মহাকাশযান আর রোমান ঘোড়ার পুচ্ছদেশ

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: রবি, ২৪/০২/২০০৮ - ৬:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoসেই বুধবার থেকে ত্রৈমাসিক হ্যালো কনফারেন্সে আটকে আছি। চেন্নাই, হেগ, লন্ডন থেকে আমার দলের সবাইকে নিয়ে এই তিন দিন ব্যাপি অন-লাইন মগজ-ঝড় আর জল্পনা কল্পনার ধুম। বিষয়টা হল আমাদের কম্পানির একটা নতুন সামগ্রীকে বাজারে উপস্থাপনা আর ভোক্তাদের মধ্যে এর গ্রহনযোগ্যতা নিশ্চিত করা। আপাতত লক্ষ হচ্ছে ২০১৫ নাগাদ এই সামগ্রিকে বাজারে পাকাপোক্ত করে বসানো। কারিগরি আর অর্থনীতির কাজ বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে, আর যাচ্ছে, কিন্তু বিতর্ক বার বার বিপনন ব্যবাস্থায় এসে আটকে যাচ্ছে। আসলেই তো! এই সমগ্রীর মধ্যে কতটা নব্যতাপ্রবর্তন (innovation) আনলে পরে ভবিষ্যতের সেই ভোক্তাগন এর দিকে ঝুঁকবেন? ইউরোপীয় জনগন তাদের জীবনযাপনে কতটা আধুনিক হবে? এইসব। আগামি কনফারেন্সে মনে হচ্ছে ম্যাকেঞ্জির geek-pool থেকে কোন মোটা চশমাদার কাউকে আনতে হবে, এই বিষয়টা খোলাসা করতে।

===

আজ শুক্রবার সকাল সকাল শুরু করে এগারটার মধ্যে এই আপদটা শেষ হওযার কথা থাকলেও দুপুর পর্যন্ত গড়াল। এখানে সবাই বারোটায় লাঞ্ছে যায়। হ্যালো-ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, সারা ফ্লোর খালি, সবাই ক্যাফেটারিয়াতে চলে গেছে। ক্যাফেটারিয়ায় পৌঁছে অবশ্য আমার দলকে সহযেই খুঁজে পাওয়া গেল। টেবিলে খাবার নামিয়ে রাখতে রাখতে চেয়ার টেনে বসার অবসরে কানে এল “মহাকাশযানের প্রস্থ আর রোমান ঘোড়ার পুচ্ছদেশ”। তিন দিনের কনফারেন্সে মাথা তখনো ঝম ঝম। স্বভাবতই মনে সন্দেহ দেখা দিল, আমি কি ঠিক শুনেছি?

নানা দিক থেকে ছুরি কাটার মৃদু টুংটাং আর মুখ ভরতি খাবরের প্রশ্নবোধক হুম হাম এগিয়ে এল বক্তার দিকে। মহাকাশ খেয়াযানের সাথে ঘোড়ার পুছদেশের কানেকশানটা কি? আর এত ঘোড়া থাকতে রোমান ঘোড়া কেন?

বক্তা ডেভিড। শুরুতে তাকে দেখে ব্লন্ড মনে হলেও আসলে সে শ্বেতি রোগাক্রান্ত। ক্যাফেটেরিয়ার অনধিক আলোতেও তার চোখ পিটপিট করছে। হাতের কাঁটাকে কন্সার্টের কন্ডাক্টরের মত হেলিয়ে দুলিয়ে সে বলে চলেছে “আরে ভাই, নাসা তো আর নিজেরা কলাম্বিয়া, ডিস্কাভারি, এন্ডেভার – এইসবের সবটুকু বানায় না। তারা নকশা করে দেয় আর গন্ডা গন্ডা সাবকন্ট্রাকটার তার টুকরা টাকরা বানিয়ে নাসার কাছে পাঠায়, তার পর গিয়ে নাসা সেগলো জোড়া লাগিয়ে আস্ত খেয়াযান খাড়া করে"।

টিমের সেক্রেটারি ইয়াসমিন তার লালবেগুনি চুল নেড়ে সামনের স্যালাডের বাটি থেকে একটা লালপানা পাতা কাঁটায় খূঁটিয়ে তুলে মুখের কাছে নিতে নিতে বলল, “তুমি বলতে চাও যে ওই সাবকন্ট্রাক্টরেরা আসলে রোমান ঘোড়া? হুমম, বেশ ইন্টারেস্টিং তো”।

আমারো মনে হয় আগামি সপ্তাহ থেকে কয়েকদিন স্যালাড খাওয়া উচিত, শুধু দৌড়ানোয় কাজ হচ্ছে না।

ইয়াসমিনের খোঁচার সরাসরি জবাব দিল না ডেভিড। “কিন্তু ঐ সাবকন্ট্রাকটারেরা তাদের গড়া টুকরাগুলিকে নাসার কাছে পৌছায় কিভাবে?”

সাপ্লাই- চেনের জন মাত্র মুখে কিছু স্পেগাটি ঠেসেছে। জিনিস পত্র নড়াচড়া নিয়ে কথা হছে, আর এই সময়ে তার মুখ ভর্তি, তা কি সয়? তারাতারি আধচাবানো স্পেগাটি গিলে নিয়ে বলে উঠল, “উত্তর আমেরিকায় ট্রাকটাই চলে বেশী, রেলেও তো বেশ কিছু মালমাল টানা হয়”।

কথাটা লুফে নিল ডেভিড। একটুও সময় নষ্ট না করে প্রশ্নছুড়ল “ তাই তো? কিন্তু ট্রাক হোক আর রেল হোক, এদের প্রস্থটাই তো বলে দেয় যে এরা কত প্রস্থের মালামাল টানতে পারে, নাকি? কিন্তু এদের প্রস্থটা এমনতর কেন?”

আমি সবে মাত্র আমার সুপের বাটির তলানিতে লুকিয়ে থাকা একটা মাংশের টুকরা আবিস্কার করেছি। আহা কি আনন্দ। চামচে তুলে নিয়ে বললাম “ওইটা তো ফোর্ড ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে।“

ডেভিডে একটা মাঝারি সাইজের কিল মেরে বলে উঠল "কিন্তু ফোর্ড বা ওয়াট তাদের যানবাহনের প্রস্থ ওই মাপের করতে গেলেন কেন?” সবার প্লেটগুলি খালি হয়ে এসেছে প্রায়। শুধু ডেভিডের প্লেটেই উচু হয়ে আছে কিছু সস মাখানো স্পেগেটী। “তার করন, সেই আমলের রাস্তাগুলিই ছিল এই মাপের, এর চাইতে চওড়া করলে গাড়ি বা রেল কোনটাই জনপ্রিয়তা পেত না”।

আস্তে আস্তে প্লেট গ্লাস চামচ কাটা গুছিয়ে নিচ্ছে সবাই। ফিলিপ চেয়ার ঠেলে ঊঠে দাড়িয়ে সবাইকে বলল “আমি ফ্রিজ থেকে দই আনতে যাচ্ছি, তোমারা কে কি চাও?” টেবিলে সবাই তাদের ফরমাশ জানিয়ে দিল। ফিলিপ এগিয়ে গেল কাফেটারিয়ার অন্য প্রান্তে রাখা ফ্রিজের দিকে। আর সবার অনুসন্ধিত্সু চোখ আবার ফিরে এল ডেভিডের ওপর।

ডেভিড বাধ্য হয়েই বলে চলল “আর ভেবে দেখ, তখনকার শিল্পন্নোত দেশগুলির যান বাহন ছিলে ঘোড়াগাড়ি, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, দুটি ঘোড়া পাশাপাশি জূড়ে দেয়া গাড়ি। মাল টানার জন্য একি গাড়ীতে বেশী ঘোড়ার ব্যবহার হত, কিন্ত পাশাপাশি থাকতো দুটো ঘোড়াই। আর এই দুই ঘোড়ায় টানা গাড়ি প্রচলন হয় সেই রোমান আমলে”।

==

লাঞ্ছ থেকে আমার ঘরে হেটে আস্তে আস্তে ভাবছিলাম কনফারেন্স আর ডেভিডের কথা। আসলেই তো, আধুনিকতা আসলে কি? যে সভ্যতার সর্বাধুনিক সব উদ্ভাবন আর প্রযুক্তির নিদর্শন দুইহাজার বছর আগের এক উদ্ভাবনের কাছে হার মেনে বসে আছে, মাত্র তিন চার বছরে অনেক নব্যতাপ্রবর্তন ঘটলেও, কিছু কিছু বিষয়ে তো আমরা রয়ে যাবো সেই অতিতেই।

প্রশ্ন হল, সেই অবিনশ্বর অতিতগুলি কি, যার থেকে আমাদের মুক্তি নেই?


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

ব্রডগেজ জানতাম রোমান চ্যারিয়টের চাকার দূরত্বের সাথে মাপ মেলানো।

পুরনো স্ট্যান্ডার্ডস খারাপ কী? যদি কাজে দেয়?


হাঁটুপানির জলদস্যু

দুর্দান্ত এর ছবি

খারাপ কেন হবে? আমি ভাবছি উলটো। পুরানো এইসব স্টান্ডার্ডের এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এরা আমাদের আধুনিক জীবন কে প্রভাবিত করছে তার যদি একটা বিষদ ফর্দ তৈরি হয়, তাহলে কোথায় নব্যতাপ্রবর্তন কঠিন আর কোথায় তা পারতপক্ষে সহজ তা কি বেরিয়ে আসবে না? কালের ধারায় যুগ যুগ ধরে যা মনবসমাজে অবিনশ্বর, খুব সহসা তার পরিবর্তন আনতে চাওয়া কেন?

হিমু এর ছবি

খুবই চোস্ত একটা ব্যাপার হবে, চোস্ত একটা পেপারও হতে পারে। মুর্শেদ নকশা আর উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে, এই ব্যাপারে ও মনে হয় কিছু ইনপুট দিতে পারে। মুর্শেদ, কুনঠে বাহে?


হাঁটুপানির জলদস্যু

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- রকেটের ফটুকটা দেখে একটা খাইষ্টা কৌতুক মনে পড়ে গেলো! মন খারাপ
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।