শহর, পাখি আর একটি মেয়ের গল্প

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৮/২০১৫ - ১১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“টুকু... টুকুটু... এই কুটু...”
দুষ্টু পাখিটা আবার ডেকে উঠলো।
এবার মনে হলো মাথার ঠিক উপরে। ছেলেটা পাখিটাকে খোঁজে।
ঝিরি ঝিরি বাতাসে পাতাগুলো দুলছে। পাখিটার দেখা নেই। “টুটুটুটুটু কুকুকুকু।” আবার ডাক। এবার আরেক জায়গা থেকে। একটু দুরে। সেই প্রথম দিন থেকে পাখিটা ওর সাথে লুকোচুরি খেলছে। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। ওর নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছে, কিন্তু দেখা দিচ্ছে না।
“হতচ্ছাড়া!” বকে ওঠে ছেলেটা।
কাল থেকে দেখবো, কাকে ডাকিস।
টুকুকুকু... পাখিটা মনে হলো ওকে ভেঙালো। যাও না চলে! তাতে আমার বয়েই গেছে। ছেলেটা উদাসভাবে আর একবার পাখিটাকে খুঁজলো। নেই। মর তুই! ছেলেটা মেয়েটার কথা ভাবতে শুরু করলো আবার।
ও কি আজকে আসবে? যদি না আসে?
কাল সে এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মেয়েটাকে আর দেখা হবে না।
মেয়েটার কি তাঁকে মনে পড়বে? ছেলেটা মেয়েটার কথা কল্পনা করে...
মেয়েটা পার্কে এসেছে। তাঁকে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। শেষ র্পযন্ত মেয়েটা হতাশ হয়ে চলে গেল। তারপর আরেকদিন। সেদিনও সে তাঁকে খুঁজতে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে খুঁজে পেল না।
এরপরও কি মেয়েটা তাঁকে আর খোঁজ করবে?
ছেলেটা নিজেই মাথা নাড়ে। না। দেখা না হতে হতে মেয়েটা তাঁর কথা ভুলে যাবে। এক সময় সে যে ছিল, মনেও পড়বে না। মনতো এরকমই। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়। সেই সকাল থেকে মেয়েটার জন্য বসে আছে সে। যদি সে আসে। এসে যদি তাকে না দেখে ফিরে যায়।
অপেÿা করতে থাকলেও মানুষের চোখ বন্ধ হয় না। সে মেয়েটার জন্য বসে থাকতে থাকতে এমনিতে যা চোখে কিংবা কানে ঢুকতো না, এরকম কিছু দৃশ্য দেখে ফেললো, কিছু শব্দ শুনে ফেললো। দেখলো-
ঝলমলে একটা ছেলে আর মেয়ে। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওরা পৃথিবীর আর কিছুই দেখছে না। শুধু ওদেরই দেখছে। ওরা জীবনে এই প্রথমবার প্রেম করতে এসেছে। চুমুটাও খায় নি এখনও। একটা চুমু খাবে- যদিও প্রকাশ করতে চায় না, দুজনেই আসলে গোপনে গোপনে সেই মুহূর্তটার তালে আছে। কিন্তু কিছুতেই মুহূর্তটা আনার জন্য ওরা দুজনেই নানা বাহানা বানাচ্ছে। হতে হতেও ব্যাপারটা হচ্ছে না। একটুর জন্য বারবার পিছলে যাচ্ছে। ভারী এক মজার কান্ড। শেষ পর্যন্ত মুহূর্তটা এলো। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের জন্য দুজনের ঠোট এক হলো। যেন এমনিতেই। বাতাসে ধূঁলো উড়বার মত। তারপর সরে গেল দুরে। ভাবখানা এমন, এমনটা যে ঘটে গেল পৃথিবীতে, ওদের কেউ এটা জানেই না।
কিন্তু সেই ছেলেটা দুর থেকে ঠিকই খেয়াল করেছিল, মুহূর্তটার ঠিক পরে- যখন ঠোঁটগুলো আলাদা আলাদা হয়ে গেল- মেয়েটার ঠোটজোড়া আবার ফাঁক হয়ে গেল। ঠিক চুমুর মত। কিন্তু অন্য ঠোঁটজোড়ার স্পর্শটা পেল না। অতৃপ্তিটা জমা রাখলো ভবিষ্যতের জন্য। আর ছেলেটা মাথা নিচু করে থাকলো খানিকÿন। লাজুক লাজুক একটা অপরাধী ভাব। কিন্তু ঠোটের কোণায় জমাট একটা হাসি।
ওপাশে ওর নজরে এলো আর একটা জোড়। একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। পাশাপাশি। কিন্তু তারপরেও একটা ফাঁক। বাতাস বয়ে যেতে পারে এরকম একটা দূরত্ব। দুজনের মুখই গম্ভীর। মূর্তির মত। চুপচাপ বসে আছে। যেন কারও কোন কথা নেই। মাঝে মধ্যে দু একটা কথা বলে ওঠে ঠিকই, কিন্তু বোঝা যায় এগুলো বলার জন্য বলা। ওদের কথাগুলো আসলে ফুরিয়ে গেছে আগেই।
বসে বসে দুজনে আকাশ দেখলো, গাছের পাতা দেখলো। মেঘ দেখলো, আকাশের পাখি দেখলো। ঘাস, ফড়িং আর ফেলে দেয়া বাদামের ঠোঙাটা পর্যন্ত মন দিয়ে দেখলো। একবার অবশ্য ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরলো। কিন্তু ধরার ঢংটাই বলে দেয়, ধরাটা আসলে ধরা নয়। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ধরার জন্য ধরেছে। মেয়েটাও যে হাত ছাড়িয়ে নিল না, এটার মধ্যেও ছিল হাতটা সরিয়ে নেয়ার মত একটা ব্যাপার। খানিকÿন এভাবেই থাকলো। শেষে মেয়েটা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল ঠিক করার জন্য হাতটা উঠালো, ছেলেটা মনে হলো বেঁচেই গেল।
সবসময় অবশ্য এরকম ছিল না। একটা সময় মেয়েটার চোখদুটো জলে ভরে উঠেছিল। কিন্তু মুখটা দেখাচ্ছিল ঠিক পাথরের মত। কান্নাটা যে কারণে সেই কারণটা মুছে ফেলার কোন ইচ্ছেই ওই মুখে নেই। ছেলেটা একবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েটা নিজেই চোখের জল মুছলো। কয়েক মুহূর্ত লাগলো নিজেকে সামলাতে। তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো, এভাবে চলে না। ছেলেটা হাসলো। মনমরা হাসি। সেও বললো, ঠিক তাই। আমরা আসলে কখনও এক হতে পারি নি।
দেখা গেল, ওদের কথাগুলো শেষের জন্য অপেÿা করে ছিল। দুজনেরই মনে হলো, ওরা যদি একসাথে থাকে তাহলে এর পরিণতি হবে একে কারো একজনের অন্যের হাতে খুন হয়ে যাওয়া অথবা নিজেকে ঝুলিয়ে দেওয়া। এর চেয়ে ভাল দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়া। সম্পর্কের বোঝাপড়া শেষ করে দুজনে দুজনের দিকে একবার তাকালো। তারপর দুই দিকে চলে গেল। ফিরেও চাইলো না।
ওপাশে পার্কের সবচেয়ে পুরনো গাছটার গোড়ায় এক জুটি এসে বসলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা অনেÿন। কিন্তু কেউ কারো মুখটাই দেখতে পারলো না। অদ্ভুৎ ব্যাপার। দুজনের মুখেই মুখোশ। কিন্তু ওদের দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল, মুখোশের আড়ালে ঢাকা থাকলেও ওরা একে অন্যকে অনুভব করতে পারছে নিজের চেয়েও বেশি। যদিও এই অনুভবের কোন শরীর ছিল না। এটা ছিল বাতাসের মতন। অশরীরীর মতন। আসলেই কিন্তু তাই। ওরা আসলে এই পৃথিবীর কেউ ছিল না।
ওরা ছিল প্রেমের ভূত। বিশ বছর আগে ওরা এই গাছের নিচ থেকে বিদায় নিয়েছিল। একটু আগের প্রেমিক প্রেমিকার মতন। যে যার পথে। কিন্তু বিদায়টা আলাদা ছিল। বিদায় নেয়ার আগে ওরা দুজনে দুজনকে একটা কথা দিয়েছিল।
যেখানেই যাক- ঠিক কুড়ি বছর পর, এখানে তাঁরা আবার দেখা করবে। এটাই হবে তাঁদের জীবনের শেষ দেখা। ওদের যখন প্রথম প্রেম হয়, এক ফেরীওয়ালার কাছ থেকে দুজনে নিজের নিজের পয়সায় দুটো মুখোশ কিনেছিল ওরা। একে অন্যকে উপহার দিয়েছিল। ঠিক করে ওরা - যেদিন ওদের দেখা হবে সেদিন ঐ মুখোশগুলো পড়ে ওরা আসবে। দেখা হবে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখবে না। আজকে সেই দিন। ওরা এসেছে। খানিকটা সময় চুপচাপ কোন কথা না বলে পাশাপাশি বসে থাকলো। কতÿন গেল, সময়ের হিসেব ছিল না। তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে গেল। আলাদা আলাদা।
সবাই আসে। শুধু ওই আসে না। টুটুটুটু। টুকুকুটু। তাই বলে কান্না কওে দিও নানা বাপু। পাখিটা বকবক শুরু করে।
ভারী নচ্ছার পাখিতো। ছেলেটা রেগে ওঠে। মেয়েটা আমার কে এ্যা! যে ওর জন্য আমার কাঁদতে হবে।
আসলেই কে ওঁ? একবারই মাত্র দেখা। কয়েকটা কথা। ব্যাস। এইতো। এর চেয়ে বেশি কিছুতো নয়। তাহলে কাঁদবে কেন ও ওঁর জন্য?
ঐ একটা কথার জন্য। আবার মনে পড়ে ছেলেটার।
নতুন বুঝি?
চমকে তাকিয়েছিল ছেলেটি। একটা মেয়ে দাড়িয়ে হাসছে। হাত ভর্তি রঙবেরঙের ফুল। চমকে উঠেছিল ও। নিজের হাত মাটিতে নোংরা হয়ে আছে। মেয়েটা ওর অবস্থা দেখে হেসেই বাঁচে না।
হাসছো কেন?
তোমার অবস্থা দেখে। আবার হাসতে শুরু করে। জোরে না অবশ্য। মুখ টিপে টিপে।
ছেলেটা বোকার মত বসে থাকে। বুঝতে পারে না কি বলবে। কোন মেয়ে তার সাথে কখনও এইভাবে কথা বলে নি। শহর তাহলে কি এরকমই?
“আজকেই এসেছো”- মেয়েটার ভ্রæ নেচে ওঠে। “ঠিক না?”
“কি করে বুঝলে?” মেয়েটা ছেলেটার কথায় আবার হাসে। হাসির রোগ আছে মনে হয় মেয়েটার। “তোমার গা থেকে গন্ধ ভেসে আসছে। মাটির গন্ধ। কিছুদিন থাকলে এই গন্ধ থাকবে না। ওখান থেকে পেট্রোলের গন্ধ বের হবে।”
ছেলেটা গন্ধ শোকার জন্য নাক খাড়া করে। মেয়েটা এবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে- “আমার গা থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসে গো। চাষের ফুলের গন্ধ। হিহিহিহি।”
এই দিয়ে কথার শুরু।
“ঘাস বুনার কাজই করবে?”
“জানি না।”
কাজটা অবশ্য খুব ভাল। পার্কটা একদম মরে গ্যাছিল। এখন আবার তাঁজা হয়ে উঠবে।
ছেলেটা মাটিতে হাত ছোঁয়ায়। নরম আর ঠান্ডা। ভেঁজা ভেঁজা। আর কি সবুজ।
সত্যিই। কদিনেই পার্কটা তাঁজা হয়ে উঠেছে। যেন ষোলো বছরের মিষ্টি একটা মেয়ে। একটা রিনরিনে বাতাস ওকে ঘিরে সবসময় বইছে। অথচ কদিন মাত্র। বিশ দিনও হয় নি। ও যখন এসেছে, পার্কটার দিকে তাকানোই যেত না। মনে হতো খনখনে একটু বুড়ো। বিবর্ণ। মাঠতো না, যেন রুÿ পাথুরে প্রান্তর। এখানে ওখানে কয়েক গোছা ঘাস, ধুঁকতে ধুঁকতে কোনভাবে মাথা উঁচু করে আছে। পুরো পার্কজুড়ে অনেকগুলো ফুলগাছের ঝাঁড়। নানান রঙের ফুলও ধরেছিল বেশকিছু গাছে। কিন্তু অমন রঙদার গাছগুলোও মনে হচ্ছিল মলিন। ফ্যাঁকাসে। আর ময়লা। একটা কোম্পানী এই পার্কটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়ার কাজ নিয়েছিল। ছেলেটার গ্রামের এক বড়ভাই সেই কোম্পানীতে কাজ করতেন। বাবা হটাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর লেখাপড়ার ইতি ঘটেছিল। গ্রামে এটা ওটা কাজ করে মা আর ছোটবোনের সংসার চালানোর দায়িত্বটা ওর কাঁধেই চেপেছিল। তাই সেই ভাই এসে যখন বললেন, ‘শহরে যাবি। শহর! ওখানে অনেক সুযোগ। বড় হতে পারবি। যাবি তো বলিস।’ সে রাজী হয়ে গিয়েছিল কোন কিছু না ভেবেই।
অনেক গল্প শুনেছে সে শহরের। গল্পগুলো শুনতে শুনতে অনেকবারই মনে হয়েছে, যাবে। গিয়ে দেখে আসবে একবার। ভাই তাকে নিয়ে এলেন সেই শহরে। শহরে মানে - সোজা এই পার্কে। ঘাস লাগানোর কাজে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, শুরু কর। এই শহরে থামা বলে কিছু নেই। টানা কুড়ি দিন। এর মধ্যে অন্য কোথাও যাওয়া হয় নি। এই পার্কের মধ্যেই শহরটাকে যতটুকু দেখেছে। কিন্তু তাতেই বুঁঝে গেছে, এখানে তার হবে না। ঘাস লাগানোর কাজটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বড়ভাই তাঁকে আরেকটা কাজের কথা বললেন। কিন্তু সে কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়েছিল।
“কি? কিছু বলবি?” সে নিচু স্বরে ভাইকে জানালো, “সে আর এখানে থাকতে চায় না। গ্রামে ফিরে যেতে চায়।”
কেন, বড়ভাই শুনতেও চান নি। কুড়িদিনের মজুরীর টাকাটা ছুড়ে ফেলে বলেছিলেন, “যা গ্রামে গিয়ে মরগে।”
“গ্রামে গিয়েই মরবো”, মনে মনে বলেছিল ও।
কালকে তাঁদের গ্রামের কয়েকজন ছুটি কাটাতে বাড়ি যাবে। সেও তাঁদের সাথে যাচ্ছে। মেয়েটা...
টুংটাং টুংটাং। মিষ্টি একটা নিররিনে শব্দে ছেলেটার ঘোর ভাঙে। আইসক্রীমের গন্ধ মাখানো। দুরে চেয়ে দেখে। একটা বড় গাছের ছায়ায় আইসক্রীমওয়ালা ঠায় দাড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে অলসভাবে ঘন্টিটা নাড়াচ্ছে। মেয়েটা যদি আসে একসাথে আইসক্রীম খাওয়া যেত। আর খাওয়ার ফাঁকে টুপ করে বলে দেয়া যেত, “তুমি কি আমার সাথে যাবে?” কিন্তু সে কি আসবে..
“তোমাকে আমার ভাল লেগেছে জানো” - মেয়েটা বলেছিল। ছেলেটাকে কখনও কেউ এসব কথা বলে নি। ওর মনে হচ্ছিল, ও মাটির পৃথিবীতে নেই। আকাশে উড়ছে। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারে নি। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়েছিল।
মেয়েটা একটা টকটকে লাল রঙের ফুল ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, “কেন ভাল লেগেছে জানো। তোমার গায়ে মাটির গন্ধ লেগে আছে।”
বলেই মেয়েটা অস্থির হয়ে ওঠে। দাঁড়াও। দাঁড়াও। হাতের ফুলগুলো একটু বেচে আসি। তারপর তোমার সাথে অনেক কথা আছে। বলে আর অপেÿা করে না। দৌঁড়ে চলে যায়।
আর সে মেয়েটার জন্য অপেÿা করতে শুরু করে। ঘাস বুনতে বুনতে ধূলোভর্তি পাথুরে মাটি সবুজ ঘাসে ভরে উঠে। অনেকদিনের জমে থাকা ধূসরতা ঢেকে সজীব সতেজতা পুরো পার্ক জুড়ে হাসতে শুরু করে। এরপর কুড়িটা দিন। মেয়েটা আসছি বলে সেই যে গেল আর আসলো না।
কুটুকুটুৎকু। সূর্য ডুবতে চললো।
“মেয়েটা মনে হচ্ছে আর আসছে না।”
“তাতে তোমার কি? নিজের চরকায় তেল দাও।” ছেলেটা বলে ওঠে।
“আহহা। চলেইতো যাচ্ছো। যাওয়ার আগে একটু মিষ্টি করে কথা বললে কি হয়।” পাখিটা বলে ওঠে।
আশ্চর্য্য। টুকু অবাক হয়ে দেখে লুকিয়ে থাকা পাখিটা ঠিক তার সামনে। সবুজ ঘাসের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে এসে তার দিকে তাঁকায়। নীল রঙের একটা পাখি। মাথার কাছে সোনালী একটা ঝুঁটি। এত সুন্দর পাখি! কখনও আগে দেখে নি।
“কি পাখি তুমি?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করে ওঠে।
“এই শহরে কত জনকেইতো চিনলে। আমাকে নাই বা চিনলে।” পাখিটা বলে।
সত্যি। আজব এক শহর। মাত্র কুড়িটা দিন। এই পার্কের বাইরে এই শহরটা যে কেমন, দেখেও নি। কিন্তু এর মধ্যেই এই শহরের প্রতিটা মানুষকেই ও চিনে ফেলেছে।
সেই প্রথম দিন থেকেই এই চেনার শুরু। সেদিন প্রায় ভোর থেকেই কাজ শুরু করেছিল ওরা। পাথরের মত শক্ত মাটি খুঁড়ে, জল ঢেলে নরম করে, তারপর সেখানে কঁচি ঘাসগুলো লাগাতে হবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেখা গেল সাদা ধুলোর মধ্যে সবুজ একটা টুকরো জেগে উঠেছে। একটা লোক হাঁটতে এসেছিল। চলার পথে সদ্য বোনা ঘাস পড়েছিল। ঘাস মাড়িয়ে যেতে শুরু করলে ও শুধু তাঁকে একটু ঘুরে যেতে বলেছিল। কঁচি কঁচি ঘাস। ঠিকমতো মাটিতে শেকড় গাড়তে পারে নি। ওর উপর দিয়ে হেঁটে গেলে ঘাসগুলো মাটি থেকে আলগা হয়ে যাবে। আর বাঁচবে না। সহজ কথা। কিন্তু লোকটা কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে এমন চিৎকার করে উঠলো, যেন সে ভীষণ কোন অন্যায় করে ফেলেছে।
“আমাকে চিনিস? জানিস আমি কে? আর একটা কথা বলবি তো..” কুৎসিৎ একটা ভঙ্গি করে আরও জোরে ঘাস মাড়িয়ে চলে যায় লোকটা।
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
কে লোকটা? এই শহরের জমিদার গোছের কেউ? চেহারা দেখে তো বোঝা যায় না। পরে বুঝতে পেরেছিল, শুধু সে নয়- এই শহরে সবাইই নিজেকে রাজাবাদশা ভাবে। একটু দূর্বল মানুষ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। পার্কটা শহরের মধ্যখানে। রাত-দিন মানুষরা আসছে আর আসছে। ছেলে, বুড়ো, ভবঘুরে, মাস্তান, অধ্যাপক, রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী, দোকানদার, কবি, শেয়ারবাজারী, কেতাদুরস্ত টাইবুটওয়ালা সব রকমই তো দেখলো- সব্বাইই এরকম। সবাই সবাইকে শাঁসানোর তালে আছে। তাঁর চেয়ে শক্তি বেশি আছে দেখলে, লেজ গুটিয়ে বিড়ালের মত ঘাপটি মেরে থাকে বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাঘের দাঁতে শান দেয়। কেউই কাউকে মানে না। আমাকে সমঝে চল, না হলে একদম ঘেউ করে দেবো- ছোট বড় সবারই এক কথা। শুয়ো পোঁকার মতন। সারা গায়ে কাঁটা নিয়ে হেঁটে বেড়ায়। নিজেকে বাঘ ভাবে। আজব একটা শহর। যেখানে প্রত্যেককে চিনে চলতে হবে, সেখানে কিছুতেই থাকা যাবে না। বুঁঝে ফেলে সে। পাখিটাই এই প্রথম কেউ, যে তাঁকে চেনাতে চাইলো না। খুঁশি হয়ে ওঠে ও।
“ঠিক আছে। এ না চেনাতেই মনে থাকবে।” ছেলেটা বলে।
লেজ দুলিয়ে পাখিটা হাসে। ফুরুৎ করে উড়ে মাথার উপরের ঝুলে পড়া ডালটায় বসে।
“যাচ্ছো তাহলে?”
সূর্যটা ডুবে গেছে। কুচি কুচি অন্ধকার নেমে আসছে পার্কটা জুড়ে। একটু পড়ে বাদুরেরা বের হবে। শহরের আকাশ দিয়ে উড়ে যাবে দুরে। আরও দুরে।
হ্যা যাচ্ছি।
টুকুকুটু। বিদায় তাহলে। পাখিটা উড়াল দিল। অন্ধকার নেমে এসেছে তখন।
তখনই তার মনে পড়লো, মেয়েটার নামটাও জানা হয় নি।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। এই শহরটায় ছেলেটা আর কখনোই আসে নি। এই এত দিন পরেও ওদের গ্রামে যখন এই শহরটা নিয়ে কথা উঠে, ও বলে- “ও ঐ শহরটার কথা বলছো। ঐ শহরের প্রত্যেককেই আমি চিনি।” ওর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে উঠতো।
“সবাইকে?” তখন সে একটু আনমনা হয়ে যেত।
এক মুহূর্তের জন্য। তারপরে হাসি ফুটিয়ে বলে, “না। সবাইকে না। শুধু একটা মেয়ে আর একটা পাখি - এই দুজনকে ছাড়া... ”


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ! ভালো লাগলো।

-------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অনেকদিন পর! বেশ লাগল লেখাটা। তবে লাইনব্রেক না থাকায় পড়তে কষ্ট হয়েছে।

তাহসিন রেজা এর ছবি

গল্পটা বেশ ভাল লাগল

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ছোট্ট ছোট্ট বাক্য গাঁথুনি আপনার লেখার একটা বড় গুণ।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মুক্তমন এর ছবি

অনেক সুন্দর ৷ শেষ লাইনটা বেশ পছন্দ হয়েছে ৷

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।