রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : অষ্টাত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৫/২০১২ - ৬:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—৩

স্বদেশী সমাজের সঙ্গে বিপ্লবীদেরও সম্পর্ক হয়েছিল। এ বিষয়ে বিপ্লবী ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন—
অনুমান হয় ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে বারীন্দ্র প্রভৃতি কর্ম্মীদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে একটি পত্র লিখি যে, আমরা ভারতীয় সভার (কংগ্রস) সহযোগে কর্ম্ম করিতে প্রস্তুত নই। তাঁহার সহিত সংযুক্তভাবে কর্ম্ম করিতে চাই। ইহাতে তিনি তাঁহার দ্বারকানাথ ঠাকুর ষ্ট্রীটস্থ বাসায় আমাকে আহ্বান করেন এবং বলেন, ‘’আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত এই বিষয়ে কথা কও’’...।

ইহাতে সখারাম বাবু, দেবব্রত বাবু এবং আমি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বালিগঞ্জের বাড়ীতে যাই। তিনি বলিলেন, রবি বাবু আমায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইঁহারা কাহারা?’’ আমি সব কথা বলি। তিনি বলেন, তিনি বক্তৃতা এবং সাহিত্য দ্বারা কার্য্য করিবেন। ইহাতে সখারাম বাবু ব্যঙ্গ করেন—‘কবিতা লিখিয়া ভারতোদ্ধার হইবে না।‘’ পরে এই সহযোগিতার তাগাদার জন্য ব্যোমকেশ মুস্তফীর সহিত সাহিত্য-পরিষদ অফিসে...আমি সাক্ষাৎ করি। তিনি ‘স্বদেশী সমাজ’ পরিকল্পনা লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলিলেন এই কর্ম্মপদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণভাবে লিখিত হয় নাই। লিখিত কর্ম্মপদ্ধতির পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত প্রুফ তিনি তৎকালে দেখিতেছিলেন এবং বলিলেন, পরিকল্পনা পূর্ণভাবে তৈয়ারী হইলে পরীক্ষার জন্য একস্থলে তাহা বাস্তবিক কর্ম্মে পরিণত করার চেষ্টা হইবে।..পরে এই দলের কোন এক মিটিং-এ রবি বাবু আমাদের ডাকিয়াছিলেন। আমি তখন ‘ভবানী মন্দির’ পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে বিহারে প্রেরিত হইয়াছিলাম। প্রত্যাবর্তন করিয়া অন্নদা কবিরাজের কাছ হইতে ইহা শুনিলাম’ তিনি এই আহ্বানে এই সভায় গমন করিয়াছিলেন। সভায় নানাদল নানাকথা বলে, রবি বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনার কি মত’! কবিরাজ জবাব দেন, ‘আমরা তর্ক করিতে অক্ষম, কার্য্য দিন, করিতে প্রস্তুত।‘ রবি বাবু বলিলেন, ‘তাহা আমি জানি।‘

তবে এই কার্য্যক্রম আর না এগুলেও স্বদেশী বিপ্লবীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিছু যোগাযোগ ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গে তার গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পে তাঁদের কাউকে কাউকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

বেঙ্গলী পত্রিকার ৩ আগস্ট সংখ্যায় একটি খবরে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারে বিকেল পাঁচটায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে বিপিনচন্দ্র পাল বক্তব্য রাখবেন। বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন-- রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলেন সভায়। এই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে স্ট্যান্ডিং কমিটি হয় তাতে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, ঠাকুরবাড়ির জামাই স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল, মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাতিজা গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রাখা হয়নি। তিনি এই আন্দোলন থেকে প্রত্যক্ষভাবে একটু সরেই ছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, সম্ভবত ঝড়ের কেন্দ্রস্থলে না থেকে দূর থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিটি কবি বুঝে নিতে চাইছিলেন। তাঁর কৌশলটি হল—এভাবে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হবে।

ভাদ্র-সংখ্যা বঙ্গদর্শনে ‘স্ত্রীসমাজে’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মেয়েদেরকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন—জগতে স্ত্রীলোক যদি বা যুদ্ধ না করিয়া থাকে, ত্যাগ করিয়াছে; সময় উপস্থিত হইলে ভূষণ হইতে প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। ...আজ আমাদের বঙ্গদেশ রাজশক্তির নির্দয় আঘাতে বিক্ষত হইয়াছে, আজ বঙ্গ রমণীদের ত্যাগের দিন। আজ আমরা ব্রতগ্রহণ করিব। আজ আমরা পীড়িত জননীর রোগসজ্জায় বিলাতের সাজ পরিয়া শৌখিনতা করিতে যাইব না। বয়কট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর চিন্তার স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ ভাষণে। প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন টাউন হলে ২৫ আগস্ট। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ও বাঙ্গালীদের বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকে ক্ষতির দিক থেকে দেখেননি। তিনি দেখেছেন লাভের দিক থেকে। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজ উপনিবেশকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।

বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্যের সম্ভানা জেগেছে। এই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে স্বদেশী সমাজ গঠন করা যায় সে বিষয় ইতিপূর্বে তিনি পরিকল্পনা হাজির করেছিলেন। সেজন্য রাজনীতিকরা তাকে উপহাস করেছিলেন। সে উপহাসেও তিনি দমিত হননি। তিনি মনে করেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আঘাতের ফলে যে বাঁক বদলটি ঘটছে রাজনীতিতে—তাতে রাজনীতি কেবলমাত্র রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। রাজনীতি চলে আসতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের দরোজায়। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। পূর্বে রাজন্যবর্গ-শাসিত রাষ্ট্রে প্রজাসাধারণের কর দেওয়া ছাড়া শাসন ক্ষমতা নির্ধারণে কোনো ভূমিকাই ছিল না। তারা ছিল রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক—জড় পদার্থের ন্যায় ছিল তাদের অবস্থা। এখন তাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের সুযোগ এসেছে।

সুতরাং এই সময়ে কিছু কর্তব্যের তাড়নায় তিনি মুখর হয়েছেন। তাঁকে এর আগে যারা উপহাস করেছিলেন, তাদের উপহাসকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, স্বদেশের কর্মভার দেশের লোকের নিজেদের গ্রহণ করিবার চেষ্টা একটা পাগলামী নহে—বস্তুত দেশের হিতেচ্ছু ব্যক্তিদের এইরূপ চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। তিনি সেটাই করছেন।

বৃটিশ শাসকদের সমালোচনা--
রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ শাসনের কঠোর সমালোচনা করে তাদের শোষণ প্রক্রিয়াটি তুলে ধরেছেন অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ইহা আমরা স্পষ্টত দেখিয়াছি, যে-সকল জাতি ইংরেজের সঙ্গে বর্ণে ধর্মে প্রথায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাহাদিগকে ইহারা নিজের পার্শ্বে স্বচ্ছন্দ্যবিহারের স্থান দিয়াছেন এমন ইহাদের ইতিহাসে কোথাও নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজদের উপনিবেশের উদাহরণ দিয়েছেন—এশিয়ার লোকদের ইংরেজরা কোনো প্রকারেই আশ্রয় দেয় না। ব্যবসায় অথবা বসবাসের জন্য তাদেরকে ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না—যদি কেউ এশিয়ানদের ঘর ভাড়া দেয় তাহলে তাদের প্রতি ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হয়। এশিয়ীদের দোকান থেকে ইংরেজরা কিছু কেনে না। এদের দোকানে অন্য কাউকে কিনতে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। ইংলন্ডে সে সময়ে এশীয়ানদের কোনো আড্ডা গাড়তে দেওয়া হয় নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ইহা স্পষ্টত দেখা যায় যে, এশিয়াকে যুরোপ কেবলমাত্র পৃথক বলিয়া জ্ঞান করে না, তাহাকে হেয় বলিয়াই জানে। ...য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতা নিজেকে জাহির করা এবং বজায় রাখাই চরম কর্তব্য বলিয়া জানে। অন্যকে রক্ষা করা যদি তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খাইয়া যায় তবেই অন্যের পক্ষে বাঁচোয়া, যে অংশে লেশমাত্র খাপ না খাইবে সে অংশে দয়া-মায়া বাছ বিচার নাই।

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বাঙালি এক সময় জাহাজ তৈরি করতে দক্ষ ছিল। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরে সে বিদ্যা বিলুপ্ত করেছে। তারা একটি জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। একটি বিদেশী নয়—একটি বিদেশী জাতি বহুদূর থেকে বাঙালিকে শাসন করছে—শোষণ করছে। সুতরাং এই বিদেশী ইংরেজ শাসনকে শুধু অবিশ্বাস করলেই চলবে না---এদের প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাসের সূত্রটাকেও ছিন্ন করতে হবে।

এখন বৃটিশ রাজশক্তি এই পঙ্গুত্বকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করছে ঐক্যকে বিনষ্ট করার মধ্যে দিয়ে। ঐক্য এক মহাশক্তি। তারা জানে ঐক্য বিনষ্ট করা গেলে মহাশক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব। এভাবেই তাদের উপনিবেশিক শাসনক্ষমতা নিষ্কণ্টক থাকবে। ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্র নহে, পরন্তুও এমন একটা আনন্দ আছে যে, সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। এ কারণে ইংরেজ রাজ বাঙালির ঐক্যের বিনষ্টির জন্য যে কোনো অপকৌশল গ্রহণ করছে।

এ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ ‘আমাদের স্বদেশহিতকর সমস্ত চেষ্টাকে নিজের দিকে ফিরাইয়া আনা’টাই কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আমাদের অবিশ্বাসের মধ্যে এইটুকুই আমাদের লাভের বিষয়। তিনি বলেন, ইংরেজদের উপর ক্ষোভের কারণে নয়—আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদের ঐক্য দরকার। ক্ষোভের কারণে সৃষ্ট ঐক্য সীমিত সময়ের জন্য টেকে—কিন্তু নিজেদের হৃদয়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট ঐক্যের ক্ষমতা অসীম। সেই ঐক্য সৃজনশীল। তখন সেখানে বাইরের কোনো শক্তি প্রবেশ করতে পারে না।

বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকেও লাভের দিক থেকে দেখেছেন। বিলেতি দ্রব্যের বদলে দেশী দ্রব্য ব্যবহার শুরু করা গেলে দেশের প্রতি সত্যিকারের প্রেম অনুভব করা সম্ভব হবে। এবং এভাবে এদেশীয় শিল্পকাঠামো গড়ে উঠবে। দেশী দ্রব্য ব্যবহার করায় অভ্যস্থ হয়ে এভাবে ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের ব্যবসা হারাবে। তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ভিতও শক্তিশালী হবে।

তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে বঙ্গচ্ছেদের আক্ষেপে আমরা যথাসম্ভব বিলেতি জিনিস কেনা বন্ধ করিয়া দেশী জিনিস কিনিবার যে সংকল্প করিয়াছি সেই সংকল্পটিকে স্তব্ধভাবে, গভীরভাবে, স্থায়ী মঙ্গলের উপর স্থাপন করিতে হইবে। আমি আমাদের এই বর্তমান উদযোগটির সম্বন্ধে যদি আনন্দ অনুভব করি তবে তাহার কারণ এ নয় যে তাহাতে ইংরেজের ক্ষতি হইবে।

এদিন তিনি স্বদেশী সমাজের রূপরেখাটি আরও বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্মসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব—তাঁহাদের নিকটে নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব; তাহাদিগকে কর দান করিব, তাহাদের আদেশ পালন করিব, নির্বিচারে তাহাদের শাসন মানিয়া চলিব; তাহাদিগকে সম্মান করিয়া আমাদের দেশকে সম্মানিত করিব।
‘আমাদের নিজেদের দিকে যদি সম্পূর্ণ দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবে, এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না।...আমাদের কিছুতেই পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের যদি জন্মে তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজেদের চেষ্টা ছাড়া আর কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না’।

এই ভয়ের কারণটি তিনি নানাভাবে প্রত্যক্ষ এবং রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। সেটা সেই নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্গের মানুষের ভেদ, নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের ভেদ, এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের ভেদ এবং অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের ভেদের মধ্যে অবস্থান করছে।

এই দিনগুলোতে এই উত্তাল সময়ে বাউল সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন আমার সোনার বাংলা গানটি। গানটি কোলকাতায় মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।

১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয়—১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। ৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়-- যদি ১৬ অক্টোবর সতি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ৩দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।

এই দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে অবস্থান করছিলেন। গিরিডিও তৎকালীন বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ লাগে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেশীয় কোম্পানীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের শেয়ার কেনেন। বাঙালী মালিকাধীন একটি ব্যাংকে টাকা রাখেন। গিরিডিতে বসে তিনি এক মাসে বাউল সুরে ২১টি স্বদেশী সঙ্গীত লেখেন। তাঁর গান লেখার খবর পেয়ে কোলকাতায় স্বদেশী গান শেখানের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গানগুলি খেয়া কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।

স্বদেশী গানগুলির তালিকা—
১) ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, ২) মা কি তুই পরে দ্বারে পাঠাবি কি তোর ঘরের ছেলে, ৩) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা, ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে, ৬) যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু, ৭) তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, ৮) সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না, ১০) ওরে তোরা নেই বা কথা বললি, দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী, ১১) ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি, ১২) বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই, ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে, ১৪) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে, তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে, ১৫) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, ১৭) আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার, ১৮) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ১৯) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন কাটবে, ২০) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে, ২১) ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না। হবার যা নয় কোনোমতেই হবেই না সে, হতে দেব না।।

রাখি বন্ধন কর্মসূচি--
গিরিডি থেকে কোলকাতায় এসে ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাব রাখেন --১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব। দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজনীতিকরা ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করে।

রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রাখি-সঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল—পূণ্য হউক, পূণ্য হউক’ রচনা করেন। ৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন-- বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলো মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও দূরে সরাবে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন। তিনি লিখেছেন--হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।

আরেকটি প্রবন্ধ ‘বঙ্গবিচ্ছেদে’ লিখেছেন, এই ব্যবচ্ছেদের ফলে দেশবাসীর অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের বিশেষ ক্ষতি না হইলেও ইহাতে আমাদের একমাত্র যথার্থ অনিষ্ট এই যে, সমস্ত বাংলা দেশ এক শাসনাধীনে থাকিলে বাঙালির অন্তঃকরণে যে একটা ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত থাকে, নানাকারণে বাঙালির একত্রে মিলিবার যে বহুতর উপলক্ষ ঘটে, তাহা নষ্ট হইলে আমরা ভিতরে ভিতরে যে বল-লাভের পথে চলিতেছিলাম, তাহাতে বাধা পড়িবে। তবে এই বঙ্গবিচ্ছেদ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে--তাতে রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন পার্টিশন আমাদের ক্ষতি করবে না। সকলের মধ্যে একটা প্রাণশক্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই বঙ্গ ভাগ হলেও বাঙালির কিছু ক্ষতি হবে না। কারণ এই প্রাণশক্তি পার্টিশনের উপর জয়ী হবে—এই আশা থাকবে। মিলনে-বিরহে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, সুবিধা-অসুবিধ বাঙালি ঐক্য অনুভব করবে।


মন্তব্য

আশরাফুল কবীর এর ছবি

#অনেক দারুন এবং প্রচন্ড ধীসম্পন্ন লেখা। প্রচন্ড পরিশ্রমের ফসল বোঝাই যায় প্রিয় কুলদা রায়। ভালবাসা ও অভিনন্দন নিন।

>বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আপনার বিশ্লেষনটি খুব খুব ভাল লেগেছে, এটা জানার পরেও দেশের বিশেষ শ্রেনীর কিছু লোক ক্রমাগত রবীন্দ্রনাথকে দোষারোপ করে চলে, যা খুব পীড়াদায়ক, আপনি সুন্দরভাবে তা বিশ্লেষন করেছেন, আবারো ধন্যবাদ আপনাকে।

>লেখা নিয়ে আসলে বলার কিছু নেই, শুরু থেকে পড়া শুরু করলাম এবং বুঝতে পারলাম আসলে ভাল লেখা একেই বোঝায়।

#ভাল থাকুন সবসময়, এ প্রত্যাশায় উত্তম জাঝা!

কুলদা রায় এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
বঙ্গভঙ্গ খণ্ডটি আরও তিনটি পর্বে যাবে। এরপর আবার পূর্ববঙ্গে জমিদারীতে ফিরে যাব।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

তথ্যবহুল এবং সুখপাঠ্য।
ঈয়াসীন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।