পায়ের তলায় সর্ষে- মৃদু মন্দে মন্দারমণি- শেষ পর্ব

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: সোম, ০১/১১/২০১০ - ১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-৪-

আমি এরকম কিছুই পাইনি, কমল পেয়েছে কড়ি,
শিশির পেয়েছে শঙ্খ, আর নীরা যা চেয়েছে তা-ই।

দেখে দেখে অবাক হয়েছি আমি,
এ যেন সমুদ্র নয়, স্রেফ কোনো পোষা হাতী,
কিংবা কোনো আলাদীন সার্কাসের বাঘ।
না কড়ি, না শঙ্খ, না শামুক,
আমার দু চোখে শুধু শস্যমগ্ন সমুদ্রের জল।

দ্যাখো- দ্যাখো কী সুন্দর অস্ত- বলতেই
পশ্চিমের সমুদ্রের ক্ষুধা গিলে খেলো পূর্বের সূর্যকে।
অমিত, শিশির, নীরা, আবছার, শাজাহান,
বন্দী হলো কমলের ক্লিকে। তারপর কয়েক মুহূর্ত
শব্দহীন, সমস্ত সৈকত জুড়ে স্তব্ধ নীরবতা।
আর কোনো ছবি নেই।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার পাশেই নুড়ি কুড়াচ্ছেন
বৃদ্ধ নিউটন, তার হাতে সায়মন হোটেলের চাবি। -নির্মলেন্দু গুণ

ছোট বড় নানা সাইজের নানা আকারের অজস্র অজস্র ঝিনুক ছড়িয়ে আছে এই মন্দারমণির সৈকতে৷ কুড়িয়ে নেওয়ার কেউ নেই ৷ প্রতিটি ঢেউএর সাথেই আসছে আরও ঝিনুক৷ ছোট্ট নুড়ির মত দেখতে আস্ত ঝিনুকও দেখলাম কিছু কিন্তু অ্যাত্ত নরম! হাতে নেওয়ামাত্রই সেগুলো ভেঙে যায়৷ সৈকতে যদ্দূর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তদ্দূর অব্দি বালি ঠান্ডা, ভেজা ভেজা৷ আর তারপরেই শুকনো তপ্ত বালি৷ খালি পা রাখতেই মনে হল যেন ফোস্কা পড়ল পায়ে! এই গরম বালিতেও কিছু মানুষ বসে আছেন৷ কেউ বেড়াতে এসেছেন, কেউ বা ওখানকারই লোক৷ দুজন মানুষকে দেখলাম খানিকটা বালি সরিয়ে তাতে প্লাষ্টিক বিছিয়ে জল ঢেলে দিয়েছেন দু-তিন গামলা৷ ছোট্ট, খুব ছোট্ট এক পুকুর যেন! তাতে কিলবিল কিলবিল করছে ভীষণ ছোট্ট সব মাছ, ইঞ্চি দুই-তিন লম্বা সাপ৷ মানুষটি বসে বসে কিছু একটা বেছে আলাদা করছেন আর সেই আলাদা করে তুলে রাখা অতি ক্ষুদ্র মাছগুলি তুলে রাখছেন পাশেই রাখা প্লাস্টিকের গামলাভর্তি জলে৷ খানিক দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করব ভেবেও কিছু বললাম না, একাগ্র মানুষটির মনযোগ নষ্ট করতে মন চাইল না বলে৷ ডাবওয়ালারা ভিজে গামছা গায়ে মাথায় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে গরম বালিতে৷ বিচের দিকে এগুনো যে কোনো মানুষকে দেখেই এগিয়ে আসছে তারা সাইকেল নিয়ে, ডাব খান বাবু ডাব৷ ডাব খাবেন না? তবে বিয়ার খান! তোমরা বিয়ারও রাখো? জানতে চাইলে জবাব এলো, হ্যাঁ দিদি, রাখি৷ যা চান সবই পাবেন! কি চাই বলুন!

চারিদিকে তাকিয়ে দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বেশ কিছু মানুষ৷ কেউ বসে আছেন একেবারে জলের ধারটি ঘেঁষে, কোলে একেবারেই ছোট বাচ্চা৷ কর্তা গিন্নি দুজনেই জলের ধারে বসে আছেন৷ ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিলে যেটুকু স্নান হয় ওটুকুতেই তারা খুশি৷ স্কুলপড়ুয়া তিনটি ছেলে হাতে একটা বল নিয়ে নেমে গেছে অনেকটা জলে৷ ঢেউএর সাথে সাথে ওরা ডুবছে ভাসছে৷ হাতের বল ছুঁড়ে দিচ্ছে একে অন্যের দিকে, গায়ে না পড়ে বল পড়ে যাচ্ছে জলে আর ঢেউয়ের মাথায় চড়ে সেই বল সরে যাচ্ছে ছেলেগুলোর থেকে দূরে। ওরা হুল্লোড় করতে করতে জলের উপর গা ভাসিয়ে পৌঁছুনোর চেষ্টা করছে বলের কাছে। বল হাতে এলেই আবার ছুঁড়ে দিচ্ছে কখনও সঙ্গীর দিকে তো কখনও আরেকটু দূরে গভীর জলের দিকে আর তারপর মহানন্দে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে চড়ে যাচ্ছে সেই বল আনতে। মাঝে মাঝে দেখাও যাচ্ছে না ওদের৷ আবার দেখা যায়, ঐ যে! ওরা লাফাচ্ছে বলের পেছনে! আমার মনে হল, এভাবেই তো সমুদ্রে স্নান করতে এসে ডুবে যায় অনেকে৷ মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে থাকে সেই সব খবর৷ কিন্তু ঐ বাচ্চাগুলোর কোনোদিকে কো্নো খেয়াল নেই৷ বিশাল উঁচু উঁচু ঢেউএর মাথায় চেপে চেপে তার চলে যাচ্ছে দূরে আরও দূরে!

একটু উঁচু জায়গায় চটি রেখে এগিয়ে যাই জলের দিকে৷ ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে৷ দু'হাত ভরে ওঠে নিমেষেই৷ এত ঝিনুক এতো এতো ঝিনুক! এক সময় মনে হয়, থাক, কী হবে! ক'টা ঝিনুক আমি সাজিয়ে রাখব? থাক ওরা এখানেই৷ সমুদ্র এখানে খুব কাছে ডাঙা থেকে৷ খুব খুব কাছে৷ বিছিয়ে আছে এক সাগর জল নিয়ে৷ শুয়ে আছে৷ ঘোলাটে জল নিয়ে ধুসর সমুদ্র বিছিয়ে আছে দৃষ্টিসীমার বাইরে অব্দি৷ এই সমুদ্রকে, এই বিছিয়ে থাকা বিস্তীর্ণ জলরাশিকে এখানে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়৷ সত্যি সত্যিই ছোঁয়া যায়! হাতে নেওয়া যায় আঁজলাভর্তি জল৷ যদিও নিমেষেই আবার তা গড়িয়ে নেমে যায় সাগরেই! একমুঠো বালি তুলে আনি আমি জলের ভেতর থেকে, মুঠো খোলার আগেই বালি নেমে যায় জলের সাথে৷ আমি দেখতে পাই আমার হাতে ছোট্ট এক নুড়ি আর একটা ছোট্ট ঝিনুক, জ্যান্ত! আমি ওকে আবার জলেই ফিরিয়ে দিই, নুড়িটিকেও৷ এই সমুদ্র গায়ে মেখে জলপরী হয়ে যাই আমি, এই প্রথমবার৷


মন্তব্য

তুলিরেখা এর ছবি

মন দিয়ে পড়েছি সিরিজটা। খুব সুন্দর।
সমুদ্র আমার জন্মজন্মান্তরের ভালোবাসা বলেই কিনা কেজানে সমুদ্র নিয়ে লেখাগুলো আলাদা করে ছুঁয়ে যায় ভিতরে কোথায়।
ভালো থেকো।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মুস্তাফিজ এর ছবি

রেশ রয়ে গেলো মনে।

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার!
রোমেল চৌধুরী

কৌস্তুভ এর ছবি

বাঃ।

হরফ এর ছবি

বাহ । খুব ভাল লাগলো পড়তে আপনার এই সিরিজটা।

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

বাউলিয়ানা এর ছবি

পুরো সিরিজটাই ভাল লেগেছে দিদি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।