চিন্তক জীবনানন্দ দাশের সাথে

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: রবি, ০৮/০১/২০২৩ - ২:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চিন্তা হচ্ছে
হেঁটে যাওয়া। চলতে থাকা;
সামনে- খোলা। উন্মুক্ত। অবারিত।
চিন্তার জন্ম জীবনে
জীবনও চলা, কিন্তু সেখানে দেয়াল আছে। বাঁধা আছে।
চিন্তা এই দেয়ালকে পাড়ি দিতে চায়।
কল্পনাও সেটা চায়। তবে-
কল্পনা আর চিন্তার একটা পার্থক্য আছে।
কল্পনায় আমরা এই দেয়ালগুলো এড়িয়ে যাই
যেন দেয়ালগুলো নেই।
কিন্তু চিন্তা এই দেয়ালগুলোকে স্বীকার করে
তাকে অতিক্রম করার পথ খোঁজে।
এজন্য চিন্তা বাস্তব।
আর কল্পনা বাস্তবের বাইরে।

চিন্তা যে বাস্তবতাকে স্বীকার করে
একে অতিক্রম করার চেষ্টা করে
তার বাহন আছে।
এই বাহনগুলো কী?
কয়েকটি শব্দ; চাবি শব্দ, মূল শব্দ, শেকড় শব্দ, key word
যা দিয়ে চিন্তা এগিয়ে চলে।

‘যদি’
যদি- মানে মানে বিকল্প। এমন না হয়ে তেমন যদি হতো।
যা নয়, তাকে ভুলে না গিয়ে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া।
“যদি আমি ঝ’রে যাই, একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশা
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুঝে”

চিন্তা বাস্তবতা তৈরি করে। অতিক্রান্ত বাস্তবতা।
যার উৎস, জীবনের বাস্তবতা।
লক্ষ্য, একে অতিক্রম করে
বাস্তবতা তৈরি করতে করতে এগিয়ে যাওয়া।
বাস্তবতার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কী?
দৃশ্য।
কোন একটা মুহূর্তে, কোন একটা স্থানে
কেউ অথবা কেউ কেউ মিলে একটা দৃশ্যের জন্ম দেয়।
যা আমরা দেখি।
যা শুনে দেখি।
যা ছুঁয়ে দেখি।
জীবনানন্দ এই
দৃশ্যের পর দৃশ্য জন্ম দেন
অথবা তার মধ্যে জন্ম নেয়।
সকালে কাকের ডাকে আলো আসে
পৃথিবীতে এক সবুজ ডাঙা জেগে ওঠে
সেখানে গাছের না: কাঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল।
কোকিলের ডাকে কুয়াশায় ভিজে…
ভেসে আসে হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ
তিনি জানেন, এই দৃশ্যসকলি বাস্তব।
তার হাঁস তিনি উড়িয়ে দেন কল্পনায়

“কল্পনার হাঁস সব- পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রং মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক…”
তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন
বাস্তবের মাটিতে।

আবার আসিবো ফিরে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে- এই বাংলায়
একটা নিখাদ বাস্তবতার ভূগোল- এই চিরচেনা ভূগোলে
জীবনানন্দ ফিরবেন- কিন্তু
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে
হয়তো দেখিবে চেয়ে
হয়তো শুনিবে
হয়তো … হয়তো… হয়তো …
এই যে সম্ভাব্যতা
যা হয়নি
যা হতে পারতো
যা হতে পারে
সেই বাস্তবতাকে এখনকার বাস্তবতাকে অতিক্রম করে উপলব্ধি করা
এটা চিন্তার এক পদ্ধতি
তা জীবনানন্দ দাশের ছিল সহজাত। অন্তর্গত।
এমনটাতো হতেই পারতো
আপনি, আমি যে কেউ
আমরা না হয়ে হতে পারতাম
একটা প্রজাপতি, একটা সুদর্শন অথবা জোনাকি।

অথবা, কিংবা
শব্দগুলো চিন্তার শব্দ।
যা আছে, তার বাইরে অন্য কিছুর দিকে নিয়ে যায়।
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোন এক নগরী ছিল একদিন

আমাদের শরীর
যে স্থানে থাকে
যে সময়ে থাকে
সেই জায়গাতেই কি থাকি আমরা?
অথবা শুধু সেই কালে?
না কি শরীরের বাইরেও
আমাদের অস্তিত্বকে পাই
স্থান ছাড়িয়ে অনন্তে,
কাল ছাড়িয়ে মহাকালে?
নিজের অস্তিত্বের এই বিস্তারকে আবিষ্কার করা
চিন্তা প্রক্রিয়ার একটা অংশ।
জীবনান্দ দাশের কবিতার দুটো শিরোনাম
‘সময়সেতু পথে’ এবং ‘যতিহীন’
অবিরাম আমাদের নিজের অস্তিত্বের বিস্তারের কথা বলে।
এই অস্তিত্বের বিস্তার
আবিষ্কার করার জন্য

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

হাজার বছর ধরে
এই যাত্রা কোন আমির?
নদী আর সুমদ্রতীরেই বেড়ে উঠেছিল
মানব সভ্যতা
নিজের শরীরের সীমাকে ছাড়িয়ে
মানব সভ্যতার বিকাশের মধ্যেই সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা
চিন্তকের কাজ।
চিন্তকই পারেন
অসীম হয়ে উঠতে।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
এ যেন পুরাকালের সেই বাণিজ্য তরণী পাড়ি দেয়া
নাবিকের গল্প
যার হাতে সভ্যতার বিকাশ।
চিন্তা এভাবেই আমাদের
মুক্ত পথে এনে দাঁড় করায়।

তিনি চিন্তক
বোধ আর সুচেতনা কবিতা দুটিতে আমরা
টের পাই।

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে…

স্বপ্ন-ইচ্ছের দাসত্ব চিন্তক করেন না।
চিন্তকের মধ্যে বোধ জন্ম নেয়।
কার কে চিন্তক?
আমরা ফিরে যাই আবার সেই মূল জায়গায়।।
চিন্তা পঙ্খিরাজ ঘোড়া নয়
যে পৃথিবীকে ভুলে মহাশূন্যে পাড়ি জমায়;
চিন্তা পাখির মতো
যে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার সময়ও
মাটির দিকে চেয়ে থাকে।

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?

তিনি শুধু মানুষ নন, মানুষের অন্তর্গত বীজ চেনেন:
যে বীজ ব্যক্তি হয়, রাজ্য গড়ে, সাম্রাজ্যের মতো কোন ভূমা চায়।
তিনি জানেন রাজনীতির চক্র
যেখানে ব্যক্তির দাবিতে সাম্রাজ্য কেবলই ভেঙে গিয়ে
তার’ই পিপাসায় গড়ে ওঠে।
কিন্তু চিন্তক তিনি এটা জেনেও এই সীমাকে অত্রিকম করে
কোন এক উজ্জ্বল সময়স্রোতে অমল রাজনীতি, নির্মল জননীতির
সন্ধান করেন।
তিনি অলীক নন, তিনি চিন্তক
তাই তিনি জানেন
সেই স্রোত আজো এই শতাব্দীর নয়।
সকলের তরে নয়।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

তবু শব্দটা চিন্তকের আরেক বাহন।
তবু শব্দটা বিশ্লেষণ করলে পাই
আমরা মানছি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
সামনে আরও কিছু আছে।
যা এখন দেখা যাচ্ছে না
কিন্তু আছে।
বস্তুকে মানছি কিন্তু এর ভেতরের সম্ভাব্যতাকে আবিষ্কার করছি।
সুচেতনা কবিতায়
এটি খুব ভাল করে ধরা পড়ে।
কী বাস্তবতা?

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;

আমরা ভালবাসি
ভালবাসে যা সদর্থক করি
তার অনিবার্য ফল হিসেবে
ঘটে যায় অমঙ্গল কিছু।
ভাল আর মন্দ আলাদা নয়?
এটা একই সঙ্গে বিরাজমান।
পৃথিবীতে একদিকে যখন আলো
অন্যপাশে ঠিক তখনই যেমন অন্ধকার তেমনই।
সুচেতনা কবিতায় লিখছেন জীবনানন্দ
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
সভ্যতা গড়েছি আমরা। শিকারের জীবন ছেড়ে
ফসল ফলিয়েছি, যাত্রা করেছি ফসলের জাহাজ নিয়ে বন্দরে বন্দরে।
এর সাথে জন্ম নিয়েছে শোষন।
লাভের ফসলে মিশে থাকে কৃষকের শ্রমভেজা রক্ত
এইতো সভ্যতা।
আমরা একে অস্বীকার করতে পারি
বলতে পারি এই সভ্যতা আমার নয়
কিন্তু এ হবে কল্পনা।
অলীক।
যদি বুঝে যাই, এটাই বাস্তব
তবে আমরা কী করবো।
কিছুক্ষণ-

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক ক’রে রাখে;

আমরা চুপ হয়ে যাবো।
মনে হয়
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
তবু- এই চিন্তক আমরা
কিন্তু ঠিকই শুনতে পারবো
অস্বীকার করতে পারবো না
চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
এ নিরবতা পালিয়ে যাওয়া নয়
এটাই চিন্তাশীলতা।
এই চিন্তা আমাদের দেখাবে
অতিক্রমের পথ।
হয়তো সেটা এখনই ঘটবে না
সেই পথ পাড়ি দিতে হবে অনেক শতাব্দী ধরে।
জীবনানন্দের ভাষায়
অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ এটা।
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
চিন্তকের তাই রেহাই নেই।
হাজার বছরের যাত্রাপথে
অন্ধকারে ডুবে যাবে জেনেও
তাই প্রতিদিন যে সূর্য ওঠে
তার মধ্যে তিনি দেখতে অনন্ত সূর্যের আহ্বান।
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
চিন্তা এক সমুদ্রের মতো
হতে পারে
কোথাও তরণী চলে গেছে আকাশ রেখায় – তবে
এই কথা ভেবে…
চিন্তা তাকে নিয়েই চলে
ক্লান্তি জমলেও
তাকে যেতেই হয়।
হয়তো কোথাও কোন বনলতা সেন
দুদন্ড শান্তি তাকে দেবে
কিন্তু… তবু…
চিন্তা চলতেই থাকে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।