একটি নাটক অথবা উপন্যাসের খসড়া : ১-৫

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৭/০৬/২০০৭ - ১০:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
সামহোয়্যার ইন ব্লগে এই সিরিজটি লিখছিলাম। এখন থেকে এখানেই এটি লিখব বলে পুরানো লেখাগুলো একসাথে পাঠালাম... ১ সমুদ্র এখানে শান্ত - সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশ ওইখানে শেষ রঙের চাদর গুটিয়ে নেয়। দিকচক্রবালে সমুদ্রের ফেনিল ঊর্মিমালা যেখানে শান্ত আকাশের সাথে মিলিয়াছে আকাশের সবটুকু নীল সেখানে তখনও অন্ধকারে ঘুচে নাই - কেবল একখানা জেলে নৌকো তীরগামী ঢেউ এর সাথে দুলিতে দুলিতে সঙ্গত ধরিয়াছে। নৌকাটিকে এই ঘনায়মান সন্ধ্যায় প্রগৈতিহাসিক গাঢ় ঘুমের প্রান্তরে স্বপ্নে দেখা দূর্গের মতো প্রগাড় মনে হয়। শত সহস্র বছর ধরে এর প্রাচীরগাত্রে কত শোক আর স্বপ্ন বিচিত্র ধ্বনি তুলিয়া কাজেম আলীর কন্ঠে ভর করিয়া দুর নত্রপানে ছুটিয়া চলে। - সমুদ্রের ওপর দিয়ে মানুষের আদি পিতা থেকে অনন্ত আগামী ছেলেটির আনন্দ এবং শোককে পাঠিয়ে দিতে চায় সে কবেকার কোথাকার কোন অনাগত বন্ধুর কাছে .. যে শব্দের গায়ে শ্যাওলার মতো জড়িয়ে ধরে থাকে এক প্রাচীন রমণীর কামনার নিঃশ্বাস শিরোনাম আর নানাবিধ কুশীলব এর নামাংলকার ক্রমান্বয়ে জেগে উঠে প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য্যদেবের মতো ডুবে যায় একে একে। ২. জেলেপপল্লীতে সন্ধ্যায় আলো আরো নেমে যাবার মুখে ছোট বড় অসংখ্য উলু আর শঙ্খ বেজে উঠলে শারিকার ঘোর ভাঙে। আয়নায় কি যে নেশা ধরানো ... রুপোলী একটুকরো কাচের মধ্যে নিজেকে কতভাবেই না দেখা যায়। এক মুখে কত ছবি আকা থাকে - দেখে দেখে তবু কান্তি ধরে না। সারিকা দ্রুত আয়নাটা তার গোপন দেরাজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দ্রত পায়ে উঠে আসে। মাথা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করে যেন আকাশ সারিকাকে বলে দেবে সে আসবে কি আসবে না। কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারে না। ইচ্ছে করে না কিছুতেই তবু তাকে রান্নাঘরে ফিরে যেতে হয়। এখানে সন্ধ্যে পড়লেই নিশুতি নামে। মশলা পোড়ার গন্ধে গোটা পাড়া ভরে ওঠে। পাড়া মানে গোটা বিশেক ঘর। এসময়টায় বেশিরভাগ পুরুষই গ্রাম ছাড়া। নৌকা নিয়ে সাগর সেচে রুপোলী মাছে নৌকার গলুই না ভরা পর্যন্ত ওরা ভেসে বেড়াতে থাকবে। সাত রাত্রি পার হয়ে অষ্টম কি নবম রাত্রে তাদের ফেরার কথা। রান্নাঘরের কোনে একটা ডালায় পেয়াজ আদা রসুন স্তুপে লিপস্টিকে মোড়া দু জোড়া লাল মরিচ পড়ে থাকে। তারা যেন ঘরের পুরুষের ফিরে আসার কথা বলছে। ৩. পাড়ায় সব ঘরে সন্ধ্যা কুপি জ্বলে উঠেছে এর মধ্যেই। সমুদ্রের ওদিকটায় ছোকরারা দল বেধে গপ্প জমিয়েছে। এ যুগের ছেলেপেলেদের কথার থই খুজে পায় না বিদ্যাপতি খুড়ো। রইসুদ্দির নাতি রাজধানী ঘুরে এসেছে উদগ্রীব ঈর্ষাকাতর বিষ্মিতসারি সারি চোখের সামনে সেলিমের কথার রঙ চড়ে। মেয়েগুলো যেন পরীর মতো সুগন্ধি পাউডারের মত মসৃন তাদের গায়ের রঙ - জাফরান মাখা চুল উড়িয়ে যেন এুনি উড়ে যাবে মেঘের দেশে। মনের ভেতরে আরো কত কথা মন উচাটন করে- কথা যেন ফুরোতেই চায় না - কথা যেন ঢেউ এর মতো - কথা যেন শারিকার চোখজোড়ার মতো ... ৪. সবাই কল্পনায় সারিকাকে দেখে। ছিপছিপে শ্য্যামাঙ্গিনী মেয়েট কে নিয়ে ভাবে নাই এমত ছেলেবুড়ো এ অঞ্চলে নাই। মন চোখের অনুগামী, ন্বপ্ন মনের। গেলবার দাশ পাড়ায় হ্যাজাক জ্বেলে কৃষ্ণ নামকেত্তন হয়েছিল সারারাত ধরে। সাগরপাড়ের মানুষেরা অস্টপ্রহর বুদ হয়ে কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে চোখের জল বুকে করেছে। ভক্তিপতির বউ কাদতে কাদতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটায়ে পড়লে সবাই হুড়মুড় করে তার নেক খবরদারীতে ব্যস্ত পড়লে সবাই অবাক হয়ে শোনে তার নিঃশ্বাস দিয়ে কৃষ্ঞ নাম বের হচ্ছে। এরপর কৃষ্ণ মহিমা আর একবার বুঝতে পেরে সবাই তার উদ্দেশ্যে লুটিয়ে পড়ে। সমবেত উলুধ্বনি সাগরের শব্দের সঙ্গে মিলে চরিদিক এক স্বর্গীয় মহিমায় ঢেকে ফেলে। সেই নিঃশংশয় আত্মসমর্পনের দিনের কথা মনে করতে গেলেও গায়ের পুরুষকুল বুকের ভেতওে একটা কাটা অনুভব করে। কৃষ্ণ নামে নত হওয়ার মূহূর্তেও সারিকার দিকে চোখ চলে যায় .. সারিকা কৃষ্ণ নামে কেমন দুলে দুলে উঠছে, সারা শরীরের গোপন আগুন দুচোখ জোড়ায় ভর করেছে। সারিকার চোখের তারার ইশারায় তারাও দুলতে খাকে। পরে এ নিয়ে যুবকদের মধ্যে আলোচনা হয় । সারিকা আসর ছেড়ে চলে গেলে কৃষ্ন নামজপে রসভঙ্গ হয় এক এক করে যুবকের দল আসর ছেড়ে পাড়ে উঠানো ভাঙা নৌকার গলুই এ বসে জটলা পাকায়। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় তারা বিড়ি ফুকে আর বাতাসে আগুনের ফুলকী ছোটায়। সাধন দাশই প্রথম কথাটা ওঠায়। ওদলু পূজার দিনে সে কি চাবে তা আর কেও জানে কি না জিজ্ঞেস করে। তোর মনের কতা .. মুই জানবো ক্যামনে .. মুই মোরটার কথা বলতে পারি কিন্তু কমু না। অন্যরা হল্লা করে ওঠে - ক্যানে ক্যানে- সমুদ্রের এ অঞ্চলটা সনাতনী হিন্দু হলেও সাগর পাড়ে বাস হওয়ার কারনে অন্যএলাকা থেকে স্বতন্ত্র লোকাচার গড়ে উঠেছে। উম্বুশা নামে এক মাঝি কোন আদিকালে নৌকাডুবিতে মাঝসমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার একশত তেরদিন পর মাঝসমুদ্রেই ভেসে উঠেছিল। সঙ্গীরা তাকে দানো মনে করে নৌকা ছুটিয়ে পালিয়ে তীরে আসার তিনদিন পর উম্বুসাও তীরে এসে হাজির হয়। সে নেকৈা জলে যে রেখা রেখে যায় সেই পথ ধরে উম্বুসা সাতরে এতটা পথ পাড়ি দেয়। দরিয়ার এক নতুন দেবতার সে গল্প বলে। সনাতনী হিন্দু আর নতুন মুসলমান সবাই সেই অলৌকিক দেবতার নাম অগ্রাহ্য করার সাহস পায় না। ওদলু নামে সেই দেবতা একশত তেরদিন পর পর উম্বুসার উত্তরপুরুষদের বাসনা পূরনে এই দ্বীপাঞ্চলে আসেন। তার তুষ্টিতে সে দিন সবাই মৌনতা অবলম্বন করে মনপ্রান ঢেলে আরাধ্য জিনিষের জন্য প্রার্থনা করে। কৃষ্ণ জপের চেয়েও ওদলুর পূজা অনেক বৈচিত্রময়। ভক্তির সাথে এখানে মেশে রহস্য, নিবেদনের বদলে এখানে জেগে ওঠে অপূর্ণ কামনার চিত্র। ফলে কৃষ্ণ বেচে থাকলেও ওদলু এখানে অনেক জনপ্রিয়। অন্তত যুবাদের কাছে। তাদের সামনে বিস্তীর্ণ জীবন অনেক অপূর্ণ কামনা আর বাসনার রসে সিক্ত। ৫. জেলেপল্লীতে রাত সহজে শেষ হতে চায় না। তাই শেষরাত্রে চাদ ঢলে পড়ার সময় হতেই অনেকে এক এক উঠে পড়তে শুরু করে। পিতেম অনেন ধরে উঠি উঠি করে শেষপর্যন্ত বিছানার আয়েশ ত্যাগ করে বাইরে এসে দাড়ায়। আকাশের কালো রঙ ফিকে হতে শুরু করেছে । সমুদ্রের দিকে তাকালে দৃষ্টি এমনিতে দিগন্তে চলে যায় আর এখনতো দুর সমুদ্রে যাত্রাকরা নৌকোগুলোর ফিরে আসার সময়। যতদুর দেখা যায় কোথাও সমুদ্রের বিশালত্ব ছাড়া কিছু নেই। পিতেমের বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস সমুদ্রেও নোনা বাতাসে মিশে যায়। এতটা বছর এই সমুদ্র দাপিয়েও সে একটা জলপরী দেখল না। সে যখন ছোট তার বাবা আর দাদু নৌকা নিয়ে মাঝ সমুদ্রে চলে গেলে তাদের ফিওে আসার অপোয় সারাদিন সমুদ্রে চোখ মেলে সারাটা দিন কাটাতো। যে কোন নৌকা কালো বিন্দুর মতো ভেসে উঠলেই সে চিৎকার কওে জানাতো বাবা আসছে - দাদু আসছে। দাদুর কাছে সে সমুদ্রেও গল্প শুনে সেও সমুদ্রকে ভালবেসে ফেলেছিল। দাদু বলতো সমুদ্রকে যে ভালবাসে সমুদ্রের কন্যারা তাদের দেখা দেয়। তুমি দেখেছো তাদের? - হ – । দাদুর চোখ তখন কোথায় জানি চলে যেত। দরিয়ার বুকে খুব বাতাস ওঠে, ঢেউ এর মাথায় মাথায় নৌকা নাচতে থাকে আর সবাই ওদলুর নাম ডাকতে ডাকতে ত্রস্ত হয়ে ওঠে। একটুকু ভুল হলেই মহা বিপদ, গোটা সমুদ্র আরো ফুসে উঠতে থাকে। প্রবল বাতাসের সাথে আসে বৃষ্টি আর আসে মাছের দল। ঢেউ এর তান্ডব বাড়তে থাকে মনে হয় এই বুঝি সব তলিয়ে যাবে। সবার চোখে তখন মৃত্যুও ছায়া কাপে এসন সময় তারা আসে। দরিয়ার অশান্ত চেহারা হটাৎ যেন শান্ত হয়ে যায় কিন্তু একটু দুরেই ঝড় যেন আরো ফুসে ওঠে। কিন্তু তার কোন চি‎ এইটুকু জায়গায় নেই। নীল আলো জ্বেলে ওরা তখন আসে। কি সুন্দর তাদের চেহারা, গোটা পৃথিবীতে তাদেও মতো কেউ নেই। একবার যে তাদের দেখেছে সে কখনো কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারে না। দাদু যখন তাকে দেখেছিল তখন তার বিয়ের মাত্র আট মাস বয়স। জলপরীরা হাসতে হাসতে উঠে আসার আগেই অন্যরা তাকে সাবধান করেছিল সে যেন চোখ বন্ধ করে রাখে কিন্তু মূহূর্তের জন্য সে তার বউটার কথা ভুলে গিয়েছিল। এরপর সে আর চোখের পলক ফেলতে পারে না .. একথাগুলো পিতেমকে দাদু কখনো বলে নি। আশেপাশের সবাই দাদুকে নিয়ে বলতো। এরপর দাদু কখনোই আর বাড়িতে থাকতো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে খালি দূর্যোগের চি‎‎হ্ন খুজে বেড়াতো। সমুদ্র উত্তাল হতে শুরু করলে একে একে সব নৌকা তীওে ফিরতে শুরু করলে দাদুর রোখ চাপতো আরো গভীর সমুদ্রে চলে যেতে। শেষে এমন হলো যে তার সাথে আর কেউ দরিয়ায় যেতে রাজী হতো না। সে তখন একাই নৌকা কওে গভীর সমুদ্রে চলে যেত। দাদীর দিকে দাদু আর কখনো নাকি মুখ তুলে দেখে নি। দাদীও যেদিন বুঝতে পারলো জলপরীরা তার স্বোয়ামী খেয়েছে এরপর থেকে বিধবার বেশে আরো পাচটি বছর কাটিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দাদু তখন ঝড়ের মাঝখানে একটুকরো শান্ত সমুদ্রে জলপরীর স্বপ্ন দেখে, আর ্যাপাটের মতো সমুদ্রে দাবরিয়ে বেড়ায়। একদিন তাকে অনেকদিন পর অনেক হাসিখুশি দেখে গ্রামের সবাই অবাক কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না। সারাদিন সবার সাথে রঙ্গ তামাসায় কাটিয়ে মাঝরাত্রে নৌকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় আর কথনোই ফিওে আসে নি। দাদু কি জলপরীর দেখা পেয়েছিল। পিতেমের মাথায় খালি এইসব ঘুরতো। সমুদ্রে ঝড় উঠলে তার মধ্যে একটা আশার আলো ফুটতো হয়ত এবার। কিন্তু চুরাশী বছরের জীবনে কখনোই সেটা পুরণ হয়নি। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এই শেষরাত্রে পিতেমের এইসব পুরোনো জীবন্ত কথা মনে পড়ে। ঠিক তখনই সে দেখতে পায় একটি নৌকা... কালো বিন্দুর মতো তীরের দিকে ছুটে আসছে।

মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি
গুট ....................................... ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
হাসান মোরশেদ এর ছবি
প্রথম প্যারায় সাধু ও চলিতের মিশ্রন কি পাঠককে হোঁচট খাওয়ায় না? -------------------------- আমি সত্য না হলে গুরু সত্য কোনকালে?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

কর্ণজয় এর ছবি
প্রথম প্যারাটি লেখার সময় একটা দৃশ্যকল্প মাথায় ছিল যেটি ঠিক ক্যামেরা, এর ফ্রেমিং , শট এর গতি এবং এর সীমানা নিয়ে ভাবনাটা প্রচ্ছন্ন ছিল। এটি পড়তে গেলে হোচট খেতে হয়, ছন্দময় একটা গতির মধ্যে হটাৎ ছেদ পড়ে অন্যদিকে গতি দ্রুত বাক খেয়ে আরেক তালে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতই টাল মাটাল লাগে কিন্তু এটা একটা নিজের কাছে একটু দেখে নেওয়া এটা পড়তে গেলে ঠিক যে রকম অনুসঙ্গ তৈরী হয় ঠিক সেটিই ক্যামেরায় যখন ধরা হবে তখন যেন এই অনুভূতিটা হারিয়ে না যায় সেই ভাবে লিখেছিলাম। সাধু চলিতের মিশেলটা সবসময় হোচট খাওয়ায় তা নয় - জীবনানন্দের ক্ষেত্রে তো নয়ই। তবে এখানে পড়ার দৃষ্টিকোন থেকে এ সমস্যা হয়েছে - তা তো বটেই।
কর্ণজয় এর ছবি
আজ আমার টাল মাটাল ঘুড়ির দশা...
সুমন চৌধুরী এর ছবি
অ্যা! ....................................... ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।