বুয়েট সমস্যার সমাধান নিয়ে বক্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: বুধ, ০৭/০১/২০০৯ - ৫:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাগিব লিখেছেন:
আর, বুয়েটের শিক্ষকেরা অন্যায্য দাবী করলে যেমন সরবে তার প্রতিবাদ করা হয়েছে, বেয়াড়া কিছু ছাত্রদের পরীক্ষা পেছানোর দাবীকেও সেরকমই গদাম লাথি জানাচ্ছি। পাবলিকের টাকায় পড়াশোনা করে দুই দিন পর পর অমুক-তমুক অজুহাতে পরীক্ষা পেছানোর দাবী করা কারো সাথে পুতুপুতু বাবা বাছা করে কথা বলার কোনো রূচি হয় না। দুনিয়ার আর কোনো দেশে এরকম হয় না, ২-৩ মাস বন্ধ পেয়েও আবারো পরীক্ষা পেছানোর কথা কেউ মুখে আনতে পারে। ধিক!

রাগিবের এই মন্তব্যের সূত্র ধরে সামগ্রিকভাবে আমার বক্তব্য:

এখানে একটা প্রহসন আছে। এই ২/৩ মাসটা কিন্তু প্রথমেই বলে দেয়া হয় না, সময়টা আসে স্টেপ বাই স্টেপ বেসিসে। ফলে, ছাত্ররা এই অনিশ্চিত সময়টার জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্ল্যান করতে ব্যর্থ হয়। পড়াশোনার সিস্টেমেও গলদ আছে। অনেক বিষয়ই আছে মুখস্ত করা লাগে। প্রথম ১ মাসে যা পড়া হলো, পরের ২ সপ্তাহে তার অধিকাংশই ভুলে যায়, সবকিছু একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। সেকেন্ড টাইম শুরু করলে অনেকের ক্ষেত্রেই আগের মত কনসেন্ট্রেশন আসে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমার সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট হয়েছিলো ১১ মাসের সেমিস্টারে।

আমার মতে, সবচেয়ে বড় সমস্যা অথোরিটির পরীক্ষা প্ল্যানিংয়ে। ছুটির সময় ছুটি, কাজের সময় কাজ - এই নীতিতে চললে সবচেয়ে এফেক্টিভ রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এজন্যই রোজার বন্ধ, ঈদের ছুটি, নির্বাচন ইত্যাদির সাথে যোগ করে পিএল বা পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করলে আখেরে ক্ষতি।

দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেগুলো কেন বারবার পরীক্ষা পিছাতে সচেষ্ট হয়, কর্তৃপক্ষের উচিত সেদিকে নজর দেয়া। যে কারণগুলো দেখানো হয়:

১) রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি: বুয়েটে শতকরা কতভাগ ছেলে অ্যাকটিভলি পলিটিক্স করে? খুবই নগণ্য। যারা পলিটিক্স করে, তাদের নিজেদের জন্য পরীক্ষা পেছানোর তেমন দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাদের অধিকাংশেরই দরকার পাস গ্রেড এবং তার জন্য ২ সপ্তাহের পিএল যা, ২ মাসের পিএলও তাই। তারপরেও পরীক্ষা পেছানোতে এদের অবদান আছে। কারণ, অনেক 'নিউট্রাল' ছেলেও পরীক্ষা পেছানোর জন্য এদের দিকে চেয়ে থাকে। এখন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা কি তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবো? সব সমস্যারই সমাধান আছে, প্ল্যানিংয়ে ত্রুটি না থাকলে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠেও নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব।

২) ফ্রি পড়ে তাই চিন্তা নাই: এইটা একটা রাবিশ তত্ত্ব। পাবলিক ইউনিভার্সিটি সো কলড ফ্রি পড়ার জন্যই। আর ফ্রি পড়লেই কেউ দায়িত্ব-জ্ঞানহীন হয়ে যায় না। (প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিস্টার ক্লাস নেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেক স্টুডেন্টই রেগুলার ক্লাস করে না, এক ল্যাব কোর্সে গ্রেডিং করতে গিয়ে দেখি ২/৩ জন এমনকি ফাইনাল কুইজও দেয় নি। এমন না যে, অসুস্থ ছিলো। পাস করানোর জন্য তাদেরকে আমিই ডেকে এনে আলাদা কুইজ নেই। বুয়েটে এই অবস্থা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না।) ফ্রি পড়া ঠেকাতে তাই টিউশন ফি আরোপের মত দুর্ঘটনা ঘটলে পরীক্ষা পেছানো বন্ধ তো হবেই না, উপরন্তু অনেক স্টুডেন্টই বিপাকে পড়বে। আমাদের দেশে স্টুডেন্টদের বাড়তি অর্থ সংস্থানের স্কোপ খুবই সীমিত।

৩) টিউশনি করে তাই পড়াশোনা করার সময় পায় না: সার্বিকভাবে এইটাও আরেকটা ফালতু কথা। কিছু কিছু পোলাপান আছে কোচিং সেন্টার ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। তার বাইরে বুয়েটের অধিকাংশ ছাত্রই টিউশনি করে স্রেফ পড়াশোনার টাকা ম্যানেজ করার জন্য। এই দলে ক্লাসের ফার্স্টবয় যেমন আছে, ক্লাসের লাস্টবয়ও তেমন আছে। কোচিং সেন্টার ব্যবসায়ীরা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। পরীক্ষা পেছানো আন্দোলনে দেয়ার মত সময় তাদের প্রায়ই থাকে না। দ্বিতীয় দলের জন্য তাড়াতাড়ি পাস করে বেরোনোই মঙ্গল। এমন না যে, সেমিস্টার দীর্ঘায়িত হলে রেজাল্ট ভালো হবে। পরীক্ষা পেছানোর মিছিলে আমি নিজেও অনেকবার গিয়েছি। গড়পড়তায় টিউশনিও করতাম ২টা। কিন্তু টিউশনি করে নিজে পড়তে পারি নাই, তাই পরীক্ষা পেছাও, এরকমটা কখনো হয় নি। অসুস্থতা ছাড়া ক্লাস ফাঁকি দিতেও হয় নি কখনো।

যেভাবে ঘটে অঘটন:
প্রথম সিনারিও: এখনকার অবস্থা জানি না, তবে আমাদের সময়ে সেশনালের কুইজগুলো থাকতো ক্লাসে শেষ দুই সপ্তাহে। ওইগুলো দিতে দিতেই পোলাপান টায়ার্ড হয়ে যেত। গ্রেড নির্ধারণে এই কুইজই ছিলো সবচেয়ে পায়াভারী জিনিস। এ অবস্থায় পোলাপানের দাবি থাকতো ৩ সপ্তাহ পিএল-এর। কর্তৃপক্ষ অনড়। তারা ধনুকভাঙ্গা পণ করেছেন, পিএল বাড়ানো হবে না। এক সপ্তাহ বাড়লে কেয়ামত হয়ে যাবে। ফলাফল ডিএসডাব্লিউ/ভিসির কাছে অনুরোধ, মিছিল করে সময় নষ্ট। যারা মিছিল করে না, তারাও পড়াশোনায় ঢিলা দেয়। কারণ, এক পরীক্ষার জন্য ২ বার প্রস্তুতি নেয়ার মত বিরক্তিকর কাজটি অনেকেই করতে চায় না।
দ্বিতীয় সিনারিও: এবার যেমনটা ঘটেছে, পিএল এর সাথে অন্যান্য ছুটির ওভারল্যাপ করে স্কেজিউল করা হয়। ফলে পোলাপান না পারে ছুটিতে রিল্যাক্সড হতে, না পরে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে। একটা অস্থির সময়ের হতাশবোধ থেকেই মূলত পরীক্ষা পেছানোর ফন্দিফিকির শুরু করে।

সমাধান কি হতে পারে?
১) প্রথমে দরকার সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের ধরণ এমন করা, যাতে পরীক্ষার চাপ কমিয়ে ছাত্ররা কি শিখলো তার যথাযথ মূল্যায়ন করা যায়। ম্যাক্সওয়েলের ফর্মূলার প্রমাণ মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় বমি করাজাতীয় প্রশ্নপত্রের হাত থেকে ছাত্রদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত।

২) পিএল সিস্টেমটাই তুলে দেয়া যায়। ছাত্রদের সাথে ক্লাসে আলোচনা করে প্রত্যেক শিক্ষক কোনো বিষয়ের পরীক্ষা কবে নিবেন, তা ঠিক করতে পারেন।

৩) সারা ইউনিভার্সিটি একসাথে পরীক্ষা না নিয়ে প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের ওপর তাদের পাছা সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া। এই প্রক্রিয়ায়ও পিএল দরকার নেই।

৪) এরপরেও পিএল রাখতে হলে সেশনালের কাজগুলো আগেভাগেই শেষ করা, যাতে সেমিস্টারের লাস্ট ২ সপ্তায় ছাত্রদের নাভিশ্বাস না ওঠে। টার্মের শুরুতে এমনভাবে প্ল্যান করা, যাতে পিএল/পরীক্ষা অন্য কোনো 'জনগুরুত্বপূর্ণ' ছুটির সাথে ওভারল্যাপ না করে। (ইউনির বাইরের ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনা করতে হবে কেন, এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে সমস্যা যেহেতু হচ্ছে, এটাও একটা বাস্তব সমাধান বলেই মনে হয়।) পিএল না বাড়িয়ে পরীক্ষার মাঝে গ্যাপ বাড়ানো যেতে পারে।

৫) শিক্ষকদের মূল্যায়ন সিস্টেম চালু করা। বুয়েটের জন্য এটা খুবই দরকার।অনেক শিক্ষকই আছেন, যারা আদ্যিকালের চোথা আবৃত্তি করে টার্ম শেষ করেন। ক্লাসে ভালো না পড়ালে সেমিস্টারের শেষে গিয়ে ছাত্রদের ওপর চাপ বেশি পড়ে। একজন ছাত্র যেমন ইচ্ছামত টিউশনি করতে পারে, একজন শিক্ষকও ইচ্ছামত প্রাইভেটে ক্লাস নেন - কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তার জন্য মেইন কাজের ক্ষতি যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্যও এই মূল্যায়ন দরকার। এটা করলে ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কেও উন্নতি ঘটবে। কোনো শিক্ষক যেমন ছাত্রকে ঝাড়ি দিতে পারবেন, "এই ছেলে তোমার স্টুডেন্ট নাম্বার কতো?" বলে, ছাত্রও মুচকি হেসে বলতে পারবে, "স্যার, কোন সাবজেক্টের ক্লাস নেন?" চোখ টিপি

৬) শিক্ষকেরা সামার ভ্যাকেশনও নেন না শুনে খুব অবাক এবং দুঃখিত হয়েছি। এত নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার দরকার নেই। আপনারা আপনাদের প্রাপ্য ছুটি নিন, ছুটিতে রিল্যাক্সড হউন। ছুটির পরে আবার পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসুন ক্লাসে। এমনকি যন্ত্রেরও বিশ্রাম দরকার। আর একজন মানুষ বিশ্রাম না নিয়ে কতোটা কাজ করতে পারে? সে কাজের কোয়ালিটিই বা কেমন হবে?

৭) ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নয়ন। এটা কিভাবে করা যায়, দুইপক্ষই ভাবুন।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।