পালকি চলে দুলকি তালে

আবু রেজা এর ছবি
লিখেছেন আবু রেজা [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১০/০৯/২০০৮ - ১২:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাক্ বাক্ কুম্ পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কাল কি
চড়বে সোনার পালকি?[/
b]
ছড়াটি লিখেছেন রোকনুজ্জামান খান। এই ছড়ায় বলা হয়েছে, পায়রা টায়রা পরে বউ সাজবে। বউ সেজে সোনার পালকিতে চড়বে। এখন পায়রা আছে, টায়রা আছে। কিন্তু সোনার পালকি নেই। সোনার পালকি দূরে থাক। কাঠের পালকিও নেই।

পালকির সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানের যোগ আছে। আগের দিনে বিয়ের বরযাত্রায় পালকি ছিল অবিচ্ছেদ্য জৌলুস। বর পালকিতে চড়ে কনে পক্ষের বাড়ি যেত। আবার কনেও পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়ি যেত।

বেহারারা পালকি নিয়ে প্রথমে বরের বাড়ি আসত। বরের সাজে সেজে বর পালকিতে উঠত। বর মুখে রুমাল চেপে পালকিতে বসে থাকত। বরের সঙ্গে পালকিতে উঠত শিশুরা। বেহারারা হাতে লাঠি, কোমরে গামছা বেঁধে হেলেদুলে রওয়ানা দিত কনের বাড়িতে। পালকির সঙ্গে থাকতো বরের আত্মীয়স্বজন। এরা সবাই বরযাত্রী।

বরযাত্রার সময় বেহারারা সুরে সুরে গান গেয়ে বিদায় নিত। এ সময় তারা বরের আত্মীয়স্বজনদের থেকে বকশিস আদায় করত। কেউ বকশিস না দিলে বেহারারা তাকে গানে গানে তিরষ্কার করত। এতে থাকত হাসির খোরাক। এতে কেউ অপমানিত হতো না। সবাই নির্মল আনন্দ উপভোগ করত।

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালকি চলত ভিন গাঁয়ে। বেহারারাদের গীত শুনে গ্রামবাসীরা টের পেয়ে যেত বর যাচ্ছে। গ্রামবাসী ছেলে-বুড়ো সবাই বর দেখতে ছুটে আসত। গ্রামের মেয়েরাও বেড়ার ফাঁকে দাঁড়িয়ে বর দেখার চেষ্টা করত। ছেলেপুলেরা পালকির পথ আগলে দাঁড়াত। বরপক্ষ ছেলেপুলেদের মিষ্টি বিলিয়ে তবে ছাড়া পেত। আর ছেলেপুলেরা পালকির পেছন পেছন ছুটে চলত অনেক দূর।

অনেক পথ পেরিয়ে পালকি কনের বাড়ি পৌঁছতো। বেহারাদের গীত আর হাঁকডাক শুনে দূর থেকে কনে পক্ষ বুঝে যেত বর আসছে। কনের বাড়ি উঠতেই কনেপক্ষ বরযাত্রীকে বরণ করে নিত। কনে বাড়িতেও বেহারারা গান শোনাত। গান গেয়ে বকশিস আদায় করত। আবার গানে গানেই বিদায় নিত।

পালকি ছাড়া সে যুগে বিয়ের কথা ভাবাই যেত না। পালকি চড়ে বরযাত্রা না গেলে বরযাত্রীদের সবাই ঠাট্টা করত। এই হাসি-ঠাট্টা থেকে বাঁচার জন্যই বিয়েতে পালকির ব্যবস্থা করা হতো। এখন তো বিয়ে-সাদীতে পালকির ব্যবহার নেই-ই।

সমাজে এক শ্রেণীর পেশাজীবী ছিল যারা পালকি বয়ে নিয়ে যেত। এরাই বেহারা নামে পরিচিত ছিল। ক্রমান্বয়ে এই বেহারা সম্প্রদায় লোপ পেয়েছে। কেউ বা অন্য পেশায় চলে গেছে।

পালকি বহনের সময় বেহারারা গাইত নানান গীত। সব সময়ই গানের সুরে সুরে তালে তালে বেহারারা পালকি বইত। এরকম গান যখন বাতাসে ভেসে আসতো তখনই বোঝা যেত পালকি আসছে। আর ছেলেপুলেরা দৌঁড়ে ছুটে যেত পালকি দেখতে।

এক সময় গ্রাম বাংলার সর্বত্র পালকির প্রচলন ছিল। এমন কি শহরে-বন্দরেও পালকি ছিল যাতায়াতের অন্যতম বাহন। রাজা-বাদশাহরা পালকিতে যাতায়াত করতো। রাজ কর্মচারীরাও যাতায়াতের জন্য পালকি ব্যবহার করত। ব্রিটিশ কর্মচারীরাও এদেশে পালকিতে চলাচল করত। আর্মেনিয় বণিকরা চলাচল করত পালকিতে। পালকি ছিল জমিদার, মহাজনদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন। অভিজাত পরিবারের মেয়ে, বউরা পালকিতে চড়ে নাইওর যেত।
পালকি ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির হতো। পালকি তৈরি হতো কাঠ দিয়ে। কাঠের উপর খোদাই করে পালকিতে বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি হতো। পালকি বিভিন্ন রঙে রাঙানো হতো। পালকির আকার আকৃতির ওপর নির্ভর করতো পালকি কয় বেহারা চালাবে। পালকি বড় হলে তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশি বেহারার প্রয়োজন হতো। বড় পালকিতে ভিতরে বসার জায়গা বেশি। একাধিক লোক বসা যেত। ছোট পালকিতে জায়গা কম। একজন বড় জোর দুইজন বসা যেত।

পালকি এখন হারিয়ে যাওয়া বাহন। কিন্তু এর প্রচলন হয়েছিল কবে? সে বিষয়ে সঠিক করে কিছু বলা যায় না। ধারণা করা হয়, সেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই পালকির প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু যুগের বির্বতনে পালকি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। মোটরযানের আবির্ভাবের কারণে পালকির কদর কমে গেছে। ক্রমান্বয়ে পালকি হারিয়ে গেছে কালের গর্বে। পালকি এখন ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে। নতুন প্রজন্ম পালকি দেখতে চাইলে যেতে হবে জাদুঘরে। কিন্তু এ গান শুনে এখনো পালকির কথা মনে পড়ে যায়ÑÑ
[b]চতুর্দোলায় চড়ে দেখ ঐ বধূ যায়,
স্বপ্ন সুখে তার চোখ দুটো যে উছলায়
হু-উম-না হু-উম-না হু-উম-না---


মন্তব্য

রাফি এর ছবি

ভাল লিখেছেন।
নৌকার রকমফের নিয়ে ছবিসহ একটা লেখা চাই।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ রাফি। নৌকার কিছু ছবি যোগাড়ে আছে। আশা করি লিখে ফলেব।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

শেখ জলিল এর ছবি

চতুর্দোলায় চড়ে দেখ ঐ বধূ যায়,
স্বপ্ন সুখে তার চোখ দুটো যে উছলায়
হু-উম-না হু-উম-না হু-উম-না---
....গানের হু-উম-না হু-উম-না হু-উম-না শব্দের সাথে যেন মিশে আছে একটি সম্প্রদায়ের কায়িক শ্রম, ঐতিহ্য। সেই বেহারা সম্প্রদায় এখন আর নেই।
আবু রেজার এই লেখাটি পড়ে মনে হলো ছেলেবেলার কথা। কতো যে ছুটেছি পালকির পেছনে...খেয়েছি কতো আছাড়!
বি.দ্র: গানের উদ্ধৃতিবাদে বাকিটুকু লেখা বোল্ড না করলে ভালো হতো।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ জলিল ভাই। আপনাকে ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিতে পেরেছি এজন্য ভালো লাগছে। আবার আপনি আছাড় খেয়েছেন এজন্য খারাপ লাগছে। ব্যথা পেয়েছেন?!

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আপনার প্রতিটি লেখা এক একটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে- চামচ,গামছা,টমটম, ঢেকি,পালকী ।

চমৎকার ।
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আবু রেজা এর ছবি

আপনিও ভাই ভিন্ন ধরনের পাঠক, ব্যতিক্রম পাঠক। এসব লেখা সবাই পড়ে না, কেউ কেউ পড়ে। দেখেন না আমার লেখার পাঠক কত কম?

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

খুব ভাল কাজ। ঐতিহ্যের প্রতি যার মমতা অগাধ বলেই মনে হয়। আবু রেজা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

আবু রেজা এর ছবি

প্রাণটা ভরে গেল ভাই। শীতের ভোরে এক গ্লাস হিমশীতল মিষ্টি খেজুরের রস যেমন প্রাণটা ভরিয়ে দেয়, ঠিক তেমন। অনেক অনেক......................................(লক্ষ কোটি বার) ধন্যবাদ।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।