রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ঊনত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৫/০৩/২০১২ - ১০:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

মুসলমান খণ্ড--১
-----------------
১৯৩১ সালে ৬ সেপ্টেম্বর হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন।
...একদিন আমার একজন মুসলমান প্রজা অকারণে আমাকে এক টাকা সেলামী দিয়েছিল। আমি বললুম, আমি তো কিছু দাবী করি নি। সে বললে, আমি না দিলে তুই খাবি কি। কথাটা সত্য। মুসলমান প্রজার অন্ন এতকাল ভোগ করেছি। তাদের অন্তরের সঙ্গে ভালবাসি, তারা ভালবাসার যোগ্য।
এ চিঠিতে তিনটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ১. মুসলমান প্রজাদের অন্ন তিনি ভোগ করেছেন—এটা রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে। ২. মুসলমান প্রজারা তাকে ভালোবাসে। ৩. রবীন্দ্রনাথ মুসলমান প্রজাদের অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসেন। এ ভালোবাসার কারণ তার এই মুসলমান প্রজারা ভালোবাসার যোগ্য।

পূর্ববঙ্গে আসার আগে মুসলমানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর পরিচয় ছিল না। ছেলেবেলায় হিন্দুমেলায় মুসলমান বয়াতির গান শুনেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ফারসি কবি হাফিজের অনুরাগী ছিলেন। ছেলেবেলায় বাবার কাছে হাফিজের কবিতার শুনতেন। দেবেন্দ্রনাথ ফারসি ভাষা জানতেন। তিনি মূল ফারসিতে আবৃত্তি করতেন। সঙ্গে সেগুলোর বাংলা অনুবাদ শোনাতেন। সে কবিতার মাধূর্য বালকের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। তিনি বলেছেন, কবিতা পারসিক হলেও তার বানী সব মানুষের। ১৯৩২ সালে ইরানে গিয়েছিলেন কবি। হাফিজের সমাধির পাশে সমবেত কবিদের বলেছিলেন, এই ফারসি সুধা তার বাবাকে জীবনান্তকাল পর্যন্ত সান্ত্বনা দিয়েছে।

এ সূত্রেই ঠাকুর পরিবারে উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পড়েছেন ফারসী, আরবী, তুর্কী সাহিত্য। জেনেছেন ইসলামী দর্শন, ইতাহাস, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে। তিনি জেনেছেন—ঈশ্বর এক। তার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তিনি সকল বর্ণের। সকল জাতির। এবং জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি অনুভব করেন—পূর্ববঙ্গে নতুন করে পাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের বিশালতা তার ভাবজগতে পরিবর্তন এনেছে—তার ধর্মচিন্তা, রাজনৈতিক ভাবনা, দর্শন তত্ত্ব, সাহিত্যবোধ, জীবনবোধ পাল্টে গেছে। তার ভেতরের মানুষটার পুরনো বাবুপরিবারের পুরনো খোলসটা ১৮৯১ সালে শিলাইদহে যাওয়ার পরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়েছে। তিনি ভেবেছেন শুধু ভাবজগতের এই খোলস বদলের সঙ্গে তার বহিরাঙ্গের পোষাকটিরও বদল হওয়া দরকার। পোষাকটি হিন্দুরও নয়—মুসলমানেরও নয়। খ্রীস্টান বা বৌদ্ধেরও নয়। বাউলদের আদলে করা হয়েছিল এই আলখেল্লা নামের পোষাকটি। করেছিলেন প্রিয় ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পোষাকটি আর পাল্টান নি-- সারা জীবন ধরে পরেছেন।

একটি ঘটনা জানা যাচ্ছে ১৯১১ সালের নভেম্বরের। শান্তি নিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে একজন মুসলমান ভদ্রলোক তাঁর পুত্রকে ভর্তি করার প্রস্তাব দেন। রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রবন্ধে হিন্দু ও মুসলমানকে সমীপবর্তি করার যে পরামর্শ দিচ্ছিলেন তাকেই বাস্তব রূপ দেবার এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে তিনি ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মুসলমান ছেলেটিকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। সে সময় বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তিনিকেতনের অন্যতম ট্রাস্টি। তার কাছ থেকে বাঁধা আসার আশঙ্কা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ২৬ অক্টোবর কলকাতা থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক নেপালচন্দ্রকে একটি চিঠি লিখে তাঁকে ভর্তি করে নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু নেপালচন্দ্রের নিকট থেকে অনুকুল উত্তর পান নি। সে সময়কার ছাত্র-শিক্ষক ও দিপেন্দ্রনাথনাথ ছেলেটিকে ভর্তি না করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তখন রবীন্দ্রনাথ নেপালচন্দ্রকে ২ নভেম্বর ১৯১১ সালে আরেকটি চিঠি লেখেন—

মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একজন চাকর দিতে তাহার পিতা রাজী। অতএব এমন কি অসুবিধা, ছাত্রদের মধ্যে এবং অধ্যাপকদের মধ্যেও যাহাদের আপত্তি নাই তাঁহারা তাহার সঙ্গে খাইবেন। শুধু তাই নয়—সেই সকল ছাত্রের সঙ্গেই ঐ বালকটিকে রাখিলে সে নিজেকে নিতান্ত যুথভ্রষ্ট বলিয়া অনুভব করিবে না। একটি ছেলে লইয়া পরীক্ষা সুরু করা ভাল অনেকগুলি ছাত্র লইয়া তখন যদি পরিবর্ত্তন আবশ্যক হয়, সহজ হইবে না। আপাতত শাল বাগানের দুই ঘরে নগেন আইচের তত্ত্বাবধানে আরো গুটি কয়েক ছাত্রের সঙ্গে একত্র রাখিলে কেন অসুবিধা হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। আপনারা মুসলমান রুটিওয়ালা পর্য্যন্ত চালাইয়া দিতে চান, ছাত্র কি অপরাধ করিল? এক সঙ্গে হিন্দু মুসলমান কি এক শ্রেণীতে পড়িতে বা একই ক্ষেত্রে খেলা করিতে পারে না?...প্রাচীন তপোবনে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু মুসলমানে একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা। আবার একবার বিবেচনা করিবেন ও চেষ্টা করিবেন যে আপনাদের আশ্রমদ্বারের আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না—যিনি সর্ব্বজনের একমাত্র ভগবান তাহার নাম করিয়া প্রসন্ন মনে নিশ্চিন্ত চিত্তে এই বালককে গ্রহণ করুন; আপাতত যদিবা কিছু অসুবিধা ঘটে সমস্ত কাটিয়া গিয়া মঙ্গল হইবে।

রবীন্দ্রনাথের এই চেষ্টা সত্ত্বেও শান্তি নিকেতনে বালকটিকে সে সময়ে ভর্তি করানো সম্ভব হয় নি। কিন্তু দশ বছর পরে বিদ্যালয়ের বিশ্বভারতী পর্বে সৈয়দ মুজতবা আলী প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন।

১৮৯১ সালের লোক গণনার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নদীর শতকরা ৫৮ জন অধিবাসী ছিলেন মুসলমান। ৪২ জন হিন্দু। এর মধ্যে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে মুসলামানদের সংখ্যা তুলানামূলকভাবে বেশি ছিল। কৃষ্ণনগর ও রাণাঘাটে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল। বর্ণভেদে নদীয়া জেলার হিন্দুদের সংখ্যার অনুপাতটি ছিল নিম্নরূপ—
কামার- ৮%, সদগোপ—৮%, কৈবর্ত—৬%, চামার—২.৭%, গোয়ালা—৫%, বাগদী—২%, তেলি—১.৫%, মালো—২.৩%, কুমোর—১%।. মোট—৩৫.৫০%
ব্রাহ্মণ—৩%, কায়স্থ—২%। .মোট—৫%।

এই শতকরা ৪২ জন হিন্দুর মধ্যে মাত্র ৫ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ। ওরা ছিলেন তথাকথিত ভদ্রলোক। এরাই ছিলেন জমিদার, তালুকদার, আমলা, ব্যবসা-বানিজ্যের অধিকর্তা। এদের মধ্যে কায়স্থ শ্রেণীরাই ছিলেন ব্যবসায়ী। ঐ এলাকার যে মহাজন-সুদের কারবারী শোষণ শ্রেণী ছিল এই কায়স্থ বা সাহা শ্রেণীর অন্তর্গত। হিন্দুদের মধ্যে ৭.৬% ছিল শিক্ষিত। এই শিক্ষিত হিন্দুদের সিংহভাগই উচ্চবর্ণের। ব্রাহ্মণ—২৭.৫ জন। কায়স্থ—১৬.৪ জন এবং বৈদ্য ৩২ জন।
মুসলমানদের সিংহভাগই ছল দরিদ্র। শিক্ষার হারও ছিল মাত্র ১.৬ জন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবাসী ছির দরিদ্র, অশিক্ষিত—নিম্নবর্ণজ, বৃত্তির দিক থেকেও নিম্নশ্রেণীর ও নিম্নবিত্তের। এরাই মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তি ব্যতীত বিপুল জনতা তাদের কৌলিক বৃত্তিক উপর নির্ভরশীল। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে এই মানুষদের প্রায় সকলেই জমি থেকে তাদের জীবিকা উপার্জন করতেন। স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি যে—এদের আয় ছিল অতি নগন্য।

শিলাইদহের অধিকাংশ চরের অধিবাসী ছিল মুসলমান। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তারা খাজনা দিতে চাইত না। ফলে জমিদারের নায়েব-গোমস্তা-আমিনদের সঙ্গে তাদের ঝামেলা লেগেই থাকত। লাঠিয়ালরা এসে লাঠির ঘায়ে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করত। আবার মুসলমান প্রজারা তাদের রুখে দাড়াত। পাল্টা আঘাত করতে ভয় পেত না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারীর দায়িত্ব নিয়ে এই এলাকায় এলেন—তিনি সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। তাদের কাছে গেলেন। তাদের বশ করলেন—লাঠির আঘাত দিয়ে নয়—ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে, সহানুভূতি দিয়ে। ন্যায়-নীতি ও মানবিকতা বোধ দিয়ে। তিনি আস্থা অর্জন করেছিলেন সকল শ্রেণীর বর্ণের ধর্মের সম্প্রদায়ের মানুষের। শিলাইদহের চরের বিদ্রোহী প্রজাদের সর্দার ইসমাইল মোল্লা রবীন্দ্রনাথের শালিসী খুশী মনে মেনে নিয়েছেন। মুসলমান প্রধান কালিগ্রামের সব প্রজা জমিদারের সঙ্গে তাদের মধ্যেকার স্বার্থ ভাগ করে নিয়েছে। এর আগে এই কাজটি ঠাকুর-এস্টেটের কোনো ম্যানেজার করতে পারেন নি। কখনো কখনো তারা সমস্যারটির সমাধান না করে জিঁইয়ে রেখেছেন।

ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে ইন্দিরাকে তিনি লিখেছেন --একদিন তিনি পতিসরের মাঠে গিয়েছেন। সেদিন একজন অতিশয় দরিদ্র প্রজা তাঁর পায়ের ধূলো নিতে এসেছে। প্রজাটি অসুস্থ। অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য তিন ধরে উপবাস করছে। তার ধারনা—এই অন্যরকম জমিদারের পায়ের ধূলো নিলে তার অসুখ সেরে যাবে। এটা তার গভীর বিশ্বাস। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন-- রবীন্দ্রনাথ কালিগ্রামের মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কফিলুদ্দিন বা জালালুদ্দিন শেখের সঙ্গে ধান ফসলের পোকামাকড় মারার কৌশল নিয়ে আলাপ করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পূর্ববঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করার সময়ে তিনি অধিকাংশ সময়ই নদীর উপরে বজরা বোটে থাকতে পছন্দ করতেন। তার বজরার প্রধান মাঝির নাম ছিল মেছের আলি। আর মুসলমান বাবুর্চির রান্না তিনি খেতেন। বাবুর্চির নাম ছিল গফুর। কুঠিবাড়ির বাবুর্চির নাম ছিল মোমিন মিঞা। মোমিন মিঞার নাম তিনি নাটকেও লিখেছেন।

আবুল আহসান চৌধুরী ডঃ আহমদ শরীফকে ১৮৯৫ সালে চিঠিতে লিখেছিলেন, চরের মুসলমান প্রজাদের উচ্ছেদ করে সেখানে নমশুদ্র প্রজা বসানোর পরিকল্পনাটা রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। তিনি এই হীনপরিকল্পনাটির কোনো প্রমাণ সেখানে দেন নি। বা তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেন নি। কিন্তু ২০১১ সালে সেই আবুল আহসান চৌধুরীই সেই পুরণো চিঠিটির হীনপরিকল্পনাটিকে নাকচ করেছেন। তিনি বিস্তারিত প্রমাণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ লিখেছেন—মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়-গভীর-আত্মিক।..তিনি এদেরকে এতটাই বশ করেছিলেন যে, যখন শিলাইদহের জমিদারী রবীন্দ্রনাথের হাতছাড়া হয়ে গেছে, নতুন মালিক তাঁর ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর—রবীন্দ্রনাথকে আসতে হলো চরের অধিবাসী মুসলমান প্রজারা আবার বিদ্রোহী হয়েছে বলে।

১৯২০ সালে ঠাকুর এস্টেটের জমিদারী ভাগ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাতের ভাগে পড়ে কালিগ্রাম জমিদারী। শিলা্ইদহ-সাহাজাদপুরের বিরাহিমপুর পরগণার জমিদারী অংশটি পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগে। ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিলাইদহ ও পদ্মা আর তাঁর নিজের রইল না। সুরেন্দ্রনাথও জমিদারী পরিচালনা করতে আসেন নি। তিনি নায়েব-গোমস্তাদের হাতে জমিদারী ছেড়ে দেন। ফলে প্রজা অসন্তোষ দেখা দেয়। আরও পরে সুরেন্দ্রনাথ সে জমিদারী রক্ষা করতে পারেন নি। সুরেন্দ্রনাথ ভাগ্যকুলের কুণ্ডু পরিবারের কাছে এই সম্পত্তি বেঁচে দেন।

রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শেষবারের মতন এলেন এই চরের প্রজাদের মনের-মতের পরিবর্তন ঘটানোর জন্যে। তাদের যে অসন্তোষ, তারা যে জমিদারকে মানতে চাচ্ছে না বা সুরেন ঠাকুরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যে খুব ভালো হয়ে উঠছে না, সেটা মেটানোর জন্যে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন।

২৩ মার্চ ১৯২২ তারিখে রাত্রের ট্রেনে করে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আ্যান্ডরুজকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা হন। ২৪ মার্চ শিলাইদহে পৌঁছান। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন-- শিলাইদহে এসে তার ভালো লাগছে। এদিন তিনি রচনা করলেন পূর্বাচলের পানে তাকাই গানটি। মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে গানটি পাঠিয়ে তিনি লিখেছেন—পুরনো শিলাইদহে এসে মনটা কেমন ঢিলে হয়ে গেচে। কর্তব্য জগতের বিপুল যে-একটা ভারাকর্ষণ ছিল সেটা ফস করে আমার চারদিক থেকে খসে পড়েছে। গুরুতর দ্বায়িত্ব বলে যে সমস্ত পদার্থকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতুম হঠাৎ তাদের কথা মনে করে হাসি পাচ্ছে। এটা তার শিলাইদহে শেষ আগমন। তিনি ২৫ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত চারটি গান লেখেন। আসা-যাওয়ার পথের ধারে, কার যেন এই মনের বেদন, নিদ্রাহারা রাতের এ গান, এক ফাগুনের গান সে আমার।

শিলাইদহকে তিনি মন থেকে ভালো বেসেছিলেন। এটা তাঁর হাত থেকে চলে যাওয়ায় বেদনা পেয়েছিলেন। ৫ এপ্রিল ১৯২২ তারিখে রাণু অধিকারীকে একটি চিঠি লেখেন শিলাইদহ থেকে--
আগে পদ্মা কাছে ছিল—একন নদী বহু দূরে সরে গেছে---আমার তেতলা ঘরের জানলা দিয়ে তার একটুখানি আভাস যেন আন্দাজ করে বুঝতে পারি। অথচ একদিন এই নদীর সঙ্গে আমার কত ভাব ছিল—শিলাইদহে যখনই আসতুম তখন দিনরাত্তির ঐ নদীর সঙ্গেই আমার আলাপ চলত। রাত্রে আমার স্বপ্নের সঙ্গে ঐ নদীর কলধ্বনি মিশে যেত আর নদীর কলস্বরে আমার জাগরণের প্রথম অভ্যর্থনা শুনতে পেতাম। তার পরে কত বৎসর বোলপুরের মাঠে মাঠে কাটল, কতবার সমুদ্রের এপারে ওপারে পাড়ি দিলুম—এখন এসে দেখি সে নদী যেন আমাকে চেনে না; ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখি, মাঝখানে কত মাঠ, কত গ্রামের আড়াল,--সবশেষে উত্তর দিগন্তে আকাশের নীলাঞ্চলের একটি নীলতর পাড়ের মত একটি বনরেখা দেখা যায়, সেই নীল রেখাটির কাছে ঐ যে একটি ঝাপসা বাষ্পলেখাটির মত দেখতে পাচ্ছি ঐ আমার পদ্মা, আজ সে আমার কাছে অনুমানের বিষয় হয়ে রয়েছে। এই ত মানুষের জীবন, ক্রমেই কাছের জিনিস দূরে চলে যায়, জানা জিনিষ ঝাপসা হয়ে আসে, আর যে স্রোত বন্যার মত প্রাণমনকে প্লাবিত করেচে, সেই স্রোত একদিন অশ্রুবাষ্পের একটি রেখার মত জীবনের একান্তে অবশিষ্ট থাকে।

এখানে দুসপ্তাহ ছিলেন। সঙ্গী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সিএফ এন্ডরুজ। ২১ শে চৈত্র গ্রামবাসীরা কবি ও এন্ডরুজ সাহেবকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানান। এই সভায় একাধিক মানপত্র দেওয়া হয়। এদিনই শিলাইদহ অঞ্চলের মুসলমান মহিলাদের পক্ষ থেকে কবিকে একটি নকশি কাঁথা উপহার দেওয়া হয়। এটি বর্তমানে রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। শিলাইদহ জমিদারীর প্রজারের পক্ষ মানপত্রটি রচনা করেছিলেন জেহের আলী বিশ্বাস বলে চর কলারোয়া গ্রামের একজন মুসলমান প্রজা। তিনি লেখেন—আজ আমাদের কী আনন্দে দিন...সমস্ত প্রকৃতি যেন আজ শরবেণুরবে গাইছে—ধন্য হয়েছি মোরা তব আগমনে।
তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করেছিলেন। আর কিছু নয়।

জেহের আলী বিশ্বাস রচিত বিরাট এই মানপত্রের শেষ দিকে বলা হয়—
সমুদ্রমন্থন করিয়া একদিন দেবতারা অমৃত তুলিযা অমর হইয়াছেন। আমরাও আজ আপনার জ্ঞানরূপ সমুদ্র ছেঁচিয়া তার মাঝখান থেকে অমৃতবাণী তুলিয়া মর্মে মর্মে গাঁথিয়া জীবনের কর্তব্যপথে অগ্রসর হব। কিন্তু শত পরিতাপের বিষয়, আমরা বিদ্যাহীন বুদ্ধিহীন; সে অমৃত তুলিতে আমাদের উপযুক্ত আসবাবের অভাব। তবে আজ আপনার ন্যায় একজন নায়কের শুভাগমনে যে আনন্দটুকু পেয়েছি, আর যতটুকু সাধ্য সাজাইয়া গুছাইয়া এই ক্ষুদ্র ঝুলিটি পূর্ণ করিয়া এই সোনার হাটের মধ্যে আনিয়া দিলাম, আপনার সুধামুখের সুধাবর্ষণ প্রার্থনা করিতেছে :

১. গৃহস্থেরা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে; তবু তাহাদিগকে দুমুঠো ভাতের জন্য পরের দ্বারস্থ হইতে হয়। কিরূপে তাদের এই দুরাবস্থা দূর হইতে পারে এই সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।
২. দেশ হইতে হাজার হাজার মন শস্য সস্তা দরে বিদেশে চলিয়া যাচ্ছে, আর বিদেশ থেকে যা আসছে তা তাহাদিগকে আতিরিক্ত মূল্যে কিনিতে হচ্ছে। তার প্রতিকারের উপায় কি, এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।
৩. বর্তমানে দেশের যেরূপ অবস্থা হইয়াছে, তাহাতে প্রত্যেকের কি কি করা কর্তব্য এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।
৪. দেশে গরীবের ছেলে উপযুক্ত লেখাপড়া শিখে সহায় অভাবে জীবনে উন্নতির দিকে যাইতে পারে না জন্য ক্রমে ক্রমে অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কি করা কর্তব্য এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।
অতএব প্রার্থনা, অধীনগণের এই ক্ষুদ্র এ আকিঞ্চন গ্রহণ করিলে জীবনে ধন্য হইব। নিবেদন ইতি। ১৩২৮। ২১ চৈত্র।

‘জগৎপূজ্য কবিসম্রাট শ্রীল শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহোদয়ের শ্রীচরণ কমলেষু’ নামে খোরসেদপুরের অধিবাসিবৃন্দ মানপত্রে লেখেন—

…আবার এসেছে ফিরে এ পল্লীর আনন্দ দুলাল
দশদিক আকুলিয়া পত্র পুষ্পে সেজে ওঠ কদম্ব তমাল।
শাখে শাখে ডাকে পাখি দাঁড়াইলা পল্লী আজি উৎসব সজ্জায়
কবীন্দ্রের চরণের তলে, অর্ঘ্য করে নতমুখী সেবিকার প্রায়।।…

১৯৩৭ সালে পতিসরের প্রজাদের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সে বছরের পূন্যাহে (১০ শ্রাবণ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ)পতিসরে আসেন। সেখান থেকে কালীগ্রামে। এখানে কবি বারো বছর পরে এলেন। তখন থাকতেন বোটে। কবির আগমণ উপলক্ষে রসুনচৌকি আর দিশি বাদ্যভাণ্ডের ধ্বনিতে সরগরম হয়ে উঠল গ্রামগুলি। পরের দিন সংবর্ধনা জানাবার বিপুল আয়োজন করেছেন গ্রামবাসীরা। স্থানীয় পতিসর হাইস্কুলে বসেছে অভিনন্দন সভা। পুষ্পমাল্যে বরণ করা হল কবিকে। স্থানীয় জনসাধারণের অনেকেই বক্তৃতা করলেন। কবিও সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন—‘’সংসার থেকে বিদায় নেবার আগে, তোমাদের দেখে যাবো—আমার সেই আকাঙ্ক্ষা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চলো,--জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা—‘এডুকেশন ফার্স্ট’, সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও, মানুষ করো।‘’ অনেক বৃদ্ধপ্রজা, যুবকেরাও ভাবাবেগে কেঁদে ফেললেন, কবির কণ্ঠও যেন রুদ্ধ।

বড়ো আকারের অভিনন্দন সভাটি অনুষ্ঠিত হল কাছারি প্রাঙ্গণে। জনৈক মুসলমান প্রজা অভিনন্দন পাঠ করলেন—

মহামান্য দেশবরেণ্য দেবতুল্য জমিদার শ্রীযুক্ত কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়ের পরগণায় শুভাগমন উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি—
প্রভো, প্রভুরূপে হেথা আস নাই তুমি দেবরূপে এসে দিলে দেখা।
দেবতার দান অক্ষয় হউক, হৃদিপটে থাক স্মৃতিকথা।।

কালীগ্রাম পরগণার প্রজাবৃন্দের পক্ষে—
মোঃ কফিলদ্দিন আকন্দ রাতোয়ান।
পতিসর, সদর কাছারী, রাজশাহী, ১২ শ্রাবণ, ১৩৪৪।

পতিসরের একটি ঘটনা বলেছেন অন্নদা শঙ্কর রায়। তখন তিনি রাজশাহীর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে এলে তার সঙ্গে অন্নদা শঙ্কর রায় দেখা করতে গেছেন। সেখানে একজন বৃদ্ধ মুসলমান প্রজা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার কাছে মন্তব্য করেছেন যে—আমাদের ধর্মের মহামানবকে আমরা দেখিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে দেখলে তেমনই মনে হয়।

সে সময়কার একটি ছবি শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর বইতে আছে যে চরের প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন চরের ভেতর দাঁড়িয়ে। মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কটাই নির্দেশ করে এ ছবিটি।

১৮৯১ সালে জমিদারি পরিচালনা করতে এসে রবীন্দ্রনাথ মহাজনী প্রথার সর্বনাশা রূপটি দেখেছিলেন। সে সময়ের মহাজনদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সাহা পরিবারের লোকজন। তিনি সে সময় ঘোষণা করেছিলেন—সাহাদের হাত থেকে শেখদের রক্ষা করাই আমার প্রথম কর্তব্য। তার জমিদারী এলাকার অধিকাংশ প্রজাই ছিল দরিদ্র এবং মুসলমান। শেখ বলতে এই দরিদ্র প্রজাদেরই বুঝিয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ যেসব পল্লীউন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলেন—যেমন কৃষি ব্যাংক খুলে দরিদ্রপ্রজাদের ঋণ প্রদান, মণ্ডলী প্রথার মাধ্যমে সমবায় প্রথায় চাষ পদ্ধতি প্রচলন, তাঁত-রেশমের প্রশিক্ষণ স্কুল খোলা, উন্নত কৃষি প্রদ্ধতির প্রচলন, হাসপাতাল স্থাপন ইত্যাদি-- সেগুলো সরাসরি আঘাত করেছিল কায়েমী স্বার্থের রক্ষক হিন্দু গোমস্তা, আমলা, মাহজন এবং জোতদারদের দূর্গে। ফলে শিলাইদহ এলাকায় তিনি সব সময় এদের দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিলেন। তারা নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করেছিল। তারা রবীন্দ্রনাথের জেদ আর কল্যাণব্রতের সামনে বিপন্ন বোধ করেছিলেন। ঠাকুর-এস্টেটের অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন মুসলমান। তারা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের কল্যাণকর্মে সর্বাধিক উপকৃত হয়েছিল। এ কারণেই তারা তাকে ভালোবাসত। তাকে ভক্তি করত। কায়েমী স্বার্থবাদীরা সে সময় প্রচার করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম বলে মুসলমানদের প্রতি তার এত প্রীতি।

জমিদারী পরিচালনার কাজে এসে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ট সম্পর্ক পরিচয় ওঠে এই নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে। পল্লীর সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ইংরেজ রাজত্বে এই সমাজ ও অর্থনীতি উভয়েরই পরিবর্তন ঘটেছিল। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার অভিঘাতে পুরনো সমাজকাঠামোর অবক্ষয় তাকে বিস্মিত করেছিল। তিনি লক্ষ করেছিলেন—নতুন ব্যবস্থায় ভারতবর্ষীয় এককালীন স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ স্টেটের কাছে মর্মান্তিকভাবে আত্মবিলোপ করতে বাধ্য হচ্ছে। এবং দেখেছিলেন—পল্লীতে এই দরিদ্য মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনটাই বড়। সাম্প্রদায়িক ভেদরেখার ছিদ্র ধনীদের মধ্যেই গোপনে গোপনে আছে। সেখানে বাইরে থেকে রোগজীবাণু সংক্রমণ ঘটলেও ঘটতে পারে। দরিদ্র মানুষের কোনো দায় নেই।


মন্তব্য

দুর্দান্ত এর ছবি

"এ সূত্রেই ঠাকুর পরিবারে উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পড়েছেন ফারসী, আরবী, তুর্কী সাহিত্য।"

উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পাশাপাশি পরিবার বানিজ্য়িক ইতিহাসও কি এর জন্য় কিছুটা দায়ী হতে পারে? ইংরেজী রাজভাষা হলেও ব্রিটিশ-রাজ এর প্রশাসন ও বানিজ্য়িক অনংগনের, বিশেষত পারসি, মারওয়ারি, আফগান ও লগ্নিকারদের ভাষা তো যথাক্রমে ফারসী ও তুরকি হবার কথা।

কুলদা রায় এর ছবি

দ্বারকানাথ নিজে এবং তাঁর ছেলে দেবেন্দ্রনাথ বানিজ্যিক কারণেই ফারসী, ইংরেজী ভাষা শিখেছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ভাষাকে বানিজ্যিকতার বাইরে বের করে আনেন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির দিকে তার উত্তর প্রজন্মকে নির্মাণ করেন। এর কারণ হল--ঠাকুর পরিবারের অর্থবিত্ত থাকলেও সামাজিক সম্মান ছিল না পিরালী ব্রাহ্মণ হিসাবে। বাঙালি তাদের সঙ্গে একপাতে খেত না। তাদের সঙ্গে কোনো বড় ঘরের পরিবার বিয়েশাদি করাত না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা নেন।
আপনাকে ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।