পায়ের তলায় সর্ষে- মৃদু মন্দে মন্দারমণি- ০৩

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: বুধ, ২৭/১০/২০১০ - ৩:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-৩-

চাকমার পাহাড়ি বস্তি, বুদ্ধমন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে
ডাকহরকরা চাঁদ মেঘের পল্লীর ঘরে ঘরে
শুভেচ্ছা জানাতে যায়, কেঁদে ফেরে ঘন্টার রোদন
চারদিকে। বাঁশের ঘরে ফালা ফালা দোচোয়ানি চাঁদ
পূর্ণিমার বৌদ্ধ চাঁদ, চাকমার মুখশ্রীমাখা চাঁদ!
নতুন নির্মিত বাড়ি সমুদ্রের জলে ঝুঁকে আছে।
প্রতিষ্ঠাবেষ্টিত ঝাউ, কাজুবাদামের গাছ, বালু
গোটাদিন তেতেপুড়ে, শ্রীতলে নিষ্ক্রান্ত হবে বলে
বাতাসের ভিক্ষাপ্রার্থী! জল সরে গেছে বহুদূর।
নীলাভ মসলিন নিয়ে বহুদূরে বঙ্গোপসাগর
আজ, এই সন্ধ্যাবেলা।
ব্ল্যাকডক মধ্যিখানে নিয়ে দুই কবির কৈশোর
দুটি রাঙা পদচ্ছাপ মেলানোর তদবিরে ব্যাকুল
ব্যর্থ আলোচনা করে, গানের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে,
বর্ণমালা নিয়ে লোফালুফি করে তীরে!
রুপচাঁদা জালে পড়ে, খোলামকুচির মতো খেদ
রীভীন কাঁকড়ার স্তুপ সংঘ ভেঙে ছড়ায় মাদুরে
একা একা। উপকূলে।
বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ কক্সবাজারের কনে-দেখা
আলোয় বিভ্রান্ত আজ। অধিকন্তু, ভরসন্ধেবেলা! -শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মন্দারমণি৷ এক কিশোরী, সমুদ্রতট৷ সদ্য সদ্য গজিয়ে ওঠা এই সৈকতে সবে লোকজন যেতে শুরু করেছে, নিয়মিত৷ সমুদ্র পাড়ের চেনা দৃশ্য ভ্যানিশ, না ট্রলার নৌকা, না শুটকির গন্ধ৷ স্নানাভিলাষীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্নান করেন সমুদ্রে৷ ঢেউএর পরে ঢেউ এসে ভাঙে আর উচ্ছ্বাস বাড়ে স্নানরত ছেলে-মেয়েদের৷ নারী ও পুরুষদের৷ বাবার হাত ধরে সমুদ্রস্নান করতে আসা ছোট্ট শিশুটি তার হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে খেলা করে জল নিয়ে, তার খিলখিল হাসির শব্দ চাপা পড়ে সমুদ্রের গর্জনে৷ সৈকতময় ভাঙা, গোটা ঝিনুকদের মাঝে ইত:স্তত দাঁড়িয়ে দু-তিনটি ডাবওয়ালা৷ সাইকেলের পেছনে ঝোলানো কাঁদি কাঁদি ডাব আর সমনে ঝোলানো বাজারের থলেতে বিয়ার৷ একটি ডাব খেতে হলে খরচ করতে হবে দশটি টাকা আর বিয়ারের দাম জানা হয়নি৷ বেলা বারোটার জ্বলন্ত সূর্যের গনগনে তাপকে উপেক্ষা করে স্নানে মগ্ন কিছু মানুষ৷ সৈকত ধরে মাঝে মাঝেই ছুটে যাচ্ছে গাড়ি৷ টাটা সুমো, কোয়ালিস, সাফারি৷ এমাথা থেকে ওমাথায়৷ কলেজ পালিয়ে কলকাতা থেকে আসা এক দল ছেলে-মেয়ে জলে হুটোপাটি করতে করতে নিজেদের মধ্যেই তামাশা করে, এখন কোন ক্লাস চলছে? আজকে কোন কোন ক্লাস ছিল? বাড়ি গিয়ে সব ঠিকঠাক বলতে হবে তো! তাদের হাসির শব্দে চাপা পড়ে সমুদ্রের গর্জন৷

আরেকটু বয়েস হলে হয়ত বলব, দিনকাল কত পালটে গেছে, ছেলে-মেয়েরা কলেজ কেটে কলকাতা থেকে মন্দারমণি গিয়ে সমুদ্রস্নান করে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে যাচ্ছে! কিন্তু আসলে বোধ হয় খুব একটা পাল্টায়নি। আমাদের স্কুল-কলেজের দিনেও ছেলে-মেয়েরা ক্লাস কেটে বেড়াতে যেত, কর্ণফুলী নদী যেখানে বঙ্গপোসাগরে গিয়ে মিশেছে, সেই মোহনায়, পতেঙ্গা বিচে, কর্ণফুলী থেকে সাম্পান ভাড়া করে দল বেঁধে মোহনার উত্তাল ঢেউয়ের মাথায় চড়ে ছোট্ট আনোয়ারা দ্বীপে আমরাও গেছি। কিন্তু সাগরে স্নান করার কথা কেউই ভাবিনি।
ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত
লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে
যার গই কর্ণফুলী।…
পাহাড়ি কন সোন্দরী মাইয়া
ঢেউওর পানিত যাই
সিয়ান গরি উডি দেখের
কানর ফুল তার নাই
যেইদিন কানর ফুল হাজাইয়ে
হেইদিনত্তুন নাম কর্ণফুলী।। -চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান

বেড়ানোতেই আনন্দ! চট্টগ্রাম শহর থেকে পতেঙ্গা বিচ খুব কাছে বলে উইকেন্ডে বরাবরই খুব ভিড় হয় বিকেলবেলা। তবে স্কুল বা কলেজ পালানো ছেলে-মেয়েরা উইকএন্ড বা বিকেলবেলায় তো যেত না, ক্লাসের সময় হিসেব করে যাওয়া, ছুটির সময় হিসেব করে বাড়িতে ঢুকে পড়া।

এখন যেমন বিশাল বিশাল বোল্ডার ফেলে ঘিরে দেয়া হয়েছে গোটা পতেঙ্গা বিচ, তখন ওরকম ছিল না, কিছু বড় আকারের পাথর তখন ছিল রাস্তার শেষমাথায়, যেখানটায় বিচ শুরু হয়েছে। জোয়ারের ঢেউ অবিরাম আছড়ে পড়ে পাড় ভেঙে দেয় বলে। কিন্তু সেগুলো লাফিয়ে পেরিয়ে দিব্যি নেমে যেতাম বালুকাবেলায়। হেঁটে চলে যেতাম দূরের ঝাউবনে। কে কার সঙ্গে আছে সেটা কারোরই খেয়াল থাকত না। সবাই যে যার মতো হাঁটতে থাকত যেদিকে মন চায়। চটি হাতে নিয়ে আলতো পায়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া, খানিকটা ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে আবার বালির উপর দিয়ে হাঁটা। ঝাউবন পেরিয়ে ওধারের বিচে একলা যেতে খানিকটা ভয় ভয় করত নীরবতার জন্যে।

যখন তখন বঙ্গপোসাগরে নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ, অতি গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়ে, ঝড় উঠে পড়ে বলে প্রায় গোটা বছরই একটা ছোটোখাটো সিগন্যাল ঝুলিয়ে রাখে আজকাল আবহাওয়া দপ্তর, বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঝড়ের আকার-প্রকার বুঝে বাড়ে-কমে সিগন্যালের নম্বর। সেই সব ঝড় যখন আছড়ে পড়ে লোকালয়ে, সঙ্গে করেই নিয়ে আসে জলোচ্ছ্বাস। শহর থেকে দশ মাইল দূরের এই কর্ণফুলী আর বঙ্গপোসাগরের মোহনা তখন সত্যিকারের ভয়াবহ হয়ে ওঠে, পনের-ষোলো ফুট কখনও বা আরো বেশি উঁচু জলোচ্ছ্বাস যখন আসে তখন কারোরই কিছু করার থাকে না কিন্তু ছোটোখাটো ঢেউ বা জলোচ্ছ্বাস যেন কর্ণফুলীর তীর ধরে গড়ে ওঠা ন্যাভাল একাডেমি বা পতেঙ্গা বিচকে ভাসিয়ে না নিতে পারে সেজন্যে বিশাল বিশাল চৌকো কংক্রিট আর সিমেন্টের বোল্ডার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে পতেঙ্গা বিচ আর শহরের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধার ধরে বয়ে চলা কর্ণফুলীর ধারকে। কর্ণফুলীর এই পারে শুধু বোল্ডার ফেলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়নি, মোটা তারের জাল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পাথর আর বোল্ডারকে।

রাঙামাটি পাহাড়ি কন্যা
খোঁপায় রাঙা ফুল
সেয়ান গইত্যে আই হাজাইয়ে
তার কানর কর্ণফুল
কাইছা খালর নাম হইয়ে ভাই
হেদিনত্তুন কর্ণফুলী

দেশ বিদেশের কত জাহাজ
এই না নদীর তীরে
নানারকম পণ্য লইয়া
বন্দরত ভিড়ে
নৌকা সাম্পান উজান ভাটি
নানা রঙের পাল তুলি।। -মোহনলাল দাশ/লোকগান

সে সব বন্ধুদের সঙ্গে পালিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার কথা। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে অফিশিয়ালি সমুদ্রে যেতাম ভোরবেলায়। সূর্যোদয় দেখতে। আজান শোনামাত্র ঘুমচোখে ঝটপট তৈরি হওয়া, হই হই করে ভাই-বোনেরা সব একে ডেকে তাকে তুলে গাড়িতে করে পতেঙ্গা। তখনও দু-একটা চায়ের দোকান ছিল সেখানে, বিচের ধার ধরে। পরোটা ভাজি আর চা খেয়ে বিচে নেমে পড়া। না। সমুদ্রস্নান করার কোনো সীন এখানেও নেই। আমরা জলের ধার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ঢেউ এসে পায়ে ভাঙত। তাতে করে যেটুকু জামা-কাপড় ভিজত তাতেই আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। ভিজে কাপড়ে চটি হাতে নিয়ে আমরা সুনসান বিচে হেঁটে বেড়াতাম। কাছে-দূরে দেখা যেত আরও দু-এক পিস গাড়ি, সেই গাড়িগুলো থেকে নেমে আসা ছেলেদের থেকে আমরা দূরত্ব বজায় রাখতাম সযতনে। সমুদ্রের দিকে তাকালে দেখা যায় কাছে-দূরে নোঙ্গর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য জাহাজ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে তাদেরকেও পরিষ্কার দেখা যায়, নইলে ধোঁয়া ধোঁয়া ধূসর কুয়াশার চাদর ভেদ করে শুধু জাহাজের আকৃতি দেখা যায়, দূর থেকে মনে হয় যেন স্থির দাঁড়িয়ে আছে জলে। ছোটো জাহাজগুলো কাছে থাকে বলে তাও খানিকটা দেখা যায়, কিন্তু বড় জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে থাকে একেবারে দৃষ্টিসীমার শেষমাথায়, গভীর সমুদ্রে, নজরে আসে শুধু তাদের আকৃতি। বিদেশি জাহাজ সব, মাল-পত্র নিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে নামাবে বলে। আকারে অনেক বড় বলে মোহনা পেরিয়ে কর্ণফুলী নদীর উপরে বন্দরে ঢুকতে পারে না, ছোট বোটে করে মাল নামিয়ে বন্দরে পাঠিয়ে দিয়ে ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছে সেখানে। ছোট জাহাজগুলো সোজা চলে আসে বন্দরে। পতেঙ্গা যাওয়া-আসার পথে কর্ণফুলী নদীতে দেখা যায় সার সার মালবাহী জাহাজ, দেশি বিদেশি জাহাজ সব, এম ভি খন্দকার, বীর সৈনিক বজলুর রহমান, বীর জামাল হোসেন, শেখ কালু, ফজলুর হক জলিল, এম ভি সৈকত, হেলেন অফ ট্রয়, সিগাল ইত্যাদি। আরো অনেক জাহাজ যেন দৃশ্যপট জুড়ে সারসারে ছড়ানো, অনেক রকম নামের অগুন্তি, অসংখ্য জাহাজ।

-ক্রমশ


মন্তব্য

বাউলিয়ানা এর ছবি

আহা অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন আবার। শেষবার গিয়ে সমূদ্রতটের ভীড় একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পা ফালানোই দায়। কর্ণফুলিতে জাহাজের সংখ্যাও অনেক কমে গিয়েছে মন খারাপ

সিয়ান গরি উডি দেখের

সিয়ান->সিনান হবে না?

শ্যাজা এর ছবি

চট্টগ্রামের উচ্চারণে 'সিয়ান' ই তো হবে? সেরকমই তো পেলাম।

শেষবার, বছর তিন আগে আমি বিকেলবেলায় পতেঙ্গায় গিয়ে হাজার খানেক বা তারও বেশি লোকের ভিড় দেখেছি, বাজার, দোকানপাটের সাথে এমনকি চলমান ফটো স্টুডিও ও দেখে এসেছিলাম।

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ, স্যায়ান/সিয়ান।

আঁই ওবা চাঁটগাঁইয়া। হাসি

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

শ্যাজা এর ছবি

আঁই ছাঁটগাঁইয়া ভুলি গেসি গই মন খারাপ

ধন্যবাদ শুভাশীষ

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

মুস্তাফিজ এর ছবি

সেই ক্যাজুরিনা থেকে আপনার এই সিরিজের ভক্ত হয়ে আছি। আর ভ্রমণ কাহিনীর কথা যদি বলেন তাহলে বলবো ফুকোওকার চিঠি থেকে। তবে ফুকোওকার চিঠি-০২ এখনও মেলেনি কিন্তু (নাকি দিয়েছেন চোখে পড়েনি?)।

...........................
Every Picture Tells a Story

শ্যাজা এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই,
খুব ভাল লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে।

ক্যাজুরিনা- বাংলোর বারান্দায় বসে ওটুকু খাতায় লিখেছিলাম, যেটা পরে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। ওটা পাঁচ দিনের জঙ্গলভ্রমণের শেষবেলার কথা। জঙ্গলের কথা বা গল্প লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি এখনও।

ফুকোওকার চিঠিগুলোও তাই। প্রায় কিছুই লেখা হয়নি আলস্য আর অসংখ্য অ-কাজের জন্যে। দুই নম্বর চিঠিটা লেখাই হয়নি। সামনের বছর হয়ত সেখানে বসে নতুন আর পুরনো মিলিয়ে আবার লিখব।

লেখাপত্র থেকে বহুদূরে আছি বেশ অনেকদিন। আকালের মধ্যে আছি বলতে পারেন।

------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

কৌস্তুভ এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।