রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১২/০৩/২০১২ - ১:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

মুসলমান খণ্ড—২
------------------
হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দিকে। ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন অই বাণীটি হযরত মোহম্মদের জন্মদিনে আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে উহার অনুবর্তিগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদিগকে সাক্ষ্য দিতে হইবে। ভারতে যে-সকল বিভিন্ন ধর্মসমাজ আছে তাহাদের পরস্পরের প্রতি সভ্য জাতিযোগ্য মনোভাব যদি উদ্ভাবিত করিতে হয় তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা ইহা সম্ভবপর হইবে না। তবে আমাদিগকে নির্ভর করিতে হইবে সেই অনুপ্রেরণার প্রতি, যাহা ঈশ্বরের প্রিয় পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্যদূতদিগের অমর জীবন হইতে চির উৎসারিত। অদ্যকার এই পূর্ণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে মস্লেম ভ্রাতাদের সহিত একযোগে ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশ্য আমার ভক্তি-উপহার অর্পন করিয়া ঊৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ ও সাত্ত্বনা কামনা করি।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনীর ৩য় খণ্ড জানিয়েছেন, বানীটির ইংরেজী পাঠও আছে। ইংরেজী পাঠটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন। বাংলা পাঠে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদকে মহাঋষি হিসাবে অভিহিত করেছিলেন কবি। কিন্তু ইংরেজী পাঠে তিনি মহাঋষি শব্দটির অনুবাদ করেছিলেন—Grand Propfet of Islam.

১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর নবী দিবস উপলক্ষে একটি বাণী পাঠান রবীন্দ্রনাথ বোম্বের আনজুমানে আহমদিয়ার সম্পাদককে—
Message to the Secretary, Anjuman Ahmadiya, Bombay, on Prophet Day—
Islam is one of the greatest religious od the world and the responsibility is immense upon
its followers who must in their lives bear testimony to the greatness of their faith.
Our one hope of mutual reconciliation between different communities inhabiting India,
of bringing about a truly civilized attitude of mind towards each other in this
unfortunate country depends not merely on the realization of an intelligent self-interest
but on the eternal source of inspiration that comes from the beloved of God and
lovers of men. I take advantage of this auspicious occasion today when I may join my
moslem brothers in offering my homage of adoration to the grand prophet of Islam and
invoke his blessings for India which is in dire need of success and solace.
Rabindranath Tagore
26.11.1933.

দিল্লীর জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত The Peshwa পত্রিকার নবী সংখ্যার জন্য ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থে ভূঁইয়া ইকবাল সেই বানীটি শান্তি নিকেতনের রবীন্দ্রভবনের অভিলেখাগার থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।
Message for the Prophet Number of The Peshwa, Jama Masjid, Delhi.
I take this opportunity to offer my veneration to the Holy Prophet Mohammad,
one of the greatest personalities born in the world, who has brought a new and
latent force of life into human history, a vigorous ideal of purity in religion,
and I earnestly pray that those who follow his path will justify their Noble faith
in their life and the sublime teaching of their master by serving the cause of
civilization in building the history of the modern India, helping to maintain
peace and mutual goodwill in the field of our national life.

Rabindranath Tagore.
Santiniketon 27the February 1936.

প্রথম বাণীটিতে রবীন্দ্রনাথ ইসলামের প্রবর্তকের নাম সরাসরি বলেন নি। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভাষায় মহাঋষি বলেছেন। দ্বিতীয় বাণীটি প্রথম বাণীটিরই অনুবাদ। সেখানে ইসলামের মহাঋষি শব্দের বদলে প্রোফেট বা নবী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তৃতীয় বাণীটিতে সুস্পষ্টভাবে পবিত্র নবী মোহাম্মদ হিসাবে অভিহিত করেছেন।

শান্তিনিকেতন প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তিনজন ধর্মপ্রবতর্কের নাম করেছেন। নামের তালিকা দেখলে বোঝা যায়—তিনি বয়স হিসাবে সিনিয়রিটি নির্ধারিত করেছেন। শুরুতে গৌতম বুদ্ধ, দ্বিতীয়টিতে যীশু এবং সবশেষে হযরত মহম্মদকে আলোচনায় এনেছেন। তিনি তিনজনের মধ্যেই মানুষত্বের সংগ্রামে তাঁদের আত্মনিবেদনকে সভ্যতার বড় অবদান হিসাবে দেখেছেন। লিখেছেন—

নিজের রচিত জটিল জাল ছেদন করে চিরন্তন আকাশ চিরন্তন আলোকের অধিকার আবার ফিরে পাবার জন্য মানুষকে চিরকালই এইরকম মহাপুরুষদের মুখ তাকাতে হয়েছে। কেউ বা ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ বা জ্ঞানের ক্ষেত্রে, কেউ বা কর্মের ক্ষেত্রে এই কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যা চিরদিনের জিনিষ তাকে তাঁরা ক্ষণিকের আবরণ থেকে মুক্ত করবার জন্যে পৃথিবীতে আসেন। বিশেষ স্থানে গিয়ে বিশেষ মন্ত্র পড়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায় এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল, তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বার্থত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবেই মুক্তি হয়। কোনো স্থানে গেলে বা জলে স্নান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না। এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ করে বনে বনে পথে পথে ফিরতে হয়েছে– মানুষের হাতে এটি এতই কঠিন হয়ে উঠেছিল। য়িহুদিদের মধ্যে ফ্যারিসি সম্প্রদায়ের অনুশাসনে যখন বাহ্য নিয়মপালনই ধর্ম বলে গণ্য হয়ে উঠেছিল, যখন তারা নিজের গন্ডির বাইরে অন্য জাতি, অন্য ধর্মপনথীদের ঘৃণা করে তাদের সঙ্গে একত্রে আহার বিহার বন্ধ করাকেই ঈশ্বরের বিশেষ অভিপ্রায় বলে স্থির করেছিল, যখন য়িহুদির ধর্মানুষ্ঠান য়িহুদি জাতিরই নিজস্ব স্বতন্ত্র সামগ্রী হয়ে উঠেছিল, তখন যিশু এই অত্যন্ত সহজ কথাটি বলবার জন্যই এসেছিলেন যে, ধর্ম অন্তরের সামগ্রী, ভগবান অন্তরের ধন, পাপপুণ্য বাহিরের কৃত্রিম বিধি-নিষেধের অনুগত নয়, সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, মানুষের প্রতি ঘৃণাহীন প্রেম ও পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাসপূর্ণ ভক্তির দ্বারাই ধর্মসাধনা হয়; বাহ্যিকতা মৃত্যুর নিদান, অন্তরের সার পদার্থেই প্রাণ পাওয়া যায়। কথাটি এতই অত্যন্ত সরল যে শোনবামাত্রই সকলকেই বলতে হয় যে, হাঁ। কিন্তু, তবুও এই কথাটিকেই সকল দেশেই মানুষ এতই কঠিন করে তুলেছে যে, এর জন্যে যিশুকে মরু-প্রান্তরে গিয়ে তপস্যা করতে এবং ক্রুসের উপরে অপমানিত মৃত্যুদন্ডকে গ্রহণ করতে হয়েছে।

মহম্মদকেও সেই কাজ করতে হয়েছিল। মানুষের ধর্মবুদ্ধি খন্ড খন্ড হয়ে বাহিরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে অন্তরের দিকে, অখন্ডের দিকে, অনন্তের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। সহজে পারেন নি, এর জন্য সমস্ত জীবন তাঁকে মৃত্যুসংকুল দুর্গম পথ মাড়িয়ে চলতে হয়েছে, চারিদিকে শত্রুতা ঝড়ের সমুদ্রের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তাঁকে নিরন্তর আক্রমণ করেছে। মানুষের পক্ষে যা যথার্থ স্বাভাবিক, যা সরল সত্য, তাকেই স্পষ্ট অনুভব করতে ও উদ্ধার করতে, মানুষের মধ্যে যাঁরা সর্বোচ্চশক্তিসম্পন্ন তাঁদেরই প্রয়োজন হয়।

মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহণ করেছেন এবং ধর্মকে দেশগত জাতিগত লোকাচারগত সংকীর্ণ সীমা থেকে মুক্ত করে দিয়ে তাকে সূর্যের আলোকের মতো, মেঘের বারিবর্ষণের মতো, সর্বদেশ ও সর্বকালের মানবের জন্য বাধাহীন আকাশে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের নাম করেছি। ধর্মের প্রকৃতি যে বিশ্বজনীন, তাকে যে কোনো বিশেষ দেশের প্রচলিতমূর্তি বা আচার বা শাস্ত্র কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না, এই কথাটি তাঁরা সর্বমানবের ইতিহাসের মধ্যে নিজের জীবন দিয়ে লিখে দিয়ে গেছেন। দেশে দেশে কালে কালে সত্যের দুর্গম পথে কারা যে ঈশ্বরের আদেশে আমাদের পথ দেখাবার জন্যে নিজের জীবন-প্রদীপকে জ্বালিয়ে তুলেছেন সে আজ আমরা আর ভুল করতে পারব না, তাঁদের আদর্শ থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারব। সে-প্রদীপটি কারও বা ছোটো হতে পারে কারও বা বড়ো হতে পারে, সেই প্রদীপের আলো কারও বা দিগ্‌দিগন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, কারও বা নিকটের পথিকদেরই পদক্ষেপের সহায়তা করে, কিন্তু সেই শিখাটিকে আর চেনা শক্ত নয়।

মূর্তি বা আচার বা শাস্ত্র কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না, এই কথাটি তাঁরা সর্বমানবের ইতিহাসের মধ্যে নিজের জীবন দিয়ে লিখে দিয়ে গেছেন। দেশে দেশে কালে কালে সত্যের দুর্গম পথে কারা যে ঈশ্বরের আদেশে আমাদের পথ দেখাবার জন্যে নিজের জীবন-প্রদীপকে জ্বালিয়ে তুলেছেন সে আজ আমরা আর ভুল করতে পারব না, তাঁদের আদর্শ থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারব। সে-প্রদীপটি কারও বা ছোটো হতে পারে কারও বা বড়ো হতে পারে, সেই প্রদীপের আলো কারও বা দিগ্‌দিগন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, কারও বা নিকটের পথিকদেরই পদক্ষেপের সহায়তা করে, কিন্তু সেই শিখাটিকে আর চেনা শক্ত নয়।

পূর্ববঙ্গে যে বছর এসেছিলেন জমিদারী পরিচালনা করতে সেই ১৮৯১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অর্ধশতকে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সম্যক ধারণা পান এবং তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন অকাতরে। শুরু করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা সাধনায় মুসলমান মহিলা নামে প্রবন্ধ লিখে। পরিচয় পত্রিকায় কালান্তর পর্যন্ত নানা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের সম্পর্কে ৩০টিরও বেশী প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর গভীর বিশ্লেষণী অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি কিছু বানিয়ে লেখেন নি। পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানদের জীবনকে কাছ থেকে দেখেই তিনি লিখেছেন। এখানেই তাঁর লেখাটার শক্তি।

১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ তখন বুড়ো হয়ে গেছেন। নানা রোগে শোকে জীর্ণশীর্ণ। নিজের হাতে লিখতেও পারেন না। হাত কাঁপে। তখন ১২ ভাদ্র সিরাজগঞ্জ থেকে আবুল মনসুর এলাহী বক্স এসেছিলেন শান্তি নিকেতনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এলাহী বক্স সিরাজগঞ্জে সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেবক নামে এই মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন। তাকে রবীন্দ্রনাথ অটোগ্রাফ দিয়ে লিখেছেন—
যে করে ধর্মের নামে
বিদ্বেষ সঞ্চিত
ঈশ্বরকে অর্ঘ্য হতে
সে করে বঞ্চিত।।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন বিশ্বভারতীর ছাত্র ছিলেন। পরে বিশ্বভারতীর ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়ি অসৃতসর, পাঞ্জাব। তিনি সদ-বন্দ-ই টেগোর নামে ১০০টি রবীন্দ্রকবিতা ও গানের ফারসীতে ও কলম-ই টেগোর নামে কবিতার উর্দু তরজমা করেন। বই দুটিই বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। ১৯২২ সালে ২৪ জুলাই শান্তি নিকেতনে সুফি ধর্ম বিষয়ে মৌলনা জিয়াউদ্দিন প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯২৩ সালে ১৬ মার্চ শান্তি নিকেতনে জিয়াউদ্দিন কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন এবং ইংরেজীতে তার অনুবাদ পাঠ করেন।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন শান্তি নিকেতনের বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীতে ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগকে একটি শক্ত ভিত্তির উপরদাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুমরণ করেন ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে। কবি গভীর ভাবে শোকাহত হন। রবীন্দ্রনাথ ৮ জুলাই মৌলানা জিয়াউদ্দিন নামে ৪৮ লাইনের একটি কবিতা লেখেন। শান্তি নিকেতনে সে সময় একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ মৌলানা স্মরণে একটি দীর্ঘ ভাষণও দেন। মিসেস জিয়াউদ্দিনকে ৬ জুলাই টেলিগ্রামে শোকবার্তা পাঠান –
Ziauddin’s passing away is a terrible blow to me personally and Santiniketon. Rabindranath Tagore.
6.7.38.

ভাষণে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—
আজকের দিনে একটা কোনো অনুষ্ঠানের সাহায্যে জিয়াউদ্দিনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে আশ্রমবাসীদের কাছে বেদনা প্রকাশ করব, এ কথা ভাবতেও আমার কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। যে অনুভূতি নিয়ে আমরা একত্র হয়েছি তার মূলকথা কেবল কর্তব্যপালন নয়, এ অনুভূতি আরো অনেক গভীর।

জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে যে স্থান শূন্য হল তা পূরণ করা সহজ হবে না, কারণ তিনি সত্য ছিলেন। অনেকেই তো সংসারের পথে যাত্রা করে, কিন্তু মৃত্যুর পরে চিহ্ন রেখে যায় এমন লোক খুব কমই মেলে। অধিকাংশ লোক লঘুভাবে ভেসে যায় হাল্কা মেঘের মতো। জিয়াউদ্দিন সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে না; আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি যে স্থান পেয়েছেন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে একদিন একেবারে বিলীন হয়ে যাবে। এ কথা ভাবতে পারি নে। কারণ তাঁর সত্তা ছিল সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আশ্রম থেকে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি ছুটিতে, তাঁর এই ছুটিই যে শেষ ছুটি হবে অদৃষ্টের এই নিষ্ঠুর লীলা মন মেনে নিতে চায় না। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই সত্য, কিন্তু তাঁর সত্তা ওতপ্রোতভাবে আশ্রমের সব-কিছুর সঙ্গে মিশে রইল।

তিনি প্রথম আশ্রমে এসেছিলেন বালক বয়সে ছাত্র হিসাবে, তখন হয়তো তিনি ঠিক তেমন করে মিশতে পারেন নি এই আশ্রমিক জীবনের সঙ্গে, যেমন পরিপূর্ণ ভাবে মিশেছিলেন পরবর্তী কালে। কেবল যে আশ্রমের সঙ্গে তাঁর হৃদয় ও কর্মপ্রচেষ্টার সম্পূর্ণ যোগ হয়েছিল তা নয়, তাঁর সমস্ত শক্তি এখানকার আবহাওয়ায় পরিণতি লাভ করেছিল। সকলের তা হয় না। যাঁরা পরিণতির বীজ নিয়ে আসেন তাঁরাই কেবল আলো থেকে হাওয়া থেকে পরিপক্বতা আহরণ করতে পারেন। এই আশ্রমের যা সত্য যা শ্রেষ্ঠ সেটুকু জিয়াউদ্দিন এমনি করেই পেয়েছিলেন। এই শ্রেষ্ঠতা হল মানবিকতার, আর এই সত্য হল আপনাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত করে দেবার শক্তি। ধর্মের দিক থেকে এবং কর্মের দিকে অনেকের সঙ্গেই হয়তো তাঁর মূলগত প্রভেদ ছিল, কিন্তু হৃদয়ের বিচ্ছেদ ছিল না। তাঁর চলে যাওয়ায় বিশ্বভারতীর কর্মক্ষেত্রে যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা পূরণ করা যাবে না। আশ্রমের মানবিকতার ক্ষেত্রে তাঁর জায়গায় একটা শূন্যতা চিরকালের জন্যে রয়ে গেল। তাঁর অকৃত্রিম অন্তরঙ্গতা, তাঁর মতো তেমনি করে কাছে আসা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না, সংকোচ এসে পরিপূর্ণ সংযোগকে বাধা দেয়। কর্মের ক্ষেত্রে যিনি কর্মী, হৃদয়ের দিক থেকে যিনি ছিলেন বন্ধু, আজ তাঁরই অভাবে আশ্রমের দিক থেকে ও ব্যক্তিগতভাবে আমরা এক জন পরম সুহৃদকে হারালাম।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কখনো কখনো কোনো অবসরে
নিকটে দাঁড়াতে এসে;
"এই যে' বলেই তাকাতেম মুখে,
"বোসো' বলিতাম হেসে।
দু-চারটে হত সামান্য কথা,
ঘরের প্রশ্ন কিছু,
গভীর হৃদয় নীরবে রহিত
হাসিতামাশার পিছু।
কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়,
অকথিত কত বাণী,
চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন
আজিকে সে কথা জানি।
প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে
সামান্য যাওয়া-আসা,
সেটুকু হারালে কতখানি যায়
খুঁজে নাহি পাই ভাষা।
তব জীবনের বহু সাধনার
যে পণ্যভারে ভরি
মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে
তোমার নবীন তরী,
যেমনি তা হোক মনে
জানি তার এতটা মূল্য নাই
যার বিনিময়ে পাবে
তব স্মৃতি আপন নিত্য ঠাঁই--
সেই কথা স্মরি বার বার
আজ লাগে ধিক্‌কার প্রাণে--
অজানা জনের পরম মূল্য
নাই কি গো কোনোখানে।
এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে
কোথা হতে খুঁজে আনি
ছুরির আঘাত যেমন সহজ
তেমন সহজ বাণী।
কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব,
কারো অর্থের খ্যাতি--
কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্‌ সহায়,
কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি--
তুমি আপনার বন্ধুজনেরে
মাধুর্যে দিতে সাড়া,
ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা
সকল খ্যাতির বাড়া।
ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি
আনন্দমহিমায় আপনার দান
নিঃশেষ করি ধুলায় মিলায়ে যায়--
আকাশে আকাশে বাতাসে
তাহারা আমাদের চারি পাশে
তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে
সৌরভনিশ্বাসে।

শান্তিনিকেতন, ৮ জুলাই, ১৯৩৮

১৯২১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বভারতীর সম্মিলনী সভায় সৈয়দ মুজতবা আলী ঈদ উৎসব নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। নসিরুল্লাহ এ বৎসর শান্তিনিকেতনে কিছুকাল উর্দু শেখান।১৯২৩ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর সভাপতিত্বে বিশ্বভারতীর সম্মিলনী সভায় রামচন্দ্র নামে এক প্রাবন্ধিক The little I know of Islam পাঠ করেন।

১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের কাজী আব্দুল ওদুদ শান্তি নিকেতনে নিজাম বক্তৃতা করেন। কাজী আব্দুর ওদুদ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক। ১৯৩৫ সালে ২৬-২৮ মার্চ তিনদিন তিনি শান্তি নিকেতনে তিনটি বক্তৃতা দেন। তিনটির বিষয়—মুসলমানের পরিচয়, হৃদয়ের জাগরণ এবং ব্যর্থতার প্রতিকার। তখন রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ। তবুও তিনি সভায় উপস্থিত থেকে তাঁর বক্তব্য পুরোটাই শোনেন। কাজী আব্দুল ওদুদের সঙ্গে ছিলেন কবি আব্দুল কাদির ও কাজী মোতাহার হোসেন। তিনটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে ১৯৩৬ সালের ৪ ফ্রেব্রুয়ারী কবি কাজী আব্দুল ওদুদের হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বইটির ভূমিকা লিখে দেন। বইটি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।