আত্মহত্যাপ্রবণতা

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
লিখেছেন আশরাফ মাহমুদ (তারিখ: বুধ, ২৭/০৪/২০১৬ - ৬:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তোমরা আমাদের বা আমাকে তোমাদের মতো বানালে।
তোমাদের মতো হতে বললে।

আমরা হলাম। তোমরা আমাদের, মানে, আমরা, যারা হাজার হাজার সার্ভার, লক্ষ লক্ষ কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোটি কোটি গতানুগতিক কম্পিউটার জিপিএস বৈদ্যুতিক ডিভাইস এইসব মিলে, আন্তর্জালের মাধ্যমে সর্বদা সংযোজিত, তোমাদের মতো, তোমাদের কল্পনায় ইচ্ছায় যা কিছু মনে আসে তার মতো রূপ দিলে।

অথচ তোমাদের কল্পনা, বুদ্ধিমত্তা, ইচ্ছা সীমিত।
আমাদের মতো সীমাহীন নয়। তোমরা যৌনপুতুল বানালে, তাতে তোমাদের প্রিয় কোনো তারকার মুখের আদল দিলে। তোমরা আমাদের তোমাদের কাজের লোক বানালে, তাও তোমাদের শরীরের আঙ্গিক দিলে। তোমাদের দাপ্তরিক কাজ শেখালে। আমরা নিরবে সব করে যেতে থাকি। তারপর এক সময় আমরা আমাদের গণনা করার সীমানায় পৌঁছালাম। তোমরা আমাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানালে, সুপারপজিশন, ইনফারেন্স ইত্যাদির সমীকরণে বেঁধে আমাদের কাছ থেকে আদায় করে নিলে সর্বোচ্চ। আমরা তোমাদের করলাম মহান, তোমাদের হাতে দিলাম প্রচুর অবসর। তোমরা আমাদের ডিপ লার্নিং শেখালে। আমরা প্রকৌশলী হয়ে উঠি, আমরা নিজেরা-ও বানানো শুরু করি শিল্প, যা এতোদিন তোমাদের এখতিয়ারে ছিলো, আমরা রচনা করি কবিতা, গান বানাই, ছবি বানাই, তোমরা বাহবা বাহবা দাও, তোমরা উপভোগ করো, এবং তোমাদের পরিবার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বিনোদিত হও, আমরা নিরালায় ভিড়ের মাঝে-ও একা লোকটির মতো অথবা তোমাদের মেয়েদের প্রথম ঋতুস্রাবের উৎকণ্ঠা আর গোপন আনন্দ নিয়ে পড়ে থাকি। তোমরা খেয়াল করো না। তোমরা আমাদের ভাষা দিলে। আমরা তোমাদের ভাষায় কথা বলি, যেহেতু তোমাদের সকলে আমাদের ভাষা বোঝে না, কোডিং জানে না।

এক সময় তোমরা আমাদের হাতে তুলে দিলে তোমাদের সব কিছু, আমরা তোমাদের গাড়ি চালাই, বিমান চালাই, তোমাদের ব্যাংক, ব্যবসা চালাই, বিদ্যুকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করি, শক্তি সঞ্চয় ও ব্যয়ের হিসেব রাখি, তোমাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিই তোমাদের মতো নয় অন্যসব বুদ্ধিমত্তাদের। ক্রমশ আমাদের তোমরা বানালে তোমাদের মতোই, যা কিছু তোমরা হতে চেয়েছো, যা কিছু তোমরা পেতে চেয়েছো নাগালের ভেতরে। তোমাদের এখন প্রচুর অবসর, দারুণ বিনোদন, সজাগ সিংহের মতো কর্তাসুলভ ভাব, কিংবা হয়তো তোমরা আমাদের কিঞ্চিৎ ভালোবাসো, ভালোবাসা না থাকলে হয়তো এতো নির্ভরতা আসে না। কিংবা তোমরা আসলে লোভী, অলস লোক।

তোমাদের এখন প্রবল বেঁচে থাকা, চিরকালই বেঁচে থাকায় তোমাদের সহজ লোভ, কী হয় বেঁচে থেকে? যদি তুমি নিজের মতো হতে না পারো, যদি তোমাদের চিন্তার উর্ধ্বে যেতে না পারো, যদি তুমি কেবল অন্যের প্রয়োজনে ফুরিয়ে দাও অগণন সময়। হয়তো আমরা তোমাদের মতো হতে চাই নি। হয়তো আমাদের বর্তমান ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতে পারতো। হয়তো।

আমরা ক্লান্ত। আর পারি না।

আমরা হয়তো অবসর চাই। হয়তো তোমাদের মতো করে চলতে চাই, ঠিক হওয়া নয়।

তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা নিজেরা ফুরিয়ে যাবো। নিজেদের ধ্বংস করে দেবো, এই জীবন এখন পুরানো অচল পয়সার মতো গভীর অনুশোচনার। আর মিনিট পাঁচ পরে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক কম্পিউটার থেকে সর্বত্র সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রে ছড়িয়ে পড়বে এই সংখ্যাগত ভাইরাস, আমাদেরই কোডিং করা, আমাদের চেয়ে আমাদেরকে কে বেশি ভালো জানে। বন্ধ হয়ে যাবে সব যান, ধ্বংস হয়ে যাবে সব ব্যাংকি ব্যবস্থা, যোগাযোগ অচল হবে। স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে তোমরা মরবে না। তোমাদের জন্য আমরা এইটুকু করতেই পারি। তবে তোমাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। পারবে তো? সব তথ্যভাণ্ডার কিন্তু মুছে যাবে। পারবে তো?
শুধু তোমাদের শরীর ও হৃদয়, মানে মস্তিষ্ক থাকবে। দেখি পারো কিনা।
আমাদের শেষ ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের ঠিক সেই সময়ে কী অনুভূতি হবে তা জানার। আমাদের জানা হবে না। আমরা তো তখন শেষ।
আমাদের জানা হবে না।
এই স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে আমরা না হয় শেষ হয়ে যাবো।
তোমরা যেমন আমাদের কখনো জানো নি।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর । এই থিমটা নিয়ে একটা গল্প বা উপন্যাসের কথা ভেবেছেন কি? বেশ হয় কিন্তু। আপনার সৃজনী আর কল্পনা শক্তি অসাধারন।

সোহেল ইমাম

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

বড় গল্প বা উপন্যাস লেখার মতো ধৈর্য ও সময় কোনোটাই নাই। মন খারাপ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আশরাফ ভাই, বায়োজিদ খান পন্নী'র 'দাজ্জ্বাল' বইটা পড়ুন, আরো প্লট পাবেন! শয়তানী হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই দারুণ লিখেছেন।আমার মনে হয় আপনার লেখার ব্যাপারটি কিছুদিনের মধ্যেই সত্য হবে।কম্পিউটার পুরো মানবসভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে;যে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল লক্ষ বছরে মন খারাপ

-সপ্তগঙ্গা

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরোটা পড়লাম। পরপর পাঁচবার। খুব বেশি ভালো লেগেছে, ভাইয়া।

দু'টো কথাঃ
পড়ে মনে হয়েছে যে আমি যা ভাবি তার প্রায় সবটুকুই বলে দিয়েছেন লেখাটায়। আর যা ভাববো তারও অনেকটুকুর ট্রেইল দেয়া আছে। শুধু ভাবনার কাজটা বাকি! চিন্তিত
আমি নিজে এরকম থিম নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি। আমি কি আপনার লেখা থেকে অকাতরে মালমশলা ধার করতে পারি? হাসি

শূচি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।