কৃষি-উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৬/০৮/২০১২ - ২:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেন না। বাবা দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল তাঁকেও বিলেতে পাঠাবেন। তিনি যাননি। দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। পাশ করেছিলেন আইসিএস। হয়েছিলেন বিচারক। দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকেও ব্যারিস্টার করতে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ব্যারিস্টারি পড়ে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-দর্শন-সমাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে কবি হয়ে ফিরে এসেছিলেন।

সেকালে উচ্চবিত্ত পরিবারের দস্তুরই ছিল ছেলেকে বিলেতে পাঠিয়ে ব্যারিস্টারী পড়তে পাঠানো। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। তবে ব্যারিস্টারী পড়তে নয়—কৃষিবিদ্যা পড়াতে। সেকালে এই বিদ্যাটি কেউ বিলেতে পড়তে গিয়েছেন এরকম ঘটনা খুঁজে পাওয়া ভার। ঠাকুর পরিবারের কেউ কৃষিজীবী ছিলেন না। কৃষিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার লক্ষণ কারও মধ্যে ছিল না। তৎকালীন বঙ্গে কৃষিকে পেশা হিসেবে নিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব এরকম ভাবনা কোনো উচ্চবিত্ত পরিবার করতেন না। সেক্ষেত্রে একমাত্র ছেলেকে কৃষি বিষয়ে পড়তে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি সহজ কোনো ভাবনা থেকে আসার কথা নয়। তাহলে এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল।
১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা যান। পিতৃস্মৃতিতে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বাবা জানতে পেলেন যে, বিজ্ঞান ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে বাঙ্গালী ছাত্র পাঠাবার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি শিক্ষার্থীর দল কিছুদিনের মধ্যে জাপান ও আমেরিকা পাঠানো হচ্ছে। সন্তোষ ও আমাকে বলে দিলেন এই দলের সঙ্গে যোগ দিতে। আমাদের গন্তব্য হবে আমারিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কৃষি ও পশুপালন-বিদ্যা দেবার ব্যবস্থা আছে।

এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল Association for the Advancement of Industrial and Scientific Education. রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেছেন সন্তোষচন্দ্র মজুমদার। তিনি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছেলে। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথই শ্রীশচন্দ্রকে রাজী করিয়েছেন । রথীন্দ্রনাথ পড়বেন কৃষি –বিদ্যা। সন্তোষ পড়বেন পশুপালন-বিদ্যা। দুজনের টিকেটের ব্যয়ভার ঠাকুর এস্টেট থেকে বহন করা হয়েছিল।

১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকা থেকে রথীন্দ্রনাথ বাবাকে কৃষি গবেষণার জন্য জমি নির্বাচন করতে অনুরোধ করেছিলেন। ২৫ অক্টোবর শ্রীশচন্দ্রকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রথীদের গত সপ্তাহের পত্রে তাহারা এইবেলা জমী সংগ্রহের কথা বলিয়াছে। তাহাদের ইচ্ছা, যেখানে তাহাদিগকে চাষ করিতে হইবে সেখানকার মাটির নমুণা লইয়া তাহাদের কলেজ Laboratory-তে analysis করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে এবং সেখানকার সমস্ত প্রাকৃতিক বিবরণ জানিয়া অধ্যাপকদের সহিত পরামর্শ করিয়া আসে। ... কিন্তু ছোটো নাগপুরে কর্ড লাইনের ধারে কি জমী পাইবার কোনো আশা নাই? তোমাদের হাজারিবাগের কর্তারা বোধহয় তাঁহাদের এলাকায় আমাদিগকে কোনোমতেই প্রবেশ করিতে দিবেন না। সেইজন্য সেবার অত শশব্যস্ত হইয়া আমাদের সহায়তা করিতে আসিয়াছিলেন।
সেখানে জমি পাওয়ার আশা নেই দেখেই ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে জমি খুঁজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও গবেষণার জন্য কৃষি জমি পাওয়া যায়নি।

এ সময়ে ছোট মেয়ে মীরাদেবীর বিয়ের পাত্র হিসেবে কবি বরিশালের ব্রাহ্ম পরিবারের নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকে মনোনীত করেন। নগেন্দ্রনাথের দাবি ছিল তাঁকে বিদেশে পড়াশুনার খরচ দিয়ে পাঠাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এই ছোট জামাইকেও আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যায় বিএসসি পড়তে রথীর কাছেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, নগেন্দ্রনাথকে বিবাহের পরে আমেরিকায় রথীদের কাছে কৃষিবিদ্যা শিখিতেই পাঠাইব। ফিরিয়া আসিলে রথীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজে যোগ দিতে পারিবে।

এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ পুর্ববঙ্গে তাঁদের জমিদারী এলাকায় গ্রাম-পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলেন। এ কাজে কিছু স্বদেশী আন্দোলন ফেরত যুবককে কাজে লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে ভুপেন্দ্রনাথ অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে ১৯০৭ সালের ১৪ জানুয়ারী শান্তিনিকেতনের শিক্ষক আজিত চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লিখেছেন, এখানকার গ্রাম সম্বন্ধে আমি যে-সব কথা ভাবছি তা এখন কাজে লাগানোর সময় হয়নি—এখন কেবল মাত্র অবস্থাটা জানার চেষ্টা করছি।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে কৃষি-জরিপের কাজ দিয়েছেন ভূপেন্দ্রনাথকে। এই সব জরিপ তথ্য বিশ্লেষণ করে এলাকার কৃষি ও কৃষকের সমস্যা নিরুপন করবেন। তারপর সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। ওই চিঠিতে কবি আরো লিখেছেন, আমি যে গ্রামে গ্রামে যথার্থভাবে স্বারাজ-স্থাপন করতে চাই—সমস্ত দেশে যা হওয়া উচিত ঠিক তারই ছোটো প্রতিকৃতি—খুব শক্ত কাজ অথচ না হলে নয়। অনেক ত্যাগের আবশ্যক—সেইজন্য মনকে প্রুস্তুত করচি—রথীকে আমি এই কাজেই লাগাব—তাঁকেও ত্যাগের জন্য ও কর্ম্মের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিজের বন্ধনমোচন করতে না পারলে আর কাউকে মুক্ত করতে পারব না।
রথীন্দ্রনাথ-নগেন্দ্রনাথকে আমেরিকায় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ—‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ—ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে হলেই যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলেই ক্ষতিপুরণ হলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষিদেরটাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের এই ঋণ সম্পুর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল—নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।‘

১৯০৯ সালে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে বি.এস.সি ডিগ্রী অর্জন করলেন রথীন্দ্রনাথ।। রবীন্দ্রনাথ তাকে ইউরোপে পাঠিয়ে দিলেন কৃষি বিষয়ক গবেষণাগার পরিদর্শনের জন্য। ৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তার জামাতা নগেন্দ্রনাথকে লিখেছেন—‘রথী আসিয়াছেন। তাহাকে এখন কিছুদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া ব্যস্ত থাকিতে হইবে। তাহাকে কাজকর্ম্মের ব্যবস্থাও করিয়া দিবার চিন্তা করিতে হইতেছে।‘

অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথের উইল অনুসারে ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ল কালিগ্রাম পরগণা। বিরহামপুর পরগণা বা শিলাইদহ এলাকাটি দুই দাদা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তা পরিচালনার জন্য তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে লীজ দিয়েছেন।

১৯০৯ সালের ১৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে জল্পথে শিলাইদুহে রওনা করলেন। সেখান থেকে গেলেন পতিসরে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘ (বিদেশ) থেকে ফিরে আসার অল্প কিছু পরেই বাবা আমায় নিয়ে বেরলেন জমিদারি অঞ্চলে—উদ্দেশ্য, প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাত আলাপ ও পরিচয় হবে ও সেই সঙ্গে জমিদারির কাজকর্ম আমি তাঁর কাছ থেকে বুঝে নেব। সে এক অপুর্ব অভিজ্ঞতা। হাউসবোটে কেবল বাবা আর আমি। বার বার মৃত্যুশোকের আঘাতে, বিশেষ করে শমী (ছোট ছেলে) চলে যাওয়ায় তাঁর মনে গভীর বেদনা, তিনি নিতান্ত একাকী। দীর্ঘকাল প্রবাসের পরে আমি ফিরে এসেছি। সুতরং তাঁর হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ-ভালবাসা তিনি যেন উজাড় করে ঢেলে দিলেন। অনেক দিনের চেনাজানা নদীর বুকে আমরা দুজন ভেসে চলেছি। প্রতি সন্ধ্যায় ডেকে বসে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। এর আগে এমন মন খুলে বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ কখনো পাইনি। স্বভাবত আমি মুখচোরা মানুষ, প্রথম প্রথম একটু বাধো-বাধো ঠেকত। সদ্য কলেজ-পাস-করা ছোকরার মখে কৃষিবিদ্যা, সৌজাত্যবিদ্যা, অভিব্যক্তিবাদ প্রভৃতি নানা বিষয়ে ধার করা কেতাবি মতামত শুনে বাবা নিশ্চয়ই কৌতুক অনুভব করতেন। অধিকাংশ সময় তিনি চুপ করে থাকতেন ও আমার মুখের বাঁধা বুলি ধৈর্য্য সহকারে শুনে যেতেন। মাঝে মাঝে যখন তিনি নিজে কিছু বলতেন, তাঁর বিষয় হত দেশের প্রজাসাধারণের সামাজিক ও আর্থিক দুরাবস্থা এবং তার প্রতিকারকল্পে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।

রবীন্দ্রনাথ তার জামাতা নগেন্দ্রনাথকেও এই গ্রামোন্নয়ন কাজে নিয়োগ করতে চাইলেন। ১৯১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারী জামাতাকে চিঠিতে লিখেছেন—দেশের নিন্মশ্রেণীর লোকদের উন্নতি বিধান করাই এখন যথার্থ আমাদের কাজ। ... রথীর কাজে তুমি যদি সহযোগী হতে চাও তাহলে ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। চাষাদের সঙ্গে co-operation-এ চাষ করা, ব্যাঙ্ক করা, ওদের স্বাস্থ্যকর বাসস্থান স্থাপন করা, ঋণমোচন করা, ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান করে দেওয়া, রাস্তা করা, বাঁধ বেঁধে দেওয়া, জলকষ্ট দূর করা, পরস্পরকে পরস্পরের সহায়তা সূত্রে আবদ্ধ করা এমন কত কাজ তার সীমা নেই। এক জায়গায় যদি আমরা এই রকম আদর্শপল্লী স্থাপনে কৃতকার্য হতে পারি তবে দেশের পক্ষে তার চেয়ে লাভের আর কিছুই হতে পারে না।

পিতার উৎসাহে রথীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির পাশেই কিছু খাস জমি নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থায় আদর্শ কৃষি খামার গড়ে তোলেন। পিতৃস্মৃতিতে এর বিবরণ লিখেছেন রথীন্দ্রনাথ -আমেরিকা থেকে চাষ-আবাদের কয়েকটি যন্ত্রপাতি আনিয়ে সেখানে তার পরীক্ষা চলতে লাগল। চাষিরা ধান ছাড়া অন্যফসলের চাষ তেমন করে না দেখে ঐ অঞ্চলে Rotation করে দু-একটা money crops করা যায় কিনা তার পরীক্ষা হতে লাগল। আমেরিকা থেকে ভালো ভুট্টার বীজ আনালুম। চাষিদের আলু ও ট্রাকটর চাষ শেখানো হল। শিলাইদহের দোঁআশলা মাটিতে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় কি কি খাদ্যসামগ্রীর অভাব তা জানবার জন্য ছোটোখাটো একটা রাসায়নিক ল্যাবরেটরী গড়ে তুললুম। চাষিদের মধ্যে ক্রমশ উৎসাহ-ও দেখা গেল।‘’

শস্যক্রম হল একই জমিতে বছরের গ্রীষ্ম (আউস)- বর্ষা (আমন)- শীত (রবি) মৌসুম অনুসরণ করে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা। যেমন আমন ধান কাটার পরে শীতকালের ফসল হিসেবে ভুট্টা, আলু, ডাল ফসলের চাষ করা যায়। আবার কোনো জমিতে সরিষা, শাকসবজির আবাদ সম্ভব। এভাবে শুধু ধান ফসলের পরিবর্তে একই জমিতে বহু ফসলের চাষের সুযোগ সৃষ্টি করা হল। পাশাপাশি কৃষকের আয় বাড়ার সূচনা হল। বহু ফসল চাষে মাটির উর্বতাও বেড়ে গেল।
মাটিতে সারের অভাব মেটানোর জন্য জৈব সার তৈরি শুরু করলেন রথীন্দ্রনাথ। জেলেদের কাছ থেকে উদবৃত্ত ইলিশ মাছ কিনে তাতে চুন মাখিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। বছরখানেক পরে এটা উৎকৃষ্ট জৈব সারে পরিণত হয়েছে। এভাবেই চাষিদের মাছের সার ব্যাবহার শিখিয়েছেন।

পতিসর মাটি ছিল শিলাইদহ থেকে অনুর্বর। এখানে একফসলি জমির পরিমাণই বেশি। শুকনো মৌসুমে মাটি এঁটেল বলে কঠিন হয়ে যায়। ফলে সে সময়ে লাঙ্গল বসানো কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানে রবি বা শীতকালীন ফসলের চাষ সম্ভব হয় না। এমন কি গাছপালাই জন্মায় না। এই সমস্যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন। গ্রামকর্মী ভুপেশচন্দ্র রায়কে তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, ‘প্রজাদের বাস্তুবাড়ি ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেঁজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উৎসাহিত করিও। আনারস পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্যও। শিমুল আঙুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে। অবশ্য তাহাতে জলসেচন আবশ্যক করে। এইজন্য প্রত্যেকে যদি নিজের ভিটায় দুই কাঠাও বপন করে তবে তাহার জলসেচন নিতান্ত অসাধ্য হয় না, কাছারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে।

এই চিঠি থেকে রথীন্দ্রনাথ পতিসরের ফসল চাষের সমস্যার সমাধান পেয়েছিলেন। এছাড়া পতিত-অনুর্বর জমিকে কাজে লাগাবার কথাও ভেবেছেন। রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছেন—‘যদু সরকার (বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও অধ্যাপক) এসেছেন—তিনি আমাকে বলছিলেন, গয়ায় খানিকটা জমিতে ফসল হত না বলে পড়েছিল—শিবপুরের একজন ছাত্র মাটি পরীক্ষা করে সেখানে খেঁসারির ডাল চাষ করাতে প্রচুর খেঁসারি হয়েছে—এখন তার চারিপাশে চাষারা তাদের পতিত খারাপ জমিতে খেঁসারি দিয়ে খুব লাভ করচে—তোদের ওখানে জমির তো ভাবনা নেই—খারাপ জমি উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। যেখানে জলের অত্যন্ত অভাব সেখানকার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার কি একটা গাছ লাগিয়ে ভারতবর্ষে কোথাও কোথাও বিশেষ ফল পাওয়া গেছে—সেই গাছ গোরুর খাদ্য।‘

এই সময়কালে রবীন্দ্রনাথের জামাতা নগেন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে কৃষিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রী শেষ করে ফিরেছিলেন। তার সঙ্গে অহিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা dairy farming শেখা এক যুবকও এসেছিলেন। কবি চেয়েছিলেন তাকে দিয়ে এখানে গবাদিপশুর খাদ্য ও শাকসবজির খামার গড়ে তুলবেন। এ জন্য জমিও খোঁজাও হয়েছিল।

চাষের সুবিধার্থে রথীন্দ্রনাথ ট্রাক্টরও কিনেছিলেন। সেটা ভাড়া নেওয়ার জন্য চাষিদের উৎসাহের অন্ত ছিল না। বর্ষা মৌসুমে কৃষকগণ বেকার হয়ে পড়ে। তাদেরকে রবীন্দ্রনাথ কুটির শিল্প শেখাতে নির্দেশ দিয়েছেন। স্থাপন করেছেন উন্নত বয়ন স্কুল। তিনি লিখেছেন, বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলচে-সেইরকম একটা কল এখানে (পতিসরে) আনাতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। এ দেশ ধানেরই দেশ—বোলপুরের চেয়ে অনেক বেশি ধান এখানে জন্মায়।।..এই কলের সন্ধান করিস। তারপরে এখানকার চাষিদের কোন Industry শেখানো যেতে পারে সেই কথাই ভাবছিলুম। এখানে ধান ছাড়া আর কিছুই জন্মায় না—এদের থাকবার মধ্যে কেবল শক্ত এঁটেল মাটি আছে। আমি জানতে চাই Pottery জিনিসটাকে Cottage Industry রূপে গণ্য করা চলে কিনা। একবার খবর নিয়ে দেখিস—অর্থাৎ ছোটখাটো –furnace আনিয়ে এক গ্রামের লোক মিলে একাজ চালানো সম্ভবপর কিনা। আর একটা জিনিষ আছে ছাতা তৈরি করতে শেখানো। ...নগেন্দ্র বলছিল খোলা তৈরি করতে পারে এমন কুমোর এখানে আনতে পারলে বিস্তর উপকার হয়। যাই হোক ধানভানা কল, Pottery’র চাক ও ছাতা তৈরির শিক্ষকের খবর নিস—ভুলিসনে।

১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি Myron H. Phelps –শিলাইদহে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি রথীন্দ্রনাথের কৃষি গবেষণা খামার দেখে খুশি হয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তাঁর (Phelps) একটি লেখায় তিনি আমাদের মস্ত সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, শিলাইদহে আমি নাকি একটি সত্যিকারের ভাল আমেরিকান ফার্ম গড়ে তুলতে পেরেছি।

রবীন্দ্রনাথ ২রা পৌষ ১৩১৮ সালে একটি লিখিত উইল তৈরি করেছিলেন। সেখানে তাঁর উত্তরাধিকারী রথীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, জমিদারীর সম্পত্তির আয় নিজের ভোগে না লাগাইয়া প্রজাদের হিতার্থে যাহাতে নিযুক্ত করেন রথীন্দ্রকে সে সম্বন্ধে বারবার উপদেশ দিয়াছি। তদনুসারে এইরূপ মঙ্গল অনুষ্ঠানে তিনি যদি তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি প্রসন্নচিত্তে উৎসর্গ করিতে পারেন তবে আমার বহুকালের একান্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

সূত্র।
রবিজীবনী : প্রশান্তকুমার পাল।
রবীন্দ্রজীবনকথা : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন : সমীর সেনগুপ্ত।
রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায় : আহমদ রফিক।
রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র : সৌমেন্দ্রনাথ সরকার।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন :


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ। রথী কে বিদেশ পাঠানো ছাড়া অন্য উদ্যোগগুলো আসলেই জানতাম না।

সারাজীবন

রাগিব এর ছবি

আপনার এই লেখায় কিছু যোগ করছি। রথীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথের আসলে যাবার কথা ছিলো ক্যালিফোর্নিয়াতে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলে-তে। কিন্তু ঘটনা চক্রে রথীন্দ্রনাথদের জাহাজ ১৯০৬ সালে যখন সানফ্রান্সিস্কোর বন্দরে ভিড়ে, তার ঠিক আগে আগেই ১৯০৬ এর ভয়াবহ ভূমিকম্পে ঐ এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তাঁরা তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা বাদ দিলেন। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের তখন বেশ সুনাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে। রথীন্দ্রনাথরা তাই ট্রেনে চেপে চলে এলেন ওখানেই।

এই ইতিহাস নিয়ে প্রফেসর অনিল বেরা বেশ চমৎকার একটি নিবন্ধ লিখেছেন, আপনারা সেটা দেখেছেন কি না জানিনা। বিরল কিছু ছবি সহ এই নিবন্ধটি পাবেন এইখানে।

ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ে পড়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথের বাড়িটির পাশ দিয়ে বহুবার সাইকেল চালিয়ে গেছি। সেখানে এখন প্রতিবছর টেগোর ফেস্টিভাল হয়, বেশ বড় মাপের আয়োজনেই।

The ship arrived in San Francisco in the morning of the fateful day of April 18, 1906—the day the great earthquake and fire devastated the city. From the ship dock they saw the charred remains of a few skyscrapers and the thick black clouds of smoke. That was the first glimpse Rathi and Santosh got of the United States.
Santosh Chandra Majumdar 1909
Santoshchandra Majumdar (1886-1926) studied Agriculture and Animal Husbandry at the University of Illinois. In 1910 he returned to Santiniketan where he taught English literature and science from 1910 to 1922. Later he joined Leonard Elmhirst at Sriniketan Rural Development Center. His untimely death was a great loss. At Santiniketan, the Children Section where he taught is named after him, called Santoshalay (Santosh Hall).

The solitary letter of introduction for a Berkeley professor was now useless—since that campus was destroyed too. Then somebody told them there was a good agricultural college at the University of Illinois. They knew about the big city Chicago, and thought the University could not be that far from it. Of course, it was not “near” either. They took a train from Chicago to Champaign. Before that, they had a inspired thought: they sent a telegraph to the Secretary of the YMCA, Mr. J.H. Miner, to ask him to receive them at the Champaign station. They congratulated themselves on such an inspiration, but nobody was waiting for them at the station. After a few days Rathi and Santosh met Mr. Miner and discovered that the telegraph had been changed to “Two students from Indiana.” The lady at the Chicago telegraph office made the correction herself, doubting the existence of any place called “India.” Indiana being the neighboring state, Mr. Miner did not bother to receive the two students.

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

কুলদা রায় এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ তথ্য সংযোজনের জন্য।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

কড়িকাঠুরে এর ছবি

কত কী জানার আছে বাকি ।
ধন্যবাদ ।

আমিনুল করিম মাসুম এর ছবি

ধন্যবাদ তথ্যবহুল সুন্দর পোস্টটির জন্য। হাসি

আমিনুল করিম মাসুম এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর ও তথ্যবহুল পোস্টটির জন্য। রবীন্দ্রনাথকে দিনে দিনে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি এখনো।

-আমিনুল করিম মাসুম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।