রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ঊনচত্বারিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৭/০৫/২০১২ - ৩:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—৪

বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৯০৫ সালের ৪ জুলাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করায় আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি ত্যাগ করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয় ৭ আগস্ট টাউন হলের একটি সভায়। প্রত্যেক জেলার বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধি, ছাত্র-জনতা এ সভায় উপস্থিত ছিল। সেখানে নরেন্দ্রনাথ সেন বিলেতি-বর্জন বা বয়কট প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বয়কট ঘোষণার পর বৃহত্তর বঙ্গের সর্বত্র শত শত সভায় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও বিলেতি বর্জনের শপথ গৃহীত হয়। বহু তরুণ ছাত্র দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। দূর গ্রামে মাথায় করে দেশীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে ভারতের ইংরেজ বনিকরাও কিছু অসুবিধা আশঙ্কা করে প্রথমে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল। বয়কট ঘোষণা হওয়ার হওয়ার পরে তারা প্রস্তাবটির পক্ষে চলে যায়। দেশি কাপড়ের তুলনায় বিলেতি কাপড়ের দাম কম ছিল। বিলেতি কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরীব মানুষের অসুবিধা হয়ে যায়। কোথাও কোথাও বিলেতি দ্রব্য বিক্রিতে জোর জবরদস্তি করা হয়। এরই কারণে ফরিদপুর ২৬ আগস্ট ফরিদপুরে ছোটো খাটো দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে উপন্যাসে এইরকম একটা ঘটনা লিখেছেন। সেখানে শিক্ষিত প্রজাহিতৈষী জমিদার নিখিলেশের কাছে এক গ্রামীণ খুদে কাপড় ব্যবসায়ীকে নিয়ে এসেছেন মাস্টার মশায়। তার নাম পঞ্চু। ঘরে বাইরে থেকে পড়া যাক--

মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?

ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে এক-শো টাকা জরিমানা করেছে।

কেন, ওর অপরাধ কী?

ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলো বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনো করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলো পুড়িয়ে ফেল্‌, তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তো সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব ; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে— লাগাও জুতি। এই বলে এক চোট অপমান তো হয়েই গেল, তার পরে এক-শ টাকা জরিমানা।

সেনাপতি লর্ড কিচেনের সঙ্গে কার্জনের মতভেদ হওয়ায় কার্জন পদত্যাগ করেন। তার স্থলে লর্ড মিন্টোর নিয়োগ হয়। মিন্টো তখন ছিলেন কানাডায়। তার আসতে দেরী হওয়ার সুযোগ নিয়ে কার্জন সিমলা থেকে ঘোষণা জারি করে বসেন, ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে। নবগঠিত প্রদেশ আসাম ও পূর্ব বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত হলেন কার্জনের চেয়েও পাষণ্ড শাসক ব্যামফিল্ড ফুলার। অ্যান্ড্রু ফ্রেজার পুনর্গঠিত বাংলা প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর থাকেন।

বঙ্গভঙ্গের এই খবরগুলো সে সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো কালো বর্ডার দিয়ে প্রকাশ করছিল। শোকচিহ্ণের প্রতীক হিসাবে এই কালো বর্ডার দিয়ে খবর প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সম্পাদকগণ। বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতেও কালো পেড়ে কাগজ বা কালো খাম ব্যবহারের চল হচ্ছিল। এটা বিদেশী প্রথা। শোকের দেশী চিহ্ণ হল সাদা—শ্বেত শুভ্র। প্রাচীনকাল থেকে এই সাদা রং বাঙালির শোককে শুভ্রতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করছে। রবীন্দ্রনাথ শোকচিহ্ণ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন সাদা শুভ্রতায় ফিরে আসতে। তিনি লিখেছিলেন, এই (কালো) চিহ্ণ ব্যবহার করে কলঙ্ক বাড়িও না। আমাদের শোক আজি শুভ্র হউক, সংযত হউক, নিরাভরণ হউক—কঠোর ব্রত দ্বারা তাহা আপনাকে সফল করুক, অনাবশ্যক অনুকরণের দ্বারা তাহা দেশে বিদেশে আপনার কৃষ্ণাশ্রুরেখাকে হাস্য করিয়া না তুলুক।

শোকচিহ্ণের মতো করতালি দেওয়ার প্রথাকেও বিদেশী বলে বাতিলের প্রস্তাব করেন কবি। তিনি করতালি প্রবন্ধে লিখেছেন, এরূপ উৎকট উপায়ে মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা হয় না, কারণ, সম্মান করিবার উপায় কখনোই অসংযত হইতে পারে না। আমাদের দেশে করতালি চিরকাল অপমানের উদ্দেশ্যই ব্যবহার করা হইয়াছে-বস্তুত তাহাই সঙ্গত—কারণ, অসংযমের দ্বারাই অপমান করা যায়। তাই চিৎকার-রব দুয়ো বা সশব্দে করতালি দেওযা অপমানের উপায়। অপরপক্ষে যিনি আমাদের সম্মানের যোগ্য, তাঁহার কাছে আমরা আত্মসম্বরণ করিয়া থাকি। কবি মান্য ব্যক্তিকে সাধু সাধু বলার প্রস্তাব করেন।

উৎসাহ উদ্দীপনার আতিসাহ্যে জনপ্রিয় লোককে ঘাড়ে তুলে নেওয়া হয়। আবার কখনো টেনে নেয় ভক্তবৃন্দ—এই প্রথাকেও অপমানজনক বিদেশী অনুকরণ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।

সে সময়ে কোলকাতার অনেকগুলো থিয়েটার ছিল। তাদের নাম ছিল ইংরেজিতে—স্টার, ক্লাসিক, গ্রান্ড, য়ুনিক। এগুলোর মালিক কিন্তু বাঙালি। থিয়েটারগুলোর ইংরেজি নামের বদলে বাংলা নাম রাখতে এই মালিকদের প্রতি কবি অনুরোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বর্তমানে এমন একটি সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে যখন এই নাট্যাশালাগুলির পক্ষে বিলাতি নাম বিলেতি পোষাকের মত ছাড়িয়া ফেলাটা লোকের চক্ষে আকস্মিক ও অপ্রাসাঙ্গিক বলিয়া ঠেকিবে না। বরঞ্চ তাহা আমাদের দেশের বর্তমান হৃদয় ভাবের সহিত মিশ খাইয়া আমাদের স্বদেশ প্রেমের আনন্দোচ্ছ্বাসে নূতন তরঙ্গ তুলিবে।
তাঁর ইচ্ছে জেগেছিল স্বদেশী ভাবধারা জনগনের মধ্যে প্রচারের জন্য স্বদেশী ভিক্ষুসম্প্রদায় গড়ে উঠুক। তিনি লিখেছেন---যে সকল ভিক্ষুক নাম গান করিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করে—তাহারা যাহা পায় তাহার চেয়ে অনেক বেশি দেয়—তাহারা দেশের চিত্ত আকাশ হইতে প্রত্যহ কলুষ মোচন করিয়া, তাহাকে মধুময় করিয়া তুলিতেছে। কর্ম্মের ঘোরতর আন্দোলনের মধ্যেও তাহারা জীবনের চরম লক্ষ্যকে স্মরণ করাইয়া সংসারের কত আবর্জনা দূর করিতেছে তাহার হিসাব লওয়া শক্ত। এই রূপে যে সম্প্রদায় স্বার্থনিরত লোকদিগকে প্রত্যহ স্বদেশী কর্তব্য স্মরণ করাইয়া বেড়াইবেন—স্বদেশের স্বরূপকে অন্যমনস্কের মনে জাগ্রত করিয়া রাখিবেন, স্বদেশের প্রতি প্রেমকে প্রত্যহ সুরে তানে দেশের পথে ঘাটে উদ্বোধিত করিয়া তুলিবেন তাহারা এই মহৎ কর্তব্য সাধনের দ্বারা যদি জীবিকা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইতে পরেন তবে তাহাতে লজ্জার বিষয় নাই।

স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে কোলকাতায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই রকম বৈতালিক গোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল। তারা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতেন। তখন পানওয়ালা বিড়িওয়ালা পর্যন্ত টাকা পয়সা দিত। সংগৃহীত এই চাঁদা জাতীয় অর্থভাণ্ডারে জমা দেওয়া হত।

উদ্বোধন নামে প্রবন্ধে কবি নারীদের উদ্দেশ্যে লেখেন, তোমরা—যাহারা আজ বিশ্ববঙ্গের বেদনায় ব্যথা পাইয়াছ, চক্ষু বিশ্ববঙ্গের মিলনাবেগে গৌরব অনুভব করিতেছ, তোমরা আজ সকলে প্রস্তুত হইয়া এস,--তোমাদের দুটি চক্ষু হইতে বিদেশী হাটের মোহাঞ্জন আজ চোখের জলে একেবারে ধুইয়া মুছিয়া এস—যে বিদেশের অলঙ্কার তোমাদের অঙ্গকে সোনার শৃঙ্খলে আপাদমস্তক বন্দি করিয়া রাখিয়াছে, তাহা আজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া এস, আজ তোমাদের যে সজ্জা তাহার প্রীতির সজ্জা হউক, মঙ্গলের সজ্জা হউক, তাহাতে বিদেশের রেশম-পশম-লেস-ফিতার জাল-জালিয়াতি অপেক্ষা তোমাদিগকে অনেক বেশি মানাইবে।

রবীন্দ্রনাথ ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরীর সভায় রাখীবন্ধনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। জনসাধারণ উৎসাহের সঙ্গে রাখীবন্ধন কর্মসূচিটি গ্রহণ করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় রাখী সংক্রান্ত ব্যবস্থা নামে একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল—

দিন। এই বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ১৬ অক্টোবর

আগামী বৎসর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।

ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত।

নিয়ম। উক্ত সময়ে সংযম পালন।

উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সুতার রাখী।

মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।

অনুষ্ঠান। উচ্চ নিচ হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই হাতে রাখী বাঁধা, অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে অথবা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সেদিন কোলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ৩০ শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখী বন্ধন করিল। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিস এবং কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, একজন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।

দুপুর সাড়ে তিনটার সময় ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে ফেডারেশন হল ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটির বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছিলেন। সভার শেষে সেই বিশাল জনতা পায়ে হেটে সার্কলার রোড ধরে বাগবাজারে চলে যায়। ঐ মিছিলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। মিছিলে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশী সঙ্গীত গীত হচ্ছিল।

এর আগে ১২ অক্টোবরে ময়মনসিংহের মহারাজার বাড়িতে একটি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল—১৬ আক্টোবর জাতীয় অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। সে টাকা দিয়ে একটি তুলার কারখানা গড়ে তোলা হবে। জনসাধারণকে অনুরোধ করা হবে তারা যেন অন্তত এক দিনের আয় এই ভাণ্ডারে দান করেন। ১৬ অক্টোবর পশুপতিনাথ বসুর বাড়ির আঙিনায় অনুষ্ঠিত সভায় অর্থসংগ্রহ সভায় উপস্থিত মতে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ১০০ টাকা।

বঙ্গবঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এই প্রথম পর্যায়ের প্রদান ৩টি কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল।

১) বিলেতি ভোগ্যপণ্য বয়কট।

২) স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং এই উপলক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার স্থাপন।

৩) মিছিল, বক্তৃতা ও লেখালেখি।

প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন, এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ৫টি সভায় যোগ দিয়েছেন, ২টি সভায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। ১টিতে সভাপতিত্ব ও মৌখিক ভাষণ দিয়েছেন। একটিতে ঘোষণাপত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছেন। একটি সভায় শুধু উপস্থিত ছিলেন। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল অন্যদের চেয়ে কম। তবে ভাণ্ডার ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ মোটেই কম নয়। এইসব লেখালেখির মাধ্যমে তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়েছেন—

১) বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা।

২) ভিতর থেকে ঐক্য গড়ে তোলা গেলে সে ঐক্য বাইরে কোনো শক্তি ভাঙতে পারে না।

৩) ইংরেজদের উপর রাগ করে নয়—দেশকে ভালোবেসে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা দরকার।

৪) দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিলেতি ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে হবে। এই ত্যাগের মধ্যেকার ইতাবাচক বা ভাবগত দিকটিকেই জোর দিয়েছেন।

৫) সহজ পরিচিত সুরের মাধ্যমে রচিত গানগুলো মাধ্যমে দেশজননীর একটি সৌন্দর্য্যময়ী কল্পমূর্তি রচনা করেছেন। এ-গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন। এবং একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতি হিসাবে পরিণত করার চেষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ করেছেন।

৬) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের জন্য মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রকৃতি
বঙ্গভঙ্গ থেকে কয়েকটি ধারায় আন্দোলন শুরু হয় বঙ্গে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে 'স্বরাজ' শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট। এই পুরো আন্দোলনটিকেই স্বদেশী আন্দোলন হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়।

ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে 'স্বদেশ বান্ধব', ময়মনসিংহে 'সুহৃদ' ও 'সাধনা', ফরিদপুরে 'ব্রতী' আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার 'অনুশীলন' সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়।কলকাতায় গড়ে ওঠে 'যুগান্তর' নামে আরেক সংগঠন।এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।


মন্তব্য

কিশলয় এর ছবি

যাক, অন্তত উনচত্বারিংশ এর মত বিদঘুটে শব্দ তো শিখতে পারলাম।
সামান্য জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
চালান।

কুলদা রায় এর ছবি

আমিও এই প্রথম শিখেছি এই শব্দটি। আগে জানতাম না।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

আশরাফুল কবীর এর ছবি

>আমি অনেকগুলো বই পড়েছি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, এরকম বিশ্লেষনী লেখা খুব কম জনই লিখতে পেরেছেন, অনেক অনেক কনগ্রাচুলেশন্স আপনাকে।।।।।

>আমি পড়া শুরু করেছি বেশ কয়েকটি পর্ব আগে থেকে, মন্তব্য করা শুরু করেছি গত পর্ব থেকে, আসলে সচলে লেখালেখি শুরু করার সময় থেকেই দেখে আসছি এ দুর্ধর্ষ পোষ্ট। ইচ্ছে আসে আগের সব কটা পর্ব পড়ে মন্তব্য করার। আবারো অভিনন্দন আপনাকে।

>এ পর্যন্ত অসংখ্য লোকের সাথে এ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি, কট্ররপন্থি অনেকেই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সুবিধাবাদী, কিন্তু সৌমিত্র শেখরের পোষ্ট পড়েই ভাল লেগেছিল আর এখন সেখানে পেলাম আপনার পোষ্ট।।।।একসিলেন্ট, ব্রাভো।

>নিয়মিত লিখতে না পারলেও পাঠক হিসেবে আপনার বিপরীতে আছি, ভালবাসা সর্বক্ষণ বাঘের বাচ্চা

কুলদা রায় এর ছবি

এই সিরিজ লেখাটায় আসলে রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে নানা বইপত্তর খুঁজে খুঁজে দেখা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে মুল লেখাটাতেই রেফারেন্স দেওয়ার। তবে প্রতিটি খণ্ডেই রেফারেন্সগুলো দেওয়া হবে।
এই অনুসন্ধানের দেখা যাচ্ছে--রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলোই সবচেয়ে বড়ো প্রামাণিক দলিল--তাঁর বিরোধিতার স্বরূপ অন্বেষণায়।
আমরা আরেকটি দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করছি--মূল বিষয়গুলি তারিখ ধরে ধরে আগানো। এটা খসড়া পর্যায়ে পাবলিশ করা হচ্ছে। পুরোটাই এডিট করা হবে। তখন হয়তো নতুন করেই টেক্সট নির্মিত হবে।
সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।