মেয়েটির নাম লুত্ ফা

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শনি, ২৭/১০/২০০৭ - ১২:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নীল আসমান, নীচেতে জমিন, ধরনী মা বসুন্ধরা৷
জমিনে জমিনে সোনার ফসল, বরষা ঢাকিছে খরা৷৷
গোয়ালে গরুতে, মাছেতে পানিতে খেলিছে অহর্নিশ৷
বাসা বুনিতেছে শিল্পী বাবুই, দোয়েল মাগিছে শিস৷৷
ছোট বেনী তার, লাল ফিতা দোলে, চাঁদ বরণী কন্যে৷
কবি গাহে গুণ, এসেছে ফাগুন,সকলি তোমার জন্যে৷৷
গাঁয়েতে লোক কানাকানি করে, গান বান্ধে তার লাগি৷
বাপ-মায়ে তার ঘরেতে ডরায়, কাটায় রাত জাগি৷৷
তার রূপ লয়ে সদা চিন্তায় থাকে বন্ধুর পিতা-মাতা৷
কতটুকু বেসন,কতটুকু সর, সারাবছরই রাখিও ছাতা৷৷
সোনার ফসল উবড়াইয়া দিয়া, চষে পাতাবাহারের গাছ৷
নদী-পানি হতে তুলে বদ্ধ পাতিলে জিইয়া রাখিছে মাছ৷৷

এক অতি সাধারণ মেয়ে, কিন্তু অসাধারণ রূপসী লুত্ফা৷ সে নিজে একদম উদাসীন তার রূপ নিয়ে, কিন্তু আত্বীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা নয়৷ পরিবারের লোকেরাই ক্রমশ গড়ে দিতে থাকে তার সৌন্দর্যজ্ঞান, এটা কর, এটা করিস না৷ তার চেতনার জগত্ ক্রমশ আক্রান্ত হয়৷ তার ড্রেসিং টেবিল ভরে ওঠা, তার পাওয়া উপহার গুলি ক্রমশ হয়ে ওঠে কেবল সৌন্দর্য প্রসাধনের সামগ্রী৷ বন্ধুরা উপদেশ দেয়৷ দিদিমনিরা সাবধান করেন৷ তার প্রিয় বান্ধবীর বাড়ী গেলে তার মা পড়ে পড়ে শোনায় হাল ফ্যাশনের হকিকত৷ খেলার সময় বয়ে যায়৷ নিরস মুখে রূপচর্চার বর্ণনা শুনতে শুনতে দেখতে পায় জানালা দিয়ে মনের আনন্দে খেলছে মেয়েরা, কবাডি কবাডি কবাডি৷ ফিরতেও দেরী করা চলে না আর,সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাওয়া চাই বাড়ি, বাপ-মা টথস্থ সুন্দরী মেয়ে নিয়ে৷ কাজেই সুর্য ডোবার আগেই ধরতে হয় বাড়ির পথ৷ হাতে মেয়েলি পত্রিকার খাঁজে খাঁজে বুকমার্ক৷ বান্ধবীর মা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন তাকে, ওগুলো জানা না কি ভীষণ জরুরী তার কাছে৷ রূপসী মেয়ে লুত্ফার কাছে৷ ফেরার পথ সোনায় মুড়ে থাকে৷ অপুর্ব আলোর মধ্যে ফুটে থাকা ভাটফুলের থোকা দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যায় লুত্ফা৷ সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে৷ লুত্ফা সেই সোনার আলো আঁকড়ে ধরে রাখে আরো কিছুক্ষণ৷ তার সারা রাস্তা জুড়েই সে দেখতে থাকে ফুটে আছে থোকা থোকা ভাটফুল,অসংখ্য৷ এতো দেরী করে এলি? হামলে পড়ে মা৷ বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে আর রক্ষে ছিল না৷ অন্ধকার ? লুত্ফা পেছন ঘুরলেই টের পায় সেই সোনালী আলো৷ কই সুর্য তো এখোনো ডোবেনি পুরোপুরি! থাক আর পাকামি করতে হবে না৷ দিনকাল যে ভাল নয় এই কথাটা তো সে শুনে আসছে ক্লাস টু থেকে, কিম্বা আরো আগে থেকে৷ জ্ঞান হওয়ার পরপর ? ও দিকে মা যে সমানে বকে চলেছে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ আছে মেয়ের ? আমি বলে তো তাও তোকে বেরোতে দিই৷ বাপ তো কবেই বারণ করে দিয়েছে৷ কৃতজ্ঞতা বলে কিছু আছে মেয়ের৷ মেয়ে যে চুপ করে আছে এতেই আরো ঘাবড়ে যান ৷ খেলতে গিয়ে কোথাও চোট পেল না তো? যা চাপা মেয়ে? আতি পাতি করে খুঁজে দেখেন গোড়ালি হাঁটু কনুই৷ বোধ হয় একটা অতিরিক্ত দাগও লুত্ফার থাকা উচিত নয়৷ কিম্বা সেটাই হয়ত হয়ে উঠবে আজ রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের কারন! কে জানে৷ কেবল ঈশ্বরইই জানেন কোথায় কোথায় চোট পেতে পেতে বড় হয়ে উঠছে মেয়েটা৷

বাড়িতেছে সে, তের'য় পড়িল, মেয়ে হইল রজ:স্বলা৷
বিবাহের লাগি আত্মীয়স্বজন ব্যস্ত করিল এইবেলা৷৷
দূরদেশ হতে সন্মন্ধ আসিছে, সন্মতি দাও মায়৷
এমন মেয়েরে ঘরেতে আনিতে কাহার না মন চায়৷৷
তোমার মেয়েকে চাহিছি আনিতে রূপালী বায়োস্কোপে৷
মানুষে ভুলিবে মনের যাতনা কত দু:খে আর শোকে৷৷
বয়স বাড়িলে মুছে যাবে রূপ আমরা রাখিব ধরি৷
হাজার বত্সর বাঁচিয়া থাকিবে ডানাকাটা এই পরী৷৷
শত শত শলা ফিরায় বাপেমায়ে প্রত্যহ দুইবেলা৷
মায়ে বলে তুলে দাও প্রাকার তাহালে বুঝিবে ঠ্যালা৷৷
মিস্ত্রি ডাকিয়া হিসাব বানায় বানাইতে জেলখানা৷
শত শত চোখ মুছি যাবে সব টের পাবে মজাখানা৷৷

মাত্র সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় ওদের এক আত্মীয় ওর জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন৷ এতদিন কানাঘুষো ছিল এ বার সশরীরে৷ এমন মেয়েকে যেন ঘরে রাখলে পদে পদে বিপদ৷ বেশ দূর দেশের এক খুব বড়লোক বাবার মোটামুটি বিগড়ে যাওয়া এক ছেলের জন্যে৷ সেই ছেলের বাবা তার ছেলেকে ঘরে বাঁধতে চান৷ তার পছন্দ হল সপ্তম শ্রেনীতে পড়া ঐ লুত্ফাকে৷ লুত্ফার সৌন্দর্যের কথা কানাকানি হতে হতে এত দূরে পৌঁছেছে! এর মধ্যেই এসে গেছে ফিল্মে কাজ করার অফার৷ মডেলিং থেকে বিজ্ঞাপনী চিত্র৷ সাবানের বিজ্ঞাপনে মেয়েকে নামালে আর পাড়াঘরে মুখ দেখাতে হবে না৷ না না করে এসেছেন লুত্ফার বাবা আব্দুন্নুর৷ আব্দুন্নুর নিম্ন মধ্যবিত্ত৷ মেয়ের জন্যে ঐ বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে হকচকিয়ে গেলেন,কিন্তু প্রস্তাব নাকচ করার জন্যে তাকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি৷ মেয়ে এত ছোট, এটুকুই যথেষ্ট ছিল৷ মাস চার-ছয় পর আবার সেই একই প্রস্তাব,এবার আর আব্দুন্নুর এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারলেন না, ভাবতে বাধ্য হলেন৷ এর মধ্যেই শুরু হয়েছে হাজার হ্যাপা৷ কোথাকার সব বিচিত্র চেহারার এজেন্টরা এসে হাজির শুক্রবারের সকালে৷ ছুটির দিন এসব উটকো ঝামেলা লেগেই আছে৷ তারা কন্ট্যাক্ট করতে চায়৷ কেন? একটু হরে দরে চললে লুত্ফা না কি হতে পারে দেশের গর্ব৷ বিবিধ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার কথা সবিস্তারে শোনেন আব্দুন্নুর৷ অসীম তার ধৈর্য! প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে একের পর এক মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স হয়ে চলেছে৷ আগামী পাঁচ বছর না কি সুযোগ দেওয়া হবে এই দেশকে৷ সুবর্ণ সুযোগ! এর জন্য লুত্ফার দরকার বিশেষ শিক্ষা৷ সহবত শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, পোশাক-আশাক অর্থাত্ জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ৷ লুত্ফার বাবার কোন খরচ লাগবে না৷ সমস্ত খরচ দেবে সরকার৷ সরকার কেন? লুত্ফা না কি জাতীয় সম্পদ৷ লুত্ফা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে তাদের পরিবারের কি হবে আর দেশের কি কি উন্নতি হবে তা সবিস্তারে জানান হয় আব্দুন্নুরকে৷ বাড়িতে ফোন নেই তাই রক্ষে৷ কিন্তু ছুটির দিনগুলোয়? লোকজন তো ছিনে জোঁকের মত লেগে আছে৷ মেয়েকে পাঁচ মিনিট চোখের নাগাল করা অসম্ভব৷ সন্ধ্যায় খোলা মাঠে দাঁড়ালে যেমন লোহার থামের মত মশা ছেঁকে ধরে মাথার উপরে তেমন দিনের বেলায় এক ঝাঁক ছেলে ছোকরা চলতে থাকে লুত্ফার পেছন পেছন৷ এ কি গেরো৷ তাকে নিয়ে বেরোলে বাবা মা সকলেরই অস্বস্তি৷ অ্যাত্ত ঝামেলা হলে সে স্কুলেই বা যায় কি করে ? বাড়ি ফিরেই মন খারাপ হয়ে যায় মেয়ের, সে পরিস্কার দেখেছে তাকে দেখতে গিয়েই ড্রাইভারটা কেমনভাবে ধাক্কা দিল, সোজা বাসের তলায় পিশে দিল দশ বছরের একটা বাচ্চার দেহ৷ হায়, হায়৷ নিজেকেই দোষী লাগে ভীষণ৷ বাড়িতে ঘর অন্ধকার করে কাটায় লুত্ফা৷ জানালা খোলারও জো নেই৷ সর্বদা কয়েক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে সেই দিকে৷ এর মধ্যেই আবার এল বিয়ের প্রস্তাব এই বিদেশে থাকা পাśরে সাথে৷ ইতিমধ্যে কিন্তু তিনি শুনেছিলেন, যে ছেলেটির জন্যে এই বিয়ের প্রস্তাব, সে মা- বাপের কথা খুব একটা শোনে না৷ সে কথা তিনি ছেলের বাবাকে জানালেন, ছেলের বাবা তাকে নিশ্চিন্ত করলেন এই বলে, ভাইসাহেব,আমার ছেলে তো এখনো ছোট,ওদের দুজনেরই দায়িত্ব আমার৷ আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিশ্চিন্ত মনে মেয়ে দিন৷ তিনি দিলেন! যেন বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তারা৷ মনকে আস্বস্ত করলেন এই ভাবে এই মেয়েকে রাখতেনই বা কি ভাবে৷ বৌ তো এক বছর ধরেই বলে আসছে, পরিখা উঁচু কর, আরো উঁচু কর৷ গোপনে হিসাব নিয়ে কি আর আব্দুন্নুর দেখেন নি৷ সম্ভব ছিল না৷

দুরু দুরু বুকে কন্যা চলিল করিতে শ্বশুরঘর৷
মাঠে বসা বক দোয়েলের শিস হইল সকলই পর৷৷
শকুন্তলার মত বৃক্ষলতাটি ধরিল না তারে জড়ায়ে৷
সবুজ দেশ হতে চলি গেল সে কাঁদায়ে বাপ মায়ে ৷৷
আঁধার এখন তীব্র এদেশে জ্বলে টিমটিম বাতি৷
বাপ-মায়ে বলে ঘুচেছে মোদের জাগরণ বিনিদ্র রাতি৷৷
দূর দেশেতে একাকী কন্যা দেখিল বিষম অন্তরায়৷
অলঙ্কারে তাহার ঢাকি গেল দেহ কেবলই কান্না পায়৷৷
বিত্ত মাঝারে পুতুল হইয়া কাটাইতে লাগিল দিন৷
রূপচর্চা ও প্রসাধনে কাটিছে দিন, সে নহে স্বাধীন৷৷
রূপ তাহার একা একা পোড়ে, কে দেখিবারে পায়৷
স্বামীটি ব্যস্ত রকমারী সম্ভারে,কী দারুণ অন্তরায়৷৷

(চলবে)


মন্তব্য

শ্যাজা এর ছবি

বেশ অনেকদিন আগেকার লেখা, সেই যখন লেখালেখির শুরু। নিজের লেখার প্রতি মমতাবশেই সচলে পোষ্টানো।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ঠিকাছে চলুক
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

দারুন হচ্ছে... হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

ভাস্কর এর ছবি

চলুক...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।