মার্কিসনের অ্যামাইনো এসিড

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: সোম, ০৪/০৫/২০০৯ - ১২:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল নিবন্ধ: Murchison’s Amino Acids: Tainted Evidence?
লেখক: Anne M. Rosenthal (অ্যান এম রোজেন্থাল)
অনুবাদ: শিক্ষানবিস

[অনেকদিন ধরে কিছু লেখা হয় না। পরীক্ষার কারণে নতুন কিছু লিখতেও পারছি না। কিন্তু নতুন কিছু শুরু করতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই অনেক আগে করা এই অনুবাদটা দিয়ে দিলাম। নিজের ব্লগে ছিল, কিন্তু আগে কোথাও প্রকাশ করা হয়নি। ভাবলাম, এ নিয়ে কিছু আলোচনা হলে ভালই হবে।]


পৃথিবীর ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক সময়ে এর উপর ঝাঁকে ঝাঁকে উল্কাপিণ্ড বর্ষিত হতো। এরাই কি কোনভাবে পৃথিবীতে জীবন গঠনকারী রাসায়নিক একক বুনে গিয়েছিল? ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহহোমা’র ভূ-রসায়নবিদ মাইকেল এইচ এঙ্গেল বলেন, "ইদানিংকালে পৃথিবীতে পতিত উল্কাপিণ্ডের রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণা করার মাধ্যমেই কেবল এর উত্তর মিলতে পারে। কারণ, এই পিণ্ডগুলো তুলনামূলক কম দূষণের শিকার হয়। পার্থিব বস্তু এবং আবহাওয়ার প্রভাব এর উপর খুব বেশি পড়তে পারে না।"

গত দুই দশকে প্রায় ৩৫টি জানা কার্বনসমৃদ্ধ কনড্রাইট উল্কাপাত থেকে নমুনা পাথর সংগ্রহ করা হয়েছে। এই পাথরগুলোতে সৌরজগৎ গঠনের আগে বা ঠিক পরপর ঘন মেঘ থেকে জড়ো হওয়া বিভিন্ন পদার্থ থাকে। এই পদার্থগুলোই আমাদের আগ্রহের বিষয়। কারণ পৃথিবীর মতই এই পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন জৈব বা কার্বন-ভিত্তিক যৌগ থাকে।

কিন্তু পদার্থগুলো নিয়ে রাসায়নিক গবেষণা করতে গিয়ে অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ অনেক বিজ্ঞানীই দাবী করেছেন, পৃথিবীতে নামার পর বিভিন্ন কারণে এই পিণ্ডগুলো দূষিত হয়ে গেছে। স্ক্রিপ্‌স ইনস্টিটিউট অফ ওশানোগ্রাফি’র জেফ বাডা বলেন, খুব যত্ন করে রাখা উল্কাপিণ্ডও সময়ের সাথে ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে।

কোনভাবে পৃথিবীর জৈব-মণ্ডলের অ্যামাইনো এসিড যদি এই পাথর ভেদ করে ভেতরে চলে যায় তাহলে সেগুলোকে আর আদি সৌরজাগতিক রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রতিনিধি মনে করা যাবে না। তখন যতই নমুনা পাওয়া যাক আমরা বলতে পারবো না যে, এই উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রাণের উপযোগী রাসায়নিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উল্কাপিণ্ডটি আসলেই দূষিত হয়েছে কি-না তা গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। এই গবেষণাও অবশ্য সহজসাধ্য নয়।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে পতিত মার্কিসন উল্কাপিণ্ড ১৯৬৯ সালে পতিত হয়েছিল। এটা খুব কাছ থেকে নিবিঢ়ভাবে গবেষণা করা হয়েছে এমন উল্কাপিণ্ডের মধ্যে অন্যতম।

autoএঙ্গেলের মতে, মার্কিসনের ভেতর থেকে পাওয়া বেশ কিছু খণ্ডাংশ থেকে এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে বোঝা যায় সেগুলোতে সুপ্রাচীন অনেক পদার্থ আছে। এই শিলার মধ্যে অবস্থিত অ্যামাইনো এসিডসমূহ এবং সেখানকার সমাণুক গবেষণার মাধ্যমে এঙ্গেল তার এই অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছেন। কিন্তু অন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পার্থিব জৈব পদার্থের কারণে এই উল্কাপিণ্ডের প্রায় পুরোটাই দূষিত হয়ে গেছে।

তথাপি মার্কিসন নিয়ে যে গবেষণাগুলো করা হয়েছে তা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমাদের একদিক দিয়ে লাভই হয়, আমরা বুঝতে পারি দ্ব্যর্থতাবোধক তথ্যাদি কিভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্যাঁচের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

অ্যামাইনো এসিডের হিসেব-নিকেশ

গত তিন দশক ধরে মার্কিসন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যানড্রা পিজারেলো ও জন ক্রোনিনের গবেষণা উল্লেখযোগ্য। তারা গবেষণায় দেখিয়েছেন, মার্কিসনের মধ্যে অ্যামাইনো এসিড সমন্বয়টি আসলেই আশ্চর্যজনক। মার্কিসনে পাওয়া গেছে এমন প্রায় ৫০টি অ্যামাইনো এসিড পৃথিবীর কোথাও নেই। পৃথিবীর জীবকূলের মধ্যকার অনেকগুলো প্রোটিন অ্যামাইনো এসিডই এই উল্কপিণ্ডের মধ্যে আছে, কিন্তু সবগুলো নেই।

এঙ্গেল বলেন, মার্কিসনের মধ্যে অ্যামাইনো এসিডের পোর্টফোলিও বলে দেয় যে এটা কোনভাবেই দূষিত হয়নি। তিনি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া, শার্লট্‌সভিলের স্টিফেন ম্যাকো আরও বলেছেন, পৃথিবীর অ্যামাইনো এসিড যদি আসলেই এই উল্কাপিণ্ডের ভেতরে ঢুকতে পারতো তাহলে বিজ্ঞানীরা অবশ্যই সেখানে পার্থিব সকল অ্যামাইনো এসিডের বর্ণালীই পেতেন। কিন্তু এঙ্গেল ও ম্যাকো সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা সেই উল্কাপিণ্ডে কিছু অ্যামাইনো এসিডের বর্ণালী পেয়েছেন।

বাডা এবং অন্যান্যরা এর বিরোধিতা করে বলেছেন, সেখানে আসলে সবগুলো অ্যামাইনো এসিডই ছিল; কিন্তু যথেষ্ট সূক্ষ্ণ যন্ত্র না থাকার কারণে এঙ্গেল ও ম্যাকো সেগুলো সনাক্ত করতে পারেননি।

দর্পণ প্রতিবিম্ব

পৃথিবী ও মার্কিসন উল্কাপিণ্ডের অ্যামাইনো এসিডের মধ্যে আরও কিছু পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থকের সাথেও দূষণের সম্পর্ক আছে। প্রধান পার্থক্য হিসেবে কাইরালিটির নাম করা যায়। কোন অনু ডান হাতি না বাম হাতি সেই ধর্মকেই কাইরালিটি বলে।

কাইরালিটি বোঝার জন্য এঙ্গেল একটি সহজ উদাহরণ দিয়েছেন: আপনার হাত দুটিকে মুখোমুখি স্থাপন করুন, দেখবেন হাতের প্রতিটি আঙ্গুল একটি অপরটির সাথে এক লাইনে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু যদি এক হাতের তালু অন্য হাতের পেছনে স্থাপন করেন তাহলে দেখবেন আঙ্গুলগুলো মিলছে না। কারণ এক হাতের তালু অন্য হাতের তালুর দর্পণ প্রতিবিম্ব। যখন দুটি অণু একে অন্যের দর্পণ প্রতিবিম্ব হয় তখন তাকে কাইরাল বলা হয়। অধিকাংশ অ্যামাইনো এসিডই কাইরাল অণু।

পৃথিবীতে জীবনের একটি মজার দিক হল এর প্রায় সব অ্যামাইনো এসিডই বাম-হাতি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা যখন কাইরাল নয় এমন পূর্বপুরুষ থেকে অ্যামাইনো এসিড সংশ্লেষণ করেন তখন অধিকাংশ সময়ই রেসিমিক মিশ্রণ পান অর্থাৎ তাতে সমান সংখ্যক ডান-হাতি ও বাম-হাতি অণু থাকে। কার্নেগি ইনস্টিটিউট অফ ওয়াশিংটনের ভূ-রসায়নবিদ জর্জ কোডি বলেন, বিজ্ঞানীরা আদিম পৃথিবীতে যে শর্তগুলো প্রাধান্য বিস্তার করেছিল সেগুলোকে অনুসরণ করে এমন কোন পরীক্ষা করতে পারেননি যাতে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ আধিপত্য প্রমাণিত হয়।

প্রোটিনের গাঠনিক একক যে অ্যামাইনো এসিডগুলো অর্থাৎ যেগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীতে জৈব বস্তুর গাঠনিক উপাদান ও প্রয়োজনীয় উৎসেচক গঠিত হয় সেগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই উৎসাহী।

১৯৮২ ও ১৯৯০ সালে এঙ্গেল ও তার সহকর্মীরা নেচার পত্রিকায় মার্কিসন থেকে পাওয়া বেশ কিছু অ্যামাইনো এসিডের রাসায়নিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিলেন। তারা গবেষণাপত্রে বলেছিলেন, মার্কিসন থেকে পাওয়া অ্যামাইনো এসিডে বাম-হাতিদের আধিক্য বা রেসিমিক মিশ্রণ কোনটাই নেই। অথচ এমনটিই আশা করা হয়েছিল। কারণ মহাকাশে গঠিত পদার্থের মধ্যে এগুলোই থাকা উচিত।

তাদের ফলাফলে এর বদলে দেখা গিয়েছিল, এই অ্যামাইনো এসিডে বাম-হাতি কাইরালের সাধারণ থেকে সামান্য বেশি আধিক্য আছে, কিন্তু কখনই খুব বেশি নয়। এঙ্গেল ও তার সহকর্মীরা বলেন, এ থেকে বোঝা যায় মার্কিসনের অপার্থিব পদার্থ মোটেই রেসিমিক ছিল না। বরং এতে বাম-হাতি ও ডান-হাতি অ্যামাইনো এসিডের ভিন্নরকম মিশ্রণ ছিল যা পৃথিবীতে পাওয়া যায় না।

তাদের এই গবেষণা এটা প্রমাণ করেনি যে উল্কাপিণ্ডটি দূষিত হয়ে গেছে। যদিও মার্কিসন অ্যামাইনো এসিড নিয়ে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত Keith Kvenvolden এর গবেষণাপত্রের সাথে তাদের ফলাফল সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছিল। কিথ ছিলেন নাসা এমিস রিসার্চ সেন্টারের গবেষক। বর্তমানে মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভেতে কাজ করছেন। নাসায় তার সহ গবেষকদের সাথে মিলে এই গবেষণাপত্র রচনা করেছিলেন তিনি।

কিথের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল মার্কিসন উল্কাপিণ্ডে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের আধিক্য আছে যদিও তা খুব অল্প পরিমাণ। এ থেকেই তারা মন্তব্য করেছিলেন, মার্কিসনে আসলেই অপার্থিব কোন উপদান টিকে থাকলে তা রেসিমিক মিশ্রণ হওয়া উচিত যেমনটা আগেই আশা করা হয়েছিল। তাদের কথার সারমর্ম ছিল, পৃথিবীতে রেসিমিক মিশ্রণ নিয়ে আসার পর দূষিত হয়ে যাওয়ার কারণে মার্কিসনে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের আধিক্য সৃষ্টি হয়েছে। তারা আরও বলেন এই দূষণের কারণে হয়তোবা তাদের গবেষণায়ও ব্যাঘাত ঘটেছে।

কিন্তু এঙ্গেল ও ম্যাকো তাদের গবেষণায় মার্কিসনে বাম-হাতিদের আধিক্য অনেক বেশি বলে প্রমাণ করেছেন। তাই তারা বলছেন, এই উল্কাপিণ্ড রেসিমিক মিশ্রণ নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। বাডা, কিথ সহ অন্য অনেকেই এই ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে, দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে যেমনটা কিথ অনুমান করেছিলেন।

দূষণের বেড়াজালে

দূষণের ব্যাপারটি আরও খতিয়ে দেখার জন্য ক্রোনিন ও পিজারেলো মার্কিসনের এমন চারটি অ্যামাইনো এসিড নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন যেগুলো পৃথিবীতে পাওয়া যায় না।

তারা দেখলেন এই এসিডগুলোতে বাম-হাতিদের সামান্য আধিক্য রয়েছে। এর থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসলেন: অন্তত কিছু অ্যামাইনো এসিডের ক্ষেত্রে আগে থেকেই মার্কিসনে বাম-হাতিদের আধিক্য ছিল অর্থাৎ দূষণের আগেই। কারণ পৃথিবীর অ্যামাইনো এসিডের পক্ষে মার্কিসন ভেদ করে এই অপার্থিব অ্যামাইনো এসিডকে এই মাত্রায় দূষিত করে ফেলা সম্ভব না।

১৯৯৭ সালে সাইন্স সাময়িকীতে ক্রোনিন ও পিজারেলো তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। স্বভাবতই এই ফলাফল এঙ্গেল ও ম্যাকোর গবেষণাকে সমর্থন করলো। অপর দিকে অস্ট্রেলিয়ার (এএসইউ) বিজ্ঞানীরা মার্কিসনের এমন দুটি অ্যামাইনো এসিড নিয়ে গবেষণা করলেন যেগুলো পার্থিব প্রোটিনে পাওয়া যায়। তারা দেখলেন মার্কিসনের এই অ্যামাইনো এসিড দুটো রেসিমিক।

এভাবে এক জটিল ধাঁধার মুখোমুখি হতে হল সবাইকে। ক্রোনিন ও পিজারেলো এই উভয় সংকট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারা ভাবলেন, হয়তোবা তারা তাদের প্রতিবেদনে যে প্রোটিন অ্যামাইনো এসিডের কথা লিখেছেন অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীধের গবেষণাকৃত অ্যামাইনো এসিডগুলো তা থেকে ভিন্ন কোন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়াগুলো কি তা এখন পর্যন্ত কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

প্রমাণগুলো তলিয়ে দেখা

এর মধ্যে এঙ্গেল ও ম্যাকো মার্কিসনের অভ্যন্তরভাগ যে আদি-অকৃত্রিম তা প্রমাণের জন্য আরও কয়েকটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। তারা মূলত দেখছিলেন, সেখানে কোন স্থিতিশীল সমাণুক আছে কি-না।

একই পারমাণবিক সংখ্যা কিন্তু ভিন্ন নিউট্রন সংখ্যা এবং তথাপি ভিন্ন পারমাণবিক ভরবিশিষ্ট পরমাণুগুলোকে পরষ্পরের সমাণুক বলা হয়। পৃথিবীর জৈব বস্তুর মধ্যে সাধারণ কার্বন ও নাইট্রোজেনের হালকা সমাণুগুলো থাকে। তাই সমাণু গবেষণার মাধ্যমে পার্থিব ও অপার্থিব পদার্থ আলাদা করা যেতে পারে। ভারী হলেই অপার্থিব।

এঙ্গেল ও ম্যাকো প্রথমে গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি নামক এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মার্কিসনের বাম-হাতি ও ডান-হাতি অ্যামাইনো এসিডগুলোকে পৃথক করে ফেললেন। এরপর ভর বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে বাম-হাতি ও ডান-হাতি পরমাণুতে উপস্থিত কার্বন ও নাইট্রোজেনের স্থিতিশীল সমাণুগুলোর অনুপাত আলাদা আলাদাভাবে বের করলেন।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, উভয় ধরণের অ্যামাইনো এসিডেই স্থিতিশীল অ্যামাইনো এসিডগুলোর অনুপাত সমান। এর থেকে বোঝা যায় তাদের উৎপত্তি একই উৎস থেকে হয়েছে এবং অবশ্যই সে উৎসটি পৃথিবী নয়। কারণ, বাম-হাতি পরমাণুগুলোর কেবল একটি অংশ যদি পার্থিব উৎস থেকে আসতো তাহলে সে অংশ ডান-হাতিগুলোর চেয়ে ভিন্ন ধর্ম প্রদর্শন করতো। অর্থাৎ সেগুলোতে কার্বন ও নাইট্রোজেনের তুলনামূলক হালকা সমাণুক থাকতো।

এর পরও কিথ ও বাডা মানতে পারলেন না। স্থিতিশীল সমাণুর নতুন এই প্রমাণেও সমস্যা আছে, এ ইঙ্গিত করে কিথ বললেন, “এই গবেষণা উল্কাপিণ্ডের প্রোটিন অ্যামাইনো এসিড নিয়ে করা ক্রোনিন, পিজারেলোর ও আমার আগের গবেষণার সাথে মিলে না।” কিথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এঙ্গেল ও ম্যাকো দূষিত উল্কাপিণ্ড নিয়ে গবেষণা করেছেন যা কখনও সঠিক ফলাফল দিতে পারে না।

ক্রোনিন ও পিজারেলো বললেন, এঙ্গেল ও ম্যাকোর গবেষণার ফলাফল কোইল্যুশনের (coelution) কারণে এসেছে। কোইল্যুশন বলতে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের মত একই সময়ে গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফ কলাম থেকে অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত যৌগের নিঃসরণকে বোঝায়। এই ক্রিয়া প্রাপ্ত উপাত্তকে উলট-পালট করে দিতে পারে।

ক্রোনিন ও পিজারেলোর এই বক্তব্যকে এঙ্গেল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, তাদের গবেষণা কার্বন ও নাইট্রোজেন সমাণুর জন্য আলাদা আলাদাভাবে করা হয়েছে। এটা খুবই অস্বাভাবিক যে, কোইল্যুশন মাস্কের কারণে কার্বন ও নাইট্রোজেন উভয়ের সমাণু অনুপাত একইভাবে দূষিত হবে। তাই এঙ্গেল পরিশেষে বলেন, মার্কিসনে অবশ্যই এমন একটি অংশ আছে যা এখনও আদি ও অকৃত্রিম অবস্থায় আছে, যাতে কোন দূষণ ঘটেনি।

এরপর কি হবে?

যদি এই সবকিছু সত্যও হয়। অর্থাৎ আমরা যদি ধরে নেই, মার্কিসন থেকে পাওয়া অ্যামাইনো এসিডে আসলেই বাম-হাতিদের আধিক্য আছে এবং এই আধিক্য কোনরকম দূষণের কারণে ঘটেনি, তার পরও এই সব উল্কাণুর কারণে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

কোডি বলেন, এটা ঠিক যে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের ইতিহাসের সাথে আদিম উল্কাপাত অঙ্গঅঙ্গিভাবে জড়িত এবং সেই উল্কাণুগুলোতে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণ সামান্য বেশি ছিল। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে যে এভাবেই বাম-হাতিদের নিরংকুশ প্রাধান্য বিস্তৃত হয়েছে তা বলা যায় না। এর পেছনে অন্য কোন কারণও থাকতে পারে।

বাডা বলেন, আদিম পৃথিবীতে বৃষ্টির মত বর্ষিত উল্কাণুগুলোতে বাম-হাতি অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণ সামান্য বেশি ছিল কি-না তা দিয়ে খুব বেশি কিছু নির্ধারিত হয় না। কারণ পৃথিবীতে নামার পর তারা পরিবেশের সাথে মিশে গেছে এবং এর ফলে বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়তো বাম-হাতি অনেক পরমাণুই মুছে ফেলেছে। তাই পরিবেশই প্রধান।

আর দূষণের বিষয়টি নিয়েও অনেক কিছু বলার আছে। সম্পূর্ণ নতুন উল্কাণু থেকে সঠিক পরিমাণ নমুনা নিয়ে সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করলেই কেবল কোইল্যুশনের বিষয়টি এড়ানো যেতে পারে। কেবল তখনই পরীক্ষাটি সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে। এ বিষয়ে কোডি বলেন, “এ বিষয়ে শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়া খুবই কষ্টকর, কারণ অনেক কিছুই আমরা জানি না। দূষণ সব সময়ই একটি ইস্যু হয়ে দেখা দিবে।”


ব্লগটা পুরো বোঝার জন্য যে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা নেয়া জরুরী:
- কাইরালিটি
- গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি
- কোইল্যুশন
আর এই ব্লগটাও কাজে দিতে পারে:
- পৃথিবীতে প্রাণের বীজ বুনলো যারা
উইকিপিডিয়ার নিবন্ধটাই বা কেন বাদ থাকবে:
- Murchison meteorite


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

খুব ইন্টারেষ্টিং লেখা---!
ওয়েলকাম ব্যাক বস----!!

শিক্ষানবিস এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। খালি লজ্জায় ফালায়া দেন...

সবজান্তা এর ছবি

বেশ বড় কলেবরের লেখা, পরে পড়ে মন্তব্য করবো। তবে আন্দাজ করতে পারছি প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ এবং সেই সংক্রান্ত এমাইনো এসিডের ভূমিকা নিয়ে কিছু লিখেছো হয়তো।

এই ব্যাপারে চমৎকার একটা বই পড়েছিলাম, অভিজিৎদার মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভব ... ( নামটা পুরা ঠিক মতো খেয়াল নেই), দুর্দান্ত একটা বই।


অলমিতি বিস্তারেণ

শিক্ষানবিস এর ছবি

হ্যা, অভিজিৎদার বইটার নাম "মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে"। চমৎকার বই। ঐটা পড়েই প্রথম এসব নিয়ে জেনেছিলাম।
এই লেখাটা আসলে খুব একটা সহজ করে লেখা না। বেশ কিছু অসংজ্ঞায়িত টার্ম আছে। অনুবাদ করেছিলাম অনেক আগে। ট্র্যাকে ফিরে আসার জন্য ভাবলাম দিয়ে দেই।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি, প্রায় গোটা বিশেক লেখা আপনার প্রায়-প্রস্তুত। ছাড়তে থাকুন একে একে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।