পুনর্মিত্রতা কী জিনিস?

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব বর্ণন (তারিখ: রবি, ১৫/০৫/২০১১ - ৬:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পার্থক্য বড় ঝামেলার বস্তু। বিশেষ করে যেইসব লোকজন দশজনের ঠিকাদারী নিয়ে রাখেন, যেমন, রাষ্ট্র, হুজুর, বহুজাতিক কর্পোরেট কিংবা পাড়ার ষণ্ডা। তাদের জন্মশত্রু হলো পার্থক্য। মানুষে মানুষে পার্থক্য। মতে মতে পার্থক্য। ধর্মে ধর্মে পার্থক্য। জাতে জাতে পার্থক্য। ফলে ঠিকাদারেরা সাধারণত মানুষরে বুঝায়, পার্থক্য বলে কিছুই নাই। খালি মিল আছে। সব রঙ একরকম। সব কিছু মিলমিশের মধ্যে আছে। বা মিলমিশ হওয়ারই খালি দরকার আছে। খুব প্রয়োজন পড়লে তারা কয় - রকম খালি দুইটা, কিংবা তিনটা-চারটা। বাদবাকিরা চেনা-জানা রকমগুলাতে মিলমিশ হয়ে যাও। মানুষও বোঝার চেষ্টা করে তাদের কথা। ভাবে - সবার মনে হয় এক হয়ে যাওয়াটাই সমাধান! যদিও হরেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। লক্ষ লক্ষ লোকের এক বা দুইরকম হয়ে যাওয়াই অস্বাভাবিক। এই একাকার করার হেজামোনি কেবলই ঠিকাদারদের ঠিকাদারীর সুবিধার জন্যে। তাদের হেজামোনি টিকিয়ে রাখার জন্যে। লোকে কেনো তাদের হেজামোনি টিকিয়ে রাখার জন্যে নিজেরে সাবাড় করে দিবে?

হেজামোনিকরা কেউ বলে সব মুসলমান ভাই ভাই তো কেউ বলে বাঙলার হিন্দু, বাঙলার মুসলমান, বাঙলার খ্রিস্টান সব একজাত - বাঙালি। কেউ বলতে চায় অবাঙালিরা সব বাঙালি হয়ে যাও। আবার কেউ বলে পশ্চিম বঙ্গের সাথে এক হয়ে যাও। কেউ বলে আমরা নাকি বৃহত্তর ভারতের পার্ট। আবার কেউ বলে - আমরা হলাম পাকিস্তানের হারিয়ে যাওয়া ভাই। সকল মানুষই নাকি এক ধরনের হিন্দু। আবার সব মুসলমানেরও নাকি বিশ্বাস একটাই। পার্থক্যগুলা লোপাট করে দেয়া এই হেজামোনিক প্রপাগান্ডা সবই আসলে ঝুট। পার্থক্যগুলা জানা দরকার। স্বীকার করা দরকার। একাকারওয়ালাদেরকে অস্বীকার করা দরকার।

ঠিকাদারের দ্বারা পার্থক্য স্বীকার করে নিলেই ঝামেলা শেষ হয় না। ঠিকাদার নাৎসিরা যেমন ইহুদিদের আলাদা করে ঠিকই দেখেছে। কিন্তু তাতে ভালো কিছু হয় নাই। পার্থক্যগুলোর মধ্যে উপর-নিচ করে দেখেছে। কিন্তু পার্থক্য পার্থক্যই। পার্থক্যে উপর-নিচ নাই। এইটাই তাবৎ ঠিকাদারের সমস্যা। হয় উপর-নিচ করে দেখে, নয় মিলিয়ে দেয়। ঠিকাদারদের ঠিকাদারী সুবিধা করার জন্যে মতের বলিদান জনগণের কর্ম না। জনগণের মতের রক্ষাস্বার্থে ঠিকাদারদের হেজামোনির অবসান প্রয়োজন। জনগণ ঠিকাদারের গোলাম না। যদি কিছু হয় তো ঠিকাদারেরই জনগণের গোলাম হওয়া দরকার। ঠিকাদারী নিলে গোলামিও মানতে হবে।

এতটুকু বলার পরে পরিষ্কার করে নিতে চাই, হেজামোনিক যেসকল মতপথ, তাদেরকে যে মানুষের বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্যের শত্রু হিসেবে দেখাচ্ছি, তাতে কিন্তু এটা বোধ করছি না যে এ সকল মতপথকে সেন্সরবোর্ড, র্যাব কিংবা পুলিশ দিয়ে দমন কাম্য। রাষ্ট্র দ্বারা মতের দমন আরেক হেজামোনি। এমন কি হেজামোনিক মতের দমনও! মত পছন্দ হিসেবে উৎসারিত হয়। তার বিরোধিতাও পছন্দ হিসেবেই উপস্থাপিত হবে। মত প্রচারের স্বাধীনতার অঞ্চলে এদের সকলের বিচরণেরই সুযোগ আছে। আমার এই মত অনেকে নাও মানতে পারেন। কিন্তু এমন কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার (সংবিধানের) মৌলিক অধিকার অংশে “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা” এবং “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানোর প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ”-এর মাঝখানে নিঃশ্বাস ফেলার যথেষ্ট সুযোগ আছে। ফলে যারা “দুই বঙ্গ এক হোক মনে করি” বলা মাত্র সেটাকে “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানোর প্ররোচনা” এবং ফলত ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন তাদের স্মরণ করায়ে দিতে চাই যে এই ধরনের ‘থট-ক্রাইম’-এর মতো হেজামোনিক ধ্যানধারণার স্বীকৃতি বাংলাদেশের সংবিধানে পাওয়া যাবে না। আমি নিজে মতের বলপূর্বক দমনকে বিনোদিত করি না। মতের বিরোধ মত প্রকাশের স্বাধীনতার অঞ্চলেই বিরাজ করবে।

এগুলো যখন বলা গেলো, এখন তাকায়ে দেখি পুনর্মিত্রতা কী জিনিস। কী তার গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ? পুনর্মিত্রতার গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ হলো অনেকটা এই রকম --- বাংলাদেশের মধ্যে বাঙালি বলে পরিচয়দানকারীকে হিংসা, ঘৃণার ভাতৃঘাতী ধ্যান-ধারণার মীমাংসা করে পাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় ভাতৃপ্রতিম, ক্ষমাপ্রার্থী অংশটির সাথে পুনরায় মিলনের সম্ভাবনাকে চিন্তা করে দেখতে হবে। এর রকম ফের আছে। যেমন - আমরা আসলে এখনও হারানো ভাই-ই রয়ে গেছি, কিংবা ঘৃণার চেয়ে ভালোবাসা উত্তম। আমি পুনর্মিত্রতার সকল ভার্শনকে এক বাক্যে সাবাড় করে দিতে চাই না। নানান রকম ফের অবশ্যই আছে। তবে যেটা নাই, সেটা হলো পার্থক্যের মধ্যে বলবৎ থাকতে চাওয়ার স্বীকৃতি। ভালোবাসার অন্ধত্বে আলাদত্ব গায়েব। বাঙালি বলে পরিচয় দেয়া লোকটা যে যেকোনো রকমের পাকিস্তানির চাইতে আলাদা থাকতে চেয়েছে, সেই আলাদত্বকে তো লোপাট করা হয়েছে, নাকি? কীভাবে করা হয়েছে? এটা বলে যে এই আলাদা থাকতে চাওয়া হলো ঘৃণার বেসাতি। এতে আছে কেবলই বর্ণবিদ্বেষ। আর পুনর্মিত্রতায় কী আছে? কেবলই ভালোবাসা। বড় শক্তিশালী এ চিন্তা! ভালোবাসাই তো মহৎ ও মানবিক, নাকি? মিত্রতাই তাহলে একমাত্র গন্তব্য? কিন্তু এই দৃশ্যত মহৎ চিন্তাটা পার্থক্যকে নিকাশ করে দেয়া হেজামোনিক ধ্যান-ধারণার গোষ্ঠির বাইরে থাকতে পারে না। একে মানুষের পার্থক্য ও বৈচিত্র্য অস্বীকার করা আরেকটা রাজনৈতিক, হেজামোনিক পছন্দ হিসেবে না দেখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যের চেয়ে আলাদা থাকার বিপরীতে দৃশ্যত অবধারিত এই মিত্রতার ‘মহৎ’ পছন্দ আরেকটা হেজামোনিক পছন্দই।

জাতে জাতে যে পার্থক্য, সেটার মধ্যে বিজাতকে অপছন্দ অবিচ্ছেদ্য। এই অপছন্দটা ঠিকাদারের ধারণ করা চলে না। রাষ্ট্র জাতপাতের মধ্যে পছন্দ দেখালে সমস্যা। কিন্তু জাতের অস্তিত্বের প্রথম শর্তই তো নিজের জাতকে অন্যের জাতের চেয়ে বেশি পছন্দ করা। অন্যের জাতকে নিজের জাতের চেয়ে বেশি অপছন্দ করা। ইহুদি অইহুদিকে অপছন্দ করে, মুসলমান অমুসলমানকে, হিন্দু অহিন্দুকে। এটাকে অনেকে নানারকমের সমস্যার মূল বলে থাকেন। কিন্ত হেজামোনিক ঠিকাদারের মতো পার্থক্য ভুলে যেতে বলা বা একাকার করে দেয়া তার চেয়ে বড় বেশি ভয়ানক সমস্যা। লোকে মনে করে - পৃথিবীর সকল মানুষ এক রঙের হয়ে গেলে অনেক সমস্যার সমাধানই হয়ে যেতো। পাঞ্জাবিরা সকল বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে বাচ্চা পয়দা করে বাঙালি জাতি নাশ করে দিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। সকল হিন্দুয়ে মুসলমান, আর সকল পাহাড়ি লোকে বাঙালি হয়ে গেলে আর কী লাগে? ইহুদিরা পৃথিবীটা থেকে গায়েব হয়ে গেলেও অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেতো। নাকি? যেদিন পৃথিবীর সব মতকে এক হয়ে যাবে, সেদিন থেকেই মতের ভিন্নতার আবার শুরু হবে। মানুষের যে নানারকম ভাবার, নানাভাবে নিজেকে উদ্ধারের ক্ষমতা, এর বিরুদ্ধে কোন রকম মিলমিশ করে দেয়া চিন্তারই টেকার ক্ষমতা নাই। ভালোবাসারও নাই। সাম্যবাদেরও নাই। বা অধুনা আবিষ্কৃত বহুজাতিক পুনর্মিত্রতারও নাই।

আমি এই এক করে দেওয়াকে অস্বীকার করি। পুনর্মিত্রতা বা মিলজুলের ধ্যান-ধারণার আহ্বানকে ব্যক্তির মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ধারণা হিসেবে অস্বীকার করি। পুনর্মিত্রতা হলো আরও একটা আধিপত্যবাদী, লোপাটমূলক, হেজামোনিক কন্সট্রাক্ট। আমি পার্থক্যকে দেখতে এবং দেখাতে চাই। কোন গোষ্ঠি যদি আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে চায়, তাকে আমি নানান পার্থক্যগুলা ধরায়ে দিতে চাই, আরেকটা আধিপত্যবাদী গোষ্ঠির সাথে একতাবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা হওয়া দেখতে চাই না। আমার কিছুই যায় আসে না, কে এই পুনর্মিত্রতার জন্যে কার কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিলো, কি না নিয়েই পুনর্মিত্রতার তত্ত্বে ইমান আনলো। আমার কাছে এই ধারণা সমান আধিপত্যবাদীই থাকে তাতে। এটা সর্বাবস্থাতেই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য-লোপাটমূলক, অগণতান্ত্রিক, মানব-অঘনিষ্ঠ এবং ফলত অমানবিক। মুসলমানের ধর্ম লোপাট করে দেয়ার চেয়ে তার নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসের উপর বহাল থাকতে দেয়াই অধিক গণতান্ত্রিক। পাকিস্তানি জাতিকে যে বাংলায় লোকে ঘৃণা করে, এটাও একটা বিশাল জনগোষ্ঠির বাস্তবতা। সে বাস্তবতা বাঙালিকে ঘৃণা করা পাকিস্তানিদের বাস্তবতার মতোই। এতে বিবদমান সমস্যাগুলো কী কী, সেটা নিয়ে কথা চলতে পারে। কিন্তু সাম্যবাদী কিংবা আন্তর্জাতিক কোকের ঠিকাদারীতে সমস্যা হয় বললে চলবে না। বা পুনর্মিত্রতার মতো লোপাটমূলক হেজামোনির চেয়ে উত্তম কিছু ভাবেন।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যুক্তির আলোচনা দুই ভাবে হতে পারে। এক, প্রতিপক্ষের একটি যুক্তি উপস্থাপন করবেন তার পর পরই সেটিকে খণ্ডন করবেন। এখানে প্রতিপক্ষের একটি যুক্তির সাথে তাদের সম্পূরক ভাবনাটাগুলোও আসতে পারে। তাতে আলোচনা লম্বা না করে আপনার একটি প্রতিযুক্তিই সম্পূরক ভাবনাসহ উপস্থাপিত যুক্তিটিকে খণ্ডন করতে পারে। দুই, প্রতিপক্ষের সবগুলো যুক্তি ও সম্পূরক ভাবনা একাদিক্রমে উপস্থাপন করবেন তারপর আপনার পালটা যুক্তিগুলো উপস্থাপন করবেন।

প্রথম পথের সুবিধা হচ্ছে, এতে দর্শক-শ্রোতা-পাঠককের মর্মমূলে আপনার যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে দর্শক-শ্রোতা-পাঠককের মাথায় প্রতিপক্ষের মতবাদ প্রথমেই একটু একটু করে গেড়ে বসে, ফলে আপনার পালটা যুক্তিগুলোকে তার মূলোচ্ছেদ করতে বাড়তি খাটুনি দিতে হয়।

এই লেখাটিতে আপনি যুক্তিখণ্ডনের দ্বিতীয় পথটি অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আপনার পালটা যুক্তি দেবার কালে বাড়তি সময়টুকু দেননি, উদাহরণ দিয়ে যুক্তিগুলোকে সাধারণের জন্য সহজবোধ্যও করেননি। লেখাটিকে যদি কখনো সম্পাদনা বা পুনর্লিখনের কথা ভাবেন তাহলে যুক্তিখণ্ডনের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আরেকবার একটু ভাববেন - পাথক হিসাবে এটা আমার অনুরোধ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

অনুরোধের জন্যে ধন্যবাদ। আমার কথা যদিও ঠিক এইটুকুই। সেটাতে পাঠকের অবোধগম্যতা অকাম্য নয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনি কি "কাম্য নয়" বলতে চেয়েছেন? যেমন আমি "পাথক" নয় "পাঠক" বলতে চেয়েছিলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

mahrufa এর ছবি

ami o ei ek kore deya k osshikar kori... morme morme osshikar kori... r lekhon shoilir bepare kichu bolar nei karon ami shudhumatro pathok
---- the reader

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।