শুভ যখন অশুভ’র কাছে পরাজিত হতে থাকে -১

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: রবি, ০৫/০৮/২০০৭ - ৬:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখনকার সবচেয়ে উচ্চারিত প্রশ্ন, “আচ্ছা বলুনতো দেশের কী হবে?”-র উত্তরে একেকজন একেকরকম উত্তর দেবেন অবশ্যই। কিন্তু একটি জায়গায় আমরা একমত হতে পারি তাহলো, আজকের এই অনিশ্চয়তা, গণতন্ত্রের অন্তর্যলি যাত্রার জন্য সত্তর ভাগ দায়ভার যদি সামরিক তন্ত্রের হয়ে থাকে তাহলে বাকি ত্রিশভাগ আবশ্যকভাবেই গণতান্ত্রিক, সুশীল ও মুক্তিযুদ্ধে আস্থাশীল অংশের। অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, সেটা কি ভাবে? এর উত্তরে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে না, একটি জ্বলজ্বলে জ্যান্ত উদাহরণ দিয়েই তা বোঝানো সম্ভব। এবং উদাহরণটির সঙ্গে সচলতায়তকরা সকলেই কমবেশি জড়িত ও জ্ঞাততো বটেই।

বাংলা ব্লগিং জগতে সামহোয়্যার ইন ব্লগ যে চমক এনেছিল তা অস্বীকার করলে সত্য গোপন করার দায় পোহাতে হয়, সুতরাং স্বীকার্য এবং প্রশংসাটুকু তাকে দিতেই হয়। শুরুতেই সেখানে যারা যাতায়াত করেছেন তারা প্রত্যেকেই উল্লেখ করার মতো সৃষ্টিতে ব্লগটিকে স্বার্থক ও জনপ্রিয় করেছিলেন। প্রথমেই সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে তর্ক শুরু হলো, দেখা গেলো এখানেও সেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদী জামায়াতের ছানাপোনারাই মুক্তিযুদ্ধকে প্রকৃত সম্মান দেওয়া তো দূরের কথা একে যে কোনও ভাবে ছোট কিংবা হেয় করাতেই তাদের আনন্দ। জামায়াত ও তাদের দোষররা একাত্তরে পাকিস্তানীদের হয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে নেমেছিল এবং সে জন্য এখনও পর্যন্ত তারা লজ্জিত বা কুন্ঠিত নয়। কিন্তু তাদের ছানাপোনা যারা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছে তারা কেন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বাঙালিকে হেয় করে তা ভেবে দেখার বিষয়। এক. হতে পারে বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তারা তাদের রক্তে বয়ে এনেছে এবং এই দুষিত রক্ত যতোদিন পুরোপুরি নিঃশেষ না হচ্ছে তাতোদিন এই বিশ্বাসঘাতকতা চলবেই। দুই. তাদেরকে এমন ভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে যে, আসলে তারা বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত রূপটি ধরতেই পারেনি, অন্যকথায় তারা তা ধরার চেষ্টাও করেনি। তিন. তারা হয়তো সবদিক ভেবেচিন্তে অ-বাঙালি থেকে যাওয়াকেই লাভজনক মনে করেছে।

কিন্তু একথা খুবই সত্য যে, তারা চাইলেই তাদের পিতা-পিতামহদের কৃত পাপ ও শাপ থেকে মুক্ত হতে পারতো। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অনেক মুসলিম লীগ নেতার ছেলেমেয়েরাও অংশ নিয়েছে, কট্টর মোল্লার ছেলেমেয়েও হয়েছেন নিরিশ্বরবাদী। সুতরাং স্বাধীন বাংলায় জন্মেও যারা বাংলা ও বাঙালির বিরোধিতা করে, এখনও যারা নিজেদের জন্মদাত্রীকে বন্ধক রেখেছে অ-বাঙালির হারেমে তারা বরং তাদের পিতা-পিতামহ যারা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তাদের এই অপরাধকে ক্ষমা তো দূরের কথা কোনও প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শনের যোগ্যও তারা নয়। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, আমরা সামহোয়্যারে এই শ্রেণীকে দেখতে পেলাম বেশ শক্তিশালী অবস্থানে। কোনও কারণে তারা কর্তৃপক্ষকে হাতের মুঠোয় রাখতে পারেন বলেও প্রমাণিত হলো। ফলে প্রথম থেকেই বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেও বাঙালি-বিরোধী Ñ এই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধটা ছিল লক্ষ্য করার মতো।

এখানেও এই শেষোক্তরা সবকিছুর মধ্যে ধর্মকে এনে ফেলে জল ঘোলা করে তারপর সেই জলে তারা তাদের শর নিক্ষেপ শুরু করে এবং কর্তৃপক্ষের সহায়তায় জয়লাভও করে। যুক্তিকে কি করে কুযুক্তি দিয়ে, সুস্থ তর্ককে কি করে কুতর্ক দিয়ে এবং কি করে নিতান্তই বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টিকে তথাকথিত ইসলামের দোহাই পেড়ে আমূল বদলে ফেলা যায় তার ভয়ঙ্কর সব উদাহরণ আমরা খুঁজে পাবো সামহোয়ারের বিভিন্ন তর্ক-বিতর্কে। অন্তর্জালে ব্লগের সংখ্যা কম নেই, সেখানে কাঁদাছোঁড়াছুঁড়ি কিংবা গলাবাজি কম নেই কিন্তু এসব যখন নোংরামিতে গিয়ে ঠেকে তখন বিষয়টা অনেককেই অনাগ্রহী করে তোলে। সামহোয়্যারেও তাই-ই হয়েছিল।

আমার মনে আছে, যখন সেখানে নিতান্তই খেলাচ্ছলে আমার উপন্যাসের দু’টি অধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর যে ঘটনা ঘটেছিল তা যেমন ছিল অনাকাঙ্খিত এবং তেমনই উদ্বেগজনক। প্রথমত, উপন্যাসের অংশটুকু ব্লগ থেকে মুছে দেওয়ার পর যেমন শুরু হলো নোংরামি তেমনই বাংলা ও বাঙালিত্বের অংশের কতিপয়কে ধর্মের আফিম খাইয়ে করে তোলা হলো বৈরি। এটা যে শুধু আমার বেলাতেই হয়েছে তা নয়, এমনও হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একের পর এক পোস্ট দিয়ে যিনি ব্লগে একজন নতুন-দিনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সকলের কাছে সম্মানিত হয়েছেন তিনিও এমন সব বিষয়ে শুধু দ্বিমত নয়, বরং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন যে, এটা তার যে পরিচিতি ব্লগে গড়ে উঠেছে ঠিক তার সঙ্গে খাপ খায় না। বোঝাই গেলো যে, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি-বিরোধীরা কয়েকটি স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছে। যেমন, তারা তাদের সমালোচনাকে ব্যবহার করছে ধর্মের বিরোধীতা হিসেবে; প্রগতিকে তারা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ইসলামের মুখোমুখি; তারা জিইয়ে রাখতে সক্ষম হয় প্রগতিবাদীদের ভেতর বিভেদ এবং সর্বশেষ তারা বাঙালিত্বের ভেতর “মোল” ঢুকিয়ে রেখে এমন এক অবস্থার জন্ম দেয় যাতে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে, স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের ঐক্যে বড় ধরনের ফাটল ধরেÑ যে ফাটল বেয়ে ধীরে ধীরে আমাদের স্বাধীনতার শরীরে ছ্যাঁতলা পড়তে শুরু করে।


মন্তব্য

থার্ড আই এর ছবি

স্বাগতম।
আপনার সচল হওয়ায় সচলায়তনের ঘর গুলো আরো অনেক বেশী আলোকিত হয়ে উঠেছে।
---------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

কেমিকেল আলী এর ছবি

আপনাকে স্বাগতম এই সচলে। অনেক আগে থেকেই আপনার লেখা পড়ি। এখন আরও বেশি পড়ার সুযোগ হল।

বেশি বেশি লেখা চাই আপনার নিকট থেকে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাংলাদেশে ধর্মাশ্রয়ী মৌলবাদী রাজনীতির দুর্ভাগ্য এখানেই যে, ৭১এর পাপ তাদের পিছু ছাড়বেনা কখনোই ।
যতোই পুরনো,বহুল আলোচিত এইসব অভিধা ব্যবহার করা হোক বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগনের নিয়তি নির্ধারনে ডি ফ্যাক্টো হিসাবে কাজ করে ৭১ , পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অরূপ এর ছবি

চলুক
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

শুভ রবিবাসরীয় সকাল সবাইকে।

আজকে পূর্ব লন্ডনে একই মঞ্চে কবিতা পড়তে যাচেছন সৈয়দ শামসুল হক ও বেলাল মোহাম্মদ। আর সেই সঙ্গে নতুন-পুরাতন কবি তো আছেনই। সচলায়তকগণ আমন্ত্রিত, বিকেল পাঁচটায়, ব্রাডি সেন্টারে।

# হাসান মোরশেদ, খুব সত্যি কথা কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানে জনগণের যে বিশাল ভূমিকা রয়েছে সেখানে কিন্তু অবহেলা, অজ্ঞতা কিংবা মুখ ফিরিয়ে থাকা এবং কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়িও আজকের বিপর্যয়ের জন্য কম দায়ী নয়। এই কথাগুলি বলেই লেখাটির নটে গাছটি মুড়ে দেবো। ভালো থাকুন।

# থার্ড আই, আমি আপনার মোবাইল নাম্বারসহ মন্তব্যটি মুছতে চেষ্টা করেও পারছি না। কি করে মুছতে হয়?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

মাসুদা দ্বিজাতিতত্ব নিয়ে লিখুন। আমার কেন যেন মনে হয় শেকড় থেকে আলোচনাটা খুবই জরুরি...
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

হ্যাঁ সুমন, শুরু করবো। এই ছোট্ট পর্বটা শেষ করেই নতুন একটি ধারাবাহিক লিখবো দ্বি-জাতি তত্ত্ব (?) নিয়ে। যদিও আমি বিশ্বাস করি না এরকম উদ্ভট কোনও তত্ত্ব হতে পারে, যাহোক, এই অ-তত্ত্বের কারণে আমাদের দশা আজ এই। বন্যায় মানুষ না খেয়ে মরে আর কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার রাংস (য-ফলাটা কেন যেনো লিখা যাচ্ছে না) ভবন ভাঙে। স্বাধীন বাংলাদেশ আসলে কারো কারো কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা, এর ষোল আনা ভোগ করতে না পারলে তাদের যেনো জারজ-নাম ঘুচবে না।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ধারাবাহিক শুরু হোক ।

সুমনের নিজের ও তো শুরু করার কথা অন্য টপিকে । ফাঁকি দেয়া হচ্ছে ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মেঘ এর ছবি

মেঘ

বহুদিনপর আপনার লিখা পড়লাম। আপনি লিখছেন এটাই আনন্দের।

মেঘ

অমিত আহমেদ এর ছবি

সামহোয়্যারে অল্পদিনের অভিজ্ঞতাতেই সমউপলব্ধি আমার হয়েছে। সম্পূর্ণ ভাবেই একমত আপনার সাথে।

সুমন ভাই, দ্বিজাতিতত্ব বলতে কি/কাদের বোঝালেন? যেসব বেজন্মাদের কথা মাসুদা বলছেন তাদের আবার জাতি কিসের? আমিতো কোন ভাবেই ওদের বাঙালি বলবো না।


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।