নোম চমস্কির সাক্ষাৎকার : রাজনীতি

পৃথ্বী এর ছবি
লিখেছেন পৃথ্বী [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৬/২০১৪ - ১০:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল : The Chomsky - Foucault Debate: On Human Nature


Mitsou Ronat: আমার কাছে ব্যাপারটা আশ্চর্যকর লাগে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আপনার রাজনৈতিক লেখাগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ও এখানে(ফ্রান্সে) প্রচলিত হলেও আপনার সৃষ্ট “জেনারেটিভ গ্রামার” নামক ডিসিপ্লিনটি তেমন একটা পরিচিত না। আপনি কি আপনার ভাষাবিজ্ঞানের কার্যক্রমের সাথে আপনার রাজনৈতিক কার্যক্রমের কোন সংযোগ লক্ষ করেন?

চমস্কি: কোন সংযোগ যদি থেকেও থাকে, তবে তা খুবই বিমূর্ত। আমি অপ্রচলিত বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করি না, আর আমার ভাষাবিজ্ঞানের জ্ঞানও আমার রাজনৈতিক আলাপনে কাজে আসে না। আমি যা যা লিখেছি, তা অন্য যেকোন ব্যক্তি লিখতে পারতেন। আমার রাজনৈতিক ও ভাষাবৈজ্ঞানিক কর্মের মাঝে যদি কোন সংস্রব থেকে থাকে, তবে তার কারণ হল মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে আমার কিছু সুনির্দিষ্ট ভাবনা আছে। মতাদর্শিক ক্ষেত্রে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ আমার কাছে যথেষ্ট সহজসাধ্য মনে হয়, মুক্ত মন আর উপযুক্ত পরিমাণে সংশয় ধারণ করতে পারলেই চলে।

আমাদের সমাজে বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকাকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক। এই সামাজিক শ্রেণীটি(যাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, রাজনীতি আলোচকরা অন্তর্ভুক্ত) সমসাময়িক সমাজবাস্তবতা বিশ্লেষণ করে তার একটি চিত্র উপস্থাপন করে। এসব বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা ফ্যাক্ট এবং জনগণের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে: সামাজিক চর্চাকে তারা মতাদর্শিক বৈধতা প্রদান করে। বিশেষজ্ঞদের সমসাময়িক ঘটনার বিশ্লেষণের সাথে ফ্যাক্টের তুলনা করে দেখুন, বাস্তবতা হতে বিস্তর বিচ্যুতি দেখতে পাবেন। এরপর আপনি আরেক ধাপ এগিয়ে বিশেষজ্ঞদের শ্রেণীগত অবস্থানকে গোণায় ধরুন, তবেই এই বিচ্যুতিটি ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

এধরণের সামাজিক বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আহামরি কঠিন কিছু নয়। একটু চেষ্টা করলেই বুদ্ধিজীবিদের প্রচারিত অপপ্রচারের বাইরে নিজস্ব অবস্থান গ্রহন করা যায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলো প্রায়ই কিছু বিশেষ স্বার্থ রক্ষার্থে রচনা করা হয়, তাই এগুলো খুব কমই শক্তিশালী হয়।

ঠিক একারণেই আমাদের মনে রাখা উচিত যে সমাজ বিশ্লেষণ এমন কোন কর্ম না যা বিশেষজ্ঞদের হাতে ন্যস্ত রেখে আমাদের নিশ্চিন্ত থাকতে হবে। বুদ্ধিজীবিরা আমাদের এটাই বিশ্বাস করাতে চায় যে তারা এমন এক কর্মে প্রবৃত্ত যা জনসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞান এবং সমসাময়িক ঘটনাবলি অধ্যায়ন আসলে মোটেই জটিল কিছু না, কারো এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকলে সে নিজেই এগুলোতে সিদ্ধহস্ত হতে পারে। এসব বিষয়কে অযাচিতভাবে “জটিল” হিসেবে উপস্থাপন করে বুদ্ধিজীবিরা আসলে জনসাধারণকে ননির পুতুল বানিয়ে রাখতে চায় যাতে সাধারণ মানুষ এসব মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তা ব্যতিরেকে সমাজকে উপলদ্ধি করতে নিজেদেরকে অক্ষম মনে করে। একারণে সমাজবিশ্লেষণকে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের সাথে তুলনা করার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে, কারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসলেই কোন কিছু বিশ্লেষণের পূর্বে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে একটি সুবিশেষ বৌদ্ধিক কাঠামো আয়ত্ত করতে হয়।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ফ্যাক্টকে আলিঙ্গন করে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনার পথ অনুসরণ করলেই চলে। মুক্ত মনে ফ্যাক্টগুলো অনুসন্ধান করতে হবে, অনুমিতিগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন করতে হবে, প্রতিটি যুক্তিকে তার অবধারিত উপসংহারে পর্যবসিত করতে হবে। এই ইস্যুগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য আর কোন “বিশেষ জ্ঞান” এর দরকার আছে বলে মনে করি না।

Ronat: সব মতাদর্শেরই সম্যকভাবে কিছু অলিখিত বিধিমালা থাকে, যা ইতিহাসের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মানুষের চৈতন্যে ধরা দেয় না।উদাহরণ হিসেবে এখানে নাৎসিবাদের উত্থান নিয়ে Jean Pierre Faye এর কর্মকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। এধরণের কাজ দেখে বোঝা যায় যে মতাদর্শের সমালোচনায়ও বৌদ্ধিক গভীরতা থাকতে পারে। এসম্পর্কে কিছু বলুন।

চমস্কি: মতাদর্শ ও তার সামাজিক ভিত্তির একটি তত্ত্ব দাঁড়া করানো খুবই সম্ভব, কিন্তু বহিঃস্থ শক্তির স্বার্থে বুদ্ধিজীবিরা কেন বাস্তবতাকে বিকৃত করেন সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য এরকম কোন তত্ত্ব দাঁড়া করানোর প্রয়োজন নেই। এই ব্যাপারটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণাপ্রকল্প হতে পারে। তবে আমাদেরকে এখানে দু’টো পয়েন্ট পৃথক করতে হবে –

১) বুদ্ধিজীবিদের এই প্রবণতাকে কি তত্ত্বীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব? – অবশ্যই। এমনকি, এই ধরণের বিশ্লেষণ বিজ্ঞানের মর্যাদাও পেতে পারে।

২) বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা বাস্তবতার বিকৃত উপস্থাপন অপসারণ করার জন্য কি ওই তত্ত্বীয় কাঠামোর দরকার আছে? – না। সংশয়কে ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারলেই চলবে।

একটা উদাহরণ দেই – দুনিয়াতে কিছু একটা ঘটলে মিডিয়া(পত্রিকা, টিভি) সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য কারও না কারও শরণাপন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রে তারা সমাজবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হয়। এখানে একটা অনুমিতি কাজ করে যে সমাজবিজ্ঞানীরাই কেবল এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা সংরক্ষণ করেন, যেটা সীমিত পরিসরে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে একদমই অমূলক একটি অনুমিতি। এই পেশাজীবিরাও সবসময় সবাইকে বোঝাতে চান যে তাঁরা একাই কেবল সেই সুবিশেষ বীক্ষণপ্রান্তে অবস্থান করেন যেখান থেকে ঘটনাটিকে তার প্রকৃত আলোকে দেখা সম্ভব। সমাজ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রে একারণে এসব পেশাজীবিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আপনি তো আর রাস্তা থেকে কাউকে ধরে এনে একটি সেতু নকশা করার দায়িত্ব দেন না, তাই না? তাহলে আমরা এঙ্গোলাতে গিয়ে যুদ্ধ করব কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য কেন আমরা অনুরুপ কোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হব না? এখানে অ-পেশাদারদের কোন প্রয়োজন নেই!

কিছু ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার পেশাগত যোগ্যতায় আমি বিভিন্ন একাডেমিক ডিসিপ্লিনে কাজ করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে গণিত অধ্যায়ন না করেও আমি গাণিতিক ভাষাবিজ্ঞানে কাজ করেছি, এই বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত(যদিও সুশিক্ষিত নই)। বিভিন্ন গাণিতিক সেমিনারে আমি নিমন্ত্রিত হয়েছি, কিন্তু কোথাও গণিতবিদরা আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেখতে চাননি। আমি গাণিতিক ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে গেলে কেউ জিজ্ঞেস করেননি যে আমি গণিতে ডক্টরেট করেছি কিনা অথবা এই বিষয়ে আমি কোন উচ্চতর পর্যায়ের কোর্স করেছি কিনা। আমার পেশাগত যোগ্যতায় তাঁরা কখনওই আগ্রহী ছিলেন না, তাঁরা কেবল জানতে চান এই ফিল্ডে আমি নতুন কোন প্রশ্ন বা উত্তর উত্থাপন করতে পারি কিনা, আমার যোগ্যতার চেয়ে তাঁরা বরং আমার কর্মেই বেশি আগ্রহী।

অথচ আমি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলতে গেলে অনেকেই আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে উঠেপড়ে লাগেন। আমি প্রায়ই জিজ্ঞাসিত হই কোন পেশাগত সনদপত্রের ক্ষমতাবলে আমি উক্ত বিষয়ে বক্তৃতা করতে এসেছি। ব্যাপারটা যেন এমন যে একটি নির্দিষ্ট পেশাগত বলয়ে অবস্থান না করলে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না!

গণিতের সাথে রাজনীতিবিজ্ঞানের তুলনা করতে গেলে একারণে চমকিত হতে হয়। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতি ফিল্ডে কেউ আপনার সনদপত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে আপনাকে গলায় সনদ ঝুলিয়ে রাখতে হবে, বিশেষ করে আপনি যদি অপ্রচলিত ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করেন। এটা বললে হয়ত ভুল হবে না যে একটা একাডেমিক ডিসিপ্লিন সারবস্তুতে যত সমৃদ্ধ হবে, সেখানে বক্তার ক্রেডেনশিয়াল তত অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে এবং বক্তার বক্তব্য তত বেশি গুরুত্ব লাভ করবে। মতাদর্শচালিত ডিসিপ্লিনগুলোতে অন্তঃসারযুক্ত কথা বলা বিপদজনক, কারণ এই ডিসিপ্লিনগুলো যতটা না ফ্যাক্ট আবিস্কার ও ব্যাখ্যায় আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী সেই ফ্যাক্টগুলোকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে মতাদর্শের মাইক্রোফোনে রুপান্তর করতে।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি যে কানাডা, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আমার অভিমত অনুরোধ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে কখনওই এই বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাওয়া হয় না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এই বৈপরীত্য নাটকীয় রুপ ধারণ করেছিল। মিডিয়ার মাধ্যমে কঠিন মগজধোলাই দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর মাঝে অনন্য। দৃষ্টিভঙ্গীকে এরুপ সংকীর্ণ করার জন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল পেশাগত যোগ্যতার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা। বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমিক ডিসিপ্লিনগুলো যেহেতু এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি অনুগামী চিন্তাচেতনাকে পৃষ্ঠপোষণ করেছে, তাই একাডেমিক ক্রেডেনশিয়ালকে প্রাধান্য দিলে জনমানসে বিপরীত স্রোতের চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না।

অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেন আমি যাতে ভাষাবিজ্ঞানের উপর আমার কাজকে আমার রাজনীতিবিশ্লেষণের সাথে সংযুক্ত করি, কিন্তু আমি দু’টো কারণে এই কাজ হতে বিরত থাকি – প্রথমত, আমার ভাষাবৈজ্ঞানিক কর্মের সাথে আমার রাজনীতিবিশ্লেষণের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত, আমি মানুষকে এই ভুল ধারণাটা দিতে চাই না যে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার জন্য কোন বিশেষ পেশাগত যোগ্যতা প্রয়োজন। হ্যাঁ, মতাদর্শ-মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ-বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পেশাদারমূলক সুসংগঠিত চিন্তা করা খুবই সম্ভব, কিন্তু একজন নাগরিকের জন্য সমাজ বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করা ও বিকৃতির অবগুন্ঠন সরিয়ে ফেলার জন্য এই সুসংগঠিত চিন্তা মোটেই অত্যাবশ্যক নয়।

Ronat: আপনি মতাদর্শের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার তুলে ধরেছেন – মাঝে মাঝে সাময়িকীগুলো পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন ও চিন্তাভাবনা পাশাপাশি উপস্থাপন করে এক প্রকার “ভারসাম্য” নীতি অনুসরণ করে। তবে শুধুমাত্র অফিশিয়াল প্রতিবেদনগুলোই গ্রহণ করা হয়(প্রায়ই বিনা প্রমাণে) আর বিরোধী প্রতিবেদনগুলোকে প্রমাণ আর নির্ভরযোগ্য সূত্র থাকা সত্ত্বেও বাতিল করা হয়।

চমস্কি: অবশ্যই। এছাড়া আপাতঃ “ভারসাম্য” নীতি অনুসরণ করলেও মার্কিন মিডিয়াতে যেরকম পক্ষপাতদুষ্টভাবে ঘটনাগুলো উপস্থাপন করা হয়, তা নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে।

আমার জানামতে আমেরিকান মিডিয়ায় একজনও সোশ্যালিস্ট সাংবাদিক কিংবা রাজনীতি বিশ্লেষক নেই। মতাদর্শিক দৃষ্টিতে দেখলে আমেরিকান মিডিয়া প্রায় শতভাগ পুঁজিবাদী। সোভিয়েত ইউনিয়নে Pravda পত্রিকায় লেখালেখি করা সকলেই যেমন সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদী সোশ্যালিজমের প্রতিনিধি ছিল, আমেরিকাতেও মিডিয়ার মূলস্রোতের লেখকরা আমেরিকান পুঁজিবাদের প্রতিনিধি। এর পেছনে দু’টো কারণ আছে –

১) আমেরিকান বুদ্ধিজীবি সমাজে চিন্তাভাবনা অত্যন্ত রকম সমসত্ত্ব, সামান্য যা বৈচিত্র্য দেখা যায় তা আসলে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদেরই কিছু প্রকরণ। এই ব্যাপারটা আলাদা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

২) মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই পুঁজিবাদী।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল – ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান সরকার বারংবার মিথ্যা বলে ধরা খাওয়ার পরও মার্কিন মিডিয়া বিনা প্রশ্নে সরকারের ভাষ্য মেনে নিয়েছিল। কিছু কিছু সংকীর্ণ প্রশ্নে, যেমন “ভিয়েতনাম যুদ্ধ কি ফলপ্রসূ হচ্ছে?” প্রভৃতি প্রশ্নে কিছু মৃদু সমালোচনা দেখা গিয়েছিল, সরজমিন হতে কিছু সৎ প্রতিবেদনও পাওয়া গিয়েছিল। তবে সম্যকভাবে মিডিয়ার বিশ্লেষণ ও ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত অনুমিতিগুলোতে অফিশিয়াল মতাদর্শের বাইরে কিছু লক্ষিত হয় না, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়া সহজলভ্য পরিসংখ্যানও চেপে গিয়েছে – Laos এ বোমাবর্ষণ এরকম একটা দৃষ্টান্ত।

১৯৭২ এর অক্টোবরে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের ঠিক আগে Hanoi রেডিও হতে প্রচারিত শান্তি চুক্তির আলোচনাটার কথাই ধরুন। কিসিঞ্জার যখন টিভিতে বক্তৃতা করলেন, “শান্তি সমাগত”, তখন মিডিয়া অনুগতভাবে বাস্তবতার কিসিঞ্জারীয় সংস্করণটিই মানুষের সামনে তুলে ধরেছে, অথচ কিসিঞ্জার তার প্রতিটি বাক্যে শান্তি চুক্তির নীতিগুলো লঙ্ঘন করেছিলেন। কিসিঞ্জারের বক্তব্যেই ইঙ্গিত ছিল যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি, আমি সহ আরও অনেকেই তখন মূলধারার মিডিয়াতে ব্যাপারটা তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছিলাম, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ’৭৩ এর জানুয়ারিতে যখন শান্তি চুক্তি অবশেষে প্রকাশিত হল, তখন আবার একই ঘটনা ঘটল। কিসিঞ্জার এবং হোয়াইট হাউজ পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল যে শান্তি চুক্তি অনুসরণ করার কোন ইচ্ছেই তাদের নেই, কিন্তু মিডিয়া তাতে কর্ণপাত না করে অনুগতভাবে অফিশিয়াল বক্তব্যটাই প্রচার করে গিয়েছে।

১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকার লিবারেল মিডিয়া এই যুদ্ধ নিয়ে কিরুপ পর্যালোচনা করেছিল আমি সেটা নিরীক্ষণ করে দেখেছিলাম। প্রায় প্রত্যেকটা লিবারেল পত্রিকা নিঃসংশয়ে সরকারী অপপ্রচার স্বীকার্য ধরে নিয়েছিল, অথচ এই পত্রিকাগুলো নিজেদেরকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী দাবি করত। সরকারী অপপ্রচার যে তাদেরকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে তারা সেটা বুঝতেও পারেনি। এই ব্যাপারটা আমেরিকার কথিত “এলিট” বুদ্ধিজীবিদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ’৭০ এর দশকে এসব এলিটদের উপর করা একটি সমীক্ষার ফলাফল আমরা C. Kadushin এর The American Intellectual Elite বইতে দেখতে পাই। আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাব যখন শিখরে ছিল তখন এই এলিটরাও যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন বটে, তবে তাদের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের মূল হেতু ছিল এটাই যে এই যুদ্ধটা লাভজনকভাবে সমাপ্ত করা যাবে না। অর্থাৎ, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ নিয়ে মার্কিন সরকারের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই। আমার মনে হয় ১৯৪৪ সনে জার্মান “এলিট” বুদ্ধিজীবিদের উপর সমীক্ষা পরিচালনা করলে একইরকম ফলাফল পাওয়া যেত। এই সমীক্ষা থেকে দেখা যায় সরকারের তথাকথিত সচেতন ও বিদগ্ধ সমালোচকরাও কী পরিমাণে রাষ্ট্রীয় অপপ্রচারে নিমজ্জিত।

Hans Morgenthau ঠিকই বলেছিলেন যে আমেরিকান বুদ্ধিজীবিদের এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি এরকম অন্ধ আনুগত্যের ফলে আমেরিকাতে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কে কোন বৈচিত্র্যই নেই। এমনকি, ফ্যাসিবাদী স্পেনেও মতাদর্শিক বিতর্কে ব্যাপক বৈচিত্র্য ছিল। স্পেনে রাষ্ট্রীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধচারণ করলে আমেরিকার চেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হত, কিন্তু তার জন্য তাদের রাজনৈতিক চিন্তা এতটা সংকীর্ণ হয়নি। ফ্র্যাঙ্কোর শাসনামলের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণরত স্পেনীয় বুদ্ধিজীবিরা আমাদের দৈন্যতা দেখে অবাক হতেন। পর্তুগালে ফ্যাসিবাদী শাসনের মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর মার্ক্সবাদী সংগঠন সক্রিয় ছিল। একনায়কতন্ত্রের পতনের পর এবং পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের মাঝে পর্তুগালের এই মতাদর্শিক বৈচিত্র্য প্রস্ফুটিত হয়েছিল।

অন্য সব সমতুল্য পুঁজিবাদী দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পার্থক্য এখানেই যে এদেশে চিন্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও অনমনীয়, অবিশ্বাস্য হলেও এদেশের বুদ্ধিজীবিদের ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি প্রযোজ্য। এখানে শিল্পের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহন নিশ্চিতকরণের জন্য কোন চাপ নেই, এমনকি পশ্চিম ইউরোপের মত যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয়ে কোন প্রাণোচ্ছল আলোচনাও হয় না। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবি সমাজে কোন দৃঢ় সোশ্যালিস্ট কন্ঠের অনুপস্থিতি এই দেশকে অন্যসব শিল্পোন্নত দেশ থেকে আলাদা করে দেয়।

ষাটের দশকের শেষের দিকে কিছু পরিবর্তন অবশ্য দেখা গিয়েছিল, তবে ১৯৬৫ সালেও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে একজন মার্ক্সবাদী অধ্যাপককে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হত। সমাজবিজ্ঞান ও অন্যসব মানবিক বিভাগগুলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী আদর্শের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত ছিল, এই আনুগত্যকে বলা হত “মতাদর্শের মৃত্যু”। কোন গোপন পুলিশ নেই, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নেই – এমন একটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়-মিডিয়া-বুদ্ধিজীবি সমাজে এরকম প্রথাবাদীতার অস্তিত্ব আসলেই বিস্ময়কর।

ষাটের দশকে অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছিল, তার মূলে ছিল ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াগুলো কৌতূহলোদ্দীপক। আন্দোলনের আমেজ মিইয়ে যাবার পর পূর্বের অচলায়তন পুনঃনির্মাণের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করা হয়েছে। সেই আন্দোলন নিয়ে পরবর্তীতে যত আলোচনা ও সাহিত্য রচিত হয়েছে, সবগুলোতেই দাবি করা হয়েছে যে সে সময়ের বামপন্থী ছাত্ররা গবেষণা ও শিক্ষকতার স্বাধীনতাকে হুমকির সম্মুখীন করেছিল; তারা কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে যেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকে বিঘ্ন করেছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাত্ররা আসলেই সীমা অতিক্রম করেছিল। এর কিছু দায়ভার যেমন সরকারী প্ররোচকদের উপর বর্তায়, কিছুটা ছাত্র আন্দোলনের উপরও বর্তায়। তবে এই ছাত্র আন্দোলনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হল এটি সাময়িকভাবে হলেও চিন্তার অচলায়তনকে সচল করতে পেরেছিল, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণকে বাইপাস করে এই আন্দোলন ক্ষুদ্র পরিসরে মতাদর্শিক বৈচিত্র্যের অবকাশ সৃষ্টি করেছিল। সমাজবিজ্ঞান ফিল্ডের ছাত্রদের এই বিদ্রোহই এলিট বুদ্ধিজীবিদেরকে ভীত করেছিল।

Ronat: ছাত্ররা প্রথমে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেও পরে তো তারা অন্য ইস্যুও আন্দোলনে টেনে এনেছিল?

চমস্কি: হ্যাঁ, আন্দোলনের মুখ্য কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ হলেও পূর্বতন বছরগুলোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলো চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। দক্ষিণাঞ্চলের নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলোতে ছাত্ররাই মূলত অংশগ্রহণ করেছিল।SNCC(Student Non-violent Coordinating Committee) এর বেশিরভাগ নেতা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, সমর্থনে ছিল শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা। প্রাথমিকভাবে ক্যামপাসে উন্মুক্ত রাজনীতি চর্চার অধিকারও আন্দোলনের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আমি মনে করি না তৎকালীন ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়কে “রাজনীতিকরণ” এর চেষ্টা করেছিল। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাকাল্টিদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে কোন আলোড়ন ছিল না, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথেষ্ট রাজনীতি ছিল; বিভিন্ন সরকারি পলিসি প্রণয়ন ও প্রচারে বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাকাল্টিদের ভূমিকা তা-ই পরিস্কার করে। আন্দোলনকারীরা বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই বহিঃস্থ প্রভাব হতে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যে গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের অনুগত রাখতে চেয়েছিল তাদের কাছে ছাত্রদের এই প্রচেষ্টাটিই “রাজনীতিকরণ” এর অগ্রহণযোগ্য রুপ মনে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অনেক আগে থেকেই রাজনীতি ছিল তা তো দিনের আলোর মতই স্বচ্ছ – বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সমরাস্ত্র উদ্ভাবিত হচ্ছে, সামাজিক বিজ্ঞানের ডিপার্টমেন্টগুলো সরকারের প্রপাগান্ডা, কাউন্টার-ইনসারজেন্সি প্রোগ্রাম, গোয়েন্দাসংস্থা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডে সহায়তা করেছে এবং করছে। একাডেমিক সাহিত্যে এই রাজনীতিটা সেরকম স্বচ্ছ নয়, তবে একই পরিমাণে সত্য।

স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাস এবং তার রিভিশনিস্ট বিশ্লেষণের উদাহরণটাই ধরা যাক। “রিভিশনিস্ট” তকমাটা সেসব বিশ্লেষকরা ব্যবহার করতেন যারা আনুষ্ঠানিকভাবে “অর্থডক্স” সংস্করণের বিরোধী। অর্থডক্স সংস্করণ অনুযায়ী রাশিয়া এবং চীন স্নায়ুযুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে, আমেরিকা কেবল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এই অর্থডক্স সংস্করণের সাথে প্রচুর লিবারেল, রিভিশনিস্ট বিশ্লেষকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একমত ছিলেন। John Kenneth Galbraith এর কথাই ধরুন, যিনি কিনা অর্থডক্সির বাইরে পদচারণা করার জন্য লিবারেল বলয়ে প্রশংসিত। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত The New Industrial State বইতে Galbraith বুদ্ধিজীবিদের সংশয়ী মনোভাবের প্রশংসা করেছিলেন বটে, কিন্তু একই সাথে তিনিও এও দাবি করেছিলেন যে স্নায়ুযুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের আগ্রাসী আচরণ “নিঃসন্দেহে প্রমাণিত”।

স্নায়ুযুদ্ধের রিভিশনিস্ট ইতিহাস প্রথমে হালে পানি পায়নি, কিন্তু ছাত্ররা ঠিকই রিভিশনিস্ট বইপত্র পড়েছিল এবং ছাত্র আন্দোলনের সময় সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠিয়েছিল। অর্থডক্স ইতিহাসবিদরা কখনও নিজেদের ভুল স্বীকার করেননি, উলটো তারা রিভিশনিস্টদেরই কিছু পয়েন্ট গ্রহণ করে রিভিশনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গী ভুলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। যেমন, তারা দাবি করেছিলেন যে রিভিশনিস্ট দৃষ্টিতে সোভিয়েতরা আসলে আমেরিকার শক্তিশালী কুটনীতির সহজ শিকার ছাড়া কিছু ছিল না। বস্তুত, অর্থডক্স Herbert Feis রিভিশনিস্ট Gar Alperovitz এর নামে এই দাবিটাই করেছিলেন, যদিও Alperovitz এর মূল দাবি ছিল, “স্নায়ুযুদ্ধকে কেবলই সোভিয়েত চ্যালেঞ্জের মুখে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলে চলবে না, স্নায়ুযুদ্ধকে দু’টো দেশের একে অপরের প্রতি পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মিথস্ক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে, এখানে দু’টো পক্ষই দোষী”। অর্থডক্সরা এভাবে স্নায়ুযুদ্ধকালীন আমেরিকাকে একটি সদাশয়, জড় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।

’৬০ এর দশকের ছাত্র আন্দোলন বুদ্ধিজীবিদের মাঝে কিরকম প্রভাব ফেলেছিল তার একটা চিত্র Galbraith এর উপরোক্ত বইয়ের মাঝে আমরা দেখতে পাই। বইটির ১৯৬৭ সনের সংস্করণে তিনি লিখেছিলেন,

the revolutionary and national aspirations of the Soviets, and more recently of the Chinese, and the compulsive vigor of their assertion was the undoubted historical source of the cold war

১৯৭১ সালের সংস্করণের তিনি লিখেছেন,

the revolutionary and national aspirations of the Soviets, and more recently of the Chinese, and the compulsive vigor of their assertion, were an undoubted historical source of the cold war

লক্ষ করুন, তিনি “the”কে প্রতিস্থাপন করেছেন “an” দিয়ে। অর্থাৎ, তিনি এখন আর চীনা-সোভিয়েত আগ্রাসনকে স্নায়ুযুদ্ধের একমাত্র কারণ মনে করেন না, তবে তিনি অন্যসব কারণসমূহের কথা আবার অনুল্লেখিত রেখে দিয়েছেন। তাছাড়া স্নায়ুযুদ্ধে চীনের ভূমিকা কী ছিল তা জানতে পারলেও মন্দ হত না। যাই হোক, বইটির এই নতুন সংস্করণ অন্তত তার পূর্বতন অর্থডক্স ঘরানার দৃষ্টিভঙ্গীর চেয়ে উন্নত মানের, এবং এর কৃতিত্ব ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন দাবি করতেই পারে। Galbraith এর উদাহরণের উপর আমি একটু গুরুত্ব আরোপ করতে চাই, কারণ লিবারেল বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উদারচেতা ও সংশয়ী ভাবাপন্ন। তিনি বইটির উদ্ধৃত অংশে স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেননি, স্রেফ কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি আসলে তুলে ধরেছেন স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে লিবারেল বুদ্ধিজীবিরা আসলে কী বিশ্বাস করেন।

ষাটের দশকের শেষভাগে লিবারেলরা কেন বাম কর্তৃত্ববাদের জুজু চারিদিকে দেখতে পাচ্ছিল তা সহজেই অনুমেয়: প্রথমবারের মত তারা বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছিল। মতাদর্শিক আধিপত্য বজিয়ে রাখতে ব্রত লোকজনের কাছেও এই দশকটা স্বস্তিকর ছিল না। Michel Crozier, Samuel Huntington এবং Joji Watanuki রচিত The Crisis of Democracy তে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগোষ্ঠী গণতন্ত্রের উপর সমসাময়িক হুমকিসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গবেষণায় value-oriented বুদ্ধিজীবিদেরকে গণতন্ত্রের প্রতি অন্যতম হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ এসব বুদ্ধিজীবি তরুণদের মতাদর্শে দীক্ষিত করা নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। এই বিশেষজ্ঞদের মতে “গণতন্ত্রের সংকট” এর দায় ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনকারীদের উপরও বর্তায়।

ষাটের দশকে বুদ্ধিবৃত্তি কেবল ভিয়েতনাম অথবা ইতিহাসের সমসাময়িক বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ ছিল না; চিরাচরিত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বয়ং হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। ছাত্ররা প্রচলিত ইকনমিক্সের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, মার্ক্স এবং পলিটিক্যাল ইকোনমি অধ্যায়ন করার অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিল। একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি:

’৬৯ এর বসন্তে এই কেমব্রিজ শহরে কিছু অর্থনীতির শিক্ষার্থী একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে অর্থনীতির প্রকৃতি নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত করতে উদ্যত হয়েছিল। এই সভায় তারা একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চেয়েছিল যেখানে প্রধান দুই বক্তা হবেন নোবেলজয়ী পল স্যামুয়েলসন ও একজন মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ। সেই ১৯৬৯ সনেও কেমব্রিজ শহরে এরকম বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য একজন মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদও পাওয়া যায়নি! তাও আবার কেমব্রিজের মত একটি শহরে, যা সবসময়ই বিভিন্ন ঘরানার বিশেষজ্ঞের পদচারণায় মুখরিত থাকে। শেষমেষ আমিই সেই বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম, যদিও আমি মার্ক্সবাদী নই এবং অর্থনীতিও আমার পঠিত বিষয় নয়। এধরণের বৌদ্ধিক আবহ আমি পশ্চিম ইউরোপ কিংবা জাপানে কল্পনাও করতে পারি না। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন এই অচলাবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন করেছিল, কিন্তু পরে সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে।

Ronat: সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাওয়ার কারণ কী?

চমস্কি: অনেকগুলো কারণ আছে। আমেরিকাতে ছাত্র আন্দোলনের মাঝে যে নতুন বামপন্থার উদ্ভব ঘটেছিল, তা কোন বৃহৎ সামাজিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হতে পারেনি যার সাথে কোন গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কোন সংশ্রব ছিল। এটাও ওই মতাদর্শিক সংকীর্ণতারই ফল। ছাত্ররা আসলে সমাজের একটি প্রান্তিক গোষ্ঠী। বামপন্থী ছাত্ররা ছিল একটি অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, তাদেরকে সমর্থন দেওয়ার মত কোন বাম বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠী ছিল না, শ্রমিকশ্রেণীতে প্রোথিত কোন সোশ্যালিস্ট আন্দোলনও ছিল না। একদম একাকী প্রতিবেশে ছাত্র আন্দোলনটি যে এতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল, সেটাই আশ্চর্যকর।

Ronat: নতুন প্রজন্মের কী অবস্থা?

চমস্কি: বর্তমান পরিস্থিতি পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। অর্থনৈতিক মন্দা ছাত্রদের মনোভাবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ষাটের দশকে সমাজে এক প্রকার আশাবাদ ব্যপ্ত ছিল, সবাই কোন না কোনভাবে খেয়ে-পড়ে থাকার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল। এখন তো সুশৃঙ্খল ও সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরাও শেষ পর্যন্ত্য ট্যাক্সি চালাতে বাধ্য হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনে এসব কিছুর প্রভাব পড়েছে।

এছাড়াও, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বামপন্থী ছাত্রদের ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।, লিবারেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বামপন্থী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এশিয়ান স্টাডিজ প্রভৃতি মতাদর্শিক ডিসিপ্লিনগুলোতে।

Ronat: আপনার Counterrevolutionary violence বইটির ফরাসী সংস্করণ প্রকাশের সময় ফ্রান্সে কথা উঠেছিল যে বইটির ইংরেজি সংস্করণে প্রকাশক ব্যাপক কাঁচি চালিয়েছে। কথিত আছে যে প্রকাশনা সংস্থাটি পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং সংস্থাটির প্রধান সম্পাদক পরে ট্যাক্সি চালক হয়ে বর্তমানে ট্যাক্সি-চালকদের ইউনিয়ন সংগঠিত করছেন।

চমস্কি: আমার বইটা আসলেই সেন্সর করা হয়েছিল, তবে প্রকাশনা সংস্থাটি সেন্সর করে বোকার মত কাজ করেছে। আমেরিকান সমাজে মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ এত বেশি যে সেন্সরশিপ কেবল বাহুল্যমাত্র। আমি সবসময়ই মনে করেছি যে কোন ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রকে টিকে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই আমেরিকান সিস্টেম অনুসরণ করতে হবে। অপেক্ষাকৃত জটিল ও বিকেন্দ্রিকৃত সিস্টেমগুলোতে যে নিপুণতার সাথে মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণের চর্চা করা হয়, সেসব সিস্টেমে সেন্সরশিপের কোন প্রয়োজন নেই, সেন্সরশিপ সেখানে খুব একটা কার্যকরীও হয় না।

Ronat: ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল সম্পর্কে আপনার মতামত কী? ফ্রান্সে তো একে “গণতন্ত্রের বিজয়” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

চমস্কি: এই স্ক্যান্ডালকে গণতন্ত্রের জয় আখ্যা দেওয়া ভুল। এখানে প্রশ্নটা এটা নয় যে নিক্সন প্রতিপক্ষের সাথে বেআইনী আচরণ করেছেন কিনা, প্রশ্নটা হল তার কীর্তিকলাপের ভুক্তভোগী কারা। আইনভঙ্গ করার কারণে তাকে নিন্দিত হতে হয়নি, তাকে নিন্দিত হতে হয়েছে কারণ তিনি ক্ষমতাশালীদের আক্রমণ করেছিলেন।

টেলিফোন কথোপকথন তো অনেক আগে থেকেই রেকর্ড করে আসা হচ্ছে। নিক্সন প্রতিপক্ষের একটা তালিকা বানিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই তালিকার ব্যক্তিবর্গের কিছুই হয়নি। আমিও ওই তালিকায় ছিলাম, আমার কিছু হয়নি। তার ভুল ছিল যে সেই তালিকায় তিনি আইবিএমের প্রধানকে ঢুকিয়েছিলেন, উচ্চপদস্থ সরকারী উপদেষ্টাদের ঢুকিয়েছিলেন, কিছু মিডিয়া পন্ডিতদের ঢুকিয়েছিলেন, ডেমক্রেটিক পার্টির কিছু হোমড়াচোমড়া সমর্থকদের ঢুকিয়েছিলেন। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে আক্রমণ করেছিলেন, যা একটি বৃহৎ পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান। এই ক্ষমতাশালীরা ঠিকই আত্মরক্ষা করেছে। ওয়াটারগেট কেলেংকারি আসলে ক্ষমতাবানদের মাঝে কামড়াকামড়ি ছাড়া কিছু না। নিক্সনের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ আনা যেত, কিন্তু সেসব কেলেংকারির ভুক্তভোগীরা হয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নয়ত কোন সামাজিক আন্দোলনের কর্মী, যাদের ব্যাপারে কারো কিছু আসে যায় না। ওয়াটারগেট কেলেংকারির সময় বাকি সব ইস্যু চাপা পড়ে গিয়েছিল।

একটা উদাহরণ দিই – শিকাগোতে ব্ল্যাকস্টোন রেঞ্জার্স নামক একটা গ্যাং ছিল, এই গ্যাংয়ের সাথে ব্ল্যাক প্যান্থার গোষ্ঠীর সংসর্গ ছিল। এরা মূলত বস্তিতে সক্রিয় ছিল। ব্ল্যাক প্যান্থার গোষ্ঠী ব্ল্যাকস্টোন রেঞ্জার্সকে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে তৎপর ছিল। এফবিআইয়ের দৃষ্টিতে রেঞ্জার্সরা মূলত একটি অপরাধী চক্র। এদের নিয়ে এফবিআই এর তেমন একটা মাথাব্যথা ছিল না, এদেরকে ব্যবহার করে বস্তিতে ক্ষমতা খাটানো সহজ ছিল। কিন্তু এরা যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠল, তখনই এফবিআইয়ের চোখে এরা বিপদজনক হয়ে গেল।

এফবিআই শুধু নামেই অপরাধ দমন করে, আসলে এটি একটি রাজনৈতিক পুলিশ। এফবিআইয়ের বাজেটে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। “Citizen’s Commission to Investigate the FBI” নামক একটি গোষ্ঠী পেনসিলভেনিয়াতে এফবিআইয়ের মিডিয়া অফিস থেকে কিছু নথি ফাঁস করেছিল। সেই নথি অনুযায়ী: বাজেটের ৩০% বরাদ্দ নিত্যনৈমিত্তিক কার্যক্রমের জন্য, ৪০% হল দু’টো ডানপন্থী গ্রুপ, অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা দশটি গ্রুপ ও দু’শতরও বেশি বামপন্থী গ্রুপকে নজরদারির জন্য বরাদ্দ, ১৪% বরাদ্দ সামরিক দায়িত্ব পরিত্যক্তকারীদের জন্য, ১% বরাদ্দ সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের জন্য আর বাকিটা খুন-ধর্ষণের জন্য বরাদ্দ।

বামদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য তখন এফবিআই একটি কাউন্টারইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম পরিচালনা করছিল – COINTELPRO। রেঞ্জার্স আর প্যান্থারদের মাঝে মৈত্রির সম্ভাবনা দেখে এফবিআই মাঠে নেমে পড়ল। তারা রেঞ্জার্সদের নেতার কাছে একটি বেনামী চিঠি পাঠাল যাতে লেখা ছিল যে প্যান্থাররা তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী রেঞ্জার্সরা প্রকৃতিগতভাবেই সহিংস, তাই তারা এই কথিত হত্যাচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় প্যান্থারদের উপর সরাসরি আক্রমণ চালাবে। তবে এই চিঠিতে কাজ হয়নি, ততদিনে প্যান্থার ও রেঞ্জার্সরা যথেষ্ট ঘনিষ্ট হয়েছে। অন্তর্ঘাত সৃষ্টির রাস্তা যেহেতু বন্ধ হয়ে গেল, প্যান্থারদের ধ্বংস করার কাজটা স্বয়ং এফবিআইকেই করতে হবে। কিভাবে?

এই ঘটনাটা নিয়ে কোন সুশৃঙ্খল তদন্ত হয়নি, তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো সন্নিবেশ করে আমরা একটি বিশ্বাসযোগ্য বয়ান দাঁড়া করাতে পারি:

১৯৬৯ এর ডিসেম্বরে গভীর রাতে শিকাগো পুলিশ প্যান্থারদের একটি ভবনে রেইড দিয়েছিল। অভিযানের সময় প্রায় একশত বুলেট ছোড়া হয়। পুলিশ দাবি করেছিল যে প্যান্থাররাই প্রথমে গুলি ছুড়েছে, কিন্তু স্থানীয় পত্রিকাগুলো এই দাবি নাকচ করে দেয়। প্যান্থারদের অন্যতম নেতা ফ্রেড হ্যাম্পটন বিছানাতেই নিহত হয়েছিলেন, এবং তাকে ড্রাগড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছিল যে তাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। মার্ক ক্লার্ক নামক আরেক নেতাও খুন হয়েছিলেন। এই ঘটনাকে গেস্টাপো ঘরানার রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

সেসময় ধারণা করা হয়েছিল শিকাগো পুলিশই বুঝি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে “রেইড” দিয়েছে। এমনিতেই এটা যথেষ্ট আপত্তিকর, কিন্তু পরে আরও ভয়ংকর কাহিনী বেরিয়ে এসেছে - হ্যাম্পটনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও প্যান্থারদের সিকিউরিটি চিফ উইলিয়াম ও’ নিল আসলে একজন এফবিআই এজেন্ট ছিলেন। রেইডের কয়েকদিন আগে এফবিআই শিকাগো পুলিশকে ভবনটির একটি বিস্তারিত নকশা প্রদান করেছিল যেখানে কোন কক্ষে কে থাকে সব নির্দেশ করা ছিল। ও’ নিল এই নকশা প্রদান করেছিলেন, একই সাথে তিনি পুলিশের কাছে একটি জাল প্রতিবেদন দিয়েছিলেন যে ভবনটিতে অবৈধ অস্ত্র লুকানো আছে। পুলিশ এই জাল প্রতিবেদনকেই রেইডের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। সাংবাদিকদের ধারণা, পুলিশের কাছে ফ্লোরপ্ল্যান ছিল বলেই তারা ভবনের প্রবেশমুখে গুলি না করে বিশেষ কিছু কোণে গুলি করেছিল। শিকাগো প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ও’নিলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন COINTEL এর শিকাগো শাখার প্রধান। এই দাবি সত্য-মিথ্যা যাই হোক, এই হত্যাযজ্ঞের সাথে এফবিআইয়ের সম্পৃক্ততা কিন্তু প্রমাণিত।

এই একটা ঘটনার গুরুত্ব পুরো ওয়াটারগেট কেলেংকারির চেয়ে অনেক অনেক বেশি। শিকাগোতে ঘটনাটির কাভারেজ ভাল হলেও জাতীয় দৈনিকগুলোতে এটি তেমন পাত্তা পায়নি। নিক্সনের ট্যাক্স ফাঁকি কিংবা “শত্রু তালিকা” এর কাভারেজের সাথে এই ঘটনার কাভারেজ তুলনা করলে চমকিত হতে হয়। এমনকি আমেরিকান উদারপন্থার মাউথপিস New Republic পত্রিকাতেই এই ঘটনা কোন প্রচার পায়নি। ফ্রেড হ্যাম্পটনের পরিবার শিকাগো পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আদালতে এফবিআইয়ের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল।

“ওয়াটারগেট কেলেংকারি” দেখে ক্ষুদ্ধ হওয়া লোকজন যদি আসলেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে চিন্তিত হত, তবে তারা অন্তত এই ব্ল্যাকস্টোন রেঞ্জার্স স্ক্যান্ডালে এফবিআইয়ের সম্পৃক্ততা তদন্ত করতে উদ্যত হত, একইসাথে তারা নিক্সন ও তার পূর্বসুরীদের অধীনে এফবিআইয়ের কীর্তিকলাপও অনুসন্ধান করত। এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় পুলিশের গুপ্তহত্যায় জড়িত থাকার একটা সম্ভাবনা আছে, ওয়াটারগেট তদন্তে প্রমাণিত নিক্সনের যেকোন অপরাধের চেয়েও এটা গুরুতর অপরাধ। ওয়াটারগেট তদন্তে অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ ছিল – ক্যামবোডিয়ায় বোমাবর্ষণ। তবে ক্যামবোডিয়ায় বোমাবর্ষণের জন্য কেউ নিক্সনকে দায়ী করেনি, নিক্সনের “অপরাধ” ছিল এটাই যে তিনি বোমাবর্ষণের ঘটনাটিকে “গোপন” রাখার চেষ্টা করেছিলেন!

ব্ল্যাকস্টোন রেঞ্জার্স ঘটনাটার ন্যায় আরও ঘটনা আছে। সান দিয়েগোতে এফবিআই একটি চরম ডানপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনকে প্রতিপালন করত, নাম Secret Army Organization। এই সংগঠনটি আমার এক ছাত্রকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, তার মাধ্যমেই আমি এদের সম্পর্কে জানতে পারি। আপনাকে কিছুক্ষণ আগে কেমব্রিজে অর্থনীতির উপর যে সেমিনারটির কথা বলেছিলাম, এমআইটিতে ছাত্রাবস্থায় এই ছেলেটিই সেই সেমিনারের উদ্যোক্তা ছিল। ছেলেটি তখন সান দিয়েগো স্টেট কলেজে শিক্ষকতা করত আর অহিংস রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল।

SAO এর প্রধান তার এক সহযোগীকে নিয়ে ছেলেটির বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির সামনে এসেই সহযোগীটি গুলি ছুড়েছিল। ছেলেটি তখন বাসায় ছিল না, তবে এক তরুণী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হয়েছিল। SAO এর প্রধান অস্ত্রটি চুরি করেছিল। স্থানীয় ACLU(America Civil Liberties Union) এর ভাষ্য অনুযায়ী অস্ত্রটি পরদিন সান দিয়েগো এফবিআই অফিসে জমা রাখা হয়েছিল, এবং এফবিআই ছয় মাস ধরে এই ঘটনার ব্যাপারে পুলিশের কাছে মিথ্যা বলেছিল।

এই একই সন্ত্রাসী সংগঠনটি পরে এফবিআইয়ের নির্দেশনায় ও অর্থায়নে একটি প্রেক্ষাগৃহে বোমা হামলা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তখন পুলিশ সংগঠনটি বিলুপ্ত করে দেয়। এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এফবিআই এজেন্টকে অভিশংসন এড়ানোর জন্য ক্যালিফরনিয়ার বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়, সংগঠনটির প্রধানও পার পেয়ে যায়, তবে সংগঠনটির অধিকাংশ সদস্য অভিশংসিত হয়েছে। সেই সময় শিকাগোর ন্যায় সান দিয়েগোতেও এফবিআই বিভিন্ন কৃষ্ণাঙ্গ গ্রুপের মাঝে গ্যাং ওয়ারফেয়ার প্ররোচনায় প্রবৃত্ত ছিল। এফবিআইয়ের নিজস্ব নথিতেই তারা বস্তিগুলোতে গোলাগুলি, মারামারি ও অশান্তি সৃষ্টির দায়ভার স্বীকার করেছে। মিডিয়াতে এগুলোর কিছুই আলোচিত হয়নি।

আমার সেই ছাত্রটি তবুও এফবিআইয়ের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। বিভিন্ন প্ররোচকের মাধ্যমে তারা ছেলেটিকে হুমকি-ধামকি প্রদান করে গিয়েছে, এমনকি তার কলেজে গিয়ে জাল তথ্য প্রদান করে তার বিরুদ্ধে মিসকন্ডাক্ট চার্জ প্রদানেও কলেজকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ছেলেটিকে নিয়ে কলেজে তিনবার তদন্ত হয়, প্রতিটি তদন্তেই সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। এক পর্যায়ে ক্যালিফরনিয়া স্টেট কলেজ সিস্টেমের চ্যান্সেলর Glenn Dumke ঘোষণ করলেন যে তিনি কোন স্বতন্ত্র্য তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তকেই গ্রহণ করবেন না, এরপর তিনি ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করে দিলেন। এধরণের ঘটনা বহুবার ঘটেছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একে “কর্তৃত্ববাদ” হিসেবে দেখেনি। ’৭৫ এর জুনে ACLU এ নিয়ে চার্চ কমিটির কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছিল, মিডিয়ার দ্বারস্থও হয়েছিল, কিন্তু কমিটি কোন তদন্ত করেনি আর মিডিয়াও টু শব্দটি করেনি।

এধরণের সরকারী অবদমনের প্রচুর নিদর্শন আছে। শিকাগোতে আর্মির গোয়েন্দাসংস্থার অবৈধ কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়ার তথ্য আছে। সিয়াটলে বামপন্থী গ্রুপগুলোকে ধ্বংস করার জন্য প্রচুর কাজ হয়েছে। এফবিআই এক এজেন্টকে নির্দেশ দিয়েছিল সে যাতে কিছু চরমপন্থী তরুণকে একটি সেতু উড়িয়ে দিতে প্ররোচিত করে; পরিকল্পনাটি এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে বোমা প্রতিস্থাপনকারী ব্যক্তিটিও ব্রিজের সাথে উড়ে যায়, এবং এফবিআইও ছাড় পেয়ে যায়। তবে এজেন্টটি কর্তব্য পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রেসের কাছে সবকিছু খুলে বলে এবং আদালতেও সাক্ষী প্রদান করে, এভাবেই চক্রান্তটি প্রকাশ পেয়ে যায়।

সিয়াটলে একটি ডাকাতির ঘটনায় এফবিআই এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে ফাঁদে ফেলেছিল। ডাকাতিটি স্বয়ং এফবিআই সূচনা করেছিল, কিন্তু ঘটনা ঘটার সময়ই তরুণটি নিহত হয়। সাংবাদিক ফ্র্যাংক ডনার Nation পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছিলেন। পত্রিকাটি হাতেগোণা কয়েকটি পত্রিকার মধ্যে অন্যতম যা এখনও এসব ঘটনার উপর প্রতিবেদন ছাপে।

এধরণের বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে যদি আপনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এফবিআইয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের পলিসির প্রেক্ষাপটে অবলোকন করেন, তবেই কেবল এই আপাতঃ বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো অর্থবহ হয়ে উঠবে। কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পঞ্চাশের দশকে COINTEL প্রোগ্রাম সূচিত হয়েছিল। কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও সবাই কমবেশি এই প্রোগ্রাম সম্পর্কে অবগত ছিল। কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি, মানুষ উলটো এটা নিয়ে মশকরা করত।

বামপন্থীদের স্যাবোটাজ করার প্রোগ্রামটা ১৯৬০ সালে পুয়ের্তো রিকোতেও বিস্তৃত করা হয়েছিল। ১৯৬১ সালে এটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির তত্ত্বাবধানে এফবিআই আমেরিকার সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিকে(আমেরিকার বৃহত্তম ট্রটস্কিপন্থী সংগঠন) স্যাবোটাজ করতে নেমেছিল। পরবর্তীতে সিভিল রাইটস আন্দোলন, কু ক্লুক্স ক্ল্যান, কৃষ্ণাঙ্গন্দের বিভিন্ন গ্রুপ, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনও এই প্রোগ্রামের আওতায় পড়েছিল। সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে কার্যক্রমের পেছনে এফবিআইয়ের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে যে যুক্তি দেখানো হয়েছিল তা বেশ মজার,

We launch this program for the following reasons: (1) the Socialist Workers Party is openly running candidates in local elections throughout the country; (2) it supports integration in the South; (3) it supports Castro

অর্থাৎ, নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড়া করানো, নাগরিক অধিকার সমর্থন করা আর আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বদলাতে চাওয়া প্রভৃতি কর্মকান্ড সম্পূর্ণ বৈধ হলেও তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পুলিশের পদক্ষেপ নেওয়া জায়েজ হয়ে যায়!

ষাটের দশকে COINTELPRO ও অন্যসব সরকারী কীর্তিকলাপের সঙ্গে ওয়াটারগেটের তুলনা করলে ওয়াটারগেটকে স্রেফ ছেলেখেলা বৈ কিছু মনে হয় না। অবৈধ কাজ করার জন্য নিক্সনের পতন ঘটেনি, শত্রু নির্বাচনে ভুল করার ফলেই নিক্সনের পতন ঘটেছে। এখানে নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কোন দুঃচিন্তা পরিলক্ষিত হয় না। ওয়াটারগেট আর যাই হোক, “গণতন্ত্রের জয়” নহে।

Ronat: যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও বিল অব রাইটস হতে কিছু অনুচ্ছেদ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা একবার লিফলেট আকারে রাস্তায় বিতরণ করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেই প্রস্তাবনায় সই করতে রাজি হয়নি, কারণ তাদের কাছে সেটি বামপন্থী প্রপাগান্ডা মনে হয়েছিল! এ ব্যাপারে কিছু বলুন।

চমস্কি: এই ঘটনাটা খুব সম্ভবত ’৫০ এর দশকে ঘটেছিল। ম্যাকার্থির সমাজতন্ত্রবিরোধী হিস্টেরিয়ার সেই যুগে মানুষ সঙ্গত কারণেই ভীত ছিল। উদারপন্থীরা মনে করেন দোষটা কেবলই জো ম্যাকার্থি আর রিচার্ড নিক্সনের, যেটা আসলে ভুল। ১৯৪৭ সালে হ্যারি ট্রুম্যান যেসব নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেগুলোও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দমন-পীড়নের জন্য দায়ী। উদারপন্থী সিনেটর হিউবার্ট হামফ্রিই প্রথম “রাষ্ট্রীয় সংকটকালে” ডিটেনশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য পরে এই উদ্দেশ্যে প্রণীত McCarran Act এর বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছিলেন, তবে তিনি এও বলেছিলেন যে তাঁর কাছে এক্টটি যথেষ্ট কঠোর মনে হয়নি; এই এক্টে বন্দীদেরকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু সিনেটর হামফ্রি মনে করেন কমিউনিস্ট কুচক্রীদের এত বেশি সুবিধা দেওয়া উচিত না! কয়েক বছর পর উদারপন্থীরা যেই Communist Control Act প্রণয়ন করেছিল তা এতটাই অসাংবিধানিক ছিল যে কেউ তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টাও করেনি। এই আইনটি ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে লক্ষ্য করে প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই সিনেটরদের পাশাপাশি উদারপন্থী বুদ্ধিজীবিরাও ম্যাকার্থির সন্ত্রাসকে সহযোগিতা করেছে, তারা কেবল তখনই প্রতিবাদ করেছে যখন তারা নিজে সেই দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হতে তারা আপাতঃ বামপন্থী ছাত্র-শিক্ষকদের হটিয়েছে, আমেরিকান সমাজ হতে এই বামপন্থী “ক্যান্সার” দূর করার মতাদর্শিক রসদটাও এই উদারপন্থী বুদ্ধিজীবিরা যুগিয়েছে। আমেরিকার বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে যে অনন্য সংকীর্ণতা আর অন্ধ আনুগত্য দেখা যায়, তা এমনি এমনিই হয়নি।

ম্যাকার্থি যখন সমাজতন্ত্রী শিকার করতে গিয়ে ফ্রেন্ডলি ফায়ার করে ফেলেছে, তখনই এসবই উদারপন্থীরা প্রতিবাদে সরব হয়েছে। ম্যাকার্থি যখন গীর্জা আর সেনাবাহিনীর দিকেও থাবা বাড়ালেন, তখন তিনি নিক্সনের মতই ভুল লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনের হেতু পতনোন্মুখ হলেন। দেশ থেকে সমাজতন্ত্রীদের বিতাড়নের বেলায় ম্যাকার্থির সাথে উদারপন্থীদের কোন মতবিরোধ ছিল না, দ্বিমত ছিল শুধু তার কর্মপদ্ধতিতে।

Ronat: বিদেশে সিআইএর গুপ্তহত্যাবৃত্তি নিয়ে যে হইহল্লা হল, সেখানেও আমি দেখেছি যে সমস্যাটার মূলে মনোনিবেশ করা হয়নি।

চমস্কি: তা তো বটেই। সিআইএ বিদেশী নেতাদের হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে জেনে মানুষ বিস্মিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে খারাপ কাজ। কিন্তু সিআইএ যখন গণহারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করে তখন সেগুলো নিয়ে হইচই হয় না কেন? সিআইএ পরিচালিত ফিনিক্স প্রোগ্রামে সাইগন সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই বছরে ৪০০০০ সিভিলিয়ান নিহত হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ কি ক্যাস্ট্রো কিংবা শ্নাইদারের হত্যাচেষ্টা হতে কম গুরুত্বপূর্ণ? এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী প্রাক্তন সিআইএ প্রধান উইলিয়াম কোলবি বর্তমানে একজন সম্মানিত কলামলেখক ও প্রভাষক। লাওসের হত্যাযজ্ঞ তো এর চেয়েও ভয়াবহ।

ঘুরে ফিরে সবসময় সেই একই কাহিনী - যে অপরাধগুলো প্রকাশিত ও আলোচিত হয় সেগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পর্দার অন্তরালের রাষ্ট্রের প্রকৃত ভয়াবহ কুকীর্তিগুলো সবসময়ই চাপা পড়ে যায়, এমনকি এগুলোকে বৈধ বিবেচনাও করা হয়।

Ronat: আপনি এই তথ্যগুলো পান কিভাবে? এগুলো তো পত্রিকায় আসে না।

চমস্কি: আমার মত যারা জীবনের একটা বৃহৎ অংশ এসব তথ্যানুসন্ধানে পার করেছে, তাদের কাছে তথ্যগুলো পাওয়া কোন ব্যাপার না। তবে এই তথ্যগুলোর লভ্যতার কোন বাস্তবিক গুরুত্ব নেই। তবে এধরণের তথ্যানুসন্ধানের জন্য অন্য সব কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক অনুকূল। সোভিয়েত ইউনিয়নে একই কাজ করতে গেলে আমি হয়ত জেলে যেতাম। এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে আমার লেখাগুলো পৃথিবীর অনেক দেশে তর্জমা করা হলেও তথাকথিত সমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে অনূদিত হয়নি। তবে তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ অবদমনমুক্ত মনে করার কারণ নেই। এখানে অপেক্ষাকৃত বেশি মতস্বাধীনতা থাকলেও জনমানসে এর তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।

একটা উদাহরণ দিই। কিছু কাল আগে আমাকে হারভার্ডে সাংবাদিকদের এক সমাবেশে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই সমাবেশে আগত সাংবাদিকদের Nieman fellows বলা হত। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যসব দেশ হতে সাংবাদিকরা এই সম্মেলনে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে যোগ দেয়। সেই সম্মেলনে আমাকে ওয়াটারগেট কেলেংকারি নিয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। আগেই বলেছি, ওয়াটারগেট কেলেংকারি উন্মোচনে মিডিয়ার নায়োকচিত ভূমিকার কারণে মিডিয়াকর্মীরা অত্যন্ত আত্মশ্লাঘায় ভুগছিলেন। আমি ওয়াটারগেটের বদলে এফবিআইয়ের উপরোক্ত কার্যক্রম নিয়ে বক্তৃতা করেছিলাম। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই সাংবাদিকদেরই এসব বিষয়ে বেশি অবগত হওয়ার কথা, কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম তাঁরা কেউই এফবিআইয়ের এই বৃহত পরিসরের দমন-পীড়ন সম্পর্কে কিছু জানেন না। শিকাগো থেকে আগত একজন সাংবাদিক হ্যাম্পটনের ঘটনাটি জানতেন, শিকাগোর মিডিয়াতে সেটা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছিল। সান দিয়েগো থেকে কেউ আসলে হয়ত তিনি Secret Army Organization সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেন।

লক্ষ করুন – এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি কাজ করে যে তাঁরা যা কিছু জেনেছেন তা সবই আঞ্চলিক ঘটনা ও ব্যতিক্রম, তারা এসব কিছুর মাঝে কোন বৃহত্তর সংযোগ খেয়াল করেন না। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তথ্যগুলো ঠিকই উঠে আসে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এসব তথ্যের গুরুত্ব ও মধ্যকার সংযোগ চাপা পড়ে যায়। ওয়াটারগেট কেলেংকারির সময়ও তা-ই হয়েছে। এটা একটা খুবই কার্যকরী মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ। ফ্যাক্ট অনুসন্ধান করার জন্য আপনাকে কারাবন্দি হতে হবে না, সেই ফ্যাক্ট জোড় গলায় প্রচার করার জন্যও আপনাকে শাস্তি পেতে হবে না, কিন্তু দিনশেষে বাস্তবতা ঠিকই অবগুন্ঠিত রয়ে যাবে।

Ronat: আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিনের ব্যাপারে আমেরিকানদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

চমস্কি: লিবারেল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়াটা ব্যাপক আগ্রহোদ্দীপক। কেউ কেউ তাঁর বাড়াবাড়ির সমালোচনা করেছে, কিন্তু অধিকাংশই তাঁর “নৈতিক মহিমা”তে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এতে করে সোভিয়েট সরকারবিরোধীরাই বিপাকে পড়ত। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার দৌর্বল্যের সমালোচক ছিলেন, স্পেনে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিরোধী ছিলেন, আমেরিকাতে সেন্সরশিপ আরোপ করতে চাওয়া একটি সাময়িকীর সমর্থক ছিলেন।

সলঝেনিৎসিনের নৈতিক দৃঢ়তার সাথে কেবল সেসব আমেরিকান সমাজতন্ত্রীদের তুলনা চলে যারা স্বদেশে নাগরিক অধিকারের জন্য লড়লেও সোভিয়েত রাশিয়ায় দমন-পীড়নের সাফাই গেয়েছিলেন, নয়ত সম্পূর্ণ চুপ ছিলেন। আন্দ্রে সাখারভ সলঝেনিৎসিনের মত বাড়াবাড়ি না করলেও তিনিও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার আগ্রাসনের পক্ষপাতী ছিলেন। আমেরিকান সমাজতন্ত্রীরা যেমন রুশ প্রপাগান্ডা আওড়েছেন, এই রুশ বুদ্ধিজীবিরাও আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা আওড়ে গিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য সাখারভের প্রশংসা হতে পারে, তবে তাঁকে নৈতিকতার স্তম্ভ মনে করা ঠিক না। তাঁদের এসব কথাবার্তা মিডিয়ায় এত গুরুত্ব পেয়েছে কেন? কারণ আমেরিকান বুদ্ধিজীবিদের একটা গুরুদায়িত্ব হল মানুষকে বোঝানো যে আমেরিকায় কোন নৈতিক বিপর্যয় হয় না, এই ব্যাপারগুলা শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই ঘটে, আর এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্যই সলঝেনিৎসিন-সাখারভদের আবির্ভাব ঘটেছে।

যত হাজার হাজার মানুষ ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যক্ত করে ফিরে এসেছে, তারা বরং নৈতিকতার দৌড়ে সলঝেনিৎসিনের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। সলঝেনিৎসিনরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়েছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধীরা অন্যদের অধিকারের জন্য লড়েছিলেন, আমেরিকান আগ্রাসনের ভুক্তভোগীদের অধিকারের জন্য লড়েছিলেন। এই যুদ্ধবিরোধীরা নিজেরা মার খেয়ে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নামেননি; তারা চাইলেই কারাগার কিংবা নির্বাসনের ঝুঁকি না নিয়ে আরামে দিনাতিপাত করতে পারতেন, কিন্তু তারা তা করেননি। আমেরিকার উদারপন্থী সাময়িকীগুলোর দৃষ্টিতে তবুও সলঝেনিৎসিনই নৈতিকতার চ্যাম্পিয়ন।

এখন প্রায়ই দাবি করা হয় যে তরুণরা যুদ্ধে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ এড়ানোর জন্যই নাকি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নেমেছিল - একটা ডাহা মিথ্যা কথা। আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই চাইলে তাদের শ্রেণীঅবস্থানবলে ড্রাফট এড়াতে পারত(যেমনটা অনেকেই করেছিল), কিন্তু তারা তবুও প্রতিবাদের কণ্টকাকীর্ণ রাস্তায় হেটেছে। যারা রণক্ষেত্র ত্যাগ করে ফিরে এসেছিল, তারাও অবধারিত পরিণতি স্বীকার করেই ফেরত এসেছে। যারা প্রথমে যুদ্ধে সমর্থন দিলেও পরে ক্ষয়ক্ষতির বোঝা বইতে না পেরে মৃদু স্বরে বিরোধীতা করেছে, তারা অন্তত এসব তরুণদের ন্যায় নৈতিক দৃঢ়তা দাবি করতে পারে না। আমেরিকান উদারপন্থীদের কাছে এই ব্যাপারটা বিব্রতকর। যদি প্রশ্ন করি যখন তরুণরা জেলে যাচ্ছিল তখন তাঁরা কী করছিলেন, কী উত্তর দিবেন তাঁরা? সলঝেনিৎসিন একারণে তাঁদের কাছে আশীর্বাদরুপে এসেছিলেন, সলঝেনিৎসিনের কাঁধে তাঁরা এই নৈতিক দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়ে বেঁচেছিলেন।

জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত ময়নিহান তৃতীয় বিশ্বের সমালোচনা করে অনেকটা একই কাজ করেছিলেন। তিনি উগান্ডার ইদি আমিনকে “বর্ণবাদী ঘাতক” আখ্যা দিয়ে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিলেন। ইদি আমিন অবশ্যই একজন “বর্ণবাদী ঘাতক” ছিলেন, তবে সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হল ময়নিহান কর্তৃক এই সমালোচনা ও তাঁর সমাদৃত হওয়ার গূঢ় তাৎপর্যটা কী?

কে এই ময়নিহান? তিনি একাধারে কেনেডি, জনসন, নিক্সন ও ফোর্ড প্রশাসনের অংশ ছিলেন, এবং এই চারটি প্রশাসনই ইদি আমিনের চেয়েও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী। মনে করেন থার্ড রাইখের কোন কর্মকর্তা কাউকে “বর্ণবাদী ঘাতক” হিসেবে অভিহিত করল! নৈতিক ইস্যুগুলো নিয়ে সরব হওয়ার দায়িত্বটা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল মার্কিন বলপ্রয়োগের নৈতিক বৈধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার অন্যতম পন্থা, যা কিনা ভিয়েতনাম যুদ্ধে নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। সলঝেনিৎসিনকে এই উদ্দেশ্যে সঙ্গতভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে, তবে তাই বলে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগকে অবমূল্যায়ন করা চলবে না।

এঞ্জেলা ডেভিসের কথাই ধরুন: তিনি আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন, কিন্তু তিনি একই সাথে চেকোস্লোভাকিয়ায় রুশ আগ্রাসনের সমালোচনা করতে অনীহ ছিলেন। তাঁকে কি “নৈতিকতার রোলমডেল” হিসেবে দেখা হয়? না। তবে আমার মতে নৈতিকতার দিক দিয়ে এঞ্জেলা ডেভিস সলঝেনিৎসিনের চেয়ে উৎকৃষ্ট। ডেভিস অন্তত সোভিয়েত রাষ্ট্রকে আরও বেশি অত্যাচারী না হওয়ার জন্য তিরস্কার করেননি।

Ronat: তাহলে আপনার বক্তব্যের জের ধরে আমরা বলতে পারি যে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র এক প্রকার ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতির চর্চা করে। ইচ্ছাকৃতভাবেই কোন অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ ঘটনাকে বৃহত কেলেংকারি রুপে তুলে ধরে মানুষকে ব্যস্ত রাখা হয়। যখন প্রকৃত কেলেংকারিগুলো অবভাসিত হয়, ততদিনে সেগুলো নতুনত্ব হারিয়ে ফেলে, মানুষ আর চকিত হয় না, পত্রিকাগুলোও শিরোনাম করে না।

চমস্কি: হ্যাঁ, যুদ্ধোত্তর সময়ে উদারপন্থী মিডিয়া সম্পর্কে আমি এই কথাটাই বলে আসছি। সরকারের জন্য এখন তার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাই সে ইতিহাস নতুন করে লিখতে সচেষ্ট। বুদ্ধিজীবিরা অনেকাংশে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই যুদ্ধ থেকে কিছু “শিক্ষা” গ্রহণ করাটাও জরুরী, তবে এই শিক্ষাটাকে যথাসম্ভব সংকীর্ণ করে উপস্থাপন করতে হবে। এজন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধকে অভিহিত করার জন্য “stupidity”, “error”, “ignorance”, “cost” প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা হয় যাতে যুদ্ধের সামাজিক দায়টা চাপা পড়ে যায়।

কেন এই কাজটি করা হয়? কারণ খুব শীঘ্রই অন্য কোন মার্কিন আগ্রাসনের পক্ষে সাফাই গাইতে হবে, হয়ত আরেকটা ভিয়েতনাম আক্রান্ত হবে। তবে এই আগ্রাসনগুলো যেন ভিয়েতনামের মত নাগালের বাইরে চলে না যায়! ডমিনিকান রিপাবলিক ও চিলিতে মার্কিন আক্রমণ হল সফল আগ্রাসনের উদাহরণ। মিডিয়া এসব সফল আগ্রাসনের সমালোচনা করার ক্ষমতা রাখে বটে, যতক্ষণ না পর্যন্ত্য তারা সীমা অতিক্রম করছে। অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত্য এসব সমালোচনার হেতু কোন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণআন্দোলন মাথাচাড়া দিচ্ছে না অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যৌক্তিক বিশ্লেষণ রচিত হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত্য লিবারেল মিডিয়া এরুপ “সমালোচনা” সহ্য করবে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যাপারে উদারপন্থী মিডিয়ার বর্তমান অভিমত কী? তারা এটিকে এখন মার্কিন সরকারের “স্টুপিডিটি” হিসেবে দেখছে। “স্টুপিডিটি” একটি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ শব্দ। মার্কিন সরকার কোন “ইন্টেলিজেন্ট” নীতিমালার অনুসরণে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরিচালনা করলে লিবারেলরা আপত্তি করত না। অর্থাৎ, আমলাদের ঔদ্ধত্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের “সৎ” উদ্দেশ্য “বেঠিক” পলিসির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে, এটাই যেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের মূল ট্র্যাজেডি! লিবারেল মিডিয়া এই যুদ্ধের নৃশংসতার মৃদু সমালোচনাও করেছে, তবে এখানেও একটা “কিন্তু” আছে – যেহেতু উদ্দেশ্যটি মহৎ ছিল, তাই মার্কিন সমরযন্ত্র আরেকটু মানবিক হলেও পারত!

যারা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, তারা নিছক বৈষয়িক কারণেই বিরোধীতা করেছিল। এই বিরোধীতার খাতিরে তাদেরকে একটি মতাদর্শ পুনঃনির্মাণ করতে হয়েছে যার প্রধান অনুমিতি হল যুক্তরাষ্ট্র মানবতার বন্ধু, ঐতিহাসিকভাবেই দেশটি মানবাধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় একনিষ্ঠ। এই দিক দিয়ে এসব যুদ্ধবিরোধীদের সাথে যুদ্ধবাজদের কোন পার্থক্য নেই – দুইটা গোষ্ঠীই একমত যে যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে হস্তক্ষেপের অধিকার রাখে। তাদের সমালোচনাকে রাষ্ট্র স্বাগত জানায়, হালকা সমালোচিত হতে রাষ্ট্রের কোন আপত্তি নেই যতক্ষণ না তার ভিনদেশে হস্তক্ষেপের “মৌলিক অধিকার” নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে এই স্মৃতিচারণমূলক সম্পাদকীয়টি দেখুন। সম্পাদকরা মনে করেন এখনও ভিয়েতনাম নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় আসেনি:

Clio, the goddess of history, is cool and slow and elusive in her ways....Only later, much later, can history begin to
make an assessment of the mixture of good and evil, of wisdom and folly, of ideals and illusions in the long Vietnam story....There are those Americans who believe that the war to preserve a non-Communist, independent South Vietnam could have been waged differently. There are other Americans who believe that a viable, non-Communist South Vietnam was always a myth....A decade of fierce polemics has failed to resolve this ongoing quarrel.

লক্ষ করুন যে সম্পাদকবৃন্দ তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করতে পারতেন কিন্তু করেননি , যে ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নৈতিক ও আইনী অধিকার যুক্তরাষ্ট্র্বের নেই। যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা নিয়ে বিতর্কটা ইতিহাসই সমাপন করবে, কিন্তু অন্য দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক না গলানোর ব্যাপারটা এখনই আলোচনার দাবি রাখে। পত্রিকাটি এই সম্পাদকীয়র অনেক পাঠক প্রতিক্রিয়া ছাপিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্নবোধক প্রতিক্রিয়াগুলো ছাপায়নি। আমি কিভাবে জানলাম যে তারা বিরুপ প্রতিক্রিয়াগুলো ছাপায়নি? কারণ, আমি নিজেই একটি প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছিলাম।

April 8, 1975
To the Editor
New York Times
229 West 43d St.
New York, N.Y. 10036

Dear Sir:
An editorial in the Times, April 5, observes that “a decade of fierce polemics has failed to resolve this ongoing quarrel” between two contending views: that “the war to preserve a non-Communist, independent South Vietnam could have been waged differently,” and that “a viable, non-Communist South Vietnam was always a myth.” There has also been a third position: That apart from its prospects for success, the United States has neither the authority nor competence to intervene in the internal affairs of Vietnam. This was the position of much of the authentic peace movement, that is, those who opposed the war because it was wrong, not merely because it was unsuccessful. It is regrettable that this position is not even a contender in the debate, as the Times sees it.

On a facing page, Donald Kirk observes that “since the term ‘bloodbath’ first came into vogue in the Indochinese
conflict, no one seems to have applied it to the war itself— only to the possible consequences of ending the war.”
He is quite wrong. Many Americans involved in the authentic peace movement have insisted for years on the elementary point that he believes has been noticed by “no one,” and it is a commonplace in literature on the war. To mention just one example, we have written a small book on the subject (Counterrevolutionary Violence: Bloodbaths in Fact and Propaganda, 1973), though in this case the corporation (Warner Brothers) that owned the publisher refused to permit distribution after publication. But quite apart from this, the observation has been made repeatedly in discussion and literature on the war, by just that segment of opinion that the Times editorial excludes from the debate.

Sincerely yours,
Noam Chomsky
Professor, MIT

Edward S. Herman
Professor, University of Pennsylvania

লক্ষ করুন, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটি যেহেতু আলোচনার পরিসর বেঁধে দিচ্ছে, তাই পিস মুভমেন্টের অবস্থানটি আলোচনাতেই আসতে পারছে না। এখানে কিন্তু পিস মুভমেন্টের অবস্থানকে “ভুল” হিসেবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে না, বরং পিস মুভমেন্টের অবস্থানটি যেন অভাবনীয়, অসম্ভব! যেন এর অস্তিত্বই নেই! যেহেতু পত্রিকাটি সংলাপের মূলনীতিগুলো নির্ধারণ করে দিচ্ছে, তাই রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডার মূলনীতিগুলোতে সংলাপের উভয় পক্ষই একমত – যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল “স্বাধীন” দক্ষিণ ভিয়েতনামকে রক্ষা করা, তবে সেই উদ্দেশ্য আদৌ সাধন করা সম্ভব হত কিনা সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। এরকম দুঃসাহসী অপপ্রচারযন্ত্র খুব কমই আছে যেখানে রাষ্ট্রীয় মতবাদকে এত দৃঢ়ভাবে রোপন করা হয়েছে যে বিরুদ্ধমতের সমালোচনা তো দূরের কথা, এর অস্তিত্বকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়।

আমরা এখানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অপপ্রচারের কার্যক্রমের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। একটি কর্তৃত্বকামী রাষ্ট্র পরিস্কার ভাষায় রাষ্ট্রীয় মতবাদটি ঘোষণা করে। আপনি অন্তরে এটা সম্পর্কে যাই ভাবুন, তা প্রকাশ করতে হলে স্বীয় ঝুঁকিতেই প্রকাশ করতে হবে। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রীয় মতবাদের বিরোধীতা করার জন্য কাগজে কলমে শাস্তির বিধান নেই, এমনকি ভিন্নমত উৎসাহিতও করা হয়। এধরণের রাষ্ট্র যে কাজটা করে তা হল তারা সম্ভাব্য চিন্তার সীমারেখা টেনে দেয়। এক পাশে থাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদের সমর্থক, আরেক পাশে থাকে এই মতবাদের সমালোচক। সমালোচকগোষ্ঠী তাদের ভিন্নমত ধারণের ক্ষমতার জন্য সম্মানিতও হন বটে। প্রথম গোষ্ঠী হল বাজপাখি, পরোক্ত গোষ্ঠী হল পায়রা। তবে একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখি যে দু’টো গোষ্ঠীই কিছু অনুমিতিতে একমত, আর এই অনুমিতিগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুকৌশলে প্রবিষ্ট করাটাই বেশি কার্যকরী, ভিন্নমতাবলম্বীদের শাস্তি দেওয়ার চেয়ে ভিন্নমতের অস্তিত্বটাই অস্বীকার করে ফেলাটা বেশি ফলপ্রসূ। এই “বিতর্ক” যত তেজস্বী হবে, রাষ্ট্রীয় অপপ্রচারের মূলনীতিগুলো তত গভীরে প্রবিষ্ট হবে। একারণেই মূলত ভাব দেখানো হয় যে মিডিয়া খুব সমালোচকের ভূমিকা পালন করছে, যখন আদতে মিডিয়া রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সাথে খুব ভালভাবেই একমত। এক্ষেত্রে এটা নিঃসংকোচে বলা যায় যে অন্যদেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের “মৌলিক অধিকার” নিয়ে মিডিয়ার কোনই আপত্তি নেই। একটি খুবই কার্যকরী অপপ্রচার যন্ত্রের ফসল এই মতৈক্য।

একই ধরণের আরেকটা উদাহরণ দেখা যাক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত ওয়াশিংটন পোস্টের “Deliverance” শিরোনামের সম্পাদকীয়র এই অংশটি দেখুন, ১৯৭৫ এর ৩০ এপ্রিলে প্রকাশিত,

ভিয়েতনাম পলিসি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি, এই পলিসির করুণ পরিণতি নিয়ে কোন সংশয় নেই, কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে পলিসিটির কিছু কিছু উদ্দেশ্য মহৎ ও প্রণিধানযোগ্য ছিল। বিশেষত, দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিজেদের সরকারব্যবস্থা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে এটা আশা করে আমরা কোন ভুল করিনি। মহৎ উদ্দেশ্য কিভাবে কদর্য পলিসিতে রুপান্তরিত হতে পারে এটা নিয়ে আমেরিকান জনগণের চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন আছে, তাই বলে সেসব মহৎ উদ্দেশ্যগুলোকে ভুলে যাওয়ার কারণ নেই।

এই “মহৎ উদ্দেশ্যগুলো” কী কী? যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কবে, কখন দক্ষিণ ভিয়েতনামকে নিজেদের সরকার নির্বাচনে সহায়তা করেছিল? এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলেই এই দাবির উদ্ভটত্ব প্রস্ফুটিত হয়। মার্কিন মদদপুষ্ট ফরাসীরা যখন ভিয়েতনামের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করতে ব্যর্থ হল, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছে, ঠেকায় পড়ে গায়ের জোড়ও খাটিয়েছে। আমাদের যে রাষ্ট্রধর্ম – যুক্তরাষ্ট্র আসলে সদাশয় কিন্তু মাঝে মাঝে অজ্ঞতাবশঃত ভুল করে ফেলে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু ভুল পলিসির ফলে মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করে ফেলে – এই রাষ্ট্রধর্মকে উদারতান্ত্রিক মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আমরা “আমেরিকানরা” সবসময়ই ভাল, তবে একেবারে ভুলের উর্ধ্বে নই,

For the fundamental “lesson” of Vietnam surely is not that we as a people are intrinsically bad, but rather that we are capable of error—and on a gigantic scale...

লক্ষ করুন - “we as a people”। আমরা সাধারণ মানুষরা কি ভিয়েতনামে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম? নাকি এখানে দায়ভারটা আমাদের রাজনীতিবিদদের ও তাদের উপর প্রভুত্বকারী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের? এধরণের প্রশ্ন তোলা রাষ্ট্রধর্মের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে, কারণ এই প্রসঙ্গ তুললে অবধারিতভাবে ক্ষমতার বাস্তবিক উৎস কী এই প্রশ্নটাও চলে আসবে, আর এই প্রশ্ন অন্য দেশের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ! যারা এসব জিজ্ঞেস করে তারা “চরমপন্থী”, তাদের সাথে তর্ক বৃথা! বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ হস্তক্ষেপ রীতিসিদ্ধকরণের এসব প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, আপনাকে এই টেকনিকের ট্র্যাকরেকর্ড দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে ব্যর্থ হয়েছে; ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ব্রাজিলে কিন্তু ব্যর্থ হয়নি।

সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ সীমিত পরিসরে বিরুদ্ধবাদী আলোচনা সহ্য করে, আগেই বলেছি। বুদ্ধিজীবি ও সরকারের উপদেষ্টাদের ভুলের সমালোচনা করা যাবে, তাদের বিরুদ্ধে “আধিপত্য বিস্তার” এর অভিযোগও উত্থাপন করা যাবে, যদিও এই অভিযোগটি সুনির্দিষ্টভাবে কোন সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক কাঠামোকে চিহ্নিত করে না বিধায় অভিযোগটি খুবই বিমূর্ত। কিন্তু আপনি যখনই “আধিপত্য বিস্তার” এর এই বিমূর্ত অভিযোগের সাথে গায়ের জোড় প্রয়োগ করে অন্য দেশে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেশনগুলোর জন্য ময়দান উন্মুক্ত রাখার সংযোগ স্থাপন করবেন, তখনই আপনি সীমা অতিক্রম করবেন। একারণে বুদ্ধিজীবি সমাজের লোকজন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির এই প্রবৃত্তি সংক্রান্ত সব প্রকার দলিল-নথিপত্র সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়। আমি এরকম দুইটা গুরুত্বপূর্ণ নথির উদাহরণ দিতে পারি –

১) Pentagon papers – ’৪০ এর দশক হতে ’৫০ এর দশক পর্যন্ত্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এই নথিগুলোতে পাওয়া যাবে

২) Council of Foreign Relations এর War-Peace Studies গ্রুপগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তব্য সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়ে যেসব নথি প্রস্তুত করেছিল

পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে করপোরেশন ও অর্থনৈতিক নিয়ামকের প্রভাব সংক্রান্ত আলোচনা কেবলমাত্র ফুটনোটেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। পলিসি নির্ধারক গোষ্ঠীগুলোর এই প্রবণতা নিয়ে গবেষণাও হয়েছে।

রাজনৈতিক আলোচনায় কী কী বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে আর কী কী বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না – এগুলা নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেই আমরা বের করতে পারব কোন নৈর্ব্যক্তিক সূত্রগুলো(objective laws) আমাদের রাজনৈতিক আলোচনার গতিপথ নির্ধারণ করে। এই নৈর্ব্যক্তিক সূত্রগুলো উন্মোচন করতে পারলে আমরা মতাদর্শকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটা “theory of ideology” দাঁড়া করাতে পারব। তবে আপাতত এই সব কিছু কেবলই রুপকার্থে নিতে হবে।


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

বেশ বড় লেখা। ভাগে ভাগে পড়ছি। পুরোটা শেষ করার আগে অনুবাদের ব্যাপারে একটা মন্তব্য করি।

লেখাটা যেহেতু সাক্ষাতকার সেহেতু, কথাগুলো দুজন মানুষের কথপোকথনের মত শোনানো উচিত। মূল ইংরেজীটা পড়িনি/শুনিনি। তবে এই অনুবাদের বাক্যগুলো বেশি আনুষ্ঠানিক শোনাচ্ছে। যেমন,

১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকার লিবারেল মিডিয়া এই যুদ্ধ নিয়ে কিরুপ পর্যালোচনা করেছিল আমি সেটা নিরীক্ষণ করে দেখেছিলাম।

বাংলায় এভাবে কেউ কথা বলে না। এটা সত্য যে আলোচনার বিষয়বস্তু ঠিক দৈনন্দিন বিষয়বস্তুর মত না। তবু, ভাষাটা অন্তত হুমায়ুন আজাদের "সাক্ষাৎকার" বইটার মত হতে পারতো।

পরিশ্রমসাধ্য কাজটার জন্য উত্তম জাঝা!
আমি চমস্কির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম বছর খানেক আগে। একসময় অনুবাদ করার চিন্তা মাথায় এলেও আকার দেখে পরে আর হয়ে ওঠেনি। http://www.theatlantic.com/technology/archive/2012/11/noam-chomsky-on-where-artificial-intelligence-went-wrong/261637/2/ কিন্তু গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছি লেখাটা থেকে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

এক লহমা এর ছবি

চলুক
এখনো অর্ধেক ও পড়ে উঠতে পারি নি। যতটুকু পড়েছি খুবই ভাল লেগেছে। বাকিটাও আস্তে আস্তে পড়ে ফেলব আশা রাখি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

পৃথ্বী এর ছবি

পোস্ট করার সময় আমারও মনে হচ্ছিল বেশি বড় হয়ে গেছে, কিন্তু সাক্ষাৎকার খন্ডে খন্ডে পোস্ট করলে ফ্লো নষ্ট হতে পারে বিধায় একবারেই পোস্ট করেছি চিন্তিত


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

নির্ঝর অলয় এর ছবি

একসাথে দিয়ে খুব ভালো করেছ। বেশ নাড়া দেয়া সাক্ষাৎকার। তথাকথিত উদারতার আড়ালে গলিত-স্খলিত বুদ্ধিবেশ্যাদের নগ্ন চেহারাটা ফুটে উঠেছে।

তোমার অনুবাদের ভাষা নিয়েও আমার অভিযোগ নেই। ভাষা সরল হতে হবে, কিন্তু তরল নয়।

পিঙ্গল এর ছবি

এতটা পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য ধন্যবাদ। বেশিরভাগটাই মাথার উপর দিয়ে গেল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।