নায়িকা : ছো্ট্ট গল্প

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বুধ, ১০/০৮/২০১৬ - ৩:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একলা। কিছুক্ষনের জন্য কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। শুধু একলা। ভাবতেই খুব ভাল লাগে তার। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এটুকু সময় বের করতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। শেষ পরযন্ত অবশ্য সব ভালোয় ভালোয় মিটেছে। এখন- এখানে এই নির্জনে এসে তার মনে হলো, অনেক বছর পর একটু নিঃশ্বাস নিতে পারছে।
সবসময় তাকে মানুষের চোখের ওপর থাকতে হয়। খুব ক্লান্ত লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিছুই করার নেই। নায়িকার জীবন এরকমই। সবসময় একাকীত্বে কাটালেও একা থাকার সুযোগ হয় না। নায়িকাদের জীবন এরকমই। নিজের বলে কিছু নেই। এমন কী মা’ও।
মা আজকাল তার সাথে আর স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন না। তিনি যেন তার মেয়ের সাথে কথা বলছেন না- একজন নায়িকার সাথে কথা বলছেন। অনেক সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট হয়। মা আর মা নেই। নায়িকার মা হয়ে গেছে।
মাকে সবাই ওই নামেই ডাকে আজকাল। নায়িকার মা। তিনিও নিজের জীবনটাকে নায়িকার মা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাকে দেখলে মনে হয়, নায়িকার মা হওয়ার জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। এটাই তার একমাত্র পরিচয়।
মাঝে মাঝে নায়িকার এসব সহ্য হয় না। মনে হয় ছোটবেলার মতো মায়ের কোলে মাথা কাঁদতে পারতো। যদি ছোটবেলার মতো মা চুলে বিলি কাঁটতে কাঁটতে রূপকথার গল্প শোনাতো। কিন্তু তা হয় না। মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে গেলে মা তার মাথার চুলে বিলি কাঁটবেন ঠিকই, কিন্তু তিনি রূপকথার গল্প শোনাবেন না। তিনি আল পাচিনোর গল্প শোনাবেন। নায়িকা হিসেবে নিজেকে ধরে রাখতে গেলে কী করতে হবে, এই নিয়ে মায়ের খুব চিন্তা। বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাছ থেকে মেয়ের জন্য পরামর্শ জোগাড় করেন। আল পাচিনোর একটা কথা তার খুব মনে ধরেছে। তিনি সেটাই তাকে কয়েকদিন বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
“আমি সব সময় সত্য বলি- এমনকী যখন মিথ্যা বলি তখনও।” আল পাচিনোর কথাগুলো মা তার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন, তোকে নায়িকা হয়ে থাকতে হবে সবসময়, এমনকী যখন জানিস তুই তা নস- তখনও।
নায়িকা এসব কথা এই সামান্য সময়টুকুর জন্য ভুলে যেতে চান। এই একালা থাকার সময়টাকে তিনি নষ্ট করতে চান না। একটা হীরে খচিত সাতনড়ি গলার হার তার জন্য এখন কোন বিষয় না। কিন্তু নিজের মতো দুটো ঘন্টা তার জন্য অনেক।
ঠিক তখনই ছেলেটা উদয় হলো। একদম আচমকা। নায়করা যেভাবে নায়িকাদের বাঁচাতে ম্যাজিকের মতো হাজির হয় তেমনি। নায়িকা একটু অবাক হলেন। বিরক্তও। এখানে কেউ থাকতে পারে তিনি ভাবেননি।
“আমি জানতাম, আপনি ঠিকই সবার থেকে পালিয়ে এখানে আসবেন।”
ছেলেটার কথা শুনে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত যেন শরীর বেয়ে নেমে এলো। ছেলেটার হাতে কিছুই ছিল না। কিন্তু নায়িকার মনে হলো ছেলেটার কাছে একটা ছুরি আছে। আর একটু পরে সেই ছুরিটা সে তার বুকে বসিয়ে দেবে। চারদিকে কেউ নেই। যে নির্জনতার জন্য তিনি এখানে ছুটে এসেছিলেন, সেটাকেই তার মনে হলো ভয়ংকর।
“শুধু দুজন। শুধু আপনি আর আমি। আমরা দুজন মুখোমুখি বসে আছি। মাঝখানে একটুকরো আকাশ। আমরা কথা বলছি। ক্যামেরা চলছে। কথা শেষ, ক্যামেরা বন্ধ। এটা একটা সিনেমা। যেখানে আপনার অভিনয় করতে হবে। আপনাকে এই কথাটা বলার জন্য আমি এখানে বসে আছি। আমি জানতাম ঠিক আপনি এখানে আসবেন। মানুষ আর কতক্ষন নিজের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারে। “
নায়িকার ভয়টা একটু কমে গেলো। এরকম অনেক প্রস্তাব তাকে শুনতে হয়। তার বিখ্যাত ভূবন মোহিনী হাসিটা তিনি ছুড়ে দিলেন। পৃথিবীকে তিনি এই হাসি দিয়েই জয় করে এসেছেন। “স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দিন। পড়ে আপনাকে জানাবো।”
ছেলেটা হাসে, “এখানে আপনার না বলবার কোন অপশন নইে। এখানে- আপনাকে অভিনয় করতে হবেই।”
নায়িকা একটু চমকে গেলেন। ছেলেটার বলার স্বরে একটা কিছু আছে। একটু অস্বাভাবিক। তার ভয়টা আবার বাড়তে শুরু করলো। তিনি স্বাভঅবিক থাকার চেষ্টা করলেন, “তাই। কেনো? না বলবার কোন অপশন নেই কেন?”
ছেলেটা নায়িকার চোখের দিকে তাকালো। যেন ভেতরটা দেখে নিচ্ছে। নায়িকা একটু কেঁপে উঠলেন।
“কেন? এক হাজার এক রাত্রি আমি আপনাকে ভাবতে ভাবতে পার করেছি। আপনি জানেনতো, আরব্য রজনীর গল্প। এক হাজার এক রাত্রির গল্প ছিল সেখানে। আপনাকে কল্পনা করে আমার এই এক হাজার এক রাত্রি নিয়ে আরব্য রজনীর চেয়েও সুন্দর একটা গল্প লিখতে পারি। আপনি কি আমার মধ্যে আপনার এক হাজার এক রাত্রি জানতে চান না? আর জানতে না চাইলেও কিছু করার নেই। এই এক হাজার এক রাত্রিতে আমার মনের ভেতরে যে আপনি ছিলেন, তার জন্মতো আপনিই দিয়েছেন। তাকেতো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। আপনি এটাও অস্বীকার করতে পারবেন না এই রকম- লক্ষ হাজার এক রাতের জন্যই আপনার জন্ম। আপনার হাসি, চোখ, কথা, ভঙ্গি তো সে ইশারাই দিয়ে গেছে। আপনি চাইলওে তাকে অস্বীকার করতে পারেন না। আর এই জন্যই আপনার না বলার কোন অপশন নইে। আপনাকে এর মুখোমুখি হতেই হবে। আমার ভেতরের এক হাজার এক রাত্রির।”
নায়িকা কিছু বললেন না। আসলে কিছু বলতে পারলেন না। কী বলা যায় তিনি ভাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছু মাথায় এলো না।
“স্ক্রিপ্টটা পাঠিয়ে দেবেন।”নায়িকার কথা শুনে ছেলেটা হাসলো।
“আমি আর আপনি- এটাই স্ক্রিপ্ট। কোন কাগজের এখানে প্রয়োজন নেই।”
নায়িকার ভয়টা বাড়তেই থাকলো। কিন্তু ভয় পেলে আরও বিপদ। ছেলেটা যদি বুঝে যায় তিনি ভয় পেয়েছেন, তাহলে সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন।
“কবে কোথায় শ্যূটিং জানিয়ে দেবেন। এই হলো আমার ফোন নাম্বার…” নায়িকা তাকে ফোন নাম্বার দিয়ে ঝামেলা থেকে মুক্তি চাইলেন। কিন্তু ছলেটো তাকে সইে সুযোগ দিলো না। “ নাম্বারের প্রয়োজন নেই। শ্যূটিংটা হবে- এখন। এই মুহূর্তে। আপনার নির্জন একলা পৃথিবীতে। এই যে এখানে এই পাথরটার ওপর বসুন।.. হ্যা হ্যা ঐ পাথরটার ওপর..” নায়িকার একবার মনে হলো চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু কেউ নেই এখানে। কেউ তার চিৎকার শুনবে না। এমন একটি জায়গা খুঁজেই তিনি এখানে এসেছিলেন। আর এসে কি না, নায়িকার কান্না এলো। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার কান্নার ভেতরেও চার্ম আছে। একদম পারফেক্ট। নিন- বসে পড়ুন। আমি ঐ পাথরটায় বসছি…”
দুটো পাথরটা কাছাকাছি। কিন্তু খুব কাছাকাছি নয়। মাঝখানে একটু শূন্যতা। আকাশরে মতো। নায়িকা আর ছেলেটা সেই দুটো পাথররে ওপর বসে আছে। ছেলেটা নায়িকার দিকে তাকিয়ে বলে, “এবার তাহলে শুরু করা যাক। কি বলেন?” বললো, কিন্তু নায়িকা কী বললো তা শোনার প্রয়োজন বোধ করে না। চিৎকার করে বলে ওঠে, “রোল ক্যামেরা।”
বাতাসে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসে, “রোল ক্যামেরা।”
“৩, ২, ১, ০ এ্যাকশন”
ছেলেটা আবার চিৎকার করে। যেন দূরে কেউ ক্যামেরা হাতে বসে আছে। সে তাকে নির্দেশ দিচ্ছে। ছেলেটা নায়িকার দিকে তাকায়। নায়িকা তখন চারদিকে ক্যামেরাটা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না।


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

রহস্য গল্পে প্রশ্ন করতে নেই। তবু দুটো প্রশ্ন এলো।
নায়িকা কি স্যুটিং এর ফাঁকে একলা হয়েছিল? নাকি স্যুটিং বিহীন দিনে কোথাও একলা গিয়েছিল?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কর্ণজয় এর ছবি

দিনটা সে বের করে নিয়েছিল, শ্যূটিং এবং শ্যূটিংবিহীন নায়িকাময় ভূমিকা থেকে-

দেবদ্যুতি এর ছবি

নায়িকার কি একটা দিনও একলা থাকতে নেই? বেচারা!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

একেবারে একরত্তি গল্প যাকে বলে। চমৎকার ভাবে শুরু করে গল্পটা টেনে নিয়ে একেবারে ঝুপ করে শেষ করলেন। মনে হল এটা হয়ত নায়িকার জীবনে বাস্তবে ঘটেনি। এটা হয়ত তার ব্যস্ত জীবনের একটা উইশ ফুলফিলমেন্ট নিয়ে দেখা স্বপ্ন। রাজিব মাহমুদ।

আদি এর ছবি

নায়িকার নিজের ইচ্ছা বলে কিছুই নেই

অতিথি লেখক এর ছবি

ধরতে পারলাম করেও শেষতক ধরা গেলো না মন খারাপ

আবীর আশরাফ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।