রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০১/০৫/২০১২ - ৪:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—২

শিক্ষা বিষয়ে ভাবনা
কার্জনের শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়, ‘আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠবে।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যবধান নেই, তাই শিক্ষাদানের উন্মুখতা ও বিদ্যালাভের জন্য প্রস্তুতি মানসিক সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী শিক্ষা অধিকর্তা পেডলারের সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা অতি দুরুহ ও অনিষ্টকর বলে ঘোষণা করেন, ‘হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিষ্পলতা নহে, কুফলতা প্রত্যাশা যায়। জাপানের মতো সুযোগ ও আনুকূল্য পেলে সহজেই ভারতীয়রা সেই শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লাচন্দ্রের সাধনা ও সাফল্য উল্লেখ করেন।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে-সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।‘

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনা
বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।

তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেন, আমাদের যে-সকল অভাব বিদেশীরা গড়িয়াছে ও তুলিতেছে, সেগুলো না হয় বিদেশী পূরণ করুক। ...আমাদের দেশে সরকার বাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয়ে তাঁহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে-কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার আধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের কাহাকেই হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেইজন্য রাজ্যশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করেন নাই।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন বাঙালির চিত্ত ঘরমুখ নিয়েছে। স্বদেশের শাস্ত্র, স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল—স্বদেশের শিল্পদ্রব্য নিজেদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস বাংলার গবেষণাবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলছে।
এ সময় রাজনৈতিক সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে ধারণ করাই সকলের কর্তব্য। সে হৃদয়কে ধারণ করার জন্য করণীয় তিনি নির্ধারণ করেছেন--

১. কৃষিমেলার আয়োজন
তিনি বিলেতি ধরনের সভার বদলে দেশী ধরনের মেলা করার প্রস্তাব করেন। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত হতে একত্র হবে। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হবে। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশসুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা-কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় করতে হবে।

২. হিন্দু-মুসলমান মিলন
প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন—কোনোপ্রকার নিষ্ফল পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে যথার্থই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন।

৩.ধর্মীয় দূষিত মেলা সংস্কার
কবি দেখেছেন আমাদের দেশে যে-সকল মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে—সেগুলোর অধিকাংশই লোকশিক্ষার অযোগ্য হয়ে উঠে হয়েছে—কুশিক্ষারও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তিনি এইসব কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই ধর্মীয় মেলাগুলোকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। তার বদলে দেশী মেলার আয়োজন করতে হবে।

৪. নতুন ধরনের নেতৃত্ত্ব সন্ধান : জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের রূপরেখা
স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে উপলদ্ধির কথা বলেন। শর্করারস যেমন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে মিছরির দানায় পরিণত হয়, তেমনি সমাজের বিচ্ছিন্ন শক্তি ও কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার জন্য তিনি একজন সমাজপতি মনোনয়নের কথা বলছেন। তিনি বলেন, এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।

এজন্য একজন সমাজপতি দরকার। তার সঙ্গে তার পার্ষদসভা থাকবে। তারা সবাই মিলে সমাজের সমস্যা, সমাজের মানুষের জন্য করণীয়-কর্তব্য নিরূপণ করবে। সেখানে সকলে আলোচনা করবেন। লোকসাধারণ প্রাণ খুলে তাদের কথা বলতে পারবেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গৃহীত হবে এবং সেগুলো সমাজপতির নেতৃত্ত্বে বাস্তবায়ন করা হবে। এইভাবে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এটাকে একটি স্বাধীন জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ়—তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে। এখান সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে।

এই স্থানীয় সরকার বা সমাজের প্রধান সমাজপতি কখনো ভালো, কখনো মন্দ হইতে পারেন, কিন্তু সমাজ যদি জাগ্রত থাকে, তবে মোটের উপরে কোনো ব্যক্তি সমাজের স্থায়ী অনিষ্ট করিতে পারে না। তার নেতৃত্বেই সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এর অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হবেন। সমাজের সমস্ত অভাবমোচন, মঙ্গলকর্মচালনা ও ব্যবস্থারক্ষা এঁরা করবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকবেন। তিনি বিশেষভাবে বলেন, আমাদের দেশে মধ্যে মধ্যে সামান্য উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমানে যে বিরোধ বেধে ওঠে, সেই বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রীতিশান্তিস্থাপন, উভয় পক্ষের স্ব স্ব অধিকার নিয়মিত করে দেবার বিশেষ কর্তৃত্ব সমাজপতির নেতৃত্বে থাকবে।

সমাজপতির হওয়ার মতো এমন লোক পাওয়া কঠিন। একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়ে তোলা না করা গেলে এই সমাজপতি নির্বাচন করা কঠিন। এ সমস্ত সমস্যা থাকা সত্বেও তিনি লিখেছেন, যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব সময়োচিত হয়, যদি রাজা সমাজের অন্তর্গত হওয়াতে সমাজ অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ অধিকারচ্যূত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাঁধিয়া তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য ইচ্ছুক হয়, তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে দাঁড় করাইয়া তাঁহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে—পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব—সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই গ্রহণ করিবে।

রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা
এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুরে। কলকাতায় ফিরেই তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে পড়ে শোনালেন। অন্য কিছু ব্যক্তিকেও তাঁর স্বদেশভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনার কথা জানালেন। চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা করেন।

প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন যে, চৈতন্য লাইব্রেরীর এই প্রবন্ধপাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়—কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি ও ইঁটপাটকেল ছোঁড়া কিছুই বাদ যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলে উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখক স্বদেশের পূজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন। কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।

যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধটিতে কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে জ্বর ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। একটি চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।

রাজনীতিতে বাঁক পরিবর্তনের লক্ষণ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে রাজনীতি আর পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতির একটি নূতন বাক পরিবর্তন ঘটছে। তিনি বলেন, দেশ যখন একদা জাগ্রত হইয়া ‘কনষ্টিটিউশনাল অ্যাজিটেশনে’র রেখা ধরিয়া রাজ্যেশ্বরের দ্বারের মুখে ছুটিয়াছিল, তখন সমস্ত শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিবেগ তাহার মধ্যে ছিল। আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে সেই স্রোতের পথ বাঁক লইবার উপক্রম করিতেছে।...যাঁহারা সাধনাদ্বারা, তপস্যাদ্বারা, ধীশক্তিদ্বারা ইংরেজশিক্ষিত সমাজের চিত্তকে স্বদেশের কার্যে চালিত করিয়াছেন, স্বদেশের কার্যে একাগ্র করিবার আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আমি ভক্তির সহিত নমস্কার করি। তাঁহারা যে পথে গিয়াছিলেন সে পথে যাত্রা যে ব্যর্থ হইয়াছে, এ আমি কখনোই বলিব না। তখন সমস্ত দেশের ঐক্যের মুখ রাজদ্বারেই ছিল।

...এখন সে চিরন্তন সমুদ্রের আহ্বান শুনিয়াছে—এখন সে আত্মশক্তি আত্মচেষ্টার পথে সার্থকতালাভের দিকে অনিবার্যবেগে চলিবে, কোনো-একটা বিশেষ মুষ্টিভিক্ষা বা প্রাসাদলাভের দিকে নহে। এই-যে পথের দিক-পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিতেছে ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের কৃতকর্ম নহে—যে চিত্তস্রোত প্রথমে এক দিকে পথ লইয়াছিল ইহা তাহারই কাজ, ইহা নূতন স্রোত নহে।

সভাভঙ্গের আগে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আরও কিছু কথা বলেন লিখিত বক্তব্যের বাইরে। বলেন, আজ সমবেত ব্যক্তিগণকে সমবেত ব্যক্তিগণকে সাহিত্যরস দেওয়ার জন্য আমি দাঁড়াই নাই। শুধু উদ্দীপনায় কোনো কাজই হয় না; আগুন জ্বালাইতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িও চড়াইতে হইবে।..আমরা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষুদ্রভাবে দেশের জন্য কাজ করিতে পারি। আমার প্রস্তাব—প্রত্যেকে নিজেদের গৃহে স্বদেশের জন্য যদি প্রত্যহ কিছু উৎসর্গ করিয়া রাখেন তবে ভবিষ্যতে সেই সঞ্চয় কাজে লাগিবে। তাহা ছাড়া উহা আমাদের একটা চেতনা প্রবুদ্ধ করিয়া রাখিবে। ...আমাদের স্বদেশ ভক্তিও যেন সেইরূপ কোনো সভা-সমিতির তাগিদের প্রতীক্ষা না করিয়া নীরবে আপন কার্য সমাপন করে। স্বদেশের কাজ যেন বৃহৎ বাহ্য অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।

রবীন্দ্রনাথের জনসংযোগ
প্রবন্ধপাঠের পরে তিনি কলকাতার বিদ্বজ্জনের কাছে এই বার্তা নিয়ে আলোচনা করতে ছুটে বেড়ালেন। ২৯ জুলাই সকাল সন্ধ্যায় দুবার গেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে, ৩০ জুলাই গেলেন বসুপাড়ায় সিস্টার নিবেদিতার কাছে, ১ আগস্ট গেলেন নারকেলডাঙায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, ২ আগস্ট শ্যামবাজার ও কর্ণওয়ালিস স্টিটে, ৪-৫ আগস্ট গিয়েছেন পার্শিবাগান, ৬ আগস্ট আবার কর্ণওয়ালিস স্টিটে গিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্বদেশী সমাজ গঠন। এছাড়া নিজেদের জোড়াসাঁকোতে প্রতিদিন নানাজন আসছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠিতে জানিয়েছেন, একটা সমাজ গঠনের জন্যে চেষ্টা চলছে।

স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রথম উদ্যোগ
অমল হোম অনুসন্ধান করে বের করেছেন-- স্বদেশী সমাজ গঠনের কিছু তথ্য পাওয়া যায় দি ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে। ছাপা হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে স্বদেশী সমাজের একটি খসড়া সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে—
আমরা স্থির করিয়াছি আমরা কয়েকজন মিলিয়া একটি সমাজ স্থপান করিব।

আমাদের নিজের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য অভাব মোচন ও কর্তব্য-সাধন আমরা নিজে করিব, আমাদের শাসনভার নিজে গ্রহণ করিব, যে-সকল কর্ম আমাদের স্বদেশীয়ের দ্বারা সাধ্য তাহার জন্য অন্যের সাহায্য লইব না। এই অভিপ্রায়ে আমাদের সমাজের বিধি আমাদের প্রত্যককে একান্ত বাধ্যভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথা করিলে সমাজবিহিত দণ্ড স্বীকার করিব।

সমাজের অধিনায়ক ও তাহার সহায়কারী সচিবগণকে তাঁহাদের সমাজনির্দিষ্ট অধিকার অনুসারের নির্বিচারে যথাযোগ্য সম্মান করিব।
বাঙালী মাত্রেই এ সমাজে যোগ দিতে পারিবেন।
সাধারণত ২১ বৎসরের নীচে কাহাকেও গ্রহণ করা হইবে না।

এ সভার সভ্যগণের নিম্নলিখিত বিষয়ে সম্মতি থাকা আবশ্যক:
১) আমাদের সমাজের ও সাধারণ ভারতবর্ষীয় সমাজের কোনো প্রকার সামাজিক বিধিব্যবস্থার জন্য আমরা গবর্নমেন্টের শরণাপন্ন হইব না।
২) ইচ্ছাপূর্বক আমরা বিলাতি পরিচ্ছদ ও বিলাতি দ্রব্যাদি ব্যবহার করিব না।
৩)কর্মের অনুরোধ ব্যতীত বাঙালীকে ইংরেজিতে পত্র লিখিব না।
৪) ক্রিয়াকর্মে ইংরেজী খানা, ইংরেজি সাজ, ইংরেজি বাদ্য, মদ্যসেবন এবং আড়ম্বরের উদ্দেশ্য ইংরেজ-নিমন্ত্রণ বন্ধ করিব। যদি বন্ধুত্ব বা অন্য বিশেষ কারণে ইংরেজ-নিমন্ত্রণ করি, তবে তাহাকে বাংলা রীতিতে খাওয়াইব।
৫) যতদিন না আমরা নিজেরা স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপন করি ততদিন যথাসাধ্য স্বদেশীচালিত বিদ্যালয়ে সন্তানদিগকে পড়াইব।
৬) সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কোনো প্রকার বিরোধ উপস্থিত হয় তবে আদালতে না গিয়া সর্বাগ্রে সমাজনির্দিষ্ট বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব।
৭)স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য ক্রয় করিব।
৮) পরস্পরের মধ্যে মতান্তর ঘটিলেও বাহিরের লোকের নিকট সমাজের বা সামাজিকের নিন্দাজনক কোনো কথা বলিব না।

এই দীর্ঘ সংবিধানে সমাজের কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি, এমন-কি কর প্রদানের ব্যবস্থাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সময়। একে আকাশকুসুম রচনা বলেছিলেন কেউ কেউ। ১১ আগস্ট সঞ্জীবনীতে একটি দীর্ঘ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় একজন শিক্ষিত লোকও রাজশক্তি, সমাজশক্তি ও আমাদের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারেন, এবং আকাশকুসুম রচনা করিয়া তাহারই পশ্চাতে ধাবিত হইবার জন্য আহ্বান করিতে পারেন, ইহা আশ্চর্যের বিষয়। বিশিষ্ট কংগ্রস নেতা পৃথ্বীশচন্দ্র রায় শ্রাবণ-সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক মতামতকে ‘দেশের পক্ষে বিশেষ অনিষ্টকর ও নানা দোষে দুষ্ট’ বলে সমালোচনা করেন। যতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই প্রবন্ধকে একটি সামাজিক কবিতা বলে উপহাস করেন।

এই স্বদেশী সমাজ গঠন কার্যক্রম আর এগোতে পারে নি। গোঁড়া হিন্দুসমাজী ও রাজনীতিকদের বিরোধিতার জন্যই সম্ভবত স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনার অপমৃত্যু ঘটে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।