আরতিবালা আর মার খেতে চায় না

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৯/২০০৭ - ৯:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাহাড়ী দেশ৷ রুক্ষ, পাথুরে৷
গাছপালা সব দূরে দূরে,
তবু তার ফাঁকে ফাঁকে,
বছরের ধস ছাড়া বেঁচে,
জমি যা আছে, যেটুকু টিকে
তা মহাজনের৷ সেই জমিতে
সারাদিন,পাথরে কোদালে
শব্দ ওঠে তালে তালে
ঘেমেনেয়ে একাকার মহিলা;
মাটি কোপায় আরতিবালা৷

প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও, দু'বেলা
জোটে না ভাত, নুন; কাঁচকলা৷
মাঝে মাঝেই উপোস বরাদ্দ;
তবু মাটি আছে,শরীরের ছেরাদ্দ
করে কুপানো চাই রোজ তার
নিজের বলতে কি আছে আর?
ঐ তিনটি ছাওয়াল ছাড়া৷
আরেকটাও দিচ্ছে তাড়া,
যখন তখন পেটের ভেতর
হাত-পা ছুঁড়ে দেয় কবুতর
সে জানান দেয়,সে আসছে,
অনাহার তার কপালেও নাচছে৷

ছাওয়াল মানেই আরেকটা মুখ৷
আরেকটা পেট৷ অরেকটু দুখ৷
তিনটের মুখে রোজ দু'বেলা অন্ন
দিতে না পেরে আরতিবালা বিষন্ন৷
ছাওয়ালগুলো ঝিমোয় সারাদিন৷
বুভুক্ষু, ন্যাংটো৷ যেন জন্মদিন;
ওদের গায়ের কাপড়ের কথা
আরতিবালা ভাবেও না, অন্যথা৷
যেটুকু রোজগার তার তাতে
ভাতের জোগানটুকু কোনমতে৷
হয়,কখনও বা তাও হয় না৷
মরদ আছে তার৷ এটুকু জানা৷

তার মরদ ভাত দেয় না বটে
কিন্তু মাঝে মাঝেই কান্ড ঘটে,
সে এসে কখন রেঁধে রাখা ভাত
খেয়ে যায় চুপিসাড়ে৷ মাঝরাত
হতে পারে সেটা,কিন্তু চুপিচুপি
পা টিপে,জ্বালায় না, লন্ঠন-কূপী
মাঝরাত্তিরে এসে ক্ষিদে তার
শরীরের, মিটিয়ে চলে যায়,নির্ভার৷
আরতিবালা পড়ে থাকে নি:সাড়;
কোপানো ফালাফালা মাটি তার
যেন পড়ে আছে পাহাড়ের বুকে
পাথর পাথর,কুলুপ এঁটে মুখে৷
ট্যা-ফোঁ করলেই বেধড়ক মার৷
এই পোয়াতী শরীরে আরতিবালা
পাথর, মার খেতে চায় না আর ৷

ফসল উঠেছে মহাজনের বাড়িতে৷
রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ের ফাঁকে
ফাঁকে পড়ে আছে ন্যাংটো মাঠ৷
মহাজনের বাড়িতে আজ উত্ সব৷
আরতিবালার বাড়িতে আজ
তিনদিন হল সবাই উপবাস৷
দুপুর থেকে হত্যে দিয়ে পড়ে
মহাজনের কাছে, চাল কোঁচড়ে
করে নিয়ে এসেছে আরতিবালা,
চারজন খাবে তার ভাত একথালা৷
মাঠে কাজ শুরু হলে ডবল খেটে
সে পুষিয়ে দেবে, এই কড়ারে৷

ফ্যানাভাত রেঁধে রেখে, চান করে,
ফিরে এসে হাড়ির ঢাকা খুলে
দেখে হাড়ি ফাঁকা৷ সব ভুলে
যায় মাটি, গাছ কত দূরে দূরে,
ছাওয়ালগুলো গুটিসুঁটি আছে পড়ে
ঘরের মেঝেয়৷ পেছনের দাওয়ায়
নাক ডাকছে, হাওয়ায় হাওয়ায়
তার মরদের৷ ভরপেট ফ্যানাভাত
খেয়ে সুখনিদ্রায় আরতিবালার মরদ৷
ভাঙা বেড়ায় গেঁথে রাখা কাটারি
হাতে তুলে নেয়, ছোট্ট গলা খাঁখারি-

এগিয়ে যায় সে৷ জংগলের ভেতর,
হাতে তার কাটারি, ফসল কাটার৷
ভাল-মন্দ আর ভাবে না আরতিবালা,
তিনদিন টানা খেটে আজ একবেলা
খাবে ভেবেছিল সে৷ বহুদিন ধরে
মনের মাঝে চেপে রাখা ভাবনাটাকে
আজ আর আটকাবে না, নিজেকে৷
আট বছরের অত্যাচারের হিসেব
চুকিয়ে দেয় আরতিবালা ফটাফট৷
কুপিয়ে সে ফালা ফালা করে দেয়;
এখন তার মরদকে চেনা সংসয়,
যেমন করে সে কোপাত এতদিন
পাথুরে মাটি সকাল বিকেল প্রতিদিন৷
প্রথম কোপের ঠিক সাথে সাথে
কেপে ওঠে দিগন্ত বিভত্ স চীৎকারে৷
সে স্থির, আরতিবালা কাঁপে না৷
চারপাশে পাথর, কেউ কাঁদে না;
ধর্মিক বক যেন,পরম নিষ্ঠায় সে
অর্জুনের লক্ষ্যে কোপায় তার মরদকে৷

একসময় থেমে যায় আরতিবালা৷
এইবার সব বিদায় নেওয়ার পালা৷
সব ফেলে ছাওয়ালগুলোর হাত ধরে
আশ্রয় খোঁজে, এগোয় থানার পথে৷
শুনেছে, জেলে নাকি দুবেলা খেতে
দেয়, প্রতিদিনই;কাজের পর সকলকে৷
এইটুকু তো পথ,আরতিবালা জানে
ব্যাস,আর মার খেতে হবে না তাকে৷


মন্তব্য

শ্যাজা এর ছবি

লেখা হচ্ছে না কিছু তাই পুরনো একটা লেখা তুলে দিলাম।

কবিতা নয় এ। কবিতা আমার আসে না। গদ্যকেই শুধু ভেঙে ভেঙে দেওয়া।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

আরশাদ রহমান এর ছবি

কিবিতায় গল্প। আরতিবালার কথা সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

মৃন্ময় আহমেদ এর ছবি

মারাত্মক সত্যের উপস্থাপনা। আর লেখা কি কখনো পুরাতন হয়!!!
______________________
চিৎকার করি জ্বলেপুড়ে ছারখার
তবুও আমি নাকি অশুচি

'

=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা

হাসান মোরশেদ এর ছবি

দারুন ছন্দোবদ্ধ!
----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

আরতীবালা, জেলখানায় কেমন আছো?

..........................................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শ্যাজা এর ছবি

আরতিবালার যাবজ্জীবন কারাবাস হয়। জেলখানায় আরতিবালা জন্ম দেয় আরেকটি কন্যাসন্তানের। ছেলে মেয়ে তিনটি আশ্রয় পায় সরকারী হোমে। তাদের অন্যত্র যাওয়ার জায়গা ছিল না বা দেখাশোনা করারও কেউ ছিল না বলে। জেলে জন্মানো মেয়েটি যদ্দিন মায়ের দুধ খেয়েছে তদ্দিন সে জেলেই ছিল, তারপর সেও যায় হোমে।

মাঝে মাঝেই ছেলে-মেয়েরা এসে দেখা করে যেত মায়ের সাথে, জেলে। হোমে তারা খানিকটা পড়াশোনা করে, শেখে হাতের কাজ, নানারকম। তারপর একসময় হোম থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, এক একজন এক একদিকে। ছেলে দুটো ফিরে যায়, পুরুলিয়ায়। পাহাড় আর পাথুরে মাটিতে, নিজেদের দেশে। ছোট মেয়েটি, মাধ্যমিক পাশ করে হোমে থেকে, তারপর একদিন এক তবলাবাদকের প্রেমে পড়ে। সংসার শুরু করে পুষ্পবালা।

গল্প তবু ফুরোয় না।
চলতেই থাকে...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

শেখ জলিল এর ছবি

নিদারুণ সত্যের উপস্থাপনা। ভালো লাগলো খুব।
আরতিবালা থেকে চলুক পুষ্পবালা..

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

বিপ্লব রহমান এর ছবি

দিদি,

খুব ভাল লিখেছেন। ...কবিতা না হলেও শেষ পর্যন্ত যেনো এটি কবিতাই।...আরতিবালার পর পুষ্পবালাও চলুক।

(অফটপিক: আপনার তিতাস পর্ব এতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলেন! ওই পর্বগুলো আমার খুব প্রিয়।)


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ বিপ্লব।

সবাইকে ধন্যবাদ।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।