চাষীদের রাণী

শামীম হক এর ছবি
লিখেছেন শামীম হক (তারিখ: রবি, ০৪/০৫/২০০৮ - ৯:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে। অন্ধকার ঘর। খাটের এক কোনে বসে থাকা পিয়ারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে হাসি। কান্না থেমেছে। সারাদিনের সব ভাবনা, বোঝাপড়া, ভয়, সব কিছুর অবসান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখন আর কিছু ভাবছে না সে।

পিয়ারী হাসির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, 'উঠ বইন আমার, অনেক রাইত হইছে....'

হাসি চুপ করে থাকে, যেমন শুয়ে ছিলো তেমনি শুয়ে থাকে।

সকালে সেই সূর্য ওঠার পর থেকে গার্মেন্টসে সেলাই মেশিনে একের পর এক সার্টের পকেট সেলাই করতে করতে হাসি আজ রাতের কথা ভেবেছে সারাক্ষণ। অন্যান্য দিন সেলাই এর ফাঁকে ফাঁকে তিন সারি পরের মেশিনে বসা আজিজ ভাইয়ের দিকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে তাকিয়ে দেখে সে তাকিয়ে আছে কি না। চোখাচোখি হয়ে গেলে লাজুক হেসে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ওইটুকুতেই অনেক কথা বলা হয়ে যায়। আজ একবারও মুখ তুলে আজিজের দিকে তাকায়নি সে।

প্রতিদিন দুপুরে টিফিনের সময় সবাই মিলে গার্মেন্টসের ছাদে উঠে দল বেঁধে গোল হয়ে বসে টিফিন খায়। আজিজ এই সময়টায় প্রায়ই হাসির পাশে এসে বসে। কিছু রঙ তামাশার কথা বলে। কিন্তু আজ পিয়ারী হাসিকে নিয়ে ছাদের কোনার দিকে রেলিং ঘেঁসে অন্যদের থেকে দূরে সরে বসেছিলো একটু নিরিবিলিতে।

টিফিন বাক্সে কলা পাউরুটি নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় হাসি বলেছিলো, 'বুবু, আমার মন সায় দেয় না....'

পিয়ারী বলেছিলো, 'মনের কথা ভাবলে আমাগো চলে না। গরীবের আবার মন কি? আমারে বিশ্বাস করস? আমি তোর ভাল চাই এইটা জানস?'

'সেইটা আমি জানি বুবু।'

পিয়ারী যে তার ভালো চায় তা নিয়ে হাসির কোন সন্দেহ নেই। সে তার বড় বোনের মতই। তাদের চরম দুঃসময়ে তাকে তুলে এনে এই গার্মেন্টসের কাজটি দিয়েছে। গ্রামে হাসিদের সবকিছু ভালোই চলছিলো। বাবা বশির মাষ্টার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অন্যতম শিক্ষক ছিলো। ছোট বোন ক্লাস সেভেনে পড়তো। ছোট ভাই বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো ক্লাস ফাইভে। তার নিজের বিয়ের কথাবার্তাও শুরু হয়েছিলো। এর মধ্যে কোনো রকম আগাম সতর্কতা ছাড়া হঠাৎ স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে গিয়ে অকেজো হয়ে গেলো বশির মাষ্টার। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেলো, সেই সাথে বন্ধ হওয়ার উপক্রম করলো আর সব কিছু। তার সাথে যোগ হলো তার চিকিৎসার খরচ। সবাই যখন চোখে অন্ধকার দেখছে, সে সময় পাশের বাড়ীর মেয়ে পিয়ারী - যার সত্যি নাম রোকসানা - ছুটিতে গ্রামে এসে তার মায়ের কাছে হাসির গার্মেন্টসে কাজ করার পরামর্শ দেয়। মায়ের আপত্তি করার জোর ছিলো না। বাবারতো কথা বলার শক্তিও অবশিষ্ট নেই আর। মা অবশ্য একবার মিন মিন করে বলেছিলো যে গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েদের নিয়ে লোকে আজে বাজে কথা বলে, তাদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। সে কথায় গুরুত্ব দেয়নি পিয়ারী। শুধু সোজা কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলো খারাপ কথা বলনেওয়ালারা তাদের ভাত দেবে না।

হাসির ভয় হয়েছিলো শহরে কাজ করার কথা শুনে। কিন্তু সেই সাথে রোমাঞ্চও বোধ করেছিলো। নিজে উপার্যন করে পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কথা ভেবে তার রক্তে ঢেউ উঠেছিলো। সে কখনো ভাবেনি কোনোদিন তার কাজ করার প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ারীকে নিজের চোখে না দেখলে সে জানতেই পারতো না যে মেয়ে মানুষও চাকরী করে ভাইদের খাওয়াতে পারে।

বছর দুয়েক আগে পিয়ারীর স্বামী তার বাচ্চাটি রেখে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করার পর পিয়ারী ফিরে এসেছিলো বাপের বাড়ীতে। বাপ-ভাইরা তাকে দায়ে পড়ে আশ্রয় দিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু ঘটনার জন্য সবাই তাকেই দোষারোপ করেছিলো। সবাই বলেছিলো পিয়ারী অলক্ষি, তাই স্বামীর ঘরে থাকতে পারেনি। তারা প্রতিনিয়ত জোর করতো তাকে স্বামীর পায়ে গিয়ে পড়ে থাকতে, তাতে যদি সে তাকে ফিরিয়ে নেয়। সেই সময় হাসিরও মনে হয়েছিলো স্বামীর পায়ে কেঁদে পড়া ছাড়া পিয়ারীর আর গতি নেই। কিন্তু পিয়ারী সবাইকে অবাক করে দিয়ে পালিয়ে শহরে চলে এসে কেমন করে যেনো গার্মেন্টসে সেলাই এর কাজ জুটিয়ে ফেলে। আর তার রোকসানা নামটি বদলে গিয়ে হয়ে যায় পিয়ারী। সেই থেকে সময়ে অসময়ে বাড়ীতে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে ভাইদেরকে। গ্রামের লোক ছিঃ ছিঃ করুক আর যত কথাই বলুক, তার ভাইরা তাকে ঠিকই সমীহ করে চলে এখন। ছুটিতে সে বাড়ী গেলে মোল্লা বাড়ীর মেয়ে হয়েও বোরখা না পরে শুধু মাথায় অর্ধেক ঘোমটা টেনে এর বাড়ী তার বাড়ী বেড়াতে যায়।

পিয়ারী টিফিন খেতে খেতে বলেছিলো, 'সেইটা যদি জানস, তাইলে আমার কথা শুন। খালি নিজের কথা চিন্তা করলে আমাগো চলে না। তোর বাড়ীর সবাইর কথা চিন্তা করতে হইবো। কাম গেলে এই শহরে আরেকটা কাম পাবি? তুই কাম না করলে বাড়ীর সবাই খাইবো কি? এই শহরে থাকতে হইলে মান-সন্মানের কথা অত চিন্তা করলে চলে না, এই শহরে মান-সন্মানের দাম নাই। আমার উপর ভরসা রাখ।'

হাসি গার্মেন্টসে কাজ করছে মাস দু'য়েক। অনেক কিছুই শিখছে সে। শিখছে কাজ। শিখছে নিয়ম-কানুন। সেলাই এর কাজ শুনে প্রথমে ভেবেছিলো কত আর কঠিন হতে পারে। কিন্তু দুই মাস কাজ করেও টার্গেট দিতে পারছে না সে কিছুতেই। কাজ যত সহজ ভেবেছিলো তত সহজ নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রতিদিনই টারগেটের চেয়ে কম সেলাই করছে সে। তার চেয়ে নতুন যারা তারা টার্গেট দিতে পারছে, সে পারছে না। তার সেকশনের প্রোডাকশন ম্যানেজার নূরালী, যাকে সবাই ডাকে পি এম নূরালী, প্রতিদিন ধমকাচ্ছে তাকে। চাকরি খেয়ে নেবার হুমকি দিচ্ছে ইদানিং। সে কাজ শুরু করার পর এই দু'মাসে টার্গেট দিতে না পারার কারণে কয়েকজনের কাজ চলে যেতে দেখেছে। আবার কয়েকজনকে চেনে যারা টার্গেট না দিলেও তাদের কেউ কিছু বলছে না। পিয়ারী তাদের একজন। হেল্পার থেকে পি এম প্রর্যন্ত সবাই তাকে খাতির করে। তার সুপারিশে হাসি ছাড়া আরও দু’জনের কাজ হয়েছে। পিয়ারী বলেছে একদিন হাসিও এমন সুবিধা পাবে।

এক টুকরো পাউরুটি কিছুক্ষণ চিবিয়ে এক ঢোঁক পানি দিয়ে গিলে ফেলে হাসি বলেছিলো, 'বুবু, তোমার উপরেই ভরসা করি। তোমার কারণে আমি আইজ এই শহরে কাম কইরা খাই, দেশে মা-বাপ ভাই-বইনরে খাওয়াই। তোমার ঋণ শোধ করনের উপায় নাই আমার।'

এ কথা সত্যি। হাসি মন থেকে বলে কথাগুলো। শহরে আসার পর থেকে সে এখনো পিয়ারীর সাথে থাকছে। গার্মেন্টসের অদূরের বস্তিতে একটি ঘর নিয়ে বাস করছিলো পিয়ারী। সম্প্রতি সে আরও দু'টি ঘর ভাড়া নিয়ে অন্যদের সাবলেট দিচ্ছে আরেকটু বেশী ভাড়ায়। প্রতিটি ঘরে চারজন করে গার্মেন্টসের মেয়ে থাকছে। কিন্তু বস্তির মালিক তার এই বাড়তি লাভের ব্যাপারটি পছন্দ করছে না। সে ভাড়া বাড়াবার হুমকি দিচ্ছে। যে ভাড়া সে দাবি করছে, তা তাকে দিতে গেলে পিয়ারীর আর কিছু থাকে না। তারপরও পিয়ারী এখন পর্যন্ত হাসির কাছ থেকে ভাড়া দাবি করেনি। বলেছে আগে হাসি গুছিয়ে নিক, তারপর ভাড়ার কথা হবে।

টিফিন শেষ করতে করতে পিয়ারী বলেছিলো, 'তুই আমার ছোট বইনের মতো। বইনের কাছে বইনের ঋণ কী? তোর লাইগা করুম নাতো কার লাইগা করুম। ছোটকালে তোর বাপ মায়ে আমারে নিজের মাইয়ার মতো আদর করছে।' বলতে বলতে তার গলা ধরে আসে, চোখ ছলছল করে ওঠে। দেখে চোখে পানি আসে হাসিরও।

এ সময় আজিজ গোল হয়ে বসা দলটি থেকে বেরিয়ে হাসির পাশে এসে বসে। হাসির কাছাকাছি আসার উত্তেজনায় সে তাদের চোখের পানি লক্ষ্য করে না। বোকার মত গলায় মধু ঢেলে হাসিকে বলে, 'কি গো হাসি রাণী, কেমুন আছগো?'

প্রথম স্কুল শুরু করার পর পিয়ারী আর হাসি ভোর বেলায় একসাথে বড় রাস্তা ধরে স্কুলে যেতো। পিয়ারী হাসির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। বশির মাষ্টারকে গ্রামের সবাই সন্মান করতো, আর তার মেয়ে বলে হাসিকেও সবাই স্নেহ করতো। বড় রাস্তার পাশের ক্ষেতি জমিতে কাজ করতে থাকা চাষীরা তাদের হেঁটে যেতে দেখলে হাসিকে উদ্দেশ্য করে বলতো, 'আমাগো হাসি রাণী কেমুন আছেন গো...', কিংবা, 'হাসি রাণীর হাসি গেলো কই আইজ...'। চাষীরা তাকে হাসি রাণী কেনো ডাকতো তা হাসি জানতো না। কিন্তু সেসব শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো সে। নিজেকে রাণী ভাবতো মনে মনে। খুব ভালো লাগতো তার। হাসি গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর পিয়ারী এই গল্প অনেকের কাছেই করেছে। যদিও আজিজ ছাড়া আর কেউ তাকে এ নামে ডাকে না। চাষীদের রাণী এই শহরের কারো রাণী নয়।

পিয়ারী আজিজকে ধমক দিয়ে বলেছিলো, 'হাসি রাণীর সাথে মস্করা করা লাগবো না। দূরে যান এইখান থিকা, ভাগেন কইলাম!'

আজিজ থতমত খেয়ে দূরে সরে গিয়েছিলো। হাসির মায়া হয়েছিলো। বলেছিলো, 'আহা বুবু, হেয় মানুষ খারাপ না...'

'মানুষ খারাপ না তুই জানলি কেমনে? সব পুরুষ মানুষ এক জাতের এই তোরে কইয়া রাখলাম, মনে রাখিস।'

সব পুরুষ মানুষ এক? বিশ্বাস হতে চায় না হাসির। পি এম নূরালী আর আজিজ এক? মন মানতে চায় না তার। সে জানে পি এম নূরালীর ক্ষমতা অনেক। নূরালী এই অঞ্চলের প্রভাবশালী স্থানীয় বাসিন্দা। তার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সাথে সহযোগীতা না করলে আবাসিক এলাকার ভেতরে এই গের্মেন্টসটি এতো সহজে গড়ে উঠতে পারতো না। তার চাকরী গার্মেন্টসে স্থায়ী বলতে গেলে। মালিকপক্ষ অকারণে তাকে ঘাঁটাবে না। গার্মেন্টসের কর্মচারীদের কাজ থাকা না থাকাও অনেক সময় নির্ভর করে তার উপর। তাছাড়া যে বস্তিতে হাসি আর পিয়ারী থাকে তার মালিক নূরালী না হলেও, বস্তির মালিক নূরালীকে মাসোহারা দিয়েই বস্তিটি টিকিয়ে রেখেছে। তার সহযোগীতাতেই আবাসিক এলাকার সংলগ্ন এই অবৈধ বস্তিটি গড়ে উঠেছে। সে যদি গার্মেন্টসের কারো কাজ খেয়ে নেয়, আর সেই কর্মচারী যদি এই বস্তির বাসিন্দা হয়, তাহলে একই দিনে সে উচ্ছেদ হয় বস্তি থেকেও।

আবাসিক এলাকার সীমানায় বাজারের কাছিকাছি একটি হোটেল ছিলো অনেকদিন থেকে। গার্মেন্টসটি গড়ে ওঠার পর থেকে এই হোটেলের ব্যবসা জমজমাট। হোটেলটি খোলা থাকে রাত দশটা পর্যন্ত। গার্মেন্টসের শ্রমিকদের অনেকেই সকালে কাজে যাবার আগে, বা রাতে ঘরে ফেরার পথে সেখানে খায়। কিন্তু নির্বিবাদে ব্যাবসা চালানোর জন্য নূরালীর সাথে আপোষ করতে হয়েছে হোটেল মালিকেরও। হোটেলের পিছন দিকে হোটেলের সঙ্গে লাগানো ঘর দু'টিও হোটেল মালিকের। পেছনের গলির দিক থেকে ঢোকার দরজা। অনায়াসে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছে ভাড়া দেয়া যেতে পারতো। কিন্তু ঘর দু'টি খালি রাখা হয়েছে। নির্বিবাদে ব্যবসা চালাতে দেয়ার শর্তে নূরালী মাঝে মাঝে ঘর দু'টি ব্যবহার করে নিজ প্রয়োজনে। তার ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে। তাই বাসায় মদ না খেয়ে কাজটি সে ওই ঘর দু'টিতে সারে। তারপর মন চাইলে বাসায় ফিরে যায়, আর তা না চাইলে সেইখানেই রাত কাটিয়ে দেয়।

আর আজিজতো হাসির মতো গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে এই শহরে আসা একজন। হাসিকে পছন্দ করে। সুযোগ পেলেই তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। প্রতি সন্ধ্যায় ছুটির পর ভীড় ঠেলাঠেলি করে গার্মেন্টসের কোলাপ্সিবল গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আজিজ তার সাথে কথা বলতে বলতে গা ঘেঁসে আসে। কখনো কখনো ভীড়ের মধ্যে যেনো খেয়াল করছে না এমনভাবে তার উরুতে বা নিতম্বে বা বুকের কাছে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। মনে মনে হাসে হাসি। আহারে! ভীড়ের মানুষগুলোর গা থেকে আসা সারাদিনের ঘামের গন্ধের মাঝেও সে আজিজের গায়ের গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারে। লোকটাকে ভালো লাগে তার।

আজিজ ধমক খেয়ে সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর টিফিন শেষ করে হাসি আর পিয়ারী কাজে ফিরে গিয়েছিলো। এরপর হাসি মাথা নিচু করে কাজ করে গিয়েছে একেবারে ছুটি পর্যন্ত। আজিজের দিকে তাকায়নি একবারো। যদিও বুঝতে পারছিলো যে আজিজ বারবার তাকাচ্ছিলো তার দিকে, বোঝার চেষ্টা করছিলো কি হয়েছে। বোকা-সোকা মানুষ, তার বোঝার ক্ষমতা নেই কি হয়েছে। পি এম নূরালীর নির্দেশে সুপারভাইজার বার বার তার কাজ দেখতে আসেনি আজ। টার্গেট দিতে পারছে না বলে অন্যদিনের মত আজ একবারো ধমকায়নি তাকে কেউ। রাত আটটায় ছুটির পর গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে আসার সময় পিয়ারী তার পাশে পাশে হেঁটেছে, হাত ধরে থেকেছে। আজিজ আজ আর তার কাছে ঘেঁসতে পারেনি।

তারপর বস্তির ঘরে ফিরে মন না চাইলেও পিয়ারীর চাপাচাপিতে কিছু মুখে দিয়ে বস্তির একমাত্র চাপকলে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সেরেছে হাসি। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে তৈরী হয়েছে বিশেষ ঘটনাটির জন্য। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করা ছিলো। পিয়ারীর কাছে আগেই চাবি দেয়া ছিলো। রাত দশটার কিছু পর থেকে হাসি অপেক্ষা করতে থাকে হোটেলের পিছনের দু’টি ঘরের একটিতে, অন্ধকারে। রাত এগারোটার দিকে পি এম নূরালী যখন ঘরে এসে ঢোকে, তখন তার মুখে মদের তীব্র গন্ধ। সে যখন হাসির দিকে হাত বাড়ায়, তখন আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবেই যেনো হাসি ফিস ফিস করে বলে, ‘সার, আপনার পায়ে ধরি, আমারে অপমান কইরেন না, আমি ভালো ঘরের মাইয়া....'

অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু পি এম নূরালীর চোখে মুখে বিশ্ময় ফুটে ওঠে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সে। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করা আছে। শেষ মুহূর্তে এসব কথার মানে কি! তারপর রাগী গলায় চাপা স্বরে বলে, ‘চুপ হারামজাদী, খবরদার, একদম কোন কথা না।'

এরপর নুরালী ঝাঁপিয়ে পড়ে হাসির উপর। হাসি আর বাধা দেয়ার চেষ্টা করে না। নুরালী তাকে বিবস্ত্র করে যখন তার শরীর নিয়ে মেতে ওঠে, সে প্রাণহীন স্থির পড়ে থাকে। নুরালী যখন সর্বশক্তি দিয়ে তার ভেতরে জোর করে প্রবেশ করে, সে তীব্র যন্ত্রণায় গোঙায়। ডুকরে কেঁদে উঠে বলে, 'আমার বাপে মাষ্টর আছিলো..., মাইনষে তারে মাইন্য করতো গো....'

পি এম নূরালী ভীষন অবাক হয়। এইসব কথার মানে বুঝতে পারেনা। সে পশুর মত শিকারের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে করতে হাসির মুখ চেপে ধরে বলে, 'চুপ কর মাগী, একদম চুপ…'

পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকা পিয়ারী চাপা স্বরে বলে, 'আস্তে পি এম সাব আস্তে, ওর কইলাম এই প্রথম…'

তান্ডব চলে আরো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঝড় থেমে যায় একসময়। পি এম টলতে টলতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পর পিয়ারী এসে ঢোকে। অন্ধকারে পড়ে থাকা হাসির রক্তাক্ত বিবস্ত্র শরীরটি সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাসির পরিধেয় দিয়ে ঢেকে দেয়। খাটের কোনে বসে হাসির মাথাটি টেনে নেয় নিজের কোলে।

বস্তির মালিক ভাড়া বাড়ানো নিয়ে পিয়ারীর সাথে আপাততঃ আর ঝামেলা করবে না। হাসির কাজটিও এ যাত্রা টিঁকে যাবে আরো কিছুদিনের জন্য।


মন্তব্য

মুশফিকা মুমু এর ছবি

আপনার লেখাটি পড়ে এত্ত কষ্ট লাগল, খুব খুব মন খারাপ হয়ে গেলো, আসলেই আমাদের দেশের গরিব মেয়েরা কত অসহায়, নির্যাতিত। খুব ভাল লিখেছেন।
---------------------------------------------------------
মূর্ছনা কেটে গেছে সুর
জোছনা ছড়ায় বেদনা, হৃদয় আনমনা ... চির চেনা তুমি অচেনা।

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

শামীম হক এর ছবি

মুমু, কষ্ট করে পড়ার আর সুন্দর মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শামীম হক এর ছবি

আপনার বলা এই একটি শব্দই আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। ধন্যবাদ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে।
শব্দটি বোধ হয় 'রাণী' হবে।

শামীম হক এর ছবি

বানান নিয়ে আমার বিরাট সমস্যা। অনেক সময় নিশ্চিত হতে পারি না বলে কিছু শব্দের ব্যাবহার এড়িয়ে যাই। এখানেও 'ন' আর 'ণ' নিয়ে মনে সংশয় ছিলো। পরে একটা অনলাইন বাংলা অভিধান পেলাম যেখানে queen এর বাংলা দেখায় 'রানী'। তাদের বানান বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে এখন বুঝতে পারছি। ঠিক করে দিচ্ছি। ভুল বানান ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না।

আপনি ছিলেন আমার প্রথম লেখার প্রথম মন্তব্যকারী। সেই থেকে পাশে আছেন। ভবিষ্যতেও আপনাকে পাশে পাবো আশা করছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটি অনেক বাস্তব।গরীব মেয়েরা আসলেও অসহায়।
ভালো লাগলো।
-নিরিবিলি

বিপ্লব রহমান এর ছবি

হুমম।.. মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে আপনার গল্প নিম্নবিত্তের আনন্দ-বেদনা স্পর্শ করতে চাইছে দেখছি। শাবাশ! শামীম হক! জীবন নিয়ে আরো লিখুন প্লিজ। হাসি
---
অনেকদিন পর লিখলেন। এতোদিন পর আমাদের মনে পড়লো? মাঝে মাঝে সচলে একটু পদধূলি দিলেও তো পারেন! মন খারাপ


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শামীম হক এর ছবি

নিরিবিলি
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

বিপ্লব রহমান
সচলে নিয়মিত লেখা না হলেও নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করি। আপনার সদয় মন্তব্যে প্রেরণা পেলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।