়েছেন। বোটের মধ্যে থেকে খোলা জানালায় মুখ রেখে প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ দেখছেন। নিজের মনকে রুদ্রের তালে দোলাচ্ছেন।

পরদিন তিনি সন্ধ্যায় তিনি নৌকায় উঠেছেন। চাঁদ উঠেছে—অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। ছেটো নদীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে বোটটি। এই স্থানটি তাঁর কাছে পরীস্থানের মত মনে হচ্ছে। একটা ধানক্ষেতে বোটটি নোঙ্গর করা হয়েছে। ‘কাছি ফেল’, নোঙ্গর ফেল’ এ কর’ সে কর’ করতে করতে ঝড় এলো, মাঝি থেকে থেকে বলতে লাগল ভয় কোরো না ভাই, আল্লার নাম করো—আল্লা মালেক। থেকে থেকে সকলে আল্লা আল্লা করতে লাগল।

এই ঝড় বাদলটা একটা মস্ত তামাশার মত মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, আমরা কিনা প্রকৃতির নাতি সম্পর্ক, তাই তিনি মধ্যে মধ্যে একটু-আধটু তামাশা করে থাকেন। জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত—কারণ, যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে গ্রহণ করতে পারে না।
এরপর ছিন্নপত্রে আরেকটি শান্ত জ্যোৎস্নার কথা বলছেন। অন্যত্র তাঁর দেখা জ্যোৎস্নার সঙ্গে এর একটা পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে। ‘সেখানে জ্যোৎস্না ছাড়াও অন্য পাঁচটা বস্তু আছে—কিন্তু এখানে নিস্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কিছু নাই। একলা বসে এই জ্যোৎস্নার অনন্ত শান্তি ও সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু এই দেখাটাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তাই তিনি বোটের জানালায় মাথা রেখে আছেন। বাতাস তার চুলে স্নেহস্পর্শ্ব দিচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন জলের ছল ছল শব্দ। জ্যোৎস্না ঝিকমিক করছে। এই জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়। অনেক সময় মনের আন্তরিক অভিমান, একটু স্নেহের স্বর শুনলেই অমনি স্নেহজলে ফেটে পড়ে।

এরপরের চিঠিতে দিয়েছেন একটি দুপুরের বর্ণনা। এই দুপুর বেলাটি তাঁর বেশ লাগে। রৌদ্রে চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে থাকে—মনটা ভারী উড়ু উড়ু করে, বই পড়ার ইচ্ছে করে না।

এই শান্ত প্রকৃতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন খেয়া ঘাটের দৃশ্য। সেটা নিঃঝুম নয়। একটু গতিশীল। বটগাছের তলায় নানাবিধ লোক জড়ো হয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষার করছে। নৌকা আসা মাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছে।...ওপারে হাট, তাই খেয়া নৌকায় এত ভীড়। কেউবা ঘাসের বোঝা, কেউবা একটা চুপড়ি, কেউবা একটা বস্তা কাঁধে করে হাঁটে যাচ্ছে এবং হাঁট থেকে ফিরে আসছে, ছোটো নদীটি এবং দুই পারের ছোটো গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় একটুখানি কাজকর্ম, মনুষ্যজীবনের জন্যে এই একটুখানি স্রোত অতি ধীরে ধীরে চলছে। সব কিছু বিষাদের ছায়া বোধ হয়। তারমধ্যে সংসারের সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা—ক্ষণস্থায়ী। নিস্ফল কাতরতা-পুর্ণ তুচ্ছ মনে হয়।

পরের চিঠিতে তিনি একটি বিকেল বেলার কথা লিখেছেন। বিকেলে বেলাটি নির্জন নয়—একটি গ্রামের ঘাট। সেখানে অনেকগুলো ছেলে খেলা করছে। তিনি জানালা দেখতে পাচ্ছেন। দৃশ্যটি তাঁর ভালো লাগছে। কিন্তু বোটের মাঝিমাল্লা আর লোকজন ছেলেগুলোর এই খেলাধূলা জমিদারের সামনে বেয়াদবী হিসেবে গণ্য করে থাকে। চাষারা গরুকে জল খাওয়াতে এলে পাইক পেয়াদারা লাঠি নিয়ে তাড়া করে। এটা কবির অপছন্দ। তিনি পাইক পেয়াদাদের থামিয়ে দেন।

শাহাজাদপুরের কুঠি বাড়ির দোতলায় বসে এমনই এক দুপুরবেলায় রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টার গল্পটি লিখেছিলেন। এইখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ ও প্রকৃতির নিরবিচ্ছিন্ন পাঠ—তার মধ্যে একটি বর্ণনাধর্মী গল্পভাষা তৈরি করেছিল। এ কারণে তার গল্পে ঘটনার ঘনঘটা কম, মানুষের সুখ দুঃখ একটি বৃহৎ পরিসরে স্থান পায়। নিচু স্বরে বিলম্বিত লয়ে খেলা করতে থাকে।

এই বিকেল বেলার ঘাটে এসে রবীন্দ্রনাথ ছুটি গল্পটি পেয়ে গেছেন। ছিন্নপত্রে লিখেছেন—ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকার মাস্তুল পড়ে ছিল—গোটা কতক বিবস্ত্র ক্ষুদে ছেলে মিলে অনেক বিবেচনার পর ঠাওরালে যে, যদি যথোচিৎ কলরব-সহকারে সেইটেকে ঠেলে ঠেলে গড়ানো যেতে পারে তাহলে খুব একটা নতুন এবং আমোদজনক খেলার সৃষ্টি হয়।...এর মধ্যে একটি ছোটো মেয়ে এসে বসেছে মাস্তুলের উপর। তাতে ছেলেদের খেলা পণ্ড হওয়ার জোগাড়। বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেটি একপাশে সরে যেতে অনুরোধ করেছে। মেয়েটি সরে না যাওয়ায় মাস্তুলটিকে মেয়েটিসহ গড়িয়ে ফেলে দিল। এই বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেটিই ছুটি গল্পের ফটিক। মেয়েটির বদলে গল্পে এনেছেন ফটিকের ছোটো ভাইয়ের চরিত্র। বাস্তবে ঘটনাটি গড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত। গল্পটি যখন লিখেছেন তখন ঘটনার গায়ে একটি নতুন আখ্যান জুড়ে দিয়েছেন। ফটিক শহরে যাচ্ছে। শহরে মামার বাসায় থাকছে। একসময়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। বাস্তবতা আর কল্পনার মিশেলে ফটিক গল্পটি বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প।

আরও দুটি চিঠি পাওয়া যাচ্ছে এই সময়কালে। প্রথমটিতে তিনি একটি স্বপ্নের বিবরণ দিচ্ছেন। শাহজাদপুরের নির্জন বিজন পল্লীতে থেকে কোলকাতার ভিড়ভাট্টা পুর্ণ জীবনের আখ্যান যেন এই স্বপ্নটি। সমস্ত কোলকাতা শহরটি যেন মহা একটা ভীষণ অথচ আশ্চর্য ভাবের দ্বরা আচ্ছন্ন হয়ে আছে—বাড়িঘর সমস্তই একটা কুয়াশার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে—এবং তার ভিতরে তুমুল কী একটা কাণ্ড চলছে।

সেন্ট জেভিয়ার কলেজটা একটু একটু বড়ো হয়ে যাচ্ছে। জোগাসাঁকোর বাড়িতে বদখত, মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের লোকজন এসে পড়েছে। মেয়েগুলো মাথায় কী একটা গুড়ো দিয়ে লম্বা হতে চেষ্টা করছে। এজন্যে বাড়িটা বেঁকে চুরে বিশ্রী হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, আধখানা মানুষ দেয়ালের মধ্যে গাঁথা রয়েছে, আধখানা বেরিয়ে আছে। বেশ শয়তানী কাণ্ড মনে হচ্ছে। পুরোটা একটা পরাবাস্তব গল্প।


মন্তব্য

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

এ পর্বটা অনেক ভাল লাগল চলুক
ধন্যবাদ এমন সহজ ও ঝরঝরে লিখার জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।