কুলীন প্রতিক্রিয়াশীলতা - ২

পৃথ্বী এর ছবি
লিখেছেন পৃথ্বী [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৭/২০১৩ - ১১:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলীন প্রতিক্রিয়াশীলতা - ১

প্রথম পর্বে বলেছিলাম এই লেখাটা তিনটি পর্বে লিখব, কিন্তু পরে ভাবলাম কাট-ছাট করে দু'টি পর্বেই শেষ করে দিই, তাই এটাই শেষ পর্ব।


আগের পর্বে প্রকৃতি বিজ্ঞানের(natural science) প্রতি যেই সমাজবৈজ্ঞানিক মনোভাবকে আক্রমণ করেছিলাম, তাকে social constructivist theory বা সামাজিক নির্মাণবাদী তত্ত্ব বলা হয়। নামেই বোঝা যাচ্ছে এই মনোভাবাপন্ন একাডেমিকরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের জ্ঞানকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবতে রাজি নন, প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সময়সিদ্ধ ধারণাগুলো যেন সর্বাঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কারে নিমজ্জিত! অতএব, “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের স্বীকৃতসত্যগুলোকে(postulate) বিভিন্ন আঞ্চলিক বিশ্বাসের উপর বিশেষাধিকার দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন এসব একাডেমিকরা।

প্রকৃতি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলোয় ব্যক্তিসংস্কারের প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। ইউজেনিক্সের মত অপবিজ্ঞানগুলো পুরোপুরি সেই সময়কার কুসংস্কার ও রাজনীতির ফসল, কিন্তু এও ঠিক যে খোদ বিজ্ঞানীরাই ইউজেনিক্সের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছিলেন। বিজ্ঞানীদের আবর্জনা বিজ্ঞানীরাই পরিস্কার করেন; প্রকৃতি বিজ্ঞানের কর্মপদ্ধতিটাই এমন যে নৈর্ব্যক্তিকতার মুখোশে ব্যক্তিসংস্কার বেশি দিন রাজত্ব করতে পারে না। যাই হোক, প্রকৃতি বিজ্ঞানের জ্ঞানভান্ডারে ব্যক্তিসংস্কারের প্রভাব কতটুকু, সেই বিতর্ক দিয়ে এই পোস্ট দীর্ঘ করব না। প্রকৃতি বিজ্ঞানে সমাজ ও রাজনীতির প্রভাবের মাত্রা নিয়ে গবেষণা ঠিক আছে, কিন্তু পুরো কর্পাসটা এক ধাক্কায় subjective আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দিলে আপত্তি থেকে যায়।

যেই বিশেষ ব্র্যান্ডের নির্মাণবাদী মনোভাবকে আমি আক্রমণ করছি, এর আরেকটা নাম হল Strong Sociology বা Strong Programme। Strong programme আসলে কী, সেটা বোঝার জন্য আমরা “weak” programme এর সাথে তুলনা করতে পারি। যেসব সমাজবিজ্ঞানী ইউজেনিক্স কিংবা phrenology এর মত অপবিজ্ঞানের উৎস নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কর্মকে “weak” sociology আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। ইনারা শুধু অপবিজ্ঞানগুলোর ক্ষেত্রেই সামাজিক ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব অনুসন্ধান ও গবেষণা করেন, মূলস্রোতের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোকে তাঁরা ছেড়ে দেন কারণ ওগুলো বাস্তবতার কোন না কোন এসপেক্টকে সঠিকভাবে উত্থাপন করতে পেরেছে। এর বিপরীতে Strong programme দাবি করে মূলধারার বিজ্ঞানকে অপবিজ্ঞানের মতই ট্রিটমেন্ট দেওয়া উচিত, অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠিত থিওরিগুলোর মধ্যেও সমাজবিজ্ঞানীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পক্ষপাতিত্ব অনুসন্ধান করা উচিত। বাকি পোস্টে স্ট্রং প্রোগ্রামকে SP হিসেবে অভিহিত করব।

SP এটা স্বীকার করে যে দুনিয়ার সব মানুষের যুক্তি প্রয়োগ ও বোঝার ক্ষমতা একই রকম, কিন্তু SP এটা স্বীকার করতে রাজি না যে সার্বজনীন জ্ঞান বলতে আদৌ কিছু আছে যা পৃথিবীর যে কোন সংস্কৃতির যেকোন অধিবাসী স্বীয় যুক্তিবলে আহরণ করতে পারে। আরেকভাবে বললে, দুনিয়াতে এমন কোন ফ্যাক্ট নেই যা বারংবার মিথ্যা-প্রতিপাদনের প্রচেষ্ঠায় উতরে গিয়েও এবং যার পক্ষে উৎকৃষ্ট প্রমান থাকা সত্ত্বেও তা স্থান-কাল নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এভাবে চিন্তা করলে যেহেতু কোন জ্ঞানই বাতিলযোগ্য না, তাই নির্মাণবাদী তাত্ত্বিকদের মনে হয়েছিল প্রকৃতি বিজ্ঞানের এই আপেক্ষিক রুপটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রাক্তন উপনিবেশের মানুষরা চিন্তার স্বাধীনতা পাবে, “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক নিজেদের আঞ্চলিক বিশ্বাসগুলোকে সগর্বে লালন করতে পারবে। নির্মাণবাদী তাত্ত্বিকরা এসব মানুষদেরকে কুসংস্কার লালন করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কুসংস্কার ত্যাগ করে বিজ্ঞানকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাটা তাঁরা কেড়ে নিয়েছিলেন।

তবে SP যে স্বীকার করেছিল যে সব মানুষের যুক্তিচর্চা করার ক্ষমতা সমান, এটা কিন্তু অতি অবশ্যই একটি অগ্রগতি। অতীতে নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের ফিল্ডে Lucien Lévy-Bruhl এবং Peter Winch এর মত অনেকেই দাবি করেছিলেন যে “আদিম” মানুষ(মানে, পশ্চিমা সভ্যতার বাইরের মানুষ) যুক্তিচর্চায় আগ্রহী নয়; কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা, তত্ত্ব প্রণয়ন করে সেগুলোকে ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বানী করা ও অবশেষে প্রাপ্ত জ্ঞান ব্যবহার করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন ইচ্ছাই এই “আদিম” মানুষগুলোর নেই, এগুলো যেন পশ্চিমাদের মনোপলি! এর বিপরীতে স্ট্রং প্রোগ্রামের একাডেমিকরা দাবি করেন যে – হ্যাঁ, সব সংস্কৃতির মানুষই বস্তুজগতের মানচিত্র নির্মাণ করে; কিন্তু সবার মানচিত্রই সমানভাবে সঠিক, কারওটা ভুল আর কারওটা সঠিক আখ্যা দেওয়া চলবে না! সবাই একই পরিমাণ দক্ষতা নিয়ে মানচিত্র তৈরী করে, সবাই তাদের হাইপোথিসিসকে প্রমাণ দিয়ে সিদ্ধ করার চেষ্টা করে, সবাই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে, এবং দিনশেষে সবার মানচিত্রই তাদের স্বীয় স্বীয় পরিবেশে সমান উপযোগী(এখানে উপযোগিতার মানদন্ডও তাদের স্বীয় সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল)! যেহেতু বস্তুজগত সম্পর্কে সব সংস্কৃতির ব্যাখ্যাই সমানভাবে গ্রহনযোগ্য, সেহেতু “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাকে বিশেষাধিকার দেওয়ার কোন কারণ নেই। পশ্চিমের বাইরের মানুষ যদি কোন কারণে “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের প্রতি সহানুভূতি বোধ করে, তবে তারা আসলে উপনিবেশের শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারেনি!

স্ট্রং প্রোগ্রামের তাত্ত্বিকদের প্রস্তাবিত জ্ঞানতত্ত্ব(epistemology) অনুসারে সব মানুষেরই বৌদ্ধিক ক্ষমতা সমান: এখানে আপত্তি করার কোন প্রশ্নই উঠে না, বস্তুত, এই স্বীকার্য ধারণ না করলে কোন তরিকার জ্ঞানতত্ত্বই গ্রহনযোগ্য হবে না! সমস্যাটা এখানেই যে SP তাত্ত্বিকরা একইসাথে এও দাবি করেন যে সকল সংস্কৃতির সকল বিশ্বাসই সমানভাবে গ্রহনযোগ্য; কোন ফ্যাক্ট অধিক পরিমাণে মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্য ও প্রমাণসিদ্ধ হলেই আমরা সেই ফ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক কোন সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে বাতিল করতে পারব না। বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বের(sociology of science) যে ধারাটার আমি সমালোচনা করছি, অর্থাৎ, এই Strong Programme এর স্থপতি Barry Barnes এর ভাষায়,

wherever men [and women] deploy their cultural resources in the authentic task of explanation and investigation [of the material world], what they produce deserves the name of knowledge

অর্থাৎ, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস পুঁজি করে বস্তুজগত সম্পর্কে আপনি যেই ব্যাখ্যাই(সঠিক-বেঠিক বিবেচ্য নয়) প্রদান করবেন, তাকে বাই ডিফল্ট জ্ঞান ধরে নিতে হবে!

Barnes এর বক্তব্য হল যখনই সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা কোন ভিন্ন সংস্কৃতির মূল্যবোধের মুখোমুখি হবেন, তখন সেগুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে,

১) “জ্ঞান” ও “বিশ্বাস” এর মাঝে পার্থক্য করা যাবে না

২) “সঠিক” জ্ঞান ও “ভুল” জ্ঞানের মাঝে পার্থক্য করা যাবে না

৩) “যৌক্তিক” অনুমিতি ও “অযৌক্তিক” অনুমিতির মাঝে পার্থক্য করা যাবে না

৪) “নৈর্ব্যক্তিক” ও “পক্ষপাতমূলক” সিদ্ধান্তের মাঝে পার্থক্য করা যাবে না

সোজা কথায় বললে, একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি কোন বিদেশী সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করতে পারবেন না, আপনার গবেষণায় আপনি কোন প্রকার মূল্যায়নমূলক distinction ও দ্বিবিভাজন ব্যবহার করতে পারবেন না, নিরপেক্ষ বিবেচিত হতে চাইলে আপনাকে কেবল বর্ণনা করতে হবে। আমি মনে করি কোন সংস্কৃতিতে সহিংসতা ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে মহিমান্বিত করলে সেই সংস্কৃতিকে “সহিংস” ও “পুরুষতান্ত্রিক” আখ্যা দিয়েও নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি নিজের নিরপেক্ষতা বজিয়ে রাখতে পারেন, তবে স্ট্রং প্রগ্রামের তাত্ত্বিকরা বলবেন এধরণের মূল্যায়ন করলে আপনি “নিরপেক্ষতা” হারাবেন।

SP তাত্ত্বিকরা খুব ভাল করেই জানেন অনেক সংস্কৃতির অনেক বিশ্বাসই রীতিমত হাস্যকর, এবং যেকোন বিচারেই ভীষণরকম ভুল, উদাহরণ হিসেবে গুটিবসন্তের উৎস ও প্রতিষেধক হিসেবে শীতলা দেবীর ভূমিকা সংক্রান্ত লোকবিশ্বাসটার কথা বলা যেতে পারে। একজন বহিরাগত পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ থাকতে চাইলে তাঁর অবিশ্বাসকে পাশে সরিয়েই মানুষের এই বিশ্বাসটাকে ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন এবং কীভাবে উক্ত সংস্কৃতির মানুষের মাঝে গুটিবসন্ত সংক্রান্ত এই বিশ্বাসটা উদ্ভূত হল। তবে নিরপেক্ষতা মানে এই নয় যে একই সাথে আপনি আধুনিক বিজ্ঞানের জীবাণুতত্ত্বকেও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে বসবেন, এই তত্ত্বের ভেতরে রাজনীতি আর সংস্কৃতি খুঁজে বেড়াবেন! জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকৃতি বিজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতির প্রতিসাম্যে বিশ্বাসী হলে একজন সমাজবিজ্ঞানী কোনমতেই আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষ্যকে লোকসংস্কৃতির ভাষ্যের উপরে স্থান দিতে পারবেন না, যদিও বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোকে বারংবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন ব্যবস্থার মাঝে কোনমতেই প্রতিসমতা(symmetry) থাকা সম্ভব না, যুক্তি-প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান অবশ্যই বিশ্বাসভিত্তিক “জ্ঞান” এর চেয়ে উৎকৃষ্ট।

আবারও বলতে হয় – স্ট্রং প্রোগ্রাম যে মানুষের বিচিত্র বিশ্বাসগুলোকে সাংস্কৃতিক প্রকরণ হিসেবে দেখছে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য হিসেবে দেখছে না, এটা কিন্তু অতীতের সমাজবিজ্ঞান হতে একটি বিশাল অগ্রগতি। স্ট্রং প্রোগ্রাম জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে – ১) কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা ২) বস্তুজগতকে নিয়ন্ত্রণ করা ৩) বর্তমান জ্ঞানকে পুঁজি করে ভবিষ্যদ্বানী করা। এই তিনটা বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে স্ট্রং প্রোগ্রাম আসলে এটাই স্বীকার করছে যে পৃথিবীর সকল মানুষের বুদ্ধিমত্তা একইরকম। এটাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে অন্যের বিশ্বাসকে বুঝতে হলে আগে তার বিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব মূল্যায়নকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে, নয়ত আমাদের উপলদ্ধিটা পুরোপুরি পক্ষপাতমুক্ত হবে না। আমরা যদি গোত্রের বাইরের মানুষ হিসেবে গোত্রের ভেতরকার মানুষদের মানসিকতা বুঝতে চাই, তবে এইটুকু উদারতা আমাদের পালন করতেই হবে; পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানীদের জন্য এই কর্মপদ্ধতি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁদের পূর্বসূরীদের ওরিয়েন্টালিস্ট প্রেজুডিস নৃবিজ্ঞানকে ব্যাপকভাবে দূষিত করেছে। তবে এই উদারতা গোত্রের ভেতরকার মানুষদের জীবনকে মোটেই প্রভাবিত করবে না, তাই এরকম উদার হয়ে আমরা যদি মনে করি আমরা “সাবঅল্টার্ন” গোষ্ঠীর উপকার করছি, তবে সেটা ভুল হবে। মানবতাকে বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রেজুডিসের হাত থেকে রক্ষা করতে স্ট্রং প্রোগ্রাম এমন এক র‍্যাশনালিটি উৎপন্ন করেছে যা কিনা মানুষকে স্বীয় সংস্কৃতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে, সাংস্কৃতিক শেকল হতে মুক্ত হওয়ার কোন রাস্তা তার জন্য খোলা রাখে না। সমাজবিজ্ঞানের এই “স্ট্রং প্রোগ্রাম” ধারাটি মানুষের উপকার করতে গিয়ে উলটো ক্ষতি করে বসে, এটি একারণেই একটি কূটাভাস(paradox)।

বস্তুত, সমাজবিজ্ঞানের এই ধারাটির নামের মধ্যেই আরেকটি কূটাভাস আছে। নামে যদিও “স্ট্রং”, এই ধারাটি আসলে র‍্যাশনালিটির একটি খুবই দুর্বল সংজ্ঞার উপর দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞানের “নির্ভরযোগ্যতা” ও “সপ্রমাণতা” নির্ধারণের ক্রাইটেরিয়া একটি বহু পুরনো জটিল দার্শনিক সমস্যা। নানা মুনির নানা মত রয়েছে – কার্ল পপারের মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্যতা মতবাদ, কুনের প্যারাডাইম মতবাদ(আগের পর্বের টীকা দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি। স্ট্রং প্রোগ্রাম যেই র‍্যাশনালিটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটি অনুযায়ী জ্ঞানকে আসলে “সঠিক” বা “ভুল” আখ্যা দেওয়া যায় না, জ্ঞান কেবলই ক্ষমতার সৃষ্টি। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নেয়, তারই ফসল হল জ্ঞান।

স্ট্রং প্রোগ্রাম র‍্যাশনালিটির যে ধারণাটির উপর অধিষ্ঠিত, সেটির সমালোচনা করার আগে আমরা র‍্যাশনালিটির প্রচলিত ধারণাটির সাথে পরিচিত হয়ে নিই। র‍্যাশনালিটির মূলত চারটি বৈশিষ্ট্য – ১) যেকোন প্রকার কর্তৃত্বের প্রতি সংশয় ২) নিজের জ্ঞানকে বারংবার পরিমার্জিত করা ৩) নতুন তথ্য-উপাত্ত ও বিকল্প ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে সম্মত হওয়া ৪) যুক্তির সঙ্গতি রক্ষায় সচেষ্ট থাকা। একটি বিশ্বাসকে “যৌক্তিক” আখ্যা দেওয়া মানে এই না যে বিশ্বাসটি সত্য, বরং, ব্যক্তি এমন একটি চিন্তন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছে যে উৎকৃষ্টতর কোন তথ্য-উপাত্ত হাতে পেলে ব্যক্তি সেই বিশ্বাসকে প্রয়োজনমত সংশোধন করে নিবে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে প্রাক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যটা এখানেই যে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে সবসময়ই কিছু না কিছু শিখছি, সবসময়ই আমরা কোন না কোন ভুল ধারণা বাতিল করছি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর মূলভাব হল জ্ঞানের প্রগতি – আমাদের থিওরিগুলো ক্রমশঃ উন্নততর হচ্ছে, আমাদের পর্যবেক্ষণগুলো ক্রমশঃ ক্রুটিমুক্ত হচ্ছে। এই মূলভাবটা তখনই সত্য হবে যখন বহিঃজগত বা external world জাতীয় আসলেই কিছু একটার অস্তিত্ব থাকবে এবং এই বহিঃজগতটি –

১) সবসময়ই কোন না কোন নির্ধারিত অবস্থায়(determined state) থাকবে

২) বহিঃজগতের সেই অবস্থা আমরা কোন না কোনভাবে উদঘাটন করতে পারব

৩) এই বহিঃজগত সম্পর্কে আমাদের উপলদ্ধি জগতটির প্রকৃত অবস্থার কত কাছে যেতে পেরেছে বা প্রকৃত অবস্থা থেকে কতদূর বিচ্যুত হয়েছে, সেটা বের করারও কোন না কোন মানদন্ডের অস্তিত্ব থাকবে। আমরা আদৌ সেই মানদন্ডটি জানি কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

এটা হল গিয়ে সবল র‍্যাশনালিটি, এর সাথে তুলনা করেই উপরে আমি স্ট্রং প্রোগ্রামের র‍্যাশনালিটিকে দুর্বল র‍্যাশনালিটি বলেছি।

স্ট্রং প্রগ্রামের উদ্দেশ্য হল নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক কেইস স্টাডি করে এইটা প্রমাণ করা যে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চর্চা জ্ঞান অন্বেষণের ক্ষেত্রে আর দশটা সংস্কৃতির চেয়ে মোটেই অধিক পারদর্শী নয়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বস্তুজগত সম্পর্কে কিছু অনুমিতি থাকে যেগুলো এখন আমরা “মিথ” হিসেবে অভিহিত করি। স্ট্রং প্রোগ্রামের তাত্ত্বিকদের মতে আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান এসব সংস্কৃতির নিজস্ব জ্ঞানের চেয়ে কোন অংশেই অধিকতর সত্য নয়, আধুনিক বিজ্ঞান যেন স্রেফ আরেকটি সংস্কৃতি! নির্মাণবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা মূলত একারনেই দাবি করেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান চর্চার সাথে লোকসংস্কৃতির জ্ঞান চর্চার কোন পার্থক্য নেই– বিভিন্ন সংস্কৃতির মোড়লরা যেমন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রচার করেন, বিজ্ঞানীরাও তেমনই পূর্বের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের তত্ত্বগুলোকে পরের প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের কাছে হস্তান্তর করেন; আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিজ্ঞানীরা যেমন একটা নির্দিষ্ট প্যারাডাইমের ভেতরে থেকে কাজ করেন(আগের পোস্টের টীকায় থমাস কুনের “প্যারাডাইম” মতবাদ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি), তেমনই মোড়ল ও তাদের অনুরাগীরাও জ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতরে বিচরণ করেন। আধুনিক বিজ্ঞান আর আঞ্চলিক সংস্কৃতির মাঝে যখন এতই সাদৃশ্য, তখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে লোকসংস্কৃতির উপরে বিশেষাধিকার দিব কেন? আধুনিক বিজ্ঞান আঞ্চলিক বিশ্বাসের মতই সমাজ ও সংস্কৃতির নিবিড়ে অঙ্গীভূত। জ্ঞান ও সমাজ যেন একে অপরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, প্রতিটি সমাজব্যবস্থাই ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য নিজেদের বিশ্বাসগুলোর মধ্যে সঙ্গতি ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়। স্ট্রং প্রগ্রাম তাত্ত্বিকদের নিজেদের ভাষ্যেই শুনি,

existing beliefs may always be defended…current experience can be described as consistent with any extant body of ancestral knowledge, even as offering inductive confirmation of it. Equally, it can be made out as refuting any specific body of knowledge or item thereof

এর অন্যথা হওয়া অসম্ভব, কারণ SP তাত্ত্বিকরা বলেন, “cognition is social”। কোন একক যুক্তিবোধ বলতে কিছু নেই, যুক্তিবোধ বা rationality জিনিসটা মানুষের মতই বৈচিত্র্যময়, সব ধরণের যুক্তিই দিন শেষে সামাজিক প্রভাব দ্বারা আবৃত। যুক্তিবোধ ও নৈর্ব্যক্তিক সত্যের মধ্যকার সময়সিদ্ধ বন্ধনটা স্ট্রং প্রগ্রাম তাত্ত্বিকরা সরাসরি অস্বীকার করেন,

What makes a belief true is not its correspondence with an element of reality, but its adoption and authentication by the relevant community

সাধারণত আমরা সত্য ও সত্য সম্পর্কিত বিশ্বাসের মাঝে পার্থক্য করে অভ্যস্ত। উদাহরণ দেই – প্রাণীমাত্রই বিবর্তিত হয়, এটা একটা সত্য। প্রাণীর বিবর্তন নিয়ে আপনার নিজস্ব মতামত থাকতে পারে; আপনি হয়ত মনে করেন প্রাণীকূল অতীতে বিবর্তিত হলেও এখন আর হচ্ছে না, অথবা ঈশ্বর প্রাণীর বিবর্তনধারার খুঁটিনাটি নির্ধারণ করে দেন। এটা হল জৈব বিবর্তনের সত্য সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস। আপনার বিশ্বাস সময়ের সাথে বদলাতে পারে, কিন্তু সত্য কখনওই বদলাবে না।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও, স্ট্রং প্রগ্রাম তাত্ত্বিকরা এই সত্য এবং সত্য সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস এর মাঝে পার্থক্য করেন না,

from a sociological perspective, there is no value in a fundamental distinction between science and ideology

বিজ্ঞানের(মূল টেক্সটে এখানে science ব্যবহার করা হয়েছে, তাই ন্যাচারাল বা সোশাল সায়েন্সের মাঝে এক্ষেত্রে পার্থক্য করলাম না) গঠণগত উপাদান হল প্রমাণনির্ভর যুক্তিবৃত্তি, এর সাথে সামাজিক-নৈতিক-নান্দনিক-অধিবৈদিক মূল্যবোধের তুলনা চলে না। পোস্টকলনিয়াল বুদ্ধিজীবিরা জ্ঞানকে প্রমাণসিদ্ধ-অপ্রমাণসিদ্ধের বৈজ্ঞানিক মানদন্ডে বিচার না করে সভ্যতাভিত্তিক(যেমন, প্রাচ্যের জ্ঞানসম্ভার অথবা প্রতীচ্যের জ্ঞানসম্ভার, ইত্যাদি) এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক(অর্থাৎ, আলোচ্য জ্ঞান কার স্বার্থ রক্ষা করে কেবল এই প্রশ্নেই উনারা আগ্রহী, কোন truth claim এর প্রমাণসিদ্ধতা ও আসঞ্জনশীলতা বা coherence এর প্রশ্নে তাঁরা আগ্রহী নন) মানদন্ডে বিচার করেন, এর জন্য তাঁরা প্রমাণসিদ্ধ জ্ঞান আর প্রেক্ষাপট-নির্ভর মুল্যবোধের মধ্যকার সীমারেখাটা মানতে চান না। পশ্চিমের আত্মসচেতন, প্রগতিশীল নির্মাণবাদী বুদ্ধিজীবিরা খাটা-খাটুনি করে আধুনিক বিজ্ঞানের সমালোচনা করে হয়ত ভাবছেন তাঁরা পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপকার করছেন। বস্তুত, আঞ্চলিক বিশ্বাসগুলো বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যমান status quoকে পরিপুষ্ট করে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিরোধীতা করে সংশয়ী মনোভাবকে অবদমন করলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা কিছুতেই বদলাবে না। খুব সাম্প্রতিককালে ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে, মোল্লাদের কুৎসিত কথাগুলো শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাসির খোরাক যোগালেও তৃণমূলে ঠিকই জনমতকে প্রভাবিত করছে। এই মোল্লাতন্ত্রের অবসান ঘটাতে চাইলে এই মোল্লাতন্ত্রে সরাসরি আঘাত হানতে হবে, মোল্লাতন্ত্র জিইয়ে রেখে এর কুপ্রভাবগুলো এড়ানো সম্ভব না। আরও ভালভাবে বললে, মোল্লাতন্ত্র নিজেই হল সমস্যা।

ভারত ও পাকিস্তানের বিজ্ঞানকর্মীরা কিছু বিশেষ সামাজিক আচার চিহ্নিত করেছিলেন যেগুলো একটি বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী জাতি গঠণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর বিপরীতে নির্মাণবাদী তাত্ত্বিকরা দাবি করেন যে কোন লোকবিশ্বাসই প্রগতির পথে বাধা নয়, সব বিশ্বাসই সমানভাবে সঠিক। আধুনিক বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ দুনিয়া সম্পর্কে উন্নততর ধারণা লাভ করবে না, তারা কেবল নিজেদের আপন মূল্যবোধ বদলে পশ্চিমা মূল্যবোধ দিয়ে প্রতিস্থাপন করবে! মজার বিষয়, তৃতীয় বিশ্বের রক্ষণশীলরা হুবহু একই অভিযোগ সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে করেন!

বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রবক্তারা কেন আধুনিক বিজ্ঞানকে আঞ্চলিক বিশ্বাসের সমতুল্য করার বিরোধীতা করেন? কারণ তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন নরগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন সমার্থক বিজ্ঞান চান, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য একটি একক বিজ্ঞান চান। সব সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গীগত সমতার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ নেই, তাঁরা শুধু এই কামনা করেন যে সব সংস্কৃতির মানুষ যাতে অর্থপুর্ণ ও পরিপূর্ণ জীবনযাপনের সমান সুযোগ পায়।

আঞ্চলিক জ্ঞানের পক্ষে ওকালতি করা বুদ্ধিজীবিরা যে একেবারেই “নৈর্ব্যক্তিক” জ্ঞানে বিশ্বাস করেন না, তা কিন্তু না। তাঁদের আপত্তি মূলত নৈর্ব্যক্তিকতার(objectivity) একটি বিশেষ সংজ্ঞায় – তাঁরা এটা মানতে চান না যে মানুষের যাপিত অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধ্বে উঠেও নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান চর্চা করা সম্ভব। এই বুদ্ধিজীবিদের মতে, বিভিন্ন knowledge system একে অপরের মুখোমুখি হলেই তখন দৃঢ়তর নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জন করা যাবে: বাস্তবতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অবলোকন করলে নতুন নতুন যোগসূত্র আবিস্কার করা অপ্রত্যাশিত নয়।

গত পোস্ট এবং এই পোস্টে আলোচিত জ্ঞানের এই রিলেটিভিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গীর পক্ষে যেসব চিন্তক ওকালতি করছেন, তাঁরা আসলে বিজ্ঞানকে পরিমার্জন করার উদ্দেশ্যেই এই কাজ করছেন। তাঁদের দর্শনকে কোন “ভুল বোঝাবুঝি” এর কারণে প্রত্যাখ্যান করলে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। এখন প্রশ্ন হল – বিজ্ঞানের এই রিলেটিভিস্টিক দর্শন কি আদৌ তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে? আপনি যখন কোন আইডিয়াকে তার সত্যতা দিয়ে বিচার না করে ভূরাজনীতি-শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণের পরিধিতে সেই আইডিয়ার অবস্থান দিয়ে তাকে বিচার করবেন, তখন উৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চা আসলে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর মাঝে সংলাপের মাধ্যমে পরিশীলিত বিজ্ঞানচর্চার যেই স্বপ্ন উত্তরাধুনিকরা দেখছেন, সেখানে ফ্যাক্ট অনুসন্ধানের বাঞ্ছার চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শই বেশি সক্রিয়, আর ফ্যাক্ট যে সবসময়ই আমাদের রাজনৈতিক বাসনার অনুকূলে থাকবে তা তো নয়! প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে আপনি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করতে চাচ্ছেন, কিন্তু এই পর্যালোচনার কোন ফল পেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন দৃষ্টিভঙ্গীটি অধিকতর বাস্তবঘনিষ্ঠ। নির্মাণবাদী তাত্ত্বিকরা দাবি করেন, এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি আপনি কিছুতেই সমসাময়ীক রাজনীতি ও সংস্কৃতির গন্ডির বাইরে গিয়ে নিতে পারবেন না। নির্মাণবাদীরা একারণে শুধু পর্যালোচনাই করেন, পর্যালোচনা-পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপটি তাঁরা এড়িয়ে যান।

নির্মাণবাদীরা রাজনীতিকে ফ্যাক্টের উপরে স্থান দেন, একারণেই তাঁদের পক্ষে প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সমালোচনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রাচ্যের কোন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মজ্জাগতভাবেই ক্ষতিকর হলেও তাঁরা সেটার সমালোচনা হতে বিরত থাকবেন, কারণ প্রাচ্যের “মর্যাদা” অক্ষুন্ন রাখার রাজনৈতিক মিশনটা তাঁদের কাছে লাভ-ক্ষতির ফ্যাক্ট-নির্ভর আলোচনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ক্ষতিকর মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে আমরা যেসব ফ্যাক্ট ব্যবহার করে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, নির্মাণবাদী সমালোচকদের ভাষ্যে এই ফ্যাক্টগুলো সবই পশ্চিমা সংস্কৃতির অঙ্গীভূত। একই সংস্কৃতির কোন বাসিন্দা যদি নিজ সংস্কৃতির কোন স্বৈরাচারী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন তাকে এই যুক্তিতেই “পশ্চিমা এলিট” আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। Status quo এর পরিচর্যাকারী মোড়লরা ভিন্নমতকে এভাবে আখ্যায়িত করতে খুবই পছন্দ করেন। বাংলাদেশের কোন শিক্ষিত শহুরে নারী যদি তার প্রতি আত্মীয়স্বজন আর সমাজের প্রত্যাশা প্রত্যাখ্যান করে নিজের সাধ-আহলাদগুলো বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, অর্থাৎ, সংসারের চাকর না হয়ে যদি নিজের ক্যারিয়ার আর ব্যক্তিগত অভিলাষগুলোর পেছনেও সময় দিতে উদ্যত হয়, তবে মোড়লরা তাকে westernized আখ্যা দিয়ে তিরস্কার করবে। এই অঞ্চলে “নারী” বলতে একটি কোমল, বশ্য প্রাণীকে বোঝানো হয়, পুরুষ ব্যতিত যার অস্তিত্ব অসম্ভব। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কর্মজীবি নারীরা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও, জীবনে কখনও ফেমিনিস্ট থিওরির নাম না শুনেও অনায়াসে “নারীত্ব” নামক কৃত্রিম কনসেপ্টের এই অহেতুক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিদিন আনমনে অস্বীকার করে চলেছে। মূল্যবোধকে নির্মাণবাদী তাত্ত্বিকদের মত প্রাচ্য-প্রতীচ্যের গন্ডিতে না বেধে, কোন বিশেষ সভ্যতার সম্পদ গণ্য না করে যদি আমরা একে একটি ইউনিভারসাল কনসার্ন হিসেবে দেখি, তবে জগতের সকল প্রাণীই সুখী হবে। সংস্কৃতিভেদে মানুষের মাঝে যতই বৈচিত্র্য থাকুক, রাষ্ট্র-সমাজের ডিসিপ্লিন উপেক্ষা করে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিকশিত হতে দেওয়ার বাসনা একটি ধ্রুব লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে ফ্যাক্ট ও মূল্যবোধের জন্য পাসপোর্ট-ভিসা বাতিল করতে হবে, এই দু’টোর কোন নাগরিকত্ব থাকতে পারে না।

টীকা:-

Falsificationism(মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্যতাবাদ) – বিজ্ঞানের দর্শনে দীর্ঘ সময় ধরে positivism নামক একটা মতবাদ রাজত্ব করেছিল। এই মতবাদ অনুযায়ী একটি থিওরিকে বৈজ্ঞানিক হতে হলে অবশ্যই সেটি sense experience দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। পপার এই মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে “মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্যতাবাদ” দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। পপারের মতে, কোন বৈজ্ঞানিক থিওরিকেই আসলে সন্দেহতাতীতভাবে “প্রমাণ” করা সম্ভব না। একটা থিওরিকে আপনি ১০০ বার পরীক্ষা করতে পারেন, হয়ত টানা ৯৯ বারই আপনার থিওরি প্রমাণিত হবে, কিন্তু সর্বশেষ পরীক্ষাটায় যদি আপনার থিওরি ব্যর্থ হয় তবে আপনার থিওরিটি সাথে সাথে প্রত্যাখিত হবে। কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আসলে অনন্তকাল ধরে পরীক্ষার সম্মুখীন করা সম্ভব না, এটা সময় ও অর্থের অপচয়। একটি তত্ত্বকে অসীম সংখ্যাকবার পরীক্ষা করা হলে একবারও ব্যর্থ না হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা যেহেতু আমরা দিতে পারি না, তাই পপার মনে করেন কোন থিওরিকে absolutely প্রমাণিত আখ্যা দেওয়াটা অযৌক্তিক হবে। একটি সময়সিদ্ধ ও সফল থিওরিকে positivistরা “নিঃসন্দেহে প্রমাণিত” আখ্যা দিবেন, কিন্তু পপারীয় দার্শনিকরা বলবেন “থিওরিটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রচন্ড, কিন্তু একে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত আখ্যা দেওয়া সম্ভব না।

তবে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত না করা গেলেও, খুব সহজেই বাতিল করে ফেলা যায়। একটি পরীক্ষাতেও যদি তত্ত্বটি ব্যর্থ হয়, তবে তাকে কালবিলম্ব না করে বাতিল করে ফেলতে হবে।

পপারের মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্যতাবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল এটি বিজ্ঞান ও ছদ্মবিজ্ঞান(pseudoscience) এর মাঝে একটি সীমারেখা টেনে দেয়। ছদ্মবিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের মতই কোন না কোন হাইপোথিসিসকে ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বানী করেন। কিন্তু কৃত পরীক্ষায় নেতিবাচক ফল পেলে যেখানে বিজ্ঞানীরা থিওরি বাতিল করে ফেলেন, সেখানে ছদ্মবিজ্ঞানীরা তাদের হাইপোথিসিসের এমন এক নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হবেন যে নেতিবাচক ফলাফলটাকেই তারা হাইপোথিসিসের স্বীকৃতি বলে দাবি করবেন। ব্যাপারটা অনেকটা গোল দিতে আসলে গোলপোস্ট সরিয়ে দেওয়ার মত!

Orientalism – উপনিবেশের যুগে ইউরোপীয়রা প্রাচ্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি অধ্যায়ন করে প্রাচ্যের একটি “চিত্র” দাঁড়া করিয়েছিল, যার সাথে বাস্তবের যৎসামান্যই মিল রয়েছে। এই চিত্র অঙ্কনের পেছনে নির্মোহ জ্ঞান অন্বেষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থই মূল প্রভাবক ছিল। খুব সম্ভবত এডওয়ার্ড সাইদ এই শব্দের প্রবক্তা, এবং Orientalism শাস্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতি নিয়ে গবেষণায় তিনিই প্রধান অথরিটি।

সাইদের মতে, প্রাচ্য কেবল ইউরোপীয় ভাষা ও সংস্কৃতির উৎপত্তিস্থল নয়, একই সাথে এটি ইউরোপের Other। অর্থাৎ, ইউরোপ যা নয়, প্রাচ্য সে সব কিছুকেই ধারণ করে। ইউরোপীয়দের কাছে একারণে প্রাচ্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রাচ্যের প্রতি এই আগ্রহ ও প্রাচ্যকে অধিগ্রহণ করার প্রবল ইচ্ছা তাদের প্রাচ্য সংক্রান্ত গবেষণাকে রঞ্জিত করেছিল, তারা প্রাচ্যের এমন একটি চিত্র দাঁড়া করিয়েছিল যা প্রাচ্যের সঠিক প্রতিনিধি নয়। উপনিবেশের পতন ঘটেছে, কিন্তু ওরিয়েন্টালিজমের প্রভাব এখনও ইউরোপীয় মানস হতে মোচন হয়নি।

Subaltern – ইতালীয় এক্টিভিস্ট এন্তনিও গ্রামসি প্রথম “সাবঅলটার্ন” ব্যবহারে করে সেসব সামাজিকভাবে দলিত গোষ্ঠীকে অভিহিত করেন যাদের হাতে বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই এবং যারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী/গোষ্ঠীসমূহের মত সংঘবদ্ধও নয়। ’৮০ এর দশকে ভারতের মার্ক্সবাদী রিভিশনিস্ট ইতিহাসবেত্তারা শব্দটির নতুন আরেক অর্থ প্রচলন করেন – গ্রামসি সাবঅলটার্ন বলতে ’৩০ এর দশকের ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীকেই বুঝিয়েছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসবেত্তারা সাবঅল্টার্ন হিসেবে সেসব গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করলেন যারা ক্ষমতার বলয় হতে গ্রামসির ইউরোপীয় প্রলেতারিয়াতের চেয়েও দূরবর্তী ছিল।

তথ্যসূত্র

১) Horton, R., Patterns of Thought in Africa and the West: Essays on Magic, Religion and Science. London: Cambridge University Press, 1993.

২) Barnes, B. Interests and the Growth of Knowledge. London: Routledge Kegan and Paul, 1977.

৩) Barnes, B. How Not to Do Sociology of Knowledge. Annals of Scholarship 8: 321–36, 1991

৪) Lewis, M. and K. E. Wigen. The Myth of Continents: A Critique of Metageography. Berkeley: University of California Press, 1997.

৫) Jarvie, I. C., Rationality and Relativism: In Search of a Philosophy and History of
Anthropology. London: Routledge and Kegan Paul, 1984.

৬) Barnes, B., D. Bloor, and J. Henry. Scientific Knowledge: A Sociological Analysis. Chicago: University of Chicago Press, 1996.

৭) Fine, A. Science Made Up: Constructivist Sociology of Scientific Knowledge. In The Disunity of Science: Boundaries, Contexts, and Power, P. Galison and D. Stump, eds. Stanford: Stanford University Press, 1996.

৮) Barnes, B., T. S. Kuhn and Social Science. New York: Columbia University Press, 1982.

৯) Nanda, M, Restoring the Real: Rethinking Social Constructivist Theories of Science. In Socialist Register, L. Panitch, ed. London: Merlin Press, 1997b.


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

আপনার লেখাটির জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। আরও লিখুন না! বেশ লাগছে।

SP যে স্বীকার করেছিল যে সব মানুষের যুক্তিচর্চা করার ক্ষমতা সমান আজকেও একাধিক মেসেজ পেলাম যে মানুষ এখনো চাঁদে যায় নি, সব নাটক।

পৃথ্বী এর ছবি

ধন্যবাদ দেঁতো হাসি এই সিরিজটা আপাতত এখানেই শেষ করে দিলাম। বাংলাদেশে এখনও এধরণের বু্দ্ধিবৃত্তির উৎপাত শুরু হয়নি, কিন্তু যখন শুরু হবে তখন আশা করি এই সিরিজটা আলোচনার জন্য একটা precedent হিসেবে কাজ করবে। আপাতত লেখার জন্য ভিন্ন টপিকে মনোনিবেশ করছি হাসি


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ছি, এক পড়ে শেষ করলাম। এটা শেষ হলে পরে মন্তব্য করব। ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।

স্বয়ম

নিটোল এর ছবি

আপনার লেখাগুলো সবসময় ফলো করার চেষ্টা করি। দু'টো পর্বই পড়েছি, ভালো লেগেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কিছু প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখলেও তা খণ্ডানোর জন্য যে মালমসলা প্রয়োজন তা হাতে খুব একটা ছিলো না। পোস্ট দুটো পথ দেখালো।

লিখতে থাকুন। চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।