তালেবান, নারীবাদ আর প্রতিবিপ্লবের রাজনীতি - ১

পৃথ্বী এর ছবি
লিখেছেন পৃথ্বী [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৩/০৯/২০১৬ - ৫:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল: Hirschkind, Charles and Saba Mahmood. "Feminism, The Taliban, And Politics Of Counter-Insurgency". Anthropological Quarterly 75.2 (2002): 339-354. Print.

কিঞ্চিত অভিযোজিত।


১৯৯৯ এর মার্চে Feminist Majority নামক একটি নারীবাদী সংগঠন তালেবানের নারী নির্যাতন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো। আয়োজকদ্বয় Jay Leno এবং Mavis Leno। হলিউড তারকারা দল বেঁধে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। Directors Guild of America এর সম্মেলন কেন্দ্র ভরাট হয়ে গিয়েছিলো শ্রোতায়, সবাই জে লেনোর অস্রুসজল বক্তৃতা শুনছিলো। শ্রোতামন্ডলির কেউই হয়ত আগে আফগান নারীদের দুরবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। সেদিন সবার চোখ আর্দ্র হয়েছিলো।

ক্যামপেইনটা শুরু করেছিলেন জে লেনোর স্ত্রী ম্যাভিস লেনো। ম্যাভিস আগে অরাজনৈতিক একটিভিজম করতেন; যেমন, তিনি “Freddy the Pig” নামক এক আউট-অফ-প্রিন্ট শিশুতোষ বই পুনঃপ্রকাশের জন্য কাজ করছিলেন। বেভারলি হিলে তাঁর এক প্রতিবেশী তাঁকে Feminist Majority তে ঢুকিয়ে দেন। তাঁর হাত ধরেই সংগঠনটির প্রধান ক্যামপেইন হয়ে উঠে তালেবানদের নারী নির্যাতনকে হেডলাইন করা। তাদের ক্যামপেইনের সাথে প্রচুর নারী-বিষয়ক ও নারীবাদী পত্রিকা যুক্ত হয়। লেনো দম্পতি ক্যামপেইনে এক লাখ ডলার অনুদান দেন। ম্যাভিস লেনো সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে তদবির করেন, Union Oil Company of California এর অংশীদারদের আফগানিস্তানে পাইপলাইন নির্মাণে বিনিয়োগ না করতে অনুরোধ করেন, বিল ক্লিনটনের সাথে সাক্ষাত করে তালেবানদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাদের এসকল কার্যক্রম সফল হয়, এবং Feminist Majority এর কৃতিত্ব দাবি করে।

পশ্চিমা নারীবাদীদের মাঝে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের “উদ্ধার” করার অহমিকার যারা সমালোচনা করেন, তারাও Feminist Majority এর ক্যামপেইনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তালেবানের নারী নির্যাতন নিয়ে তো কোন সংশয় নেই; তারা মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে, চাকুরী থেকে বঞ্চিত করেছে, গৃহবন্দী করে রেখেছে, বোরকা পরতে বাধ্য করেছে, “অবাধ্য” নারীদের চাবুক মেরেছে। যেহেতু ওই এলাকায় আমেরিকার শক্ত প্রভাব আছে, তাই তালেবান সমস্যা সমাধানের দায়টাও আমেরিকার উপরেই পড়ে! তালেবানদের বিরুদ্ধে তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্ণচ্ছটার প্রত্যেকটা মানুষ জোটবদ্ধ – রক্ষণশীল-প্রগতিশীল, রিপাবলিকান-ডেমোক্রেট, সেলিব্রিটি-আমজনতা। যুদ্ধের আগেই যুদ্ধের আবেশ তৈরী হয়ে গিয়েছে। নারীবাদীরা জেনারেলদের সাথে সাক্ষাৎ করে Operation Enduring Freedom এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন, নারী বৈমানিক দিয়ে বোম ফেলার সম্ভাবনাও আলোচনা করলেন।

আফগান যুদ্ধের পেছনে এই অপূর্ব ঐক্যমত তৈরীতে অনেকগুলো চলক প্রভাবশালী ছিলো, তার মধ্যে দু’টো চলক এই লেখার আধেয়: ১) আফগান নারীদের এই দুরবস্থা সৃজনে মার্কিন ভূরাজনীতির দায় ২) ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে কিছু ভ্রান্ত অনুমিতি, কুসংস্কার ও শঙ্কা। এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে যুদ্ধের আগেই যুদ্ধের দামামা বাজানো আলোচকরা কেউই আফগান নারীদের দুরবস্থা বর্ণনা করার সময় স্নায়ুযূদ্ধের কৌশল হিসেবে তালেবানদের প্রতি মার্কিন আর্থিক-সামরিক প্রশ্রয়ের উপর আলোকপাত করেননি। মার্কিন সেনাবাহিনী নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও জনসাধারণের মাঝে যে শ্রদ্ধা ও গর্ব কাজ করে, তার নিচে এই নীরবতা চাপা পড়ে যায়। আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণের ফলে প্রচুর মানুষ মারা যায়, পূর্বের দুর্ভিক্ষ আরও প্রকট হয়, তখনও আলোচনায় মার্কিন দায় ভেসে উঠেনি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসেও তালেবানের ব্যাপারে Feminist Majority এর ওয়েবসাইটে শক্ত অবস্থান দেখা যায়, অথচ বোমাবর্ষণের কারণে খাদ্যপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় তিন বছরের দুর্ভিক্ষ বিভীষণ হয়ে যে ২২ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলো তার ব্যাপারে সংগঠনটি একদম নীরব। Afghan Women’s Mission এবং বিবিধ মানবাধিকার সংগঠন বোমাবর্ষণ বন্ধের আহবান জানিয়েছিলো যাতে ভয়াল শীতকালের আগমনের পূর্বেই জনসাধারণের মাঝে খাদ্যবন্টন করা যায়, কিন্তু সংগঠনটি সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। আফগান নারীদের বিমুক্ত করার ক্রুসেডে লাশের পাহাড় যতোই উঁচু হোক, দিনশেষে কাবুল থেকে তালেবানদের পলায়ন লগ্নে আফগান নারীরা যে স্বেচ্ছায় বোরকা পরার স্বাধীনতা পেলো, তাতেই New York Times পত্রিকা আনন্দে বগল বাজাতে লাগলো।

ইসলামী মৌলবাদীরা অবলা নারীদের অত্যাচার করছে – এই দোহাই পেড়ে আফগানদের লাশের পাহাড় ও মানবিক বিপর্যয়কে আফগানদের ভালোর জন্য “স্যাক্রিফাইস” আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। ১১ই সেপটেমবরের ঘটনার পর বোরকা পরিহিতা আফগান নারী হয়ে গেলো আমাদের অদৃশ্য শত্রুর দৃশ্যমান রুপ, যা গোটা সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরুপ। প্রথমে Feminist Majority এই চিত্রটি নির্মাণ করে, পরে বুশ প্রশাসন সেটা তাদের ক্যামপেইনের পোস্টার বানিয়ে ফেলে। এভাবে তালেবান হয়ে উঠলো আমাদের পরম শত্রু, কারণ তালেবান নারী নির্যাতন করে। ১৭ নভেম্বর এক রেডিও বার্তায় লরা বুশ বলেছিলেন,

Civilized people throughout the world are speaking out in horror – not only because our hearts break for the women and children of Afghanistan, but also because in Afghanistan, we see the world the terrorists would like to impose on the rest of us.

অতএব, Operation Enduring Freedom হয়ে উঠলো আফগান নারীদের “স্বাধীনতা যুদ্ধ” ।

আফগান নারীদের “উদ্ধার” করার ফেমিনিস্ট মেজরিটির ক্যামপেইনের ক্রুটিগুলো নিয়ে তো আলোচনা করবোই, এই ক্যামপেইন ও মোটা দাগে মার্কিন সমাজ মুসলিম বিশ্ব সংক্রান্ত যে সকল অনুমিতির উপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর উপরেও আলোকপাত করবো: যেমন ইসলামী সমাজের পাবলিক স্ফিয়ারে ধর্মীয় নৈতিকতার অবস্থান কী, আর নারীদের উপর তা কীরুপ প্রভাব ফেলে। উদারপন্থীদের মানসে তালেবান মুসলিম বিশ্বের পশ্চাতপদতা, ইসলামের নারী বিদ্বেষ ও ইসলামী মৌলবাদের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলো। আফগানদের দেহ ও সমাজ নিয়ে ভূরাজনীতির ছেলেখেলায় যে ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে যে আমরা ইসলামী মৌলবাদের নারী নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না, সেটা ঠিকই ইঙ্গিত দেয় ক্ষমতার রাজনীতি আমাদের চিন্তার গণ্ডি কিরকম সংকুচিত করে রেখেছে।

প্রতিবিপ্লব

যারা আফগান গৃহযুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করে, তারাও ২০০১ এ আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পেছনে তালেবান-নারী নির্যাতনের অযুহাত দিতে ছাড়ে না। খুব সংক্ষেপে আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপের ইতিহাস পর্যালোচনা করা যাক। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান দখল করলে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার এই অবহেলিত অঞ্চলে মার্কিন আগ্রহ হঠাত তুঙ্গে উঠে। প্রেসিডেন্ট জিমি কারটার আফগানিস্তানে গোপন সামরিক কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ জারি করেন। সোভিয়েতদের বেকায়দায় ফেলার জন্য আফগান মুজাহিদীনদের অস্ত্র-অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা হয়। ১৯৮৬ সালে রিগ্যান আমলে এই গোপন সামরিক কার্যক্রম হয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম মার্কিন বিনিয়োগ। আমেরিকা মুজাহিদীনদের প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার দেয়। সৌদি আরবও সমমানের অর্থ প্রদান করে। মুসলিম বিশ্বে বামপন্থীদের দমন করার জন্য সৌদি আরব অনেক দিন ধরে টাকা ঢেলে আসছে। মার্কিনীরাও তৃতীয় বিশ্বের সোভিয়েত মদদপুষ্ট দেশগুলোতে কমিউনিস্ট-বিরোধী অভ্যুত্থান পৃষ্ঠপোষণ করে এসেছে। আফগানিস্তানে এসে এই দুই কপোত-কপোতী যেন আংটি বদল করলো!

পাকিস্তান ছিলো এই গোপন সামরিক অভিযানের ঘাঁটি। তখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হটিয়ে জেনারেল জিয়া-উল-হক ক্ষমতায় বসেছেন। আর্থিক অনুদান ও নিজ শাসনের প্রতি বৈধতা পাওয়ার লোভে আমেরিকাকে সহায়তা করার জন্য জেনারেল জিয়া ছিলেন এক পায়ে খাঁড়া। পাকিস্তানের আইএসআই মুজাহিদীনদের মার্কিন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এঙ্গোলা আর নিকারাগুয়ায় সিআইএ সরাসরি প্রতিবিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিলেও এখানে তারা একটু ভিন্ন রাস্তা নেয় – তারা পাকিস্তানীদের প্রশিক্ষণ দেয়, আর পাকিস্তানীরা মুজাহিদীনদের প্রশিক্ষণ দেয়।

আফগান গৃহযুদ্ধের সময় সিআইএর গুপ্ত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দু’টো পয়েন্ট সমালোচকরা তুলে ধরেন: ১) মার্কিন অনুদান আফগান প্রতিবিপ্লবীদের মাঝে সবচেয়ে গোঁড়া আর মৌলবাদী অংশে প্রবাহিত হচ্ছে ২) আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চল হেরোইন ও অবৈধ অস্ত্রের বাজারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে। দু’টো পয়েন্টই আলাদাভাবে দেখা যাক। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত মদদপুষ্ট প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও সেকুলার -দু’টো গোষ্ঠীই সংগ্রাম করছিলো। এদের কারও কারও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান আমাদের ভাষায় “মডারেট” ছিলো। অথচ মার্কিন অনুদানের প্রায় ৭৫% প্রতিবিপ্লবীদের সবচেয়ে মৌলবাদী অংশের কাছে চলে যাচ্ছিলো, যার ফলে মডারেটরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আইএসআই স্বয়ং ঠিক করতো কোন দলগুলোর কাছে অনুদান পৌছানো হবে। কিন্তু World Policy Journal এ আমরা দেখি,

There is no evidence to indicate that CIA officials or other US policymakers strenuously objected to the channeling of aid to the most extreme authoritarian elements of the Afghan resistance.

আইএসআইয়ের প্রিয় গ্রুপগুলোর একটার নেতা ছিলো গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, যে বোরকা পরতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়েদের মুখে এসিড মারতো। সে ৫০% মার্কিন অনুদান পেয়েছিলো। হেকমতিয়ারকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানে এক সিআইএ কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,

উন্মাদগুলা ভালো লড়াই করে।

এভাবে মৌলবাদীদের হাতে সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জামাদি তুলে দেওয়ার ফলেই পরে তালেবানের উত্থানের পরিবেশ তৈরী হয়। সোভিয়েত ও মার্কিনীরা আফগানিস্তান ত্যাগ করার অনেক পরে ১৯৯৫ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তাদের কর্মপদ্ধতি মার্কিন মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর চেয়ে ভিন্ন ছিলো না। পরবর্তীকালে আমেরিকা তালেবানের বিরুদ্ধে নর্দার্ন এলায়েন্সকে(United Islamic Front for the Salvation of Afghanistan) লেলিয়ে দেয়, অথচ এরা ক্ষেত্রবিশেষে তালেবানের চেয়েও ভয়ংকর। আফগান নারীদের সংগঠন Revolutionary Association of the Women of Afghanistan) তাদের সম্পর্কে একটা বিবৃতি প্রকাশ করে,

The people of the world need to know that in terms of widespread raping of girls and women from seven to 70, the track record of the Taliban can no way stand up against that of these very same Northern Alliance associates.

মার্কিন-আইএসআই-মুজাহিদীন অস্ত্র পাইপলাইনের ফুটো গলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, এবং এমন সব গোষ্ঠীর হাতে পড়ে যারা নির্বিচারে বেসামরিক মানুষের উপর চড়াও হওয়ার জন্য কুখ্যাত। সিআইএ এই লিকগুলোকে পাত্তা দেয়নি, কারণ গোপনে যুদ্ধ চালাতে হলে এধরণের অঘটন ঘটবেই! ফলাফল – এই অঞ্চল এখন গোটা পৃথিবীতে অবৈধ অস্ত্রের স্বর্গ। মুজাহিদীনরা যখনই কোন এলাকা দখল করতো, তখনই সেখানে হেরোইনের চাষ শুরু করতো। সিআইএর ছায়াতলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর আফগান মুজাহিদীনরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে হেরোইন ল্যাব পরিচালনা করতো। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে হেরোইনের চাহিদার ৬০% মেটাতো মুজাহিদীনদের হেরোইন। পাকিস্তানে এর প্রভাব ছিলো ভয়াবহ: হেরোইনখোরের সংখ্যা ১৯৭৯ সালে ছিলো গুটিকয়েক, ১৯৯৫ সালে বেড়ে হলো ১২ লাখ। Feminist Majority দাবি করেছিলো তালেবানরা ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তানকে আফিম ও হেরোইনের শীর্ষ রপ্তানিকারক বানিয়েছে। তালেবান ১৯৯৫ সালে ক্ষমতায় গিয়েছিলো, অথচ ১৯৮৫ সালেই আফগানিস্তান হেরোইনের শীর্ষ যোগানদাতা ছিলো, তাই Feminist Majority এখানে ভুল তথ্য দিচ্ছে। উলটো জাতিসংঘ বলছে তালেবান ক্ষমতায় এসে প্রথম বছরেই হেরোইন চাষ বন্ধ করেছে। কেবলমাত্র নর্দার্ন এলায়েন্স নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই হেরোইন চাষ হতো। হেরোইন চাষ করে তারা তাদের কার্যক্রম অর্থায়ন করতো; যখনই তারা তালেবানের হাত থেকে কোন এলাকা দখল করেছে, তখনই সেখানে হেরোইন চাষ শুরু করেছে। Feminist Majority যখন ভুল তথ্য দিয়ে তালেবানের ঘাড়ে এই দোষ চাপাচ্ছে, তখন তারা আসলে আফগানিস্তানের দুরবস্থার জন্য তালেবানকে একা দায়ী করে মার্কিন আগ্রাসন হালাল করার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে।

Feminist Majority তালেবানদের হাতে নারীদের নিগৃহীত হওয়ার ব্যাপারে খুব উৎকণ্ঠিত হলেও ২৪ বছর ব্যাপী সংঘাতে নারীদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তারা নিরুদ্বেগ ছিলো। প্রাক-তালেবান আমলে নারীদের তুলনামূলক ভালো অবস্থান তুলে ধরে তারা সম্যক চিত্রটা চেপে গিয়েছিলো। ১৯৯৮ সালে লেনো দম্পতি তাদের এক লাখ ডলার অনুদান ঘোষণা করার সময় ম্যাভিস লেনো বলেন,

Two years ago women in Afghanistan could work, be educated, and move about freely. Then the Taliban seized power. Today women are prohibited from leaving their homes unless accompanied by a close male relative and are forced to wear the burqa. Girls and women are banned from schooling.... No healthcare ... no education ... no freedom of movement. This nightmare is reality for 11.5 million women and girls in Afghanistan.১০

তালেবানদের হেতু আফগানদের দুরবস্থার যে চিত্র সংগঠনটি তুলে ধরছে, তা আগে থেকেই সবার জানা ছিলো। আফগানিস্তান পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ, মা ও শিশু মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি। ২০ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের ফলে তাদের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। এই গৃহযুদ্ধে পশ্চিমারা অস্ত্র সহায়তা দিয়ে গোত্রগুলোর মাঝে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি করেছে। ২০ লাখ আফগান মারা গিয়েছেন, ৬০ লাখ আফগান শরণার্থী হয়েছেন – যাদের মধ্যে ৭৫% হলো নারী ও শিশু। পৃথিবীর আর কোন দেশে রাস্তায় রাস্তায় এতো লুক্কায়িত মাইন ছড়িয়ে থাকে না, আর কোন দেশে মাইন বিষ্ফোরণে দৈনিক এতো মানুষ মৃত্যুবরণ করে না। এতো কিছুর পরও ফেমিনিস্ট মেজরিটি যখন তালেবানের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ কিন্তু বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে(যারা পরবর্তী তালেবান গঠণ করেছে) মার্কিন অনুদান পৌছে দেওয়ার ব্যাপারে নীরব থাকে, তখন তারা একটা অত্যন্ত জটিল বিষয়কে অতিরিক্ত সরলীকরণ করে উপস্থাপন করছে। প্রশ্ন জাগে – যুদ্ধ, আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি, শিক্ষা ও চাকুরীর অভাবের চেয়ে আফগান নারীদের জামাকাপড় কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো?

বিশেষজ্ঞ ও একটিভিস্টরা এসব ক্ষেত্রে নীরবতা পালনের পাশাপাশি আফগান নারীদের যে সরলীকৃত চিত্র অঙ্কন করতেন, তাতে আসল পরিস্থিতি বুঝা যেতো না। যেমন, নারীশিক্ষার উপর তালেবানের নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র শহুরে আফগানদের প্রভাবিত করেছিলো, অথচ সিংহভাগ আফগান গ্রামে থাকেন আর গ্রামে স্কুল অপ্রতুল; ৯০% নারী ও ৬০% পুরুষ এখানে নিরক্ষর। যে দেশে কখনওই সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত ছিলো না, সেদেশে তালেবানরা নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ করে এমন কোন মানবিক বিপর্যয় ঘটায়নি। পশ্চিমা মিডিয়া কখনও এটা উল্লেখ করেনি যে তালেবানরা বেসামরিকীকরণ ও কড়া নজরদারি জারি রাখায় নারীরা বহু বছর পর ধর্ষণের ঝুঁকি ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পেরেছিলো(যদিও তালেবানদের শরীয়াহ না মানলে প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো)। তালেবানদের পলায়নের ফলে এই নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়েছে। Agence France Presse এর প্রতিবেদন অনুসারে,

Just 10 weeks after the Taliban fled Kabul city, Afghans are already starting to say they felt safer under the now-defeated hardline militia than under the power-sharing interim administration that has replaced it. Murders, robberies and hijackings in the capital, factional clashes in the north and south of the country, instability in Kandahar and banditry on roads linking main centres are beginning to erode the optimism that greeted the inauguration of the interim administration on December 22.১১

আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য যে তালেবানদের অনেক আইন শহুরে নারীদের উত্যক্ত করলেও গ্রামীণ নারীদের জীবনে তেমন প্রভাব ফেলেনি, কারণ তালেবানদের রীতি-নীতি অনেকটা গ্রামীণ ঐতিহ্য সঞ্জাত। অনেক বিধান তালেবানরা সেভাবে প্রয়োগও করেনি। আফগানিস্তান নিয়ে লেখালেখি করা অনেক সংবেদনশীল লেখক এই ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। আফগান গ্রামাঞ্চল নিয়ে New Yorker এর একটা প্রতিবেদন দেখুন,

one sees raised paths subdividing wheat fields ... in which men and women work together and the women rarely wear the burka; indeed, since they are sweating and stooping so much, their heads often remain uncovered. The Taliban has scarcely altered the lives of uneducated women, except to make them almost entirely safe from rape.১২

তালেবানদের নিপীড়নমূলক বিধানের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিলো জানমালের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়া।১৩ ফেমিনিস্ট মেজরিটি ও সমমনা সংগঠনগুলো বাস্তবতার এই সূক্ষ্ম দিকগুলো চেপে গিয়েছে। তারা বাস্তবতার যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা এক ক্যারিকেচার ব্যতিত কিছু হয়নি।

আফগান নারীদের দীর্ঘমেয়াদি উপকার করতে হলে বাস্তবতার এই দিকগুলো জানতে হবে। বোমাবর্ষণ শুরুর আগে ফেমিনিস্ট মেজরিটির এরুপ ক্যামপেইনিং এর ফলে আফগানিস্তানে humanitarian aid কমে যায়, এতে নারী ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।১৪ যখন ভুক্তভোগীরা এর প্রতিবাদ করলো, তখন তাদেরকে তালেবানের প্রতি সহানুভূতিশীল আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো।১৫ ভাবখানা এমন যেন আফগান নারীদের চিত্রায়নের ক্যানভাস তালেবানের বাইরে বিস্তৃত করলেই সেটা নারী নিপীড়নের সমতুল্য! তালেবান নিপীড়নের বাইরে যেন আফগান নারীদের কোন জীবন নেই!

(চলবে)

তথ্যসূত্র

১) Steve Coll. "Anatomy of a Victory: CIA's Covert Afghan War," The Washington Post, July 19, 1992.

২) World Policy Journal, "The Unintended Consequences of Afghanistan," Spring 1994, p. 81.

৩) Sharon Lerner, "Feminists Agonize Over War in Afghanistan: What Women Want," The Village Voice, October 31, 2000

৪) Diego Cordovez and Selig Harrison, Out of Afghanistan: The Inside Story of Soviet Withdrawal
(New York: Oxford University Press), pp.62-63.

৫) Reuters Wire Service, "Afghan Women's Group Gloomy of the Post-Taliban Era,"' December 10, 2001.

৬) Electronic Telegraph reported that the CIA had spent "more than L70 million in a belated and often bungled operation to buy back the missiles" it had provided to the Afghan resistance (Daniel Mcgrory, "CIA Stung by Its Stingers," November 3, 1996)

৭) Alfred McCoy, The Politics of Heroin (New York: Lawrence Hill Books), pp. 445-460.

৮) From "Campaign to Stop Gender Apartheid in Afghanistan Organizational Co-Sponsor Resolution," http://www.feminist.org/afghan/afghanresolution/html (July 4, 2000).

৯) New York Times reported that the Taliban's "ban on opium-poppy cultivation appears to have wiped out the world's largest crop in less than a year" (Barbara Crossette, ''Taliban's Ban on Poppy A Success, U.S. Aides Say, May 20, 2001). The Times acknowledged that poor farmers
were most adversely affected by this ban since they could not grow any other crop that would fetch them the same kind of income.

১০) "Mavis Leno to Chair Feminist Majority Foundation's Campaign to Stop Gender Apartheid," http://www.feminist.org/news/pr/pr102198.html, July 4, 2001.

১১) Agence France-Presse, Friday January 25, 2002, http://sg.news.yahoo.com/020125/1/2crv0.html.

১২) William Vollmann, "Letters from Afghanistan: Across the Divide," The New Yorker, May 15,
2000, p. 67.

১৩) Vollmann, pp. 64-65

১৪) Megan Reif, "Beyond the Veil-Bigger Issues," Christian Science Monitor, May 3, 2000. Also see "Afghanistan-UN Denies Aid," Off Our Backs, 28, no.51998.

১৫) See, for example, the response to Megan Reif's article (May 3, 2000) by Mavis Leno in the Christian Science Monitor, May 18, 2000, p. 8.


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

ব্লগ পরিসরে বিখ্যাত পেপার অনুবাদ করা আগ্রহ উদ্দীপক আইডিয়া মনে হল। অনুবাদ ভালো হয়েছে। প্রতি পর্ব শেষে সেই পর্বের রেফারেন্সগুলো যোগ করতে দিলে ভালো হয়।

পৃথ্বী এর ছবি

রেফারেন্স যোগ করতে ভুলে গেছিলাম, পরে যোগ করতে গিয়ে দেখি অতিথি লেখকরা পোস্ট প্রকাশের আগে সম্পাদনা করতে পারেন না।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

Emran  এর ছবি

মূল আর্টিকেলে তো ফার্স্ট অথর হিসেবে Charles Hirschkind-এর নাম দেখা যাচ্ছে চিন্তিত এটা সংশোধন করলে মনে ভাল হয়!

সোহেল ইমাম এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

দিগন্ত এর ছবি

কোল্ড ওয়ার আমলেই যে বর্তমান জঙ্গিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল সে নিইয়ে আমি খুব নিশ্চিত হলেও তা নিয়ে লেখা বিশেষ একটা দেখিনা। আপনাকে ধন্যবাদ বিষয়টা সামনে আনার জন্য।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

তালেবান তো তাহলে খুব একটা খারাপ নয় দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে নারীদের জন্য। বেশ, তাহলে-

আমরা সবাই তালেবান
বাংলা হবে আফগান

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার কাছে ভাষা অনেক আড়ষ্ট লেগেছে, আগাতে কষ্ট হয়েছে। পরের পররব্গুলোতে এদিকে একটু খেয়াল রাখবেন।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

অনুবাদ দারুণ ঝরঝরে হয়েছে। পেপারটাও আগ্রহদ্দীপক। পরের পর্বের অপেক্ষায়।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।