রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রয়োবিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০২/২০১২ - ১০:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড : এক
-----------------------------
অধ্যাপক আহম্মদ শরীফ ১৯৮৫ সালে ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ প্রবন্ধের জন্য গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীকে কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা’ এবং ঠাকুর জমিদারদের সম্পর্কে জানতে চেয়ে একটি চিঠি লেখেন।

আবুল আহসান চৌধুরীর বাড়ি কুষ্টিয়া। তার পিতার নাম ফজুলল বারী চৌধুরী। মামা বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম নায়ক কাজী মোতাহার হোসেন। রবীন্দ্রনাথ, লালন ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার বিষয়ে আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণা উচ্চমানের। তিনি সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যানুসন্ধানী। তাঁর চর্চার বিষয় উনিশ শতকের সমাজ ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, সাময়িকপত্র, আধুনিক সাহিত্য ও আঞ্চলিক ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডির অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রফেসর আহম্মদ শরীফ।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হত। কাঙাল হরিনাথ গ্রামেই থাকতেন। সুতরাং তিনি গ্রামের পরিস্থিতি শুনে নয়—দেখেই লিখতেন। মিছে কথা লেখার লোক তিনি নন। কাঙাল হরিনাথ তার পত্রিকায় সে সময় জমিদার-প্রজার সংবাদ লিখেছেন। জমিদারদের নিপীড়নের খবর নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন। আহম্মদ শরীফ এই প্রজানিপীড়ন বিষয়ে খোজ নিতে বলেছিলেন তার ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে। এজন্য জমিদার তার বিরুদ্ধে লাঠিয়াল পাঠিয়েছিলেন পিটিয়ে তক্তা খোলার জন্য।

ঠাকুর পরিবাররা সে সময় সাজাহাদপুরের জমিদার ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রজানিপীড়নের অভিযোগ। আহম্মদ শরীফ তাঁর ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে এই অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য তথ্যপ্রমাণাদি প্রেরণের নির্দেশনা দিয়ে চিঠিটি লিখেছেন। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। সুতরাং ঠাকুর-পরিবারের বিরুদ্ধে প্রজাপিড়ীনের অভিযোগের তদন্তের কথা বললেও আসল লক্ষ্য জমিদার রবীন্দ্রনাথ। এজন্য প্রফেসর শরীফ বলে দিচ্ছেন কাঙাল হরিনাথের নামটি আর তার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামের পত্রিকাটার কথা। তিনি বলছেন—এই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় ঠাকুরপরিবারের প্রজানিপীড়নের খবর ছাপা হয়েছিল।

অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী প্রফেসর আহম্মদ শরীফকে যে উত্তরটি লেখেন-সেটি একটি ইতিহাস। ইতিহাস এই কারণে যে এই চিঠিটি দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রাবন্ধিক চিঠিটি ব্যবহার করেছেন। চিঠিটি পুরোপুরি আহম্মদ শরীফের রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়। এইসব প্রাবন্ধিকদের উদ্দেশ্য চিঠিটি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা যে, রবীন্দ্রনাথ অত্যান্ত প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। মজার ঘটনা হল কেউ কিন্তু প্রফেসর শরীফের চিঠিটি তুলে দিচ্ছেন না। তাদের আগ্রহের বিষয় আবুল আহসান চৌধুরীর উত্তরসম্বলিত চিঠিটি। আবুল আহসান চৌধুরী চিঠিটি লিখেছিলেন ৭. ৯. ৮৫ তারিখে। চিঠির অংশ—

‘’শ্রদ্ধাভাজনেষু স্যার, সালাম জানবেন। অসুস্থতার জন্যে আপনার চিঠির জবাব দিতে কয়েকদিন দেরী হলো। অনুগ্রহ করে মাফ্‌ করবেন আমাকে। ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র কোন্‌ বর্ষ কোন্‌ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমার সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে ‘গ্রামবার্তা’র যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। প্রজাপীড়নের এই সংবাদ-সূত্রটি পাওয়া যায় কাঙাল-শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র একটি প্রবন্ধে। কাঙালের মৃত্যুর পর অক্ষয়কুমারের এই প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে মৈত্রেয়বাবু কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র পরিচালনায় সততা ও সাহসের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রজাপীড়নের সংবাদ ‘গ্রামবার্তা’য় প্রকাশের উল্লেখ করেন। ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার সম্পর্কে হরিনাথ নিজে অক্ষয়কুমারকে যে পত্র লেখেন, তিনি এই প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করে দেন।‘’

অধ্যাপক আহম্মদ শরীফের প্রবন্ধ, চিঠি এবং প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরীর উত্তরসম্বলিত চিঠি থেকে কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। তার তালিকাটি এরকম—

১. জমিদার ঠাকুর-পরিবার প্রজানিপীড়ণে অভ্যস্থ ছিল।
২. জমিদার রবীন্দ্রনাথও প্রজানিপীড়ন করেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান প্রজাদের নিপীড়ণ করেছেন। প্রজা-নির্যাতনের দলিলপত্র নষ্ট করে ফেলেছেন। ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন নিপীড়িতদের। খাজনা পরিশোধে অপারগ মুসলমান প্রজার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবার, এমনকি মুসলমান প্রজাদের শিক্ষা দেবার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে মুসলমানদের এলাকায় বসতি স্থাপনের সামপ্রদায়িক বুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন।
৩. প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র তিনি দেখলেও সেগুলি তার সাহিত্য রচনা করেন নি। প্রজাহিতৈষী কোনো কাজই করেন নি।
৪. মুসলমান প্রজাদের কলাটা-মূলাটা-মাখনটা খেয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে তাঁর সাহিত্যে স্থান দেন নি।
অভিযোগগুলি মারাত্মক। এই অভিযোগগুলি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হবে এই খণ্ডে।
তাহলে প্রজানিপীড়নের ঘটনাটি অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।

প্রজাবিদ্রোহ থেকে প্রজানিপীড়নের--------------------------------------
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা সরকারের কাছ থেকে জমিদারীর পাট্টা নিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। তারা সরকারকে নির্ধারিত হারে কর প্রদান করতেন। অবশিষ্ট অংশ তারা রেখে দিতেন। সে সময় অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৮৬৮ সালের ২৩ জুলাই সংখ্যায় লেখা হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দবস্তের ফলে জমিদারদিগের জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের যত্ন হয়, প্রজার উপর অত্যাচার কমিয়া যায় ও গবর্নমেন্টের আয় এক প্রকার নিশ্চিত হইয়া দাঁড়ায়। এ বন্দোবস্তটি ১৭৯৩ সালে শেষ হইয়া যায়। তাহার পরে কত গবর্নর আসিয়াছেন ও গিয়াছেন কত ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে কিন্তু এ বন্দবস্তটি যেমন তেমনি রহিয়া গিয়াছে। এরূপ বন্দবস্তে প্রজাদিগের ক্ষতি জমিদারদিগের লাভ।

অমৃতবাজার পত্রিকাটি কোলকাতা থেকে নয়-- যশোরের একটি গ্রাম থেকে প্রকাশিত হত। ১৮৬৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় সেকালের জমিদারী পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হয়েছে—
ভূমির যত মূল্য বাড়িতেছে, জমিদারদিগের ধন সম্পত্তি তত বাড়িতেছে। ...প্রজারা অন্নকষ্ট পাইতেছে, প্রজারা রোগে প্রপীড়িত, প্রজাদিগের বিদ্যাভাসের প্রয়োজন, এ সমূহের নিমিত্ত অর্থ দরকার...জমিদারগণ একটু মনোযোগ করিলে এ সমুদায় অভাব অনায়াশে পূরণ হইতে পারে।

অমৃতবাজার পত্রিকায় ঐ খবরটিতে বলা হয়েছে, অনেক জমিদার মদ্য, বেশ্যা, অনর্থক মকর্দ্দমা ও ঘৃণাস্কর বাবুগিরির নিমিত্ত বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকে। যে অর্থ খাজনা আকারে প্রজাদের কাছ থেকে তারা আদায় করছে-তাতে জড়িয়ে রয়েছে করুণ ইতিহাস, তাতে প্রজাদের জীবনের অমঙ্গলই ডেকে আনছে, সেই অনর্থের মূল অর্থ জমিদারগণকে আমোদ বিলাসে প্রিয় করে তুলেছে। এমন কি বংশপরম্পরায় যে জমিদারী চলে আসছে, সেই জমিদারের বড় ছেলে যদিচ জমিদারী পরিচালনার কাজ গ্রহণ করে তো পরিবারের অন্য ছেলেরা কোন কাজ করেন না, বৃথা আমোদে সময় অতিবাহিত করেন।

অমৃতবাজারে লেখা হয়েছে, অদ্য ৭৬ বছরের কথা হইল, গবর্নমেন্ট দেখিলেন যে বৎসর বৎসর ক্রমেই রাজস্ব কমিতেছে, তখন নিরুপায় হইয়া জমিদারগণকে বললেন, ‘তোমাদের বৎসর বৎসর এত টাকা দিতে হইবে, ইহাতে তোমরা কিছু লাভ করিতে পার সে তোমাদিগের, আমরা আর ইহার বেশী কখন লইব না। প্রজারা টাকা না দেয় মারো, ধরো, কাটো, আমাদের কিছু আপত্তি নাই, আমাদের টাকা পাইলেই হল। ইহাতেও না পারো, যাহাতে তোমাদের সুবিধা হয় এইরূপ সমুদয় আইন করিতেছি।...তখন গবর্নমেন্ট লাভ প্রত্যাশায় জমিদারগণকে প্রজাদিগের উপর লেলাইয়া দিলেন।

অমৃতবাজার পত্রিকায় ১৮৬৯ সালের ২৬ আগস্ট লিখেছে, জমিদারেরা প্রজার নিকট থেকে অনেক বেশী খাজানা লইয়া থাকেন। তাহারা যাহা গবর্নমেন্টকে দেন, অনেক স্থানে তাহারা প্রজার নিকট থেকে তাহার বিশ গুণ খাজানা লইয়া থাকেন। প্রজার যত লোকসান যায়, ইহা সমুদায় বাদ দিলে, ভুমির উৎপন্ন হইতে প্রজারা যাহা পায়, জমিদারেরা তাহার অর্দ্ধেক লইয়া থাকেন। মনু ছয় ভাগের এক ভাগ লইবার বিধি দেন। আকবার অতি কঠোর রূপে কর লইতেন, কিন্তু তবু তিন ভাগের একভাগ লইতেন।

তাহলে প্রজার সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক কর বা খাজনা আদায়ের। জমিদাররা এই খাজনা আদায়ের দায়িত্বটি পেয়েছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে। ৭৬ বছর আগেকার করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার সময় কয়েকটি বড় ধরনের অমীমাংসিত ঝামেলা ছিল।
১) জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার দায়িত্বে ছিল। তবে তারা কী পরিমাণ খাজনা আদায় করতে পারবে—তা নির্দিষ্ট করা ছিল না।
২) খাজনা আদায়ের বেলায় কী ধরনের ক্ষমতা জমিদাররা প্রয়োগ করার অধিকারী তা নির্দিষ্ট করা ছিল না।
৩) কোন পরিস্থিতিতে একজন প্রজাকে জমিদাররা জমি থেকে উৎখাত করতে পারবে সে বিষয়েও কোনো নির্দেশনা ছিল না। শুধু বলা ছিল, তুমি জমিদার, তোমার জমিদারি এলাকার জন্য এই বছরে এই পরিমাণ খাজনা আদায় করে সরকারের কাছারিতে জমা দাও। না পারলে তোমাকে পত্রপাঠ বিদায় করা হবে। অর্থাৎ ইংরেজদের খাজনা পাওয়াটাই একমাত্র এবং প্রথম ও শেষ কথা। ‌যারা খাজনা দিতে পারবে না তাদের জন্য দৈহিক শাস্তি এ জেলখানার ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং জমিদাররা এই সুযোগেরই সদব্যবহার করেছে।

১৭৯৩ সালে কোম্পানী এই কর্তৃত্বটা তুলে দেয়। জমিদাররা তখন অভিযোগ করে যে, এর ফলে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতা না থাআয় প্রজারা তাদের থোড়াই কেয়ার করছে। খাজনা দিচ্ছে না। ফলে খাজনা আদায় করতে প্রজাদের সঙ্গে তাদের রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে।

১৭৯৫ সালে কুখ্যাত Vii লেগুলেশন জারি করে। এই রেগুলেশনঅনুসারে কোর্টের আদেশ ছাড়াই কোনো জমিদার তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রজাদের উপর শারিরীক শক্তি প্রযোগ করার ক্ষমা রাখে। ১৮১২ সালের রেগুলেশন অনুসারে জমিদাররা প্রজাদের সম্পত্তি থেকে উৎখাত করারও ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিল আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে। আইনটি এভাবেই ইংরেজরা দুর্বলভাবে তৈরি করে রেখেছিল।

এর মধ্যে আবার মধ্যসত্বাভোগী বা বরগা জমিদারী প্রথারও জন্ম হয়। এটা একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। খাজনা আদায়ের জন্য জমিদাররা তাদের জমি পত্তনীদার নামে একটি মধ্যসত্তাভোগীকে বর্গা দিয়ে কোলকাতায় আরাম আয়েশে জীবনযাপন করত। এই পত্তনীদাররা আবার আরেকটি দরপত্তনীদারদের কাছে বরগাপ্রাপ্ত জমি আবার বরগা দিয়ে দিত। ফলে খাজনা আদায়ের কাজটি প্রকৃত জমিদারদের হাত থেকে শাখা প্রশাখাবাহিনীর হাতে চলে যেত। দেখা যেত এই মধ্যসত্তাভোগীরা ঐ জমিদারেরই নায়েব গোমস্তা গ্রুপই। এটা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৮১৯ সালে এই মধ্যসত্তাভোগীদেরকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ইংরেজ সরকারদের পক্ষ থেকে। এদেরই নাম দেওয়া হয় পত্তনিদার।

তবে সত্তরের মন্বন্তরে ফলে এবং প্রজাশোষণের ফলেপালিয়ে যাওয়া প্রজার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বাংলায়। এবং আবাদী জমির পরিমাণও বেড়ে যায় জঙ্গল কেটে। ফলে খাজনা আদায়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। তখন জমিদাররা আগের মতো আর নির্দয় ব্যবহার না করে অনেক সহিষ্ণু ববহার করে। এবং কৃষি উন্নয়নে তারা কিছু সহযোগিতাও করতে থাকে কৃষকদেরকে।

প্রজাবিদ্রোহের ঘটনা-----------------------------------------------
উনিশ শতকে জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রজাবিদ্রোহ ঘটেছিল ১৮৭২ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত। ঘটনাস্থল ছিল পাবনা-সিরাজগঞ্জ। সেকালে এর নাম ছিল ইউসুফশাহী পরগণা। বর্তমানে এ এলাকাটি বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ জেলাধীন। এই পরগণার কিছু অংশ দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনেছিলেন নাটোর রাজ জমিদাররের নিকট থেকে। দাম মাত্র মাত্র ১৩ টাকা। ১৮৩০ সালে তিনি কালীগ্রাম পরগণা কিনলেন, ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুর। সে সময়ে অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তি নানা কায়দায় ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন। তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুযোগে ইস্টি ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে জমিদারী কেনেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব আদায়। সে জন্য জমিদারদের নির্দিষ্ট অঙ্কের একটি রাজস্ব ধার্য করে দিত। যারা এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে দিতে ব্যর্থ হত, তাদের জমিদারী নিলাম করে অন্য আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে যেত। সুতরাং নব্য জমিদারগণ এই ধার্যকৃত রাজস্ব বা খাজনা আদায় করে নিজের জমিদারী রক্ষা এবং নিজেদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করত।

১৮৫৮ সালে X রেগুলেশন অনুসারে জমিদাররা তিনটি কারণে খাজনা বাড়াতে পারত।
১) কাছাকাছি কোনো জমিদারি পরগণায় কোনো জমির খাজনা যদি বেশি হয়ে থাকে এবং ঐ ধরনের জমির খাজনা যদি অন্য জমিদারের পরগণায় কম হয়ে থাকে—তাহলে ঐ জমিদারও সেই জমির খাজনা বাড়াতে পারেন।
২) যদি পন্যসামগ্রীর বাজারমুল্য বেড়ে যায়।
৩) যদি জমিদার মনে করে থাকেন যে, প্রজারা তাদের প্রকৃত জমির চেয়ে কম জমি দেখিয়ে খাজনা কম দিচ্ছে।

সেকালে বাংলায় সেচ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় প্রায়ই বন্যা হত। ফলে ফসল নষ্ট হত। কখনো নীরব কখনো সরব দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। ইংরেজরা সেগুলো কখনোই বিবেচনায় নেয়নি। তারা জমিদারের উপর বার্ষিক নির্ধারণ করে দিত। আবার জমিদাররাও পত্তনীদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাজনা আদায়ের ভার তাদের উপর ছেড়ে দিত। পত্তনীদাররাও এভাবে দরপত্তনিদারদের হাতে খাজনা আদায়ের কাজ দিত। প্রজাদের ফসলের বা আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করার কোনো সুযোগই তাদের ছিল না। পুরো পদ্ধতিটাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় চিনে জোঁকের মত রক্ত চোষা। আর সুদখোর মহাজনদের কারণেও তারা সর্বশান্ত হচ্ছিল।

সূত্র............................................
উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র : মুনতাসীর মামুন
রবিজীবনী : প্রশান্তকুমার পাল
ব্রাত্য লোকায়ত লালন : সুধীর চক্রবর্তী
জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধুরী
সাক্ষাৎকার--প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী : শাশ্বতিকী, রবীন্দ্রসংখ্যা. সম্পাদক : মোজাফ্ফর হোসেন
রবীন্দ্রমানস ও সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের প্রভাব : গোলাম মুরশিদ
Pabna Peasant Uprising : Nurul Hossain Choudhury
রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ : প্রফেসর আহম্মদ শরীফ
রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ : ফরহাদ মজহার


মন্তব্য

মানবমনে আপনি জন্মিয়াছেন এর ছবি

চলুন, আমার সাথে, আজ অন্য গল্প শোনাই।
খুবই কম মানুষ এই সত্য গল্পটি সাথে পরিচিত।
============
আশ্চর্যের কথা__ রবীন্দ্রনাথের মতন এক অনন্য সাধারণ প্রতিভার জন্ম হয়েছিল সমাজচ্যুত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে।
যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগণার জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চারপুত্র জাতিচ্যুত হয়েছিলেন মামুদ তাহির বা পীর আলি নামক স্হানীয় শাসকের চক্রান্তে।
এই চারজন পিরালী ব্রাহ্মণের কধ্য সর্বকনিষ্ঠ শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করেন পিঠাভোগের জনিদার জগন্নাথ কুশারী।
এই অপরাধে জগন্নাথ কুশারীও আত্মীয়-পরিত্যক্ত হন।এই জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর পরিবারের অদি পুরুষ।

জগন্নাথ কুশারীর পুত্র পুরুষোত্তম। পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রামানন্দ। রামান্দের পুত্র মহেশ্বর। মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন জাতিকলহে দেশত্যাগ করে কলকাতায় আসেন।
সেই সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ।
গোবিন্দপুরে আদিগঙ্গাতীরে মৎসজীবী মালো কৈবত্যদের মধ্য বসসকারী পঞ্চানন কুশারী হয়ে ওঠেন__ পঞ্চানন ঠাকুর।
পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো ও কয়লাঘাটার ঠাকুরবংশের উৎপত্তি এই পঞ্চানন ঠাকুরের হাত ধরেই।

পঞ্চানন ঠাকুরের দুই পুত্রের মধ্য অন্যতম জয়রাম ঠাকুরের পুত্র নীলমণি ঠাকুরের বংশধররাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবংশ হিসাবে সমাজ- সংস্কৃতিক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হন।
নীল মণির তিন পুত্র_ রাম লোচন, রামমণি ও রামবল্লভ।
১৭৯১ তে নীলমণির মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অভিভাবক হন রামলোচন। রামলোচনের একটি কন্যা সন্তান জন্মালেও শৈশবে মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে নীলমণির অন্য পুত্র রামমণির চার সন্তান। রাধানাথ,জাহ্নবী, রাসবিলাসী এবং দারকানাথ (১৭৯৪-১৮৪৬)
রামলোচন কন্যাহারা হলে রামমণির পুত্র দ্বারকানাথকে দত্তক গ্রহণ করেন।
দ্বারকনাথের স্ত্রী দিগম্বরী, তাঁদের পাঁচ সন্তান-- দেবেন্দ্রনাথ ,নরেন্দ্রনাথ,গিরীন্দ্রনাথ,নগেন্দ্রনাথ এবং স্বল্পায়ু এক কন্যা।

১৮২৯ এ সারদা দেবীর সাথে বিবাহ হয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চর্তুদশ (১৪) তম সন্তান হলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ(১৮৬১-৭ই মে), সর্বকনিষ্ঠ এবং অষ্টম পুত্র-সন্তান।

শিশু রবি বড় হলেন, জমিদার হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারী বৃত্তান্ত এখন আপনার লেখা থেকে পড়ছি: ভালই লাগছে এগিয়ে চলুক।

সমাপনে
মানব

মানবমনে আপনি জন্মিয়াছেন এর ছবি

চলুন, আমার সাথে, আজ অন্য গল্প শোনাই।
খুবই কম মানুষ এই সত্য গল্পটি সাথে পরিচিত।
============
আশ্চর্যের কথা__ রবীন্দ্রনাথের মতন এক অনন্য সাধারণ প্রতিভার জন্ম হয়েছিল সমাজচ্যুত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে।
যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগণার জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চারপুত্র জাতিচ্যুত হয়েছিলেন মামুদ তাহির বা পীর আলি নামক স্হানীয় শাসকের চক্রান্তে।
এই চারজন পিরালী ব্রাহ্মণের কধ্য সর্বকনিষ্ঠ শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করেন পিঠাভোগের জনিদার জগন্নাথ কুশারী।
এই অপরাধে জগন্নাথ কুশারীও আত্মীয়-পরিত্যক্ত হন।এই জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ।

জগন্নাথ কুশারীর পুত্র পুরুষোত্তম। পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রামানন্দ। রামান্দের পুত্র মহেশ্বর। মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন জাতিকলহে দেশত্যাগ করে কলকাতায় আসেন।
সেই সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ।
গোবিন্দপুরে আদিগঙ্গাতীরে মৎসজীবী মালো কৈবত্যদের মধ্য বসসকারী পঞ্চানন কুশারী হয়ে ওঠেন__ পঞ্চানন ঠাকুর।
পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো ও কয়লাঘাটার ঠাকুরবংশের উৎপত্তি এই পঞ্চানন ঠাকুরের হাত ধরেই।

পঞ্চানন ঠাকুরের দুই পুত্রের মধ্য অন্যতম জয়রাম ঠাকুরের পুত্র নীলমণি ঠাকুরের বংশধররাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবংশ হিসাবে সমাজ- সংস্কৃতিক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হন।
নীল মণির তিন পুত্র_ রাম লোচন, রামমণি ও রামবল্লভ।
১৭৯১ তে নীলমণির মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অভিভাবক হন রামলোচন। রামলোচনের একটি কন্যা সন্তান জন্মালেও শৈশবে মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে নীলমণির অন্য পুত্র রামমণির চার সন্তান। রাধানাথ,জাহ্নবী, রাসবিলাসী এবং দারকানাথ (১৭৯৪-১৮৪৬)
রামলোচন কন্যাহারা হলে রামমণির পুত্র দ্বারকানাথকে [b]দত্তক[/b] গ্রহণ করেন।
দ্বারকনাথের স্ত্রী দিগম্বরী, তাঁদের পাঁচ সন্তান-- দেবেন্দ্রনাথ ,নরেন্দ্রনাথ,গিরীন্দ্রনাথ,নগেন্দ্রনাথ এবং স্বল্পায়ু এক কন্যা।

১৮২৯ এ সারদা দেবীর সাথে বিবাহ হয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চর্তুদশ (১৪) তম সন্তান হলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ(১৮৬১-৭ই মে), সর্বকনিষ্ঠ এবং অষ্টম পুত্র-সন্তান।

শিশু রবি বড় হলেন, জমিদার হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারী বৃত্তান্ত এখন আপনার লেখা থেকে পড়ছি:
এগিয়ে চলুন সামনের দিকে

সমাপনে
মানব

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

ইউক্লিড

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।