একজন আইজুদ্দীন মোড়ল।

থার্ড আই এর ছবি
লিখেছেন থার্ড আই (তারিখ: বুধ, ২৬/১২/২০০৭ - ৩:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কল্পনার আইজুদ্দীন

আইজুদ্দীন মোড়ল বর্তমানে হজ্জ্বে আছেন। সৌদি আরব থেকে লন্ডনে তার ছেলে আক্কাসকে ফোন করেছেন। তার সৌদি ভালো লাগছেনা তাকে যেন জলদি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ৬৫ বছর জীবনে তার এই প্রথম বাড়ীর বাইরে রাত যাপন। আক্কাসের খুব টেনশন হচ্ছে, এমনিতেই হজ্জ যাত্রীদের টিটিক প্ওয়া মুশকিল তার উপর ফিরতি টিকেট পরিবর্তন ...!! খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আইজুদ্দীনকে টেলিফোনে বুঝানোর চেষ্টা করছে আক্কাস, বাবা মাত্র তো দুইটা দিন ... কষ্ট করে থাকা যায়না??

পিতা পুত্রের এমনই আলাপচারিতায় আমার আগমন। চরিত্রটি আমাকে কৌতুহলী করে তুললো। তাই আইজুদ্দীন মোড়ল সম্পর্কে জানার জন্য আক্কাসের সাথে কথা হলো দীর্ঘ সময়। একে একে সে তার বাবার কাহিনী বলতে শুরু করলো। আমার কখনও হাসি পায়, কখন্ও গায়ে কাঁটা দেয়, কখন্ও আবার পিঠ চাপড়ে বলতে হয় শাব্বাস আইজুদ্দীন!! সচলের সদস্য হলে আইজুদ্দীনকে বিপ্লব না দিয়ে উপায় নেই।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে আজকে সচলদের উদ্দেশে থাকছে আইজুদ্দিনের গল্প, ”একজন আইজুদ্দীন মোড়ল”। তবে চরিত্রগুলো ঠিক রেখে নামগুলো বদলাতে হয়েছে।

মোড়লপ্রথা বাংলাদেশে এখন্ আর নাই বললেই চলে, তব্ও আইজুদ্দীন মোড়লের ভয়ে সবাই থর থর করে কাঁপে। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় আইজুদ্দীনের রাজত্ব। ১৪ টি গ্রাম নিয়ে হয় এক চাকলা, তাই আইজুদ্দীনকে স্থানীয় লোকজন চাকলা মোড়ল বলেই চেনে। আক্কাস জানালো, ১৪ পুরুষ ধরে তাদের পরিবার মোড়ল গিরি করে আসছে। তার দাদা মারা যাবার পর ১৯৭৫ সনে সেই দায়িত্ব আসে বড় ছেলে আইজুর ঘাড়ে।

বাবা দুই বিয়ে করেছেন। আমার মা থাকতেন এক বাড়ীতে তার ঠিক আধ মাইল দূরে ছিলো বড় মায়ের ঘর। এর মাঝে ছিলো রঙ্গ শালা। সেখানে বাবা মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতেন। প্রতিদিন চার পাঁচটা নতুন মেয়ে আসতো ঐ রঙ্গশালায়। মা দুঃখ করে এসব বলতেন.. প্রতিবাদ করলে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে মাকে পেটাতো বাবা। পরে আমরা যখন বড় হয়েছি তখন লোক মুখেও এই সত্যতা খুঁজে পেয়েছি। তবে বাবার অনেক দুঃখ ছিলো তার পাঁচ পাচটি মেয়ে , কোন ছেলে সন্তান ছিলোনা। যেদিন আমার বড়ভাই জন্মা নেন সেদিন পুরো গ্রামের মানুষ দ্ওায়াত করে ধান ক্ষেতে মাঝখানে সিমেন্টের ব্যাগ বিছিয়ে সেখানে ড্রামে ড্রামে মিষ্টি জড়ো করেছিলেন বাবা। সবাইকে বল্লেন,” গ্রামবাসী আপনারা আজ রঙ খেলবেন মিষ্টির সুরা দিয়ে .. আজ শূধু আনন্দ হবে... ”
আর সেই খুশিতে ছেলের নাম রাখলেন,’ আনন্দ’

বাবার আকেটা শখ ছিলো শিকার করা। খুব জেদি স্বভাবের লোক ছিলেন তিনি, সাথে সব সময় বন্দুক রাখতেন। একদিন হরিণ শিকারে গেলে গরু তাকে শিং দিয়ে তাড়া করলে বাবা গুলিকরে সেই গরু মেরে ফেলেন। বদ মেজাজী হল্ওে তিনি উল্লাস প্রকাশ করতেন ভিন্ন কায়দায়। মা বলেছেন আমার যেদিন জন্ম হয়েছিলো বাবা সেই রাতে খুশিতে ৪০ টি বালি হাস মেরে মায়ের সামনে হাজির করেছিলেন।

১৯৭১ সলে মোড়ল আইজুদ্দীন একবার মেঘালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার পাহাড়ীরা আইজুদ্দীনের বিরত্বের কথা জেনেছে। তাই তারা আবদার করলো পাহাড়ের একটা বুনো শুকর আছে , বিশাল সে শুকর তাদের খুব বেশী জালাতন করে। ভয়ে কেউ সেটা মারার সাহস পায়না। আইজু একাই সেই পাহাড়ী শূকর মেরে এক বস্তা গুলি উপহার পেয়েছিলেন গাড়োদের কাছ থেকে ।

আইজুদ্দীন যে সৌখিন ছিলেন তার আরেকটা উদাহরণ দিলো আক্কাস, ১৯৬৫ সনের কথা বাংলাদেশে তখন মাত্র টেলিভিশন এসেছে। তখন একখানা টিভি কিনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন তিনি। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভীর করতো সেই টিভি দেখতে।

অফিসার্স চয়েস ছিলো আইজুদ্দীনের প্রিয় পানীয়, রঙ্গশালার সোফায় বসলে আইজ উদ্দীনের পাটিপে দিতো সামাদ মুন্সি। আর মধু মালি ছিলো আইজুর ডান হাত। একদিন আইজুদ্দীনের এই অপকর্ম সর্ম্পকে তার মা তাকে ডেকে নিলো,” বাবা আইজু, গ্রামের মোড়ল তুমি, এই সব করো কেন? আর এভাবে চললেতো সব টাকা একদিন ফুরিয়ে যাবে!!”
-আইজুর সরল উক্তি, "মা- আমি আইজু একাই তিন কামলার সমান কাজ করি, সেই তিন কামলাদের ক্ষেতে কাজ করালে যেই টাকা দিতে হতো সেই টাকা দিয়ে ফূর্তি করি , তাই আমার টাকা ফুরাবেনা।”

দুপুর ১ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত বাবার ঘুমানোর সময়। যত বড় কাজ হোক কেউ ডাকতে পারবেনা, এমনকি মানুষ মরলেও তাকে ডাকা যাবেনা। প্রচুর অর্থ সম্পদ থাকার র্পও তার প্রিয়ছিলো বিনোদ বিড়ি সম্প্রতি ডাক্তারের পরামর্শে ,মৃত্যু ভয়ে বিড়ি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

এমনই একটা শাসন আর ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে বড় হয়ে আমি বাধালাম আরেক ক্যাঁচাল, ক্লাস নাইনে পড়া এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম, জানালো আক্কাস। বাবার অজান্তেই.. আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করে লন্ডন নিয়ে চলে আসবো। কিন্তু মন মানছিলোনা। তাই লন্ডনে আসার দুই দিন আগে বাবাকে জানালাম ঘটনা। বাবা বললেন মেয়ের কয়শ বিঘা জমি আছে?? তোর বাপের তো ১৫০ বিঘা জমি আর ১৪ পুরুষের মোড়লগিরি!! গুষ্টির মধ্যে কেউ মাতুব্বর মোড়ল আছে ??

-আমি বল্লাম ওরা এখানে ভাড়া থাকে...
কি!!! বাবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা !!

বাবার এমন অগ্নী মূর্তি !! আমার জান যায় অবস্থা । পরে বললেন, এই কে আছিস মেয়ে তুলে নিয়ে আয়। এক্ষুনি বিয়ে হবে।

মেয়েকে তুলে নিয়ে আসা হলো আমাদের বাসায় । কিন্তু মেয়েতো আন্ডার এজ !! পড়ে মাত্র ক্লাস নাইনে!! এখন বাবা বললেন , আমার তো ইজ্জত আছে মেয়ে তুলে আনছি , বিয়ে না করলে লোকে গাল মন্দ করবে। এখন কাবিন করে রাখো পরে লন্ডন থেকে ফিরে সংসার করবা। বাবার সামনে সেই দিনই তিনবার কবুল বলে আগুন ঠান্ডা করলাম। তার পরদিনই লন্ডন চলে আসি। দুঃখের কথা কারে কই ভাইজান, কবুল কইলাম, ম্যাগার এখন তরি বাসর রাইতের দেখা পাইলামনা।

আইজুদ্দীনের হাতে পড়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত থেমে গেছে রাহেলার শিক্ষা জীবন। বাড়ীর বাইরে যাবে মোড়ল বাড়ির বউ, অসম্ভব!! স্কুলে গেলেতো পরপূরুষ দেখে ফেলবে !!


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।