দায়িত্বশীল বাঙ্গালী

পৃথ্বী এর ছবি
লিখেছেন পৃথ্বী [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৪/২০১৫ - ৮:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুর্যোগের বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়ে মানুষের মুখোশ খুলে পড়ে। শুধু দুর্যোগ নয়, শাহবাগ আন্দোলনের মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময়ও প্রয়োজনীয় মেরুগুলো প্রস্ফুটিত হয়। একেকটা ঘটনার(Event) প্রসবযন্ত্রনার মধ্য দিয়েই মানুষের জন্ম হয়, মানুষের অন্তরাত্মা পরিপূর্ণ নগ্নতায় অবভাসিত হয়। স্থবির সময়ে আমরা মানুষের যে রুপটা দেখি, তা শুধুই মরীচিকা।


অভিজিত রায় শুধু তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আলো ছড়াননি, মরণেও তিনি আলো ছড়িয়েছেন। যখন তাঁর মস্তিষ্ক ছিটকে টিএসসির ফুটপাথে ছড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখনই এই মরু অঞ্চলে আযান ধ্বনিত হল। দলে দলে অনলাইন সেলিব্রেটিরা পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় দিল, চোখে সুরমা আর গায়ে আতর ভিজিয়ে “দায়িত্বশীল” লেখালেখির নূরানী ফতোয়া ঝাড়া শুরু করল। জামায়াত-হিযবুত-হেফাজত-আওয়ামী লীগের একাংশের মুখে একই বাণী – “অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া আর শরীরে আঘাত দেওয়া একই কথা”। সুশীল, নিরপেক্ষ ছাগুরা অনেকদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির মেলবন্ধন স্থাপনের ওকালতি করে আসছে, জামায়াতকে কোলে নিয়ে “বহুদলীয় গণতন্ত্র” এর ফতোয়া দিয়ে আসছে। অভিজিত রায়ের হত্যাকাণ্ড সুশীলদের “মিলেমিশে থাকার” স্বপ্ন সাময়িকভাবে হলেও সত্য করেছে। ইশ্বরের রসবোধ আসলেই দারুণ।

অভিজিত হত্যাকাণ্ড পরবর্তী বিভিন্নজনের প্রতিক্রিয়ায় আমরা শিখেছি আপনি স্রেফ কলমের জোরে আপনাকে খুন করার জন্য “উসকানি” দিতে পারেন। বই-জার্নাল ঘেটে যুক্তি-ভিত্তিক আলোচনা করা আর আমারদেশ-বাঁশেরকেল্লার কায়দায় জামায়াতের হিট স্কোয়াডের জন্য ক্রসহেয়ার এঁকে দেওয়া একই কথা। মসজিদের মাইকে দিনরাত ধর্ম প্রচার করা যাবে, নীলক্ষেত-কাঁটাবনের সারি সারি বইয়ের দোকানে ধর্মপ্রচার করা যাবে, ফেসবুকের পেইজে পেইজে ধর্মপ্রচার করা যাবে, টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামিং এর বিভিন্ন স্লটে, এমনকি গোটাখানেক বিশেষায়িত টিভি চ্যানেল খুলেও ধর্মপ্রচার করা যাবে; কিন্তু মৃদ্যু স্বরেও যদি আপনি প্রচারিত এসব ধর্মবাণীর সামান্য ক্রিটিক উত্থাপন করেন, তাহলে আপনি কল্লা কাটার “উসকানি” দিচ্ছেন। ধর্মপ্রচারক ফাঁকা মাঠে ফাঁকা পোস্টে গোল দিবে এটাই নিয়ম। এই ময়দানে গোলরক্ষক মাত্রই “উসকানিদাতা”।

অনুভূতিতে আঘাত লাগে, এমন ভিন্নমত মাত্রই “উসকানি”। মুখ খুললেই “উসকানি”। শুধু বই নয়, বাক্য নয়, কেবল একটা শব্দ লিখলেও সেটা “উসকানি” হতে পারে। বাংলাদেশের আইন-আদালতের উপর সরকারী-দল, বিরোধী-দল নির্বিশেষে কারও আস্থা নেই, অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তাই দু’ দলই হাইকোর্ট দেখানোর বদলে চাপাতির ঝকঝকে ধার দেখায়। একবিংশ শতকের বাংলাদেশে মানুষ কথায় কথায় “উসকে” যায়। আগের দিনে কবিরা বাতাসে পুষ্পরেণু আর রুপসীর মেঘকুন্তল ভেসে বেড়ানো নিয়ে কবিতা লিখত, এখন লিখবে মস্তিষ্কের টুকরা আর আঙুলের টুকরা উড়ে বেড়ানোর কবিতা। রক্তজবার রঙে নয়, রক্তের রঙেই গাছ লাল হয়ে থাকে, কারণ গাছের নিচেই হয়ত “উসকে” দেওয়ার জন্য কোন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হোমো সেপিয়েন্স নিথর পড়ে আছে।

একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তাই একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালীর প্রথম বৈশিষ্ট্য হল সে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না। সে জাপানি আনিমে দেখে, হলিউডের মুভি দেখে, টিভি সিরিজের পর্ব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, ইউরোপীয় ফুটবল নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, কোন রেস্তোরাঁর বার্গারে মাংসের পরিমাণ কত কম তা নিয়ে ভোজনরসিক গ্রুপে পোস্ট দেয়, ফেসবুকে নতুন কোন ভিডিও বা মিম ভাইরাল হলে সেটা নিয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকে, প্রেমিক-প্রেমিকার মনস্তত্ত্ব আর প্রেমের রসায়নের উপর থিসিস পয়দা করে। অর্থাৎ, একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালী ভোক্তা হয়, ভোগবাদী হয়। কিন্তু সে কখনও দ্রষ্টা হয় না, বক্তা হয় না। পণ্য আর পপ কালচারের উর্ধ্বে উঠে রাজনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়(যে দু’টো অঙ্গনে ধর্মের প্রভাব প্রকট) নিয়ে চিন্তা করলেই কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, কেউ না কেউ “উসকে” যাবে, নগরীর বিদ্যমান অল্প কয়েকটি গাছে রক্তের ছিটে লেগে যাবে।

একবিংশ শতকের একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালী তাই একজন ভোক্তা। উৎপাদন ও ভোগের চক্র চলমান রাখাই তার দায়িত্ব।

কৃতজ্ঞতা: লেবানিজ আঁকিয়ে Mazen Kerbaj

"I think, so I no longer exist!"

পহেলা বৈশাখ, মাতৃভাষা দিবস, চৈত্র সংক্রান্তি, বিজয় দিবস প্রভৃতি দিবস আসলেই আমার মা’য়ের দুঃচিন্তা বেড়ে যায়। সবসময় কড়া নিরাপত্তায় স্কুল-কোচিং এ যাওয়া-আসা করা আমার বোন এই দিনগুলোতে একটু হাওয়া খেতে বের হতে চায়, কিন্তু সে তো আর বুঝে না এই দিনগুলোতেই হায়েনারা রাস্তায় বের হয়। ভদ্র হায়েনাগুলো গায়ে হাত দেয়, মন্তব্য বিধে দেয়। অভদ্র হায়েনাগুলো একেবারে জামা-ই ছিড়ে ফেলে। কয়েক দিন আগে পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে সংঘবদ্ধ হায়েনাদের আক্রমণের রেশ এখনও কাটেনি। আমার মা একা একা স্কুল-কলেজ-ভারসিটিতে যাওয়া-আসা করেছে, বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে, কখনও একটা কটু কথাও শুনতে হয়নি রাস্তা-ঘাটে। এখন আর সেই দিন নাই, কিন্তু তাই বলে কি একটা কিশোরী মেয়ের সেজেগুজে বেড়াতে বের হওয়ার আকাঙ্খা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে? এই বিশেষ দিবসগুলো আসলেই তাই খাওয়ার টেবিলে দু’টো ভিন্ন কালের সংঘাত বাধে, মান-অভিমানে প্রকট হয়ে উঠে পতনোন্মুখ ২১ শতকের বাংলাদেশ।

বুয়েটের সাংস্কৃতিক সংগঠন মূর্ছনা বিভিন্ন উপলক্ষে নাচ-গানের আয়োজন করে। এছাড়াও বছরব্যাপি বুয়েটের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ফেস্টিভাল আয়োজন হয়, ২-৩ দিন ব্যাপি সেই ফেস্টিভালে জব সেমিনার – একাডেমিক কনফারেন্স ছাপিয়ে সবার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্লাবের অনুষ্ঠান কি ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠান, এটা রীতিমত একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে যে কিছু দেশ-সেরা মেধাবী, হবু-প্রকৌশলী হায়েনা অডিটোরিয়ামের সামনের সারিতে কিংবা উপরের তলায় বসে কল্পনাতীত, অকথ্য সব মন্তব্য ছুড়ে মারবে মেয়ে পারফরমারদের উদ্দেশ্যে, মঞ্চের মেয়েদের গায়ে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করার ঘটনাও সাম্প্রতিককালে ঘটেছে। বছরের পর বছর পারফর্ম করে আসা মেয়েদের এই ব্যাপারটা সয়ে যায়, স্বীয় মেধায় মঞ্চ মাতানোর ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য হলেও তারা দাঁতে দাঁত চেপে মঞ্চে হায়েনাদের সামনে পারফর্ম করে যায়; বাঙ্গালী নারীর মুখ বুজে সওয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, প্রথাগত বাঙ্গালীর দৃষ্টিতে এটা বাঙ্গালী নারীর একটা বড় “গুণ”। আমার এক বান্ধবীর মত যেসব মেয়ে জীবনে প্রথমবার বুয়েটের অডিটোরিয়ামে পারফর্ম করতে যায়, তারা এর জন্য প্রস্তুত থাকে না। বুয়েটে আসার আগে এদের সকলের ধারণা থাকে অন্তত দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠের পুঙ্গবদের চরিত্র আবহমান বাংলার গড়পড়তা হায়েনার চেয়ে উন্নত হবে। ক্যামপাসের প্রথম দিন থেকেই অবশ্য তাদের বোধদয় হয় যে অংক-বিজ্ঞানে ভালো নম্বর হাঁকিয়ে কেউ ভালো মানুষ হতে পারে না, বড় জোর নখ-দাঁত বের করা ভালো প্রকৌশলী হতে পারে। অতঃপর, সারা জীবন তারা ঘরে-বাইরে, আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশী-শিক্ষক-সহপাঠীদের হাতে যে এবিউজ সহ্য করে এসেছে, স্বপ্নের ক্যামপাসে এসেও সেই এবিউজ সহ্য করার জন্য নির্লিপ্তির বর্ম গায়ে চাপাতে হয়। চিরায়ত বাঙ্গালী নারী। প্রতিদিন আত্মীয় আর আগন্তুকের কল্পনায় ধর্ষিত হওয়াটা বেশি কষ্টের, নাকি স্বপ্নভঙ্গ হওয়াটা বেশি কষ্টের – সেটা একজন পুরুষতান্ত্রিক, প্রথা-আক্রান্ত সমাজের পুরুষ হিসেবে আমি কখনওই অনুভব করতে পারব না। এজন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

এসব ঘটনার জন্যও “উসকানি” থিওরি প্রয়োগ করা হয়। এই থিওরিস্টরা কেবল বখাটে পোলাপান না, ছাত্র-অপরাজনীতির ক্যাডার না। এরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, কবি-সাহিত্যিক, করপোরেট কর্মকর্তা, শিক্ষক, এমনকি আপনার পিতাও হতে পারে; যে বুড়া লোকটা ভীড়ের মধ্যে গায়ে হাত দেয়, তারও বউ-বাচ্চা আছে। উৎসবের দিন মেয়েরা সেজেগুজে বের হয়ে পুঙ্গবদের “উসকে” দেয়। মেয়েরা যদি “উসকানিপ্রাপ্ত” পুঙ্গবদের হাতে নিগৃহীত হতে না চায়, তাহলে এসব উৎসব-ফুৎসব পালন না করে ঘরে বসে থাকতে হবে। বীর পুঙ্গব হিসেবে আমারও উচিত হবে মা-স্ত্রী-কন্যাকে এসব দিনে গৃহবন্দি করে রাখা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এমন কিছু করেছে কিনা জানি না, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি তারা “উসকানি” ঠেকানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও উদ্যানগুলো ব্যারিকেড করে রাখে, তাহলেও অবাক হবো না। ২১ শতকের স্বাধীন বাংলাদেশে উসকানিপ্রবণ চাপাতিধারী-শিশ্নধারী হায়েনাদের ঠেকাতে মানুষের স্বাধীন চলাচলের অধিকারও হরণ করা লাগতে পারে। উসকানি-প্রবণ লোকজন ক্ষমতাসীনদের খুবই পছন্দের মানুষ; তারা কতিপয় সরকারী জমি উপহার পায়; পুলিশ তাদেরকে দেখেও দেখে না, ধরলেও ছেড়ে দেয়। এদেরকে আইনী প্রক্রিয়ায় দণ্ড দেওয়ার চেয়ে সাধারণের চলাচলের স্বাধীনতা হরণ করা বেশি সহজ হবে।

এমতাবস্থায় একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল উৎসবের দিন সেজেগুজে বের না হয়ে উসকানি-প্রবণদের রেহাই দেওয়া। নাচ-গান-আনন্দ-ফূর্তি কিছু হবে না, বিজনেস এজ ইউজুয়াল। অবশ্য ইউজুয়াল বিজনেস করতে গেলেও যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। বছরের ৩৬৫ দিনই উসকানি-সমৃদ্ধ দিবস, এমন কোন দিন নেই যেদিন কেউ “উসকানিপ্রাপ্ত” হয় না। তবে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি উসকানি-প্রদায়ক, এটা থামাতেই হবে।

একবিংশ শতকের দায়িত্বশীল বাঙ্গালী তাই পালা-পার্বণ করে না, আরেকটা দিন কাউকে “উসকানি” না দিয়ে কোনমতে তিষ্ঠানোর জন্য ইশ্বরের কাছে শুকরিয়া আদায় করে।

আকাশটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।

প্রিয় রক ব্যান্ড এ্যালিস ইন চেইন্স এর নাটশেল গানে শুনেছি,

My gift of self is raped
My privacy is raked
And yet I find
And yet I find
Repeating in my head
If I can't be my own
I'd feel better dead

মানুষ দায়িত্বশীল বাঙ্গালী হবে না। বর্তমানে যেসব অঘটন ঘটছে, এগুলোর প্রবল প্রসবযন্ত্রণা থেকেই একদিন মেরুদণ্ডী বাঙ্গালী পয়দা হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে সময়টায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের সবচেয়ে দাপট ছিল, সেই সময়টাতেই শাহবাগের গণজাগরণ হয়েছিল। রিকশাওয়ালারা মানুষকে সেদিন বিনা পয়সায় শাহবাগে পৌছে দিয়েছিল। মাথায় ঘোমটা পরা বাঙ্গালী গৃহিণী ছেলেমেয়ে-নাতিপুতি নিয়ে শাহবাগের মাটিতে বসেছিল। হিজাব-দাড়িটুপি-সিঁদুর সবই শাহবাগে ছিল। সকল শ্রেণী-পেশা-ধর্ম-লিঙ্গের মানুষের জমায়েতে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিস্ময়ে, ও স্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি - “না, আমি একা নই”। সেই গণজোয়ারের মানুষেরা জনস্রোতে মিশে গেছে, তবে হারিয়ে যায়নি, গণজোয়ারের আগে আমরা কল্পনাও করিনি এদের অস্তিত্ব ছিল।

আমি আশাবাদী এসকল ভস্ম হতেই একদিন ফিনিক্স পাখিরা উড়াল দিবে। তার আগ পর্যন্ত্য দগ্ধ মানুষের মিছিল আর না বাড়ুক, আর কেউ দিন বদলের জ্বালানি না হোক, এটাই কামনা।


মন্তব্য

নিটোল এর ছবি

একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে তাই একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালীর প্রথম বৈশিষ্ট্য হল সে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেয় না। সে জাপানি আনিমে দেখে, হলিউডের মুভি দেখে, টিভি সিরিজের পর্ব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, ইউরোপীয় ফুটবল নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, কোন রেস্তোরাঁর বার্গারে মাংসের পরিমাণ কত কম তা নিয়ে ভোজনরসিক গ্রুপে পোস্ট দেয়, ফেসবুকে নতুন কোন ভিডিও বা মিম ভাইরাল হলে সেটা নিয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকে, প্রেমিক-প্রেমিকার মনস্তত্ত্ব আর প্রেমের রসায়নের উপর থিসিস পয়দা করে। অর্থাৎ, একজন দায়িত্বশীল বাঙ্গালী ভোক্তা হয়, ভোগবাদী হয়। কিন্তু সে কখনও দ্রষ্টা হয় না, বক্তা হয় না। পণ্য আর পপ কালচারের উর্ধ্বে উঠে রাজনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়(যে দু’টো অঙ্গনে ধর্মের প্রভাব প্রকট) নিয়ে চিন্তা করলেই কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, কেউ না কেউ “উসকে” যাবে, নগরীর বিদ্যমান অল্প কয়েকটি গাছে রক্তের ছিটে লেগে যাবে।

বরাবর! চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

রানা মেহের এর ছবি

১) অভিজিৎদা একজন প্রবল বিক্রয়যোগ্য পণ্য। চরম সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী মানুষও অভিজিৎ দা আর বন্যা আপার রক্তাক্ত ছবিতে 'লাইক' দেয় আর শেয়ার দিয়ে 'লাইক' 'ফলোয়ার' কুড়ায়।

২) ধর্ম প্রচার চলতেই পারে। কিন্তু নাস্তিকতার প্রচার চলতে পারেনা। নাস্তিক আপনি হতে পারেন। কিন্তু সেটা চর্চা করবেন আপনার ঘরের ভেতর চার দেয়ালের মধ্যে। নাস্তিকতা বাইরে আসা মানে আপনি টার্গেট। তখন আপনার কাপড় ঠিক না থাকারই কথা।

৩) নারী? নাস্তিকতার মতই। চার দেয়ালের মধ্যে থাকবেন। বাইরের পৃথিবী নারীর জন্য নয়। অদূর ভবিষ্যতে পুরানো দিনের মতো পুরুষ অভিনেতা দিয়ে নারী চরিত্র করানো দেখলে অবাক হবোনা। সেটা হলেই বরং স্বাভাবিক হবে।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আয়নামতি এর ছবি

চলুক
ডানা ভাঙা পাখি তারপরও উড়াল হবে একদিন, ভরসা রাখি!
-----
অফটপিক:
ঈশ্বর, পর্যন্ত,উস্কানি, বানানগুলো এমন হবার কথা না ভাইয়া?

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বই-জার্নাল ঘেটে যুক্তি-ভিত্তিক আলোচনা করা আর আমারদেশ-বাঁশেরকেল্লার কায়দায় জামায়াতের হিট স্কোয়াডের জন্য ক্রসহেয়ার এঁকে দেওয়া একই কথা। মসজিদের মাইকে দিনরাত ধর্ম প্রচার করা যাবে, নীলক্ষেত-কাঁটাবনের সারি সারি বইয়ের দোকানে ধর্মপ্রচার করা যাবে, ফেসবুকের পেইজে পেইজে ধর্মপ্রচার করা যাবে, টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামিং এর বিভিন্ন স্লটে, এমনকি গোটাখানেক বিশেষায়িত টিভি চ্যানেল খুলেও ধর্মপ্রচার করা যাবে; কিন্তু মৃদ্যু স্বরেও যদি আপনি প্রচারিত এসব ধর্মবাণীর সামান্য ক্রিটিক উত্থাপন করেন, তাহলে আপনি কল্লা কাটার “উসকানি” দিচ্ছেন। ধর্মপ্রচারক ফাঁকা মাঠে ফাঁকা পোস্টে গোল দিবে এটাই নিয়ম। এই ময়দানে গোলরক্ষক মাত্রই “উসকানিদাতা”।

চলুক মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাসুদ সজীব এর ছবি

অভিজিত রায় শুধু তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আলো ছড়াননি, মরণেও তিনি আলো ছড়িয়েছেন। যখন তাঁর মস্তিষ্ক ছিটকে টিএসসির ফুটপাথে ছড়িয়ে পড়ল, ঠিক তখনই এই মরু অঞ্চলে আযান ধ্বনিত হল। দলে দলে অনলাইন সেলিব্রেটিরা পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় দিল, চোখে সুরমা আর গায়ে আতর ভিজিয়ে “দায়িত্বশীল” লেখালেখির নূরানী ফতোয়া ঝাড়া শুরু করল। জামায়াত-হিযবুত-হেফাজত-আওয়ামী লীগের একাংশের মুখে একই বাণী – “অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া আর শরীরে আঘাত দেওয়া একই কথা”। সুশীল, নিরপেক্ষ ছাগুরা অনেকদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির মেলবন্ধন স্থাপনের ওকালতি করে আসছে, জামায়াতকে কোলে নিয়ে “বহুদলীয় গণতন্ত্র” এর ফতোয়া দিয়ে আসছে। অভিজিত রায়ের হত্যাকাণ্ড সুশীলদের “মিলেমিশে থাকার” স্বপ্ন সাময়িকভাবে হলেও সত্য করেছে। ইশ্বরের রসবোধ আসলেই দারুণ।

চলুক মন খারাপ

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

দারুণ লেখা হয়েছে পৃথ্বী।

আমি এখন সেলিব্রেটি বিশেষ করে অনলাইন সেলিব্রেটি দেখলেই ভয় পাই। এদের অধিকাংশেরই কোনো চরিত্র নাই। যে কোনো সময় যে কোনো কারণে এদের আচরণ বদলে যেতে পারে। অনেকেই মূলত ফ্যানবেইজটা যাতে ধ্বসে না যায় সেই চিন্তা করে স্ট্যাটাস বা বাণি প্রসব করে বলে আমার মনে হয়। শাহবাগ, রাজীব হায়দার হত্যা, অভিজিৎ রায় হত্যা এক একটা ঘটনা যেখানে এক এক গ্রুপের মানুষের প্যান্ট খুলে যেতে দেখেছি। শেষ পর্যন্ত আমার বিচারে টিকে যাওয়া মেরুদণ্ডী মানুষের সংখ্যা খুব কম।

এই 'উসকানি' থিওরি দিয়ে এরা নিঃশর্ত ইমিউনিটি দাবী করে। মসজিদে মসজিদে প্রতি জুমার খুৎবায় অন্য ধর্মের সমালোচনা হবে, মূর্তিপূজা, খোদার পুত্র, অন্য ধর্মের শিরক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে। অভিজিৎ রায় হত্যার পর দিনই বিভিন্ন মসজিদে নাস্তিকরা কীভাবে ধর্মের সমালোচনা করছে সেসব নিয়ে কথা হবে। কেউ কেউ নাস্তিকদের কীভাবে কতল করা দরকার সেই আলোচনা করবেন। আর আমাদের মডারেট শিক্ষিত মুস্লিমরা সেসব শুনে টু শব্দটিও করবেন না। তাঁদের শব্দ বের হবে যখন কেউ বলবেন ইসলাম তাইলে নাস্তিকদের কতল করা সমর্থন করে? তখন তারা ভোকাল কর্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবেন, এই ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয় বলে। কিন্তু সেই কথা কোনো ইমামের মুখে কখনও শোনা যাবে না, আর আমাদের মডারেট মুস্লিমদের সেই ইমামের পেছনে নামাজ পড়তে নৈতিক কোনো সমস্যাও কখনও হবে না।

চিন্তা একটা ভয়াবহ বিষয়। সবাই যা ভাবছে, সবাই যা বলছে, ছোটবেলা থেকে যা শিখেছ, শুধু তাই ভেবে যেতে হবে, শুধু তাই বলতে হবে, শুধু তাই করতে হবে। এর বাইরে গেলেই বিপদ। সেটা হোক ধর্মের বিপক্ষে, সেটা হোক পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে।

এক একটা ঘটনার পর শুরু হয় দায় ছোড়াছুড়ি খেলা। আজকে দেখলাম কিছু বিকৃত রুচির অনলাইন ব্যক্তিত্ব লাকি আক্তারের পিছনে লেগেছে। মূল ইস্যু নিয়ে তাদের কোনো কথা নাই, লাকি আক্তার কী বলল, সেটা নিয়ে এখন লাকি আক্তারকে গালাগালি করা হচ্ছে। লাকি আক্তার যে একজন নারী এটা সম্ভবত তারাও ভুলতে পারছেন না। এই সুযোগে নিজেদের ধর্ষকামকে একটু মিটিয়ে নেয়া তো গেল।

জানি না এই সব দুর্যোগে আমাদের মেরু শুধু প্রস্ফুটিত হতেই থাকবে, নাকি মেরুকরণ হতে হতে একটা শক্তিশালি উত্তরমেরু সৃষ্টি হবে। আমি ভরসা পাই না, আমার শুধু মনে হয় কেবল দক্ষিণ মেরুই শক্তিশালি হচ্ছে দিনে দিনে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাসুদ সজীব এর ছবি

সেই গ্রুপটি অনলাইনে শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় প্রকৃত মুসলমান, ইসলাম আর নারীদের ইজরাদার। মৌলবাদীদের দেখেও অামার এত ঘৃনা হয় না, যতটা না এদের দেখে হয়। রেগে টং

এইযে উস্কানী তত্ত্ব, প্রকৃত মুসলমান তত্ত্ব, ’বেশি করে কাপড় পড়ুন ধর্ষন প্রতিরোধ করুন তত্ত্ব, এমন অসংখ্য তত্ত্ব হাজির হচ্ছে চারিদিকে আর তাতে বেশিভাগ মানুষ বিশ্বাসী হয়ে উঠছে তার মূল অনুঘটক কি? অনেক লম্বা করে অনেক কিছু বলা যায়। তবে সহজ চোখে আমার কাছে দুটো বিষয়কে মূল কারণ মনে হয়। প্রথম কারণটি পারিবারিক শিক্ষার অভাব আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় প্রভাব।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অরফিয়াস এর ছবি

একটা যুদ্ধকালীন সময়ে যে কোন একটা দিক বেছে নিতে হয়, আমাদের দেশের সমস্যা হচ্ছে, মধ্যবর্তী পাব্লিকের সংখ্যা বেশি। তারা সব বিষয়েই নিজের গা বাঁচিয়ে চলতে আগ্রহী। সুতরাং এদের কাছে সমাজ পরিবর্তনের আশা করা একটু বেশিই চাওয়া।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

মুক্তমন এর ছবি

আমার মনে হয় বাঙালীর "সহনশীলতা" এর মূল কারণ "কেউ একজন আগে শুরু করুক" ধরণের মনোভাব ৷ কেউ নিজে এগিয়ে এসে নজরে পরতে চায়না৷ কিন্তু কথা হচ্ছে ঘন্টাটা বাঁধবে কে !

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

কার্ল স্যাগেন এর ছবি

অগ্রগতির চেয়ে আমাদের পিছুটান সবসময় বেশি।আর আমাদের সবচেয়ে বড় পিছুটান এই মধ্যস্থলীর প্রাণিগুলো।

আরাফ এর ছবি

চলুক শুভকামনা লেখক।

এক লহমা এর ছবি

চলুক ৫ তারা।
এ যুগের ভস্ম থেকে উড়াল হোক আগামীর ফিনিক্স পাখীর।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

যে ক্রমবিবর্তনের পথ ধরে বাঙালি আজ মুসলমান বাঙালিতে পরিণত হয়েছে তার অনুভূতির তর্জমা করা এখন আর কঠিন কিছু নয়। পাহাড় থেকে শুরু করে সমতল সবখানে তার অনুভূতির কামান সদা জাগ্রত। সবখানে তার জন্য হাজির কিছু উস্কানিদাতা। আর এই উস্কানিদাতার কাতারে সবচেয়ে সামনে আছে সম্ভবত নারীরা। উদাসদা যেমন বলেছেন, ৩ বছর বয়স থেকে শুরু করে সকলেই এখানে উস্কানিদাতা যার কারণে ৩ বছরের একটি শিশুকেও হতে হয় ধর্ষণের শিকার।

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।