আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের প্রসঙ্গে

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন রাজিব মোস্তাফিজ [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০৯/২০১৪ - ৫:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আপিল বিভাগের দেয়া সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে বিচার প্রত্যাশী সব মানুষ যখন হতাশ, তখন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রতিক্রিয়ায় আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান প্রসিকিউশন টিমের উপর চরম অনাস্থা লক্ষ্য করি। তদন্ত প্রক্রিয়ায় ত্রুটির পাশাপাশি এই মামলার সঙ্গে যুক্ত প্রসিকিউটরদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। রায়ে হতাশা প্রকাশ করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আসা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিও সাঈদীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ত্রুটিকে কারণ হিসেবে দেখান। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কমিটির আহ্বায়ক এম এ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপনে দুর্বলতা ছিল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকেই জানতে পারি সেই রাতে একাত্তর টেলিভিশনের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মাহবুবে আলম সরাসরি তদন্ত সংস্থার গাফিলতিকে দায়ী করেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি ইব্রাহিম কুট্টির হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার স্ত্রীর করা মামলার এজাহার তদন্ত সংস্থা জোগাড় করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বরাতেই এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের ভাষ্য জানতে পারি যেখানে তিনি বলেন,

এই মামলায় তদন্তকারী দলের গাফিলতি ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার পর তার স্ত্রী যে এজাহার করেছিল, তা খুঁজে পায়নি। সাঈদীর আইনজীবী (আদালতে) ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর যে এজাহারটি তুলে ধরেছেন, তাতে সাঈদীর নাম নেই। অথচ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সেটি খুঁজে পায়নি। এমনকি ওই এজাহার ধরে সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা চলেছে কি না, কিংবা পরবর্তীতে তার নাম এসেছে কি না, সেটাও তারা জানেন না।

অ্যাটর্নি জেনারেল প্রসিকিউটদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্ন তোলেন প্রধান প্রসিকিউটরের শারীরিক সামর্থ্য নিয়েও। প্রসিকিউটরদের বিরোধের কথাও উঠে আসে তার কথায়। তিনি বলে চলেন,

ট্রাইব্যুনালে এমন ঘটনা ঘটছে, যা শুনলে আপনারা শিউরে উঠবেন। প্রসিকিউটরদের মধ্যে এমন লোকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার একটি ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞতাও নেই। কিছুদিন আগে ট্রাইব্যুনালের একজন আইনজীবীকে বিচারক বিরক্ত হয়ে বিচারকক্ষ থেকে বের করে দিয়েছেন। কারণ উনি এতই উল্টাপাল্টা কথা বলছিলেন।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ‘অদক্ষ’ প্রসিকিউটর নিয়োগের জন্য সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে দোষারোপ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রসিকউশন টিমের উপর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার এত তীব্র অনাস্থা চরম শংকার জন্ম দেয়।

শুধু অ্যাটর্নি জেনারেল নন, পত্রিকায় দেখতে পাই ট্রাইব্যুনালের বিচারকদেরও প্রসিকিউটরদের অদক্ষতায় বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝেই মন্তব্য করতে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই খবরে দেখতে পাই -- একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক হাসান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশনের প্রস্তুতির ঘাটতি থাকায় সোমবার অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের প্রস্তুতির ঘাটতির জন্য আগামী ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম ‍মুলতবি করা হয়। একইসঙ্গে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলীকে আগামীতে শুনানির জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসতেও পরামর্শ দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর থেকেই আরও বিস্তারিত জানতে পারি -- সোমবার সকালে হাসান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি শুরু করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। শুনানির এক পর্যায়ে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন জানান। এসময় বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন,

আপনাদের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণাদি নেই। আসামি পলাতক বলে কি আপনাদের নিকট মামলার গুরুত্ব নাই? আপনারা কোনো মামলার তদন্তে বা শুরুতে গুরুত্ব দেন না, কিন্তু রায়ের পর ঠিকই একে অন্যের সমালোচনা করতে পারেন।

মামলার নথিপত্রের দুর্বলতা তুলে ধরে ট্রাইব্যুনাল আরো বলে,

হাসান আলীকে আপনারা রাজাকার কমান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই রাজাকার কমান্ডার প্রমাণে রাজাকারদের তালিকা কোথায়?

এসময় প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত প্রসিকিউটর আবুল কালামকে তালিকা জমা দিতে বলেন। আবুল কালাম তখন জানান, তিনি অনেক খোঁজাখুজি করেও তালিকা পাননি। তখন ট্রাইব্যুনাল বলে,

অপরাধ সংগঠনের জায়গায় বহু ডকুমেন্ট রয়েছে। এলাকায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসেন। অপরাধ প্রমাণে অনেক তথ্য পাবেন। আপনারা আদালতে অনেক পত্রিকার কাটিং দিয়েছেন। তাতে আসামির সম্পৃক্ততা কী আছে, তার জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।

একই পত্রিকার একই খবর থেকে জানতে পারি -- মো. কামারুজ্জামানের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় সাবেক প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলামের প্রস্তুতির অভাব নিয়েও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২। এই সাবেক প্রসিকিউটর উমর খৈয়াম মোঃ সাইফুল ইসলাম সম্পর্কে মামলার নথি গায়েব সংক্রান্ত যুগান্তরের রিপোর্টের এই অংশটুকু অত্যন্ত শংকাজনক --

নিজামীর মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে জানান, আদালতে কিছু নথি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, সংরক্ষণে থাকা তথ্যের মধ্যে ফরমাল চার্জ, সাক্ষ্য বেং ওপেনিং স্টেটমেন্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও দাবি করে বলেন, আগের প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার বুঝিয়ে দিয়ে যাননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা যুগান্তরকে বলেছেন, মাত্র ১৪ দিনের ছুটি নিয়ে সাইফুল ইসলাম বিদেশে গেলেও তিনি কোনো কিছু বুঝিয়ে দিয়ে যাননি। মামলার নথি সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন সাইফুল ইসলাম।ট্রাইব্যুনালের একটি সূত্র জানায়, কম্পিউটার ল্যাবের দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর উমর খৈয়াম মোঃ সাইফুল ইসলাম। বিনা অনুমতিতে বিদেশে ছুটি কাটানোয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই প্রসিকিউটরকে গত আগস্টে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি ৩ এপ্রিল ১৪ দিনের ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্র যান। তিনি ট্রাইব্যুনালকে না জানিয়ে ৩ মাসের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন। ছুটির নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর রহস্যজনক কারণে তিনি আইন মন্ত্রণালয় বা প্রসিকিউশন অফিসেও যোগাযোগ করেননি। ২৩ জুলাই প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলামের বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে ট্রাইব্যুনাল। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই আইন মন্ত্রণালয় সাইফুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল করে। সাইফুল ইসলামের মেয়াদেই নিজামী, সাঈদী এবং অন্য দুজনের মামলার ফাইলগুলো মুছে ফেলা হয়েছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ করছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।

যদিও পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু দাবি করেছেন,

একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মামলার নথি গায়েব’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার বলে কোনো কিছু রাষ্ট্রপক্ষের নেই। মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলিরা তাঁদের নিজ নিজ কম্পিউটারে সংশ্লিষ্ট মামলার নথি রাখেন। এ ছাড়া ওই পত্রিকার প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ আল মালুম ও রেজিয়া সুলতানার নামে যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, তা আদৌ সঠিক নয়। তাঁরা আদৌ এ ধরনের কোনো কথা বলেননি।

একটা রায় প্রকাশের পর যখন তা আশানুরূপ হয় না তখন বিক্ষুব্ধ মানুষজন সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে নানা অভিযোগ তোলে যার অধিকাংশই হয়ত সত্য নয়। কিন্তু আমি যতটুকু বুঝতে পারি একটি শক্তিশালী প্রসিকিউশন টিম করা এবং তারা ঠিকভাবে কাজকর্ম করছে কিনা তা দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের --- সরকার এ দায় এড়াতে পারে না। ট্রাইব্যুনালে দায়িত্বরত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম যখন বলেন,

ফৌজদারি মামলা বিচারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ প্রসিকিউটর নিয়োগ করা জরুরি; যাঁরা ওকালতি জীবনে অন্তত কয়েকটি ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছেন। আমার জানামতে, ট্রাইব্যুনালে গুটি কয়েক প্রসিকিউটর ছাড়া অনেকেই ফৌজদারি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।

তখন প্রসিকিউশন টিমে যথাযথ পরিবর্তন এনে একে দ্রুত আরও শক্তিশালী করার দায়ভার সরকার এবং আইনমন্ত্রী সম্ভবত এড়াতে পারেন না। আশা করব, আইনমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমকে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নেবেন। এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে যাঁরা রক্তিম সূর্য আনলেন, তাঁদের হন্তারকদের বিচার শুধুমাত্র অদক্ষতা আর গাফিলতির কারণে আমরা যেন ব্যর্থ করে না দেই।


মন্তব্য

শেহাব এর ছবি

ওনারা খুব সম্ভবত: ওভারলোডেড।

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

সেক্ষেত্রে লোড ব্যালান্সিং-এর পরিকল্পনা ঠিকঠাক করে করতে হবে।

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

অতিথি লেখক এর ছবি

কেন যেন মনে হয় সমস্যাটা ওভার লোডিং চেয়ে প্রফেশনালিজম এবং এ ধরনের মামলার অভিজ্ঞতার অভাবের । এরকম মামলায় তদন্ত, নিষ্ঠার সাথে তথ্য উপাত্তের সাথে যুক্তি-তর্ক সুতায় গাঁথার জন্য যেমন অভিজ্ঞতা কিংবা ট্রেনিং দরকার প্রসিকিউটরদের কারো আছে বলে তো মনে হয় না । আবেগের ঠেলাতেই উনারা মামলা জিতে জেতে চান । আঈনজীবি হয়েও, আঈন আবেগ মানে না এই জিনিসটা আমাদের বিজ্ঞ প্রসিকিউটরা কত্টা বোঝেন এই ব্যপারে সন্দেহ আছে ।

আর সরকারের তরফ থেকেও আগ্রহটা এখন আর খুব বেশি থাকার কথা না । তারা রাজনৈতিক দল । রাজনীতির স্বার্থে খাটে । পাবলিকের চাপে যা কিছুটা উন্নতি হয়েছিল । প্রসিকিউশন বা পাবলিক কোন তরফ থেকেই চাপ না থাকলে তারাও খুব একটা নড়াচড়া করার কথা না ।

দস্যু ঘচাং ফু
======================================================
মানবতা ব্যপারটা বড় পুঁদ্দিচেরী । তাই আমি আজ মানবতারে ধিক্কার জানায়ে দানবতার গান গাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।