ঘূর্ণিঝড় সিডরঃ দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: শনি, ০১/১২/২০০৭ - ৫:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[এ লেখাটা গতকাল (নভেম্বর ৩০, ২০০৭) প্রথম আলো সম্পাদকীয়/উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদকের কাঁচির নীচে মূল লেখার কিছু অংশ/ছবি কাটা পড়েছে। 'সচলায়তনে' তাই কাঁচিবিহীন কাঁচা লেখা মানে মূল লেখাটা তুলে দিলাম]

ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ সৌভাগ্যক্রমে সুন্দরবন এলাকা দিয়ে সাগরে ভাটার সময় প্রবেশ করায় বাংলাদেশ এক মহাবিপর্যয়-এর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যদিও সিডরে ক্ষয়-ক্ষতি যা হয়েছে তা যথেষ্ট ব্যাপক, কিন্তু এটা সুন্দরবন ব্যতিত অন্য উপকূল দিয়ে প্রবেশ করলে বা সে সময় সাগরে জোয়ার থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত। বাংলাদেশ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্যানেল সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। এ অঞ্চলে আগে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়ার প্রচলন না থাকলেও ইদানীং প্যানেল-সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রস্তাবিত তালিকানুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হচ্ছে। এ পযার্য়ে সদস্যরাষ্ট্র ওমান প্রস্তাবিত ‘সিডর’ নামটি নেয়া হয়েছে, যেটির আসল অর্থ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে (কারও মতে এটি আরবীতে জুজুবি গাছের নাম, কেউ বলছেন ল্যাটিন ‘সিড্রা’ বা উল্কা থেকে এই নাম এসেছে, আবার কেউ বলছেন ‘সিংহলী’ ভাষায় সিডর অর্থ ‘চোখ’)।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮৭৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানা ১১৭ টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে খুলনা উপকূল দিয়ে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় (৩৬টি) বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্ত্ত এ উপকূলে সুন্দরবনের অবস্থিতির কারণে এসব ঘূর্ণিঝড় থেকে মোট হতাহতের পরিমাণ বরিশাল, চট্টগ্রাম বা নোয়াখালী উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর চাইতে অনেক কম (চিত্র-১) auto। কোস্টাল গ্রীনবেল্ট বা উপকূলীয় সবুজ-বেষ্টনী ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে কাযর্কর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে এবং ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কা প্রতিহত করে একে দুবর্ল করে দেয়। এছাড়া এ ধরনের জায়গায় লোকসংখ্যা কম থাকার কারণেও হতাহতের সংখ্যা কম হয়। অতীতে সুন্দরবন আরও বিস্তৃত উপকূল জুড়ে থাকলেও দুঃখজনকভাবে আমরা বন কেটে বসতি স্থাপন করে নিজেদের বিপদই ডেকে আনছি। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভূ-প্রকৃতি একই রকম হওয়ায় বনায়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে খুব সহজেই সুন্দরবনকে উপকূল জুড়ে বিস্তৃত করা যায়, যা ঘূর্ণিঝড়ের বিরূদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে পারে এবং পাশাপাশি দুযোর্গপ্রবণ এলাকায় জনসংখ্যা কম রাখতে সাহায্য করবে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বর্তমান ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের উপকূলীয় জনসংখ্যা শতকরা ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে যারা ঘূর্ণিঝড় এবং সুনামীর মত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে দুযোর্গ আরও বাড়িয়ে তুলবে। এমতাবস্থায়, উপকূলীয় সবুজ-বেষ্টনী কিছুটা হলেও বাংলাদেশে ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাও বাংলাদেশের দুযোর্গ ব্যবস্থাপনার একটি প্রধান সমস্যা। এলজিইডি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উপকূলবর্তী ১৪টি জেলার ১৮২৭-টি আশ্রয়কেন্দ্রে মাত্র প্রায় ১২ লাখ লোক দুযোর্গের সময় আশ্রয় নিতে পারে, যা মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগেরও কম। শুধুমাত্র এই তথ্য থেকেই বোঝা যায়, উপকূলীয় এলাকায় জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ দুযোর্গের সময় আশ্রয়হীনভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকে এবং এদেরকেই সবচাইতে বেশী আঘাত সইতে হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও জনসংখ্যা অনুপাতে সমভাবে বিন্যস্ত নয় (চিত্র-২)auto। জনসংখ্যা অনুপাতে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যানুযায়ী ভোলা এবং কক্সবাজার জেলার অবস্থান সবচেয়ে ভাল। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে ১৯৭০-এর ‘ভোলা সাইক্লোন’ এবং ১৯৯১-এর প্রলয়ংকরী ‘চট্টগ্রাম’ সাইক্লোনের পরে বেশীরভাগ আশ্রয়কেন্দ্র এ অঞ্চল এবং তার আশেপাশেই গড়ে উঠেছে। পক্ষান্তরে, সবচেয়ে বেশী অবহেলিত থেকেছে বৃহত্তর খুলনা এবং তার আশেপাশের কিছু জেলা, যেখান দিয়ে সাইক্লোন সিডর এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড় প্রবেশ করেছে। এ অঞ্চলের প্রায় এক কোটি লোকের জন্য মাত্র ২২২ টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, যা নিতান্তই নগণ্য ও অপযার্প্ত। আমরা জানি, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে এক মহাপরিকল্পনা নেয়া হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার কিয়দংশমাত্র বাস্তবায়িত হয়েছে। সব এলাকায় যদি একসাথে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব না হয়, তবে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত এলাকা অনুযায়ী পযার্য়ক্রমে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি ঘরবাড়ীর অবস্থার কথাও বলা যেতে পারে। দালান-কোঠাবাদে বাংলাদেশের বেশীরভাগ ঘরবাড়ী এতই নাজুক সাধারণ কালবৈশাখী ঝড়েই যেখানে এগুলো ভেঙ্গে পড়ে, সেখানে ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডো মোকাবিলা করা আরও দুরুহ ব্যাপার। দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে কম খরচে টেকসই ঘর নির্মাণের জন্য স্থপতি ও প্রকৌশলীদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগও এ উদ্যোগ নিতে পারে। বিদেশে দেখেছি এ ধরণের গবেষণায় সশস্ত্র বাহিনীর বিমান ব্যবহার করা হয়। বিমানের প্রপেলার সাহায্যে ঘূর্ণিঝড় শক্তির বাতাস ঘরবাড়ীর উপর দিয়ে প্রবাহিত করে পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে টেকসই কাঁচামাল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডো উপযোগী ঘরবাড়ী নির্মাণ করা হয়। আমাদের দেশেও সাধারণ মানুষের উপযোগী করে উপকূলীয় এবং টর্নেডো উপদ্রুত এলাকায় এ ধরণের ঘরবাড়ী নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া উচিত। প্রয়োজনে সরকার এ ধরণের বাড়ী নির্মাণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে। এছাড়া ছাদ হিসেবে টিনের বিকল্প অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার। দেখা গেছে, বাতাস একটু জোরে বইলেই টিনের চালা খুলে পড়ে এবং ঝড়ে নিহত বা আহতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ থাকে যারা এই টিনের চালে আঘাতপ্রাপ্ত। সরকার আইন করে ঘূর্ণিঝড় এবং টর্নেডো উপদ্রুত অঞ্চলে টিনের চাল ছাদ হিসেবে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারে। এতে অনেক জীবন অন্তত রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়গুলোতে সাধারণত অধিকাংশ লোক নিহত হয় জলোচ্ছ্বাসে ডুবে। উপকূলবর্তী এলাকায় বঙ্গোপসাগরের তলদেশ খুবই অগভীর হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের উচচতা সাধারণত অত্যধিক হয়। দেখা গেছে, জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা যদি সাগরেই প্রতিহত করা যায়, তবে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় এটা আর তেমন ভয়ংকর থাকে না। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে উপকূল রক্ষার জন্য সাগরে কৃত্রিম বাঁধ এবং আরও নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় প্রবণতা ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে অচিরেই এসব উদ্যোগ নেয়া জরুরী। প্রয়োজনে এসব দেশের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা পৌঁছে দেয়া এবং মানুষকে নিরাপদে স্থানান্তর করার ব্যাপারে সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর প্রশাসনেরও কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে দুযোর্গ মোকাবেলা ও ত্রাণ বিতরণে আলাদা পরিকল্পনা থাকা উচিত যেন এলাকার লোকজনের জান-মাল রক্ষায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারে। গভীর সমুদ্রে জেলেদের কাছে রেডিও ছাড়া সতর্কবার্তা পাবার আর কোন উপায় নেই। রেডিওর অভাবে সতর্কবার্তা না জেনে সমুদ্রে যাওয়ায় অনেক সময় দেখা যায় ছোট-খাট ঝড়েও নৌকাডুবি হয়ে প্রচুর মাঝি-জেলে মারা যায়। সমুদ্রগামী নৌকাপ্রতি বিনামূল্যে একটি রেডিও বরাদ্দ করা যায় কি না সরকার ভেবে দেখতে পারেন।

ঘূর্ণিঝড় সিডর সংঘটিত হওয়ার সময় বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় আবহাওয়া বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে সিডরের পূর্বাভাস দিলেও বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ আজ পর্যন্ত একটি কার্যকর ওয়েবসাইট চালু করতে পারে নি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের পূবার্ভাস দেয়ার জন্য কোন ওয়েবসাইট নেই, যা সত্যিই দুঃখজনক। একটা ওয়েব সাইটের মাধ্যমে আবহাওয়া বিভাগ যদি প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার পূবার্ভাস দিত তবে তাৎক্ষণিকভাবে রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেল এবং পত্রিকাগুলো খুব সহজেই তা দেখে পূবার্ভাসগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারত এবং সাধারণ মানুষও তখন আবহাওয়া সম্পর্কে আরো বেশী সচেতন হত। দেখা গেছে আবহাওয়া সম্পর্কে আমাদের অসচেতনতাই অনেক দুর্ভোগের কারণ। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুযোর্গে আঘাত হানার আগে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কিছুটা সময় পাওয়া গেলেও টর্নেডো খুব তাৎক্ষণিকভাবে সংঘটিত হয়। ওয়েবসাইটে তাৎক্ষণিক আপডেট এবং সে অনুযায়ী তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে টর্নেডো থেকেও অনেক জান-মাল রক্ষা করা সম্ভব।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রথম আলো সম্পাদক এ লেখার কোন অংশ কাঁটলেন,জানতে ইচ্ছে করছে ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তানভীর এর ছবি

??
শেষ প্যারার পুরোটাই হাওয়া। মাঝখানে মাঝখানেও কিছু লাইন বাদ গ্যাছে। পেপার ভার্সনে ছবি শুনেছি একটা এসেছে, কোনটা বলতে পারছি না।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'সরকার ভেবে দেখতে পারেন' এই লাইনে এসে তারা উপসংহার টেনেছেন ।
এই উপদেশমুলক বাক্য সব শেষে দিলে সম্ভবতঃ আর কাটছাট হতোনা হাসি
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তানভীর এর ছবি

ধন্যবাদ। হয়তো তাই। তবে আমি আগেও দেখেছি এই ধরণের কোন বিভাগের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগমূলক কিছু থাকলে প্রথম আলো বরাবরই কাট-ছাট করে। নীতিমালা বহির্ভূত হয়ত।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।