বিভ্রান্তি

কী কমু এর ছবি
লিখেছেন কী কমু [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/০৭/২০১৩ - ১২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সোহরাওয়ারদি উদ্যানের ভেতর যেখানটায় এসে আমরা দাঁড়ালাম, সেখানে তিল পরিমাণ ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। আমি শক্ত মুঠোর ভেতর ছেলের হাতটি ধরে অভয় হাসি হাসলাম। ‘কী রে, ভয় লাগছে?’

সমস্ত মুখ ভরিয়ে পাল্টা হাসি ফিরিয়ে দিল ছেলে। ‘না বাবা, খুশি লাগছে।’

আমার বুকের ভেতর ধাক্কা লাগল। আজ থেকে বেয়াল্লিশ বছর আগে ঠিক এখানটায় একবার দাঁড়িয়েছিলাম আমি, বাবার হাত ধরে, এক পরম পুরুষের মন্দ্রকণ্ঠ শুনব বলে। বাবা কম্পিতস্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভয় লাগছে কীনা, আমিও ঠিক একই জবাব দিয়েছিলাম। পুরুষ পরম্পরায় দু’টি ঘটনায় কী আশ্চর্য মিল!

লক্ষ লক্ষ লোক, অথচ কী এক আশ্চর্য মন্ত্রবলে চারদিক শুনশান নীরবতা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই জীবনের এই পরম মুহূর্তটির জন্য। সকলের চোখ অদূরে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। কেউ কথা বলছে না, অথচ আমি শুনতে পাচ্ছি, সবাই বলছে, ‘জানোয়ারটাকে এক্ষুনি ঝুলিয়ে দেবে।’

ছেলে হাত নাড়িয়ে বলল, ‘বাবা, আমি রাজাকার দেখব।’

চারপাশে উঁচু উঁচু মাথা, আমি দু’হাতে তুলে কাঁধে বসিয়ে দিলাম তাকে। ‘কী রে, দেখতে পাচ্ছিস?’

‘হু, পাচ্ছি।’

পরের দৃশ্যটুকু দেখতে দেওয়া ঠিক হবে কীনা, বুঝতে পারলাম না। খানিক পরে নামিয়ে দিলাম ছেলেকে। গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন দেখলি রাজাকার?’

ছেলে অবাকভাবে বলল, ‘কিন্তু বাবা, ওটা তো অনেকটা মানুষের মত। আবার মুসলমানের মত দাড়িও আছে।’


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

আফসোস এমন একটা কল্পদৃশ্য বাস্তবে রূপ নিলো না বয়স জনিত কারণেই।
হায় বয়স! হায় বয়স!

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

----------------
সুবোধ অবোধ

সাকিন উল আলম ইভান  এর ছবি

শেষে আইসা কনফু খাইয়া গেসি :/

ফরহাদ হোসেন মাসুম এর ছবি

আমিও, কী সিদ্ধান্ত টানবো, ঠিক বুঝতেসিনা !!

মাসুম এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
ইসরাত

রাত-প্রহরী এর ছবি

আপনার ছেলের মত আমারও খুব অবাক লাগে, এখনও।
---------------------------------------
উত্তম জাঝা!
---------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

arshafi এর ছবি

রবীন্দ্রনাথ থেকে টুকলিফাই করা ।খুব ছোটবেলায় পিতা দেবেন্দ্রনাথ তাকে চোর দেখাতে নিয়ে গেলে চোরটাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-চোর কই ,এটাত মানুষ ।
চোরেরা অভাবের তাড়নাতেই চুরি করে, ওরাও আমাদের মতই মানুষ ।এই রকম বোঝাতেই রবীন্দ্রনাথের ওই স্মৃতিচারণা ।এর সাথে রাজাকারদের গল্প মেশানোর কোন স্কোপ নাই । রাজাকাররা জেনেশুনেই সজ্ঞানে বাঙালি নিধনযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল ।তাদের প্রতিসহানুভূতি দেখানোর এই চৌর্যীয় অপপ্রয়াস নিন্দনীয় ।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই কমেন্টটি সাপ্তাহিক একতার রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত বিশেষ পাতায় ব্যাবকহার করার অনুমতি চাচ্ছি।

স্বয়ম

বন্দনা এর ছবি

ইস সত্যি যদি এমন হত।

তারেক অণু এর ছবি

মুসলমানের মতো দাড়ি আছে না বলে কিন্তু হুজুরের মত দাড়ি বা মৌলভীর মত দাড়ি বললে যথার্থ হত সম্ভবত।

গল্পটা ভাল লেগেছে কিন্তু কোন এক লেখকের চোর দেখার অভিজ্ঞতার সাথে একটু মিলে গেল।

লেখা চলুক চলুক

কী কমু এর ছবি

দুঃখিত, রবীন্দ্রনাথের গল্পটি আমার জানা ছিল না। সাদৃশ্যটুকু আমার জন্য কাকতালীয় হলেও অভিজ্ঞ পাঠকের কাছে কুম্ভিলকবৃত্তির দায়ে দূষিত।

নরঘাতক গোলাম আজমের বিচারের রায় শোনার পর আমাদের ঘরে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হল। আমার স্ত্রী বললেন, জানোয়ারটার কোনও ভিডিও আছে ইউটিউবে? বললাম, দেখি। ছেলেমেয়েসহ সবাই গোল হয়ে বসলাম। পাওয়া গেল একটা সাক্ষাৎকার। ছবি দেখে আমার সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে বলে উঠল, It rather looks like a human being! And he wears humongous beard. Like a Muslim. (জন্মভূমি ও পরিবেশের কারণে তার প্রথম ভাষা ইংরেজি, বাংলা বুঝলেও শব্দস্বল্পতার কারণে বলতে পারে না। তার ধারণা ছিল সে কোনও অদ্ভুত জন্তু দেখবে, তাই মানুষের মত একজনকে দেখে এই প্রতিক্রিয়া। তার আরও ধারণা, দাড়ি কেবল মুসলিমেরাই রাখে। আমদের পাড়ায় বেশ কিছু ইহুদিও থাকে, তাদেরও সে দাড়ির কারণে মুসলমান ভাবে।)

ছেলের মন্তব্য শুনে আমার কোথাও টঙ্কার বাজল। মনে হল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালিদের অনেকেরই বয়স বোধ হয় সাড়ে পাঁচ পার হয়নি। আমার মত যাদের বেয়াল্লিশ বছর আগে একদিন ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে সোহরাওয়ারদি উদ্যানে বজ্রকণ্ঠ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, তারা নিশ্চিতভাবেই জানে, এরা জানোয়ার। এরা মুসলমানের মত দাড়িজামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ালেও মুসলমান নয়। এদের একমাত্র পরিচয়, এরা মর্ত্যের ক্ষমতালোভী ভয়ঙ্কর জানোয়ার। খুনী, ধর্ষক, লম্পট। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনভিজ্ঞ চোখে (নাকি সাম্প্রদায়িকতা-প্রশিক্ষিত চোখে?) এদের মানুষী অবয়ব আর টুপিদাড়িটাই বড় হয়ে ধরা পড়ে। এরা বিভ্রান্ত হয়ে শিবিরে নাম লেখায়। একদল জানোয়ারের অশুভ মুক্তির জন্য গাড়ি পোড়ায়, মানুষ হত্যা করে।

কথাগুলো এভাবে বললেই হত হয়ত, ভাবলাম একটু ঘুরিয়ে বলি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণটি আমার পড়া ছিল না। লিখতে গিয়ে তাই কোনওরকম Déjà vu-তেও আক্রান্ত হইনি। এরকম একটি ভয়ঙ্কর জানোয়ারের প্রতি সামান্য মমতা তৈরি হয়, এমন কিছু করতে অন্তত আমি রাজি নই। আমার লেখাটির উদ্দ্যেশ্য মোটেও তা ছিল না। সেকারণেই নাম রেখেছি বিভ্রান্তি। কবিগুরুর লেখার সাথে মিল পেয়ে কারও মনবেদনা হয়ে থাকলে (আমার নিজেরই হচ্ছে, লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে) আমি নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।

আমার ছেলেমেয়েরা ভারি মজার মজার কাণ্ডের জন্ম দেয় প্রতিদিন। তাদের নিয়ে আবারও লিখব হয়ত। দৈবাৎ এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত মিল পেলে প্রথমেই কুম্ভিলকবৃত্তি ভাববেন না। আমি গল্পকার নই, অলস পাঠক মাত্র। বড় হলে একদিন লেখক হব, এমন স্বপ্ন দেখার যোগ্যতাও আমার নেই।

মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

নিতান্তই গেরস্ত মানুষ, চারপাশে কেবল
শস্যের ঘ্রাণ পাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।