মানুষ সংস্কারা : মানবজীবনের পাঠশালায়

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শনি, ২৬/০৩/২০২২ - ৯:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোর আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আপনায়...

নিজের চেয়েও যে আপন-
সে কেমন আসলে?

মানবজীবন যখন পাঠশালা
সেই পাঠশালায় পড়াশোনা কেমন হয়-
তা বোঝাতে সাধু কাজী নজরুলকে ডেকে এনেছেন।
কাজী নজরুল সেখানে পড়েছেন।
নিজের ভেতরকে জেনেছেন।
ভেতরের আমিকে খুঁজেছেন।
খুঁজতে খুঁজতে
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
নিজেকে আবিষ্কার করেছেন
চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
এই হলো ভেতর আর বাইরের খেলা।
এটা মেলাতে হয়।

যখন বাইরের বিদ্যালয়ে পড়ছি
ভেতরের সাথে মিলছে না।
কিন্তু অন্তরে পড়াশোনা করলে
বাইরের সাথে মিলে যাচ্ছে।
ভেতরে বাইরে মিল না হলেতো
দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

এই দাঁড়ানোটো কীরকম?
এর একটা উদাহরণ খুঁজে পাই
জাপানে।
গত শতকের পঞ্চশের দশকে জাপানে
আদমশুমারীর তথ্যমালায় একটা অবাক করা বিষয় সবার নজরে এলো।
সেখানকার এক গ্রামের গড় আয়ু আশেপাশ থেকে প্রায় দশ বছর বেশি।
কেন?

উত্তর খুঁজতে গবেষক দল গেলেন সেই গ্রামে।
সেখানে পৌঁছে সবাই ঠিক করলেন
সবাই একা একা গ্রামটাতে ঘুরে দেখবেন
তারপর রাতে একসাথে বসে
নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো বিনিময় করবেন।
তারা সারাদিন ঘুরে বেড়ালেন।
গ্রামের মানুষের সাথে কথা বললেন।
তারপর ফিরে যখন একসাথে বসলেন
দেখা গেল, কেউ ঠিক কারণটা খুঁজে বের করতে পারেন নি।
এমন নয় সেখানকার জলবায়ু অন্য এলাকাগুলো থেকে অনেক স্বাস্থ্যকর।
এমন নয় সেখানে খাবার মানুষ গ্রহণ করে তা বেশি পুষ্টিকর।
তাহলে?
উত্তরটা খুঁজে বের করতে না পারলেও
একটা অভিজ্ঞতা সবার মিলে গেল।
এই গ্রামের মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে খুব সুখি।
তারা এটুকু বুঝতে পারলেন
তাদের এই সুখি জীবনেই আছে
এই দীর্ঘ জীবনের রহস্য।
এরপর তারা খুঁজতে শুরু করলেন
কেন তারা সুখি?

অনেকদিন তারা এই উত্তর খুঁজলেন।
আলাদা করে ভাববার মতো কিছুই তারা খুঁজে পেলেন না।
শুধু একটি বিষয় ছাড়া।
সেই গ্রামে লোকায়ত একটি শিক্ষা আছে।
আর কোথাও এই শিক্ষাটা দেয়া হয় না।
শৈশবে- ছোটবেলাতেই যখন বোঝার শুরু
তখন বাচ্চাদের চারটি প্রশ্ন শিখিয়ে দেয়া হয়।

১. তার কোন কাজ করতে ভাল লাগে?
২. সে কোন কাজ ভাল করে করতে পারে?
৩. কোন কাজ করে সে জীবিকা অর্জন করবে?
৪. কোন কাজ করে সে মানুষ, পৃথিবী আর প্রকৃতির উপকার করবে?

প্রশ্নগুলো শিখিয়ে তাদের বলা হয়
এই চারটি প্রশ্নের উত্তর একদিনে তারা পাবে না।
বড় হতে হতে উত্তরটা তারা খুঁজে বের করবে।
এই উত্তর মেলাবে।
এই উত্তর মেলানোর একটা নিয়ম আছে।
এই প্রশ্নের উত্তর যার যত বেশি হবে, সে তত দুখি।
আর প্রশ্নটার উত্তর যত কম, সে তত সুখি।
যার ভাল লাগে একটা, ভাল পারে আরেকটা,
জীবিকা অন্যটা, আর মানুষের ভাল করতে চায় আলাদা কিছু করে
তার জীবনে দুঃখের শেষ নেই।
যার চারটা প্রশ্নের উত্তর একটাই- সেই সবচেয়ে সুখি।
তার যা ভাল লাগে, তাই সে করে।
করতে ভাল লাগে বলে,
কাজটা করলে সেটা ভাল হয়।
আর যে কাজ একজন ভাল করে করতে পারে
সে কাজটাই যদি জীবিকা হয়,
তাহলে জীবিকার পথটাও সুন্দর হয়।
আর সে কাজটা যদি
মানুষের ও পৃথিবীর জন্য উপকারী হয়
তবে জীবন স্বার্থক হয়।সুন্দর হয়।
সে সুখি হয়। আনন্দিত হয়।

এই হলো ঐ গ্রামের সবার সুখি হওয়ার গল্প।
গল্পটা শেষ সাধু চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন
কাজ কী, বলতে পারবেন?
এই যে করা করা বলি, এটা কী?
কী করি আমরা?
দম বন্ধ করে গল্পটা শুনছিলাম।
প্রশ্নটার সাথে সাথে জানালাটা খুলে গেল
আর মিষ্টি একটা হাওয়ার মতো
রবীন্দ্রনাথ এসে হাজির হলেন।

কাজ? কাজ হলো ভেতরের মুক্তি।
আমার ভেতরে আমি আটকে থাকি।
কাজ হলো
আমির সেই খোলস ছেড়ে
পৃথিবীর সাথে এক হওয়া। মেলা।
কাজের ভেতর দিয়ে
জগতকে আমি গ্রহণ করি
আমাকে জগত গ্রহণ করে।
সীমাবদ্ধ আমি অসীম হয়ে উঠি।
সেইতো মানুষের কর্ম
অসীম হয়ে ওঠা।
সেইতো মানুষের ধর্ম
অসীমের সাথে মেলা।
কৃষক বীজ বোনে
পৃথিবী শস্যে ভরে ওঠে
সেই শস্য গ্রহণ করে আমরা গান গেয়ে উঠি
সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

কাজ হলো আমার মুক্ত প্রকাশ- বিশ্ববীণার সুর
যা আমি করি, কিন্তু যার ফল
শুধু আমার নয়, যার ফল বিশ্ব প্রকৃতির।
আর তা যদি না হয়
যে কাজের ফল শুধু তোমার
তবে তাকে কাজ বলো না।
বলো তোমার বন্দিত্ব-
তোমার খোলসের মাঝে
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর মতো...
রবীন্দ্রনাথকে দেখি-
শব্দগুলোর মধ্যে জেগে উঠি।
সাধুকথা এমনই,
আমরা জ্বলে উঠি
প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলে ওঠে যেমন করে।


মন্তব্য

করবী মালাকার এর ছবি

ভাল যে লাগে অনেক কিছুই। ভাবছি অন্তত আজকের দিনের জন্য কেবল এই পড়াটাই ভাল লাগুক। হো হো হো
ভাল লেগেছে লেখাটা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।