রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তবিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২০/০২/২০১২ - ১১:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড : পাঁচ

কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার : খুঁজে দেখা
------------------------------------------------------------------------

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জন্মেছিলেন ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়ার এক গণ্ডগ্রামে।। এর ঠিক ২৮ বছর পরে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারে রবীন্দ্রনাথ।

অল্প বয়সেই হরিনাথ বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে তাঁর পড়ালেখা শুরু। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে বেশিদূর এগোতে পারেননি। নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়েছেন। খুলেছেন স্কুল। শিক্ষকতাও করেছেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা পথিকৃতের।

পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। তবে নীলকুঠিতে নীলকরদের অত্যাচার দেখে সে চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন।

স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়ন ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল হরিনাথকে। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে,১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। মেশিনের মাঝখানে এ যন্ত্রটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনের তারিখ লেখা রয়েছে। লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কলম্বিয়ান প্রেস মডেলের ১৭০৬ নম্বর এ মুদ্রণযন্ত্রটি তৈরি করা হয় ১৮৬৭ সালে। প্রয়াত এডওয়ার্ড বিভান এ যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। অমৃতবাজার পত্রিকার বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যায় কুমারখালীতে কাগজ ছাপা কল বসার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খবর লোকমুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অসংখ্য লোক তাই দেখতে আসে কেমন করে কাগজের গায়ে অত ছোট লেখা হয়। ৩০-৩৫ মণ ওজনের ডাবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। দেখতে একটি দানবের মতো। এ মেশিনে কাগজ ছাপাতে তিনজন লোক লাগত। মেশিন চলাকালে দেখা যেত মেশিনের মাথার ওপর ডানা প্রসারিত ঈগল পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে আসছে।

গ্রামবার্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেন। পাশাপাশি লালনকেও প্রকাশের দায়িত্ব তিনিই নিয়েছিলেন।

কাঙাল হরিনাথ ও লালন সাঁইয়ের জন্ম একই অঞ্চলে। হরিনাথ জন্মেছিলেন অধুনা কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে। লালনের জন্ম এই কুমারখালিরই অন্তর্গত গড়াই নদীর অপর পারে ভাঁড়ারা গ্রামে। হরিনাথের সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড কুমারখালিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। লালন ফকিরের সাধনপীঠও ছিল এই কুমারখালির নিকটবর্তী ছেঁউড়িয়া গ্রামে।

লালন ও হরিনাথ দুজনেই ছিলেন দরিদ্র। কিন্তু এর মধ্যে থেকেই দুজনেই মহৎজীবনের সন্ধান করেছেন। দুজনেই পার্থিব আকাঙ্খামুক্ত ছিলেন। দুজনেই মনাবমিলনপ্রয়াসী লোকায়ত পথের মরমী পথিক ছিলেন। এই অন্তর্গত মিলের কারণেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
লালন মাঝে মধ্যে কাঙাল কুটিরে কুমারখালিতে আসতেন। অপরদিকে কাঙ্গালও ছেউড়িয়ার লালনের আখড়ায় যেতেন। দুজনেই গানের ভূবনে মেতে উঠতেন।

কাঙাল-শিষ্য জলধর সেন (১৮৬০-১৯৩৯) কাঙাল জীবনীতে লিখেছেন—
সে দিন প্রাতঃকালে লালন ফকির নামক একজন ফকির কাঙালের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। লালন ফকির কুমারখালির অদূরবর্তী কালীগঙ্গার তীরে বাস করিতেন। তাঁহার অনেক শিষ্য ছিল। লালন সেদিন কাঙালের কুটিরে গেয়েছিলেন—
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে;
আমার ঘরের কাছে আরসী-নগর,
তাতে এক পড়সী বসত করে।

লালনের অনুপ্রেরণায় আইনজীবী, ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১—১৯৩০) একটি বাউলের দল গঠনের চিন্তা করেন। কাঙাল হরিনাথের নির্দেশে তাঁর শিষ্যদল ফিকিরচাঁদের দল গঠন করে। তারা ফিকিরচাঁদ ভনিতা যোগ করে গান লেখেন—ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি, সত্য-পথের সেই ভাবনা। কাঙালও গান লেখা শুরু করেন। তাঁর লেখা প্রথম গান--
আমি কোরব এ রাখালি কতকাল
পালের ছটা গরু ছুটে, কোরছে আমায় হাল-বেহাল।

কাঙাল তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন—
শ্রীমান অক্ষয় ও শ্রীমান প্রফুল্লের গানগুলির মধ্যে আমি যে মাধুর্য্য পাইলাম, তাহাতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, এইভাবে সত্য, জ্ঞান ও প্রেমতত্ত্বে প্রচার করিলে, পৃথিবীর কিঞ্চিৎ সেবা হইতে পারে। এতএব কতিপয় গান রচনার দ্বারা তাহার স্রোত সত্য, জ্ঞান ও প্রেমসাধনার উপায়স্বরূপ পরমার্থ-পথে ফিরাইয়া আনিলাম এবং ফিকিরচাঁদের আগে কাঙ্গাল নাম দিয়া দলের নাম ‘কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদ’ রাখিয়া তদানুসারেই গীতাবলীর নাম করিলাম।

কাঙালের ডায়েরী থেকে জানা যায়, অল্প দিনের মধ্যেই ফিকিরচাঁদের গান নিম্নশ্রেণীর লোকের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও তাঁর আদর হয়েছিল। মাঠের চাষা, ঘাটের নেয়ে, পথের মুটে,, বাজারের দোকানদার এবং তাহার উপর শ্রেণীর সকলে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদের গান শুনতে লাগলেন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সামান্য বীজ থেকে প্রকাণ্ড বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল।
কাঙাল হরিনাথের শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১), জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তন্ত্রাচার্য বিদ্যার্ণব (১৮৬০-১৯১৩) প্রমুখ।

গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, লালনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনে কাঙ্গাল হরিনাথের গান উত্তরকালে হৃদয়গ্রাহী, সরস ও মার্জিত হয়ে উঠেছিল। লালনের গানের ভাব-ভাষা-ভাবনার একটা প্রভাবও পড়েছিল হরিনাথের গানে। কাঙ্গাল হরিনাথের একটি গান বিখ্যাত সকল মানুষের কণ্ঠে গীত হয়েছে—
ওহে দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।।
(ওহে দীন দয়াময়)
আমি আগে এসে ঘাটে এসে রইলাম বসে
(ও হে আমার কি পার করবে না হে, অধম বলে)
যারা পাছে এল, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে।।

এই গানটি সত্যজিৎ রায়ের পথে পাঁচালী চলচ্চিত্রে গীত হয়েছিল। সেখানে গীতিকার হিসাবে কাঙ্গাল হরিনাথের নামটি ব্যবহার করা হয় নি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনের মানুষ বইতে লিখেছেন,
একদিন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল।
সেদিনও লালন তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে হরিনাথের বাড়ির সামনের প্রাঙ্গনে বসে অন্যদের কথা শুনছে। হরিনাথ এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছে জমিদারদের বিরুদ্ধে। এমন সময় এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে এসে হরিনাথের কানের কাছে কী যেন বলল।
একটুক্ষণ শোনার পর হরিনাথ উত্তেজিতভাবে বলল, তাই নাকি, চলো, সবাই যাই।
উঠে দাঁড়িয়ে সে লালনকে বলল, চলো বন্ধু, তুমিও চলো।
লালন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
হরিনাথ বলল, নদীর ধারে। বেশী সময় নেই, চলো, যেতে যেতে তোমায় সব বলব।

ঘটনাটি এই—কুমারখালির মানুষের নানারকম অভাব-অভিযোগ রয়েছে। ইস্কুল-মাদ্রাসা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত নেই। বন্যায় ভোরাই নদীর পাড় ভাঙছে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার তো লেগেই আছে। কিন্তু জমিদারের নায়ে এর কোনও প্রতিকার করে না, পুলিশ এসব অভিযোগে কান দেয় না। সর্বত্র অরাজকতা।একমাত্র জেলার হাকিমের কাছে সব কিছু জানালে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু হাকিম সাহেবের কাছে তো পৌঁছানই যায় না। খবর আছে, আজই হাকিমসাহেব তার নামের কলের জাহাজে এই ভোরাই নদী দিয়ে যাবেন। তখন সাহেবের কাছে অনেকে মিলে গিয়ে অভাব-অবিযোগের জানাবার এক সূবর্ণ উপস্থিত হয়েছে।

প্রায় হাজার খানেক মানুষ সমবেত হয়েছে ভোরাই নদীর তীরে। হরিনাথের সঙ্গে লালনের দলবলও সেখানে এসে দাঁড়াল।
হাকিমসাহেবের স্টিমারটির কিন্তু সেখানে থামল না। পাড়ের লোকদের উপেক্ষা করে নদী দিয়ে সোজা চলে যেতে লাগল। তখন লালন ফকির দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সঙ্গে সমবেত হাজারখানেক পল্লীবাসী। তারা সাঁতরে স্টিমারটি ঘিরে ফেলেছিল। সাহেবের স্টিমারটি থামিয়ে দিয়েছিল। সাহেব শুনেছিল প্রজাদের অভাব-অভিযোগ। সে সময়টা ছিল দেবেন্দ্রনাথের জমিদারকাল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। লালনের কাছে খবর এসেছিল, জমিদারের লোকজন হরিনাথের বাড়িতে লেঠেল পাঠিয়েছে। সঙ্গে আছে পাঞ্জাবী গুণ্ডা। কারণ হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজানীপিড়নের সংবাদ ছাপা হচ্ছে।

লালন তার শিষ্যদলকে নিয়ে কুমারখালিতে হরিনাথের বাড়িতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন কাঙালের উঠোনে নায়েব শ্রেণীর এক লোক বসে আছে। তারা তখনো হরিনাথের ঘরে আগুন দেয় নি। হরিনাথ বাড়িতে ছিল না।

সেখানে শীতল নামে একজন লালন শিষ্য বলেছিল, অন্য এক জমিদার আমার বাড়ি পুড়ায়ে দিয়েছিল। পেয়াদারা আমার ভগিনীরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ঋণ শোধ করতে পারি নি তাই জমিদার জুতা মেরেছিল আমার দুই গালে।

লালন সেদিন জমিদারের বাহিনীকে লড়াই করেই হটিয়ে দিয়েছিলেন। সুনীল লিখেছেন, পরে লালনকে জমিদারের কুটি বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে লালনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, জমিদারের ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্র তখন নবীন যুবক। দীর্ঘকায়, অত্যন্ত রূপবান। দেবেন্দ্রনাথের পরিবর্তে তার পুত্রদের কেউ যে তখন জমিদারি পরিদর্শনের ভার নিয়েছে, তা এ অঞ্চলে কেউ সেভাবে জানত না। জ্যোতিরিন্দ্র লালনের মুখে সেদিন প্রজানিপীড়নের কথা শুনেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, জমিদারেরা থাকেন সব কলকাতায়, দূরের জমিদারিতে নায়েব-কর্মচারীরা যে কী করছে, তার খবরও রাখেন না। তাঁরা টাকা পেলেই খুশি। কীভাবে সেই টাকা আদায় হচ্ছে—সেটা জানার চেষ্টা করছেন না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী পাওয়ার পরে নিয়মিত জমিদারী এলাকায় পরিদর্শনে আসতেন। কিন্তু পরে তিনি ঈশ্বরের সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। জমিদারীর কিছু দেখেন না, কলকাতায়ও থাকেন না। মাঝে মাঝেই চলে যান সিমলে পাহাড়ে কিংবা গঙ্গায় বোটে থাকেন। জমিদারির ভার দিয়েছেন ছেলেদের উপর। তার বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ কবি ও দার্শনিক মানুষ, বিষয়কর্মে একদমই মন নেই। পরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ খুবই উচ্চশিক্ষিত, সরকারী চাকরি করেন—জমিদারীতে আগ্রহ নেই। থাকেন বোম্বাই নগরীতে। আর তিনি নিজে গানবাজনা, ছবি, থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জমিদারির ভবিষ্যৎ নেই জেনেও এ বিষয়ে মন লাগিয়ে কাজ করতে পারেন না। ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। ফলে তাদের জমিদারিটা নায়েব-কর্মচারীদের কব্জায় পড়েছে।

লালনকে ফকিরের আখড়া সংশ্লিষ্ট এলাকাকে জ্যোতিরিন্দ্র নিষ্কর পাট্টা করে দিয়েছিলেন সেবার। হরিনাথের বাড়িতে আর লাঠিয়াল যায় নি।
সুনীলের লেখাটা উপন্যাস। ইতিহাস নয়। সুতরাং তার এই বিবরণকে পুরোপুরি সত্য ধরার সুযোগটা কম। তবে সুনীল সে সময়ের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা, আবুল আহসান চৌধুরীর কাঙাল হরিনাথ : গ্রামীন মণীষার প্রতিকৃতি, লালন স্মারক গ্রন্থ, সমাজ সমকাল ও লালন সাঁই, শক্তিনাথ ঝাঁর ফকির লালন সাঁই : দেশকাল ও শিল্প, ধনঞ্জয় ঘোষাল সম্পাদিত হরিনাথ মজুমদার ও বাঙালি সমাজ, ইত্যাদি আকর গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপন্যাসটি লিখেছেন। সুতরাং তার লেখা উপন্যাস হলেও অনেকটাই ইতিহাসের তথ্য মেলে।

আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণা থেকে জানা যায় যে. কাঙাল হরিনাথের গান ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেছিল। কাঙাল নিজে একসময়ে ব্রাহ্মসমাজে গান গেয়েছেন, ঢাকায় গান গেয়ে মাতিয়েছেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, যিনি একসময় ব্রাহ্মধম্যের প্রচারক ছিলেন, তিনি হরিনাথের গান খুব পছন্দ করতেন। ব্রাহ্মসঙ্গীতের যেসব বই বেরিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজের তরফ থেকে বা বাইরে থেকে তাতেও দেখা যায় কাঙাল হরিনাথের গান দুচারটে আছে। ব্রাহ্মধর্ম দেবেন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত হত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ব্রাহ্মসমাজের দীর্ঘকালীন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

হরিনাথের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮টি। তার প্রণীত উপন্যাসের নাম বিজয়-বসন্ত। এটা সংস্কৃত ‘কথা’ জাতীয় উপাখ্যান ধরনের লেখা হয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দে। ১২৬০, ১৮৬৫ এবং ১৮৬৯ সালে বইটির আরও কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাঙাল হরিনাথের এই বিজয়-বসন্ত উপন্যাসটি কোনো কোনো বিদ্যালয়ে পাঠ্য-তালিকাভুক্ত ছিল। এছাড়াও সাধারণ পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন এগার বছর তখন তিনি কাঙাল হরিনাথের এই বইটি প্রথম পড়েছিলেন।

বিজয়-বসন্তের ভূমিকা প্রথমবারের বিজ্ঞাপন হিসাবে কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন, ...এক্ষণে কামিনীকুমার, রসিকরঞ্জন, চাহারদরবেশ, বাহারদানেশ প্রভৃতি যে সমুদয় রূপক-ইতিহাস প্রচারিত আছে, সে সমুদয়ই অশ্লীল ভাব ও রসে পরিপূর্ণ। তৎপাঠে উপকার না হইয়া বরং সর্বতোভাবে অনর্থের উৎপত্তি হয়। এই সমুদয় অবলোকনে বালকদিগের রূপক-পাঠের নিমিত্তে কতিপয় বন্ধুর অনুরোধে আমি বিজয়-বসন্ত নামক এই গ্রন্থ প্রণয়নে প্রবৃত্ত হই। ইহা কোন পুস্তক হইতে অনুবাদিত নহে, সমুদয় বিষয়ই মনঃকল্পিত। ইহার আদ্যন্ত কেবল করুণরসাশ্রিত এবং নীতিগর্ভ বিষয়ে পরিপূর্ণ। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (ইংরেজী ১৯০১) বসুমতি প্রতিষ্ঠান থেকে জলধর সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলীতে’ বিজয়-বসন্ত’ অর্ন্তভুক্ত হয়।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এইসব পাঠ্য-তালিকার বইগুলির বেশীর ভাগই বাড়ির মেয়েরা সংগ্রহ করতেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন—‘মনে আছে, বাড়ীতে মালিনী বই বিক্রি করিতে আসিলে মেয়েমহল সেদিন কি রকম সরগরম হইয়া উঠিত। সে বটতলার যত কিছু নতুন বই, কাব্য, উপন্যাস, আষাঢ়ে গল্প আনিয়া দিদিদের লাইব্রেরীর কলেবর বৃদ্ধি করিয়া যাইত। বড় হইয়া সে-কালের বইগুলি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করিয়াছি—মানভঞ্জন, প্রভাস-মিলন, দূতী সংবাদ, কোকিল দূতি, রুক্মিনীহরণ, পারিজাতহরণ, গীতগোবিন্দ, প্রহ্লাদচরিত, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, আন্নদামঙ্গল, আরব্যোপন্যাস, চাহারদরবেশ, হাতেম তাই, গোলেবকায়েলী, লায়লামজনু, বাসবদত্তা, কামিনীকুমার ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ কাঙাল হরিনাথের রচিত বিজয়-বসন্তের কথা কয়েকটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ যখন ১৮৮৯ সালের ২৫ নভেম্বর জমিদারি পরিদর্শনের ভার পেয়ে শিলাইদহে গিয়েছিলেন তখন সঙ্গে ছিলেন শিশুকন্যা, শিশুপুত্র, স্ত্রী মৃণালিনী, স্ত্রীর এক সহচরী এবং রবীন্দ্রনাথের দাদা বীরেশ্বরের ছেলে প্রিয় বলেন্দ্রনাথ। তখন তারা নদীর উপরে বোটে থাকতেন। সে সময় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় তাদের বোটে গ্রাম্য গাইয়েরা এসে গান শুনিয়ে যেত। বলেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ফিকিরচাঁদের দলের গান খুব মাতিয়ে ছিল। তখন কাঙাল হরিনাথ ফিকিরচাঁদের দলের সঙ্গে আসতেন কিনা জানা যায় না। তবে ফিকিরচাঁদের দলটি তার শিষ্যদেরই গড়া। তারাই গান শোনাতে আসতেন। সেইসব গানের একটা সংকলন করেছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে।

কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল কিনা জানা যায় না। কাঙালের গ্রামবার্তা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। ১৮৮৮ সালে পত্রিকাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঠাকুরবাড়িতে গ্রামবার্তা প্রকাশিতা রাখা হত। দেবেন্দ্রনাথও পড়ে থাকবেন হয়তো। রবীন্দ্রনাথ যে সময়কালে শিলাইদহে জমিদারি পরিদর্শন বা জমিদারী পরিচালনা করতে এসেছেন তার বাবার আদেশে—সে সময়ে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি প্রকাশ হত না। আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং যে পত্রিকাটি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রজানীপিড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকার কথা নয়।

রবীন্দ্রনাথ কাঙাল হরিনাথের লেখার ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। নায়েবকে পাঠিয়ে তিনি ধারে কাঙাল হরিনাথের কিছু বই কুমারখালির মথুরানাথ মুদ্রাযন্ত্র থেকে আনিয়েছিলেন। ঐ প্রেসের ১৩০০ সালে পত্রনকলের খাতায় একটা চিঠি আছে ঠাকুর-এস্টেটের নায়েবকে লেখা, কাঙাল হরিনাথের বড় ছেলে সতীশচন্দ্র মজুমদার বইয়ের দাম চেয়ে এই তাগাদা পত্র লেখেন, তাতে উল্লেখ ছিল কি কি বই কতো দাম ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায় কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা না হলেও তাঁর লেখালেখির ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ উদাসীন ছিলেন না।

মুনতাসীর মামুন উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্রে গ্রন্থের দশম খণ্ডে লিখেছেন—১৮৫৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিসাব অনুযায়ী বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ-সাময়িকপত্রের সংখ্যা মোট ৯০৫টি। এর মধ্যে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০টি। কিন্তু, এছাড়াও খোঁজ পাওয়া গেছে আরো ৯৭টি সংবাদ সাময়িকপত্রের। ফলে উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদ সাময়িকপত্রের সংখ্যা মোট ২৭৭টি বলে ধরে নিতে পারি। সে সময় ছিল বাংলাদেশ বনে জঙ্গলে ঢাকা, এবং বহির্বিশ্বে কেন, বাংলাদেশেরই অনেক অঞ্চলের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সে সময়ে সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশ হওয়াটাই ছিল অভাবনীয় ঘটনা।

কুষ্টিয়ার কুমারখালি থেকে হরিনাথ বের করতেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা—যশোরের এক গ্রাম থেকে শিশিরকুমার ঘোষ বের করতেন অমৃতবাজার পত্রিকা। হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, ‘দেশীয় জমিদারগণ পূর্বের ন্যায় অত্যাচার করেন না একথা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু মফস্বলে এখনও যে প্রকার অত্যাচার লক্ষিত হয়, তাহা অল্প নহে।‘ কোনও কোনও প্রদেশের প্রজারা যে মধ্যে মধ্যে জমিদারের অবাধ্য হইয়া ওঠে, সেই দোষ প্রজার নহে।‘ (জুলাই, ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা)।. তবে, একই সঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থার উপর যেন কারো হামলা না আসে সে ব্যাপারেও সে সময়কার পত্রিকার সম্পাদকগণ সচেতন ছিলেন। মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থনে হরিনাথ লিখেছিলেন, জমিদার-ই প্রজাদিগের পিতামাতা স্বরূপ ও সহায় সম্পদ (জুলাই, ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দ)।. শিশিরকুমার লিখেছিলেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমরা প্রাণপণে জমিদারদিগের পক্ষ সমর্থন করিয়া থাকি। পাশাপাশি এও লিখেছেন অমৃতবাজার পত্রিকায়, অধিকাংশ জমিদারই প্রজার উপর নিপীড়ন করেন ও তাহাদের সর্বস্ব শোষণ করিয়া লন। এর কারণ হিসাবে মুনতাসীর মামুনের মন্তব্য হল—পাশ্চাত্যের মানবতাবাতী ধারা ও ভারতীয় অভিভাবকবাদ ভাবধারার মিশ্রণে , উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালির মনে যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, সম্পাদকরা তার বাইরে ছিলেন না। এর অর্থ, প্রজার উপর জমিদারের অত্যাচার মেনে নিতে তার বিবেকে বাধে, তিনি তাই প্রজার পক্ষে লেখেন, কিন্তু অন্তিমে জমিদারের সঙ্গে প্রজার সংঘাত বাঁধলে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর জমিদারের সঙ্গে তার আঁতাত সৃষ্টি হয়। আর প্রজা হয়ে ওঠে নিয়তিবাদি, যার শাসকের কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ সে সময়কার সংবাদপত্রের সম্পাদকদের মতো প্রজাও জানে, নীলকরদের চেয়ে জমিদার অপেক্ষাকৃত ভালো। জমিদাররা ইংরেজদেরই সৃষ্টি। তাদের নির্দেশেই তারা চলে। নীলকররা যখন প্রজাদের সকল কিছু হরণ করতে নিয়ে যায়, তখন দেশীয় জমিদাররাই নীলকরদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। দেবেন্দ্রনাথও এসেছিলেন। তিনি নীলকর কেনী সাহেবকে তার জমিদারি ইজারা দেন নি প্রজাদের অনুরোধ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।