Its good... Be back home again'- ডেনভারের গানে এক ফেরারীর বাড়ি ফেরা

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: রবি, ১২/০২/২০২৩ - ২:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Its good... Be back home again'
গানটা বাজছে।
শিমুলকে টের পাচ্ছি। ও এসেছে।
ওর ডাকাতদলের বারো জনের সবার মুখ মনে পড়ে গেল।
long long lost friends!
মনে পড়লো সুন্দরবনের নৌকার জীবন,
চিঙড়ি ঘেরের মাচাঙ, জঙ্গলের মাঝখানে গোলপাতার ডেরা।
প্রায় চল্লিশ দিন আমি শিমুলের ডাকাত দলটার সাথে ছিলাম।
মানুষ কত কারণে ভালবাসে।
আমাকে ওরা ভালবেসেছিল,
ভদ্র সমাজের একজন হয়েও আমি ওদের ঘৃণা করিনি দেখে।
একদল মানুষের ওপর চড়াও হয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া ডাকাত-
নেশায় বুঁদ হয়ে নিজেকে নষ্ট করে দেয়া মাতাল নেশারু,
টাকা আর চাবুকের জোরে মেয়েদের দাসী বানানো মানুষগুলোকে-
কোন ভদ্রলোক ভালবাসবে?

আমি কি ওদের ভালবেসেছিলাম?
হ্যাঁ- বেসেছিলাম। অনেক রকম ভালবাসা আছে জীবনে।
মায়াও একরকম ভালবাসা।
একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল ওদের ওপর।

প্রাচীন প্রবাদে আছে,
কারও সাথে চল্লিশ কদম হাঁটলেই তুমি তার বন্ধু হয়ে যাবে।
আমি ওদের মধ্যে যখন আসি, আমি ওদের ঘৃণা করিনি,
এটাই ছিল ওদের জন্য বিশাল ভালবাসার হ্রদ।
সবার ঘৃণা পেতে পেতে ওরা ভালমানুষদেরও ঘৃণা করতে শুরু করেছিল।
আমরা ভুল পথে চলে এসেছি বলে
যদি আমাদের শুধু ঘৃণাই করবেন-
সারাজীবনের জন্য
তাহলে আমরা ভাল হবো কেমন করে?
সমাজের ভাল মানুষেরা আসলে স্বর্থপর;
ওরা বলতো।

ওরা বলতো। আমি শুনতাম।
এই ছিল আমার কাছে ওদের আর ওদের কাছে আমার অস্তিত্ব।
ওদের প্রত্যেকেরই নিজের একটা গল্প ছিল,
সারা জীবন ধরে যেটা তারা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল।
গল্পগুলো ছিল আলাদা আলাদা কিন্তু
গল্পটা মিলে গিয়েছিল একই জায়গায়।
আর প্রত্যেক মানুষের মতোই
সেগুলো ছিল হাসি-কান্নায়- স্বপ্নে আর হতাশায় ভরা
রাগে গণগণে। আগুনের মতো।

বোরহেসের একটা গল্প আছে। মার্কের সুসমাচার।
দূর্ভাগ্যের মধ্যে ডুবে থাকা
দলিত অন্ত্যজ ধর্মহীন এক অন্ধকার জনগোষ্ঠীর মাঝে
একজন শিক্ষিত তরুণ হাজির হয়।
ছেলেটা তাদের বাইবেলের মার্কের অংশটা পড়ে শোনায়।
যিশু সবার পাপকে নিজে বহন করে
সবাইকে মুক্তি দিয়ে গেছেন।
সেই দূর্ভাগ্যপীড়িত মানুষেরা
ভাবে, একজন যিশু নেই বলে
তাদের দূর্ভাগ্যের শেষ হয় না।
শেষে সেই দলের মানুষরা
ছেলেটিকেই যিশু জ্ঞান করে
তাকে ক্রশবিদ্ধ করতে নিয়ে চলে...
আর তাদেরও পাপ থেকে উদ্ধারের জন্য
একজন যিশু প্রয়োজন।

ওদের যিশুর দরকার ছিল না,
কিন্তু একজনকে দরকার ছিল,
যেই পথ ধরে তারা আজ
জীবনের এই অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছে
নিজের ভেতরের বয়ে নিয়ে চলা কথাগুলো
যাকে তারা বলতে পারে।

এটা খুব অদ্ভুত
সবাই নিজের নিজের কৃতকর্মের বয়ান দেয়ার সময়
এমন একটা জায়গায় চলে যায়,
সে যেন সে নয়, সে নিজেকে দেখে
প্রকৃতির একটা অংশ হিসেবে।
সে নিজে অপরাধের পথে আসে নি
তার চারপাশ তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে।
আমি বুঝতে পারি,
মানুষ এরকমই। নিজের দায় নিজে নেয় না।
স্বীকারোক্তির মতো সব বলে চলে ওরা
বুঝতে পারি, ওরা হালকা হয়ে ওঠে।

এই লেখাটা লিখছি, ডেনভারের একটা গানের সূত্র ধরে।
এই Its good, be back home again
সেই সময়, ওদের আখড়ায় বসে
আমি একদিন ওয়াকম্যানে শুনছি।
সন্ধ্যা নেমেছে জঙ্গলের ওপর।
সন্ধ্যা তারা জ্বলজ্বল করছে মাথার ওপর।
শিমুল বোতল বের করে চুক চুক করে মদ খাচ্ছে।
আমিও মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছি।
আজ রাতে কোথাও যাবে ওরা।
জিজ্ঞেস করি নি। কিন্তু বুঝতে পারছি,
কোন ঘের এর চিংড়ি লুঠের কাহিনী হবে।

শিমুলের মা যশোর সরকারী কলেজের ইংরেজি পড়াতেন, বাবা এঞ্জিনিয়ার।
সে নিজে ইশকুল পর্যন্ত খুব ভাল ছাত্রই ছিল।
প্রেমের অন্য রকম একটা গল্পে উড়াল দিয়ে
সে ফেরারী হয়ে বাড়ি ছেড়েছিল পাঁচ বছর আগে।
আজ সে ডাকাত দলের সর্দার।
সে গল্প বাড়ি ছাড়ার গল্প, আজ নয়।
আজ ডেনভারের গান আর শিমুলের বাড়ি ফেরার গল্প।

গানটা বাজছিল।
গানটা শেষ হলে শিমুল গানটা আবার বাজাতে বললো।
গানটা চুপচাপ শুনে গেল। কয়েকবার।
এরপরে রাত আসলো। শিমুল সাতজনের একটা দল বের হলো।
পাঁচ জন থেকে গেল আস্তানায়। তিন দিন পর শিমুলরা ফিরলো।
সবাই না। আদম নামে একজন ছিল,
ও গুলি খেয়েছে তাকে কোথাও রেখে এসেছে।
আমার ভয় দেখে, হেসে জানালো- ভয় নেই, মারা যাবে না।
কিন্তু ওর মুখ দেখে আমার মনে হলো কিছু লুকোচ্ছে।

তবে আমার ভয়টা ভুল ছিল। আদম মরে নি।
ও মারা গিয়েছিল তার আরও বছর ছয়েক পরে।
আমি খবর পেয়েছিলাম তারো বছর ছয় পরে।
শিমুলের কথাও জেনেছিলাম।
পুলিশের গুলিতে নদীর বুকে তলিয়ে গিয়েছিল ও।
হোসেনের কাছ থেকে শুনে
চুপচাপ বসে ছিলাম অনেকক্ষণ।
ওর মুখটা মনে পড়ছিল শুধু।

শিমুলরা ডাকাতির অভিযান শেষে
ফিরে এসেছিল সেদিন অনেক রাতে।
সবাই নিজের জায়গায় ঘুমুতে যাওয়ার পর
কাছে এসে বললো, বাড়ি যাবো।

আমি অবাক।
শিমুল বাড়ি ছেড়ে এসেছে চির জীবনের জন্য।
ওখানে আর তার যাওয়া হবে না।
ওর কোন স্থান কখনও হবে না সেখানে।
এমনকি মায়ের কাছেও।
তাহলে ও বাড়ি যেতে চাইছে কেন?
আমার অবাক দৃষ্টি দেখে ও হাসে।
উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলে।
ঐ যে গানটা শুনছিলে-
Be back home গানটা বাজাও।
ওই গানটা শোনার সময় মনে হচ্ছিল
আমি বাড়িতে চলে গেছি।
বাড়ি যাওয়া হবে না কখনও-
কিন্তু ঐ গানটা আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে।
আমি গানটা বাজিয়ে দেই

There's a storm across the valley, clouds are rollin' in
The afternoon is heavy on your shoulders
There's a truck out on the four lane, a mile or more away
The whinin' of his wheels just makes it colder
… He's an hour away from ridin' on your prayers up in the sky
Ten days on the road are barely gone
There's a fire softly burning, supper's on the stove
It's the light in your eyes that makes him warm
… Hey, it's good to be back home again
Sometimes this old farm feels like a long lost friend
Yes, and hey, it's good to be back home again
… There's all the news to tell him, how'd you spend your time?
What's the latest thing the neighbors say
And your mother called last Friday, sunshine made her cry
You felt the baby move just yesterday
… Hey, it's good to be back home again, yes it is
Sometimes this old farm feels like a long lost friend
Yes, and hey, it's good to be back home again

গানটা ও শুনতে থাকলো।
আর চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে লাগলো কান্না।

ওদের ওখান থেকে যখন চলে আসি
শিমুল আমাকে নৌকা করে মঙলাতে নামিয়ে দিতে এসেছিল।
বানিয়াশান্তার কামনাবিধূর পল্লীর চকমকিতে হারিয়ে যাবে ওরা।
আর আমি ফিরে আসবো আমার বাড়িতে।
আসি-
শিমুলের চোখে জল।
আমি জড়িয়ে ধরি।
ফিসফিস করে বলে
আমার ফেলে আসা বাড়িটা ফিরিয়ে দেবে না?
বুঝতে পারি, ও ডেনভারের গানটা চাইছে।
ক্যাসেটটা বের করে ওকে দেই।
আবার জড়িয়ে ধরি।

চলে আসতে আসতে দেখি
দূরে- আরও দূরে ছোট হয়ে আসছে।
আমারও কান্না পায়।
কান্না পাড়ি দিয়ে চলে আসি; যেমন আসি প্রতিবার।
its good be back home.

গানটা বাজছে।
… It's the sweetest thing I know of, just spending time with you
It's the little things that make a house a home
Like a fire softly burning and supper on the stove
The light in your eyes that makes me warm
… Hey, it's good to be back home again
Sometimes this old farm feels like a long lost friend
Yes, and hey, it's good to be back home again

শিমুলের ঘরের জানালাটা দিয়ে অনেক দূরের আকাশ দেখা যায়।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
একটা পাখি- ডানা মেলে ভেসে আছে।
পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকি
টের পাই, শিমুল এসেছে।
বাতাসে ভর করে কাঁধের কাছটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
চোখ বন্ধ করে ওকে দেখি।

যতবার এই গানটা বেজে ওঠে
ততবার এমন হয়।
এই গানটাই ওর বাড়ি কি না-


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।