হয়তোবা কোন একদিন

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/১২/২০১৭ - ৪:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“কামনা হচ্ছে তোমার আত্মার ভেতরের
সেই ক্ষুধার্ত অন্ধ কুকুর
যে জেগে উঠলে তুমি বেহুশ হয়ে যাও।
তখন তুমি মানুষ থাকো না।
মানুষ কাকে বলে?
যার মান আছে আর হুশ আছে।
সেই কুকুরটা জেগে উঠলে
তোমার মান জ্ঞান হারিয়ে যায়।
পাখির মত ফুরুৎ করে উড়ে পালায়।
তুমি যে কী করলে তখন তা তুমি জানতেও পারো না।
...
এরপর কুকুরটা যখন ঘুমিয়ে পড়ে
তোমার হুশ আবার ফিরে আসে
বিবেক জেগে ওঠে
তখন আবার তুমি মানুষ হও
তুখন তুমি বুঝতে পারো কী করেছো।
হাঃ! হায়!
তোমার খারাপ লাগতে শুরু করে।
যতদিন তোমার খারাপ কাজ করার জন্য খারাপ লাগবে
ততদিন তুমি বুঝতে পারবে
তুমি মানুষ আছো।
তুমি ধর্মে আছো।
যেদিন খারাপ কাজ করার পর আর কিছু মনে হবে না
মনে হবে না,
উফ! খারাপ কাজটা করে ফেললাম!!
যেদিন তোমার এমন কিছু মনে হবে না
সেদিন বুঝবে
তুমি আর মানুষ নাই।
তুমি খান্নাস হয়ে গেছো।
খান্নাস হলো, মানুষের মধ্যে থাকে
কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। “

কথা হচ্ছিল সাধুর ঘরে। নফস নিয়ে আরেক সাধু ইমাম গাজ্জালী কী বলেছিলেন তা নিয়ে আলাপটা জমে উঠেছিল। নফস হলো কামনা। কামনা? কিন্তু কামনাতো সব সময় খারাপ নয়। কামনার মধ্যে একটা টান আছে। যেই টানে ভালবাসা হয়। যেই টানে প্রেম জমে। ঘোর নামে। কামনা আমাদের পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলে। জীবনকে গল্পের মতোন, কবিতার মতোন করে তোলে।
সাধু হাসলেন। বললেন, কামনা সবসময় সুন্দর হয়ে আসে। এটাই প্রবৃত্তি।
ফিরে এলাম। জীবনে যেভাবে ফিরে আসতে হয়।

রাত তখন গভীর। আকাশে চাঁদ উঠেছে। এক একা হাঁটছি।
চাঁদ ছোটবেলায় উড়িয়ে কল্পনায় নিয়ে যায়। বড়োবেলায় নিয়ে যায় স্মৃতিতে।
আমার চাঁদ দেখে পুরনো দিনের স্যারের কথা মনে পড়লো।
কত কাল আগে, ইকোনমিক্সের ক্লাশে ডিমান্ড সাপ্লাই বুঝাতে গিয়ে
স্যার দুই হাত হৃদয়ের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করে বলেছিলেন-
প্রেম হলো একটা apatite
এক ধরণের আকুলিবিকুলি
হাত দুটিকে হৃদয় থেকে দু দিকে প্রসারিত করে বলেছিলেন।
আমার ভেতরে কী জানি জেগে ওঠে।
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ডুবে যেতে ইচ্ছে করে।
আমি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ি।
পেয়ালার অর্ডার দিয়ে অন্ধকারে তাকাই।
শরাবখানার জায়গায় জায়গায় অন্ধকার ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।
যেন কেউ কারো মুখ দেখতে না পারে।
ভেতরটাকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
পেয়ালা এলো। শরাবে শরাব।
মীর্জা গালিব যে পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অনুভব করেছিলেন
যার শরাব আছে সে বেহেশত চাইবে কেন?
এইটাই কী বেহুশ অবস্থা?
হবেও বা। তাহলে আমি কি মান হুশ নই?
চিন্তাগুলো জমাট বাঁধে না। এক জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে থাকে।
মারজুক রাসেলের লেখা গানটা মাথায় আসে।
আমি প্রেমে পড়ি নি। প্রেম আমার ওপরে পড়েছে।
আসলেই তো। আমি তো কিছুই করি নি।
চুমুক চুমুক। স্বপ্ন। কল্পনা। দুঃখ।
হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। মেয়ে না। পরী। শুধু ডানা নেই। মনে হলো মানুষ না। মোমের তৈরি। আগুনের শিখায় চকচক করছে। মনে হলো ঘন শাদা শরৎকালের মেঘের তৈরি। পূর্ণিমার আলো পড়েছে তার গায়ে।
চলো।
আমার হাত ধরে সে নিয়ে চলে।
একটা হোটেলের মতো। সারি সারি ঘরের মধ্য দিয়ে মেয়েটা আমাকে নিয়ে চলে।
ঘরগুলোর মধ্যে বুঝতে পারি। আনন্দের উৎসব। রঙিন ফোয়ারা।
মেয়েটা সব ঘরের মধ্য দিয়ে একটা ঘরে এসে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো
অপেক্ষা করো।
আমি আসছি।
সে আসে না।
আমি বের হতে গিয়ে দেখি কোথাও বাজনা বাজছে। শব্দ শুনে শুনে এক জায়গায় গিয়ে দেখি গানের জলসা বসেছে। আর সেই মেয়েটা অনেকগুলো ছেলের সাথে নাচছে।
আমার অসহ্য লাগে।
সাথে সাথে আমি বের হতে গিয়ে দেখি একটা প্রহরী, হাতে রাইফেল আমাকে বলে এখানে ঢোকা যায়। বের হওয়া যায় না।
এটা কি প্রেম না কি? যে একবার ভেতরে ঢুকলে আর বের হওয়া যাবে না?
আমি চিৎকার করি। শুধু প্রেমই এমন।
সাথে সাথে বুঝতে পারি আমি আসলে
Eagles এর welcome to hotel California গানটার মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।
ছোটবেলায় এই হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া গানের আসল অর্থটার রহস্য নিজেরা তৈরি করতাম।
আমার সবসময় মনে হতো- ওটা প্রেম। আমরা প্রেমিকার বা প্রেমিকের মনের ভেতরে গিয়ে নিজের জগত বানাতে গিয়ে দেখি সেখানে আরও অনেকে জড়ো হয়েছে। আমি একা নই।
আমি মেয়েটার দিকে তাকাই। না, এ সেই প্রেম নয়। এ শুধুই কামনা।
আমি মেয়েটার হাত ছেড়ে দি। কত বিল, জানতেও চাই না। একগাদা বখশিশ দিয়ে বের হয়ে আসি।
বিল দিয়ে আর একবারও পেছন ফিরে তাকাই না।
রাস্তায় একটা বুড়ো। একলা বসে আছে। একটা নিঃসঙ্গ বুড়োর চেয়ে দুঃখী ছবি পৃথিবীতে নেই। খেয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করারও কেউ নেই।
আমি তার কাছে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে চমকে উঠি। মনে পড়ে সব টাকাই আমি বখশিশ দিয়ে এসেছি। কত টাকা গুনিও নি। এখন এই বুড়ো দাদুর কাছ থেকে পালানো ছাড়া আমার কিছু করার নেই। আমি এবার তার কাছ থেকে পালিয়ে ছুটতে থাকি।
ভেতর থেকে কে জানি বলতে থাকে, তুমি এটা কী করলে। বুড়োর মুখটা ভাসে।
আমি বলি, কাল আমি সেই বুড়োর কাছে যাবো।
কাল কি সে তোমার জন্য ওখানে থাকবে।
ঠিক খুঁজে বের করবো।
মনে মনে ঠিক করে নেই, ঠিক লোকটাকে খুঁজে বের করে তার জন্য একটা কিছু করবো। মাসে মাসে খোঁজ করবো।
আমি হেঁটে চলি।
আমি জানি ঐ বুড়োর জন্য যাওয়া হবে না।
আমি মনে মনে ঠিক করি, না যাবো।
কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বলে, তুমি যাবে না। দেখে নিও।
আমি জানি ভেতরের যে আমাকে বলছে, তার কথাই ঠিক হবে।
আমার ঐ বুড়োর জন্য আর যাওয়া হবে না।
আমি ভুলে যাবো।
ঐ ভুলে যাওয়ার জন্য আমার কষ্ট হতে থাকে। কিন্তু এই কষ্টটার জন্য খুব ভাল লাগে।
মনে হয়, হয়তো মানুষ হওয়া যাবে, কোন একদিন।
কোন একদিন
হয়তোবা


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

নীড়পাতায় সারসংক্ষেপ দেখে কবিতা ভেবে আর এগোইনি। এমন নয় যে কবিতা আমার অপছন্দ, ইদানীং পড়তে ইচ্ছে করছে না। গল্প বলার স্টাইলটি ভালো লেগেছে। এই রকম ছোটো ছোটো দৃশ্যকল্প আমার দারুণ লাগে।

----মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।