একটি বিরক্তিকর সকাল এবং ব্লাডি সিভিলিয়ানদের গল্প

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: সোম, ২৪/১২/২০০৭ - ১২:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


--------------------------------------------------------------
এইবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, বেশ বড় একটা বন্ধ পাচ্ছি। সাধারণত, পরীক্ষার সময় যা হয়, ভাবি, খালি পরীক্ষাটা শেষ হোক বাবাজি, তারপর যত কাজ জমে আছে সব শেষ করে ফেলবো। সেলফের নিচের তাকে রাখা সিসিএনএ'র কাগজগুলি, কিংবা তার উপরের তাকে রাখা লিনাক্স বাইবেল --- দেখি আর মনে মনে ভাবি, এগুলো এই বন্ধেই শেষ করতে হবে। ১ বছরেরও বেশি আগে কেনা জি আর ই বইটা তো মনে হয়, ডজনখানেক ডিমই পেরে ফেলেছে বসে থাকতে থাকতে। এই জগতসংসারে হেন কোন কাজ নেই যা আমি ফেলে রাখি নি পরীক্ষার পরে করবো এই আশায়।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই আমার নবজন্ম হয়। ধুর শালা কবে কোন কালে কি পড়বো ঠিক করে রেখেছিলাম, সেইগুলা এখন পড়ে কি হবে ? পরে পড়া যাবেখন। আমার দিন কাটে এখন সারাদিন সিনেমা দেখে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করে আর চ্যাট করে। অপরিচিত, অল্প পরিচিত, মধ্য পরিচিত, অতি পরিচিত ( আসলে পরিচিত গুলির বদলে পরিচিতা ব্যাবহার করলেই বেশি সত্য বলা হত ) --সবার সাথে ভাবের আদান প্রদান করে, কখনোবা একটি চলচ্চিত্র দেখে, রাত পার করে যখন আমি বালিশ এবং বিছানার কাছে নিজেকে সপে দেই, তখন পূর্ব দিগন্তে ডিম পোঁচের মত সূর্য উঠছে আর সুদূরে মুর্গা সম্প্রদায় নাইনথ সিম্ফনী বাজানো শুরু করে দিয়েছে। যখন নিদ্রাদেবী পাটে যান তখন বেলা প্রায় ১২-১২.৩০ । দিনগুলি মন্দ যায় না।


------------------------------------------------------------
কালরাতেও একজন পরিচিতাকে বিভিন্ন গাণিতিক ধাঁধা জিজ্ঞেস করে জ্বালিয়ে মারছিলাম। শরাফতের জিন্দেগীর এই এক সমস্যা। যথেষ্ট ত্যক্ত বিরক্ত হওয়ার পরেও ভদ্রতার খাতিরে তিনি বিশেষ প্রতিবাদ করতে পারছিলেন না। সব ঝামেলা শেষ করার পর, ঘুমাতে ঘুমাতে সেই ভোর ৫টা। মনের সুখে যখন ভোঁস ভোঁস করে নিদ্রা যাচ্ছি, হঠাৎ বিধি বাম। এমনিতেই পিতাশ্রী বেলা পর্যন্ত ঘুমানো ২ চোখে দেখতে পারেন না।সারাক্ষণ হাকডাক দিতে থাকে, আর হা হুতাশ করতে থাকে। এত বেলা পর্যন্ত কিভাবে কোন ছাত্র ঘুমায়,(হোক না তার পরীক্ষা শেষ) তা তার বুদ্ধির অগোচরে। আমি অবশ্য কানে বালিশ গুঁজে শুয়ে থাকি। আজ মনে হল, কেউ যেন ধাক্কা দিলো সকালবেলা (৯টার দিকে)। তবে কি আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পিতাজি প্রহারের পথ বেছে নিলেন ? কিভাবে একটা কড়া প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার ধাক্কা। এইবার রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা যথেষ্ট বেশি। আর পারলাম না। ৩০ সেকেন্ড হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে চোখটা খুললাম। দেখি, খুবই কোমল চেহারা করে, পিতাজি আমাকে বলছেন, আজ না ভোটার আইডি'র জন্য ছবি তুলতে যাওয়ার কথা। তাড়াতাড়ি উঠ। আমার ভেতর যে দেশপ্রেম এবং রাজনীতি প্রেম এত বেশি আগে টের পাইনি। সাথে সাথে আমি উঠে, দাঁত মাজতে চলে গেলাম।


-----------------------------------------------------------------

স্থানীয় কেন্দ্রে যেয়ে দেখি, রীতিমত উৎসব চলছে সেখানে। কতিপয় জলপাই পোশাকের আর্মি চাচ্চুরা বসে আছেন। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে খোশ গল্প করছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ষণ্ডা-পান্ডা-গুন্ডা গোছের কিছু পাতি এবং ব্যার্থ নেতা। খুব ছোটবেলা থেকেই আমার অবজারভেশন হচ্ছে, এই শ্রেণীর লোকেরা পুলিশ-আর্মি দেখলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। কি ভাবে তাদের সাথে একটু খাতির করা যায়, এই ভাবনাতে তাদের নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকে,শরীরে মৃদু কাঁপুনি দেখা দেয়। চোখ কিছুটা ঘোলাটে হয়ে যায় ( এই বর্ণনা যদি কোন বাংলা গল্প/উপন্যাসের চুম্বন দৃশ্যর সাথে মিলে যায়, আমি ক্ষমাপ্রার্থী )। তারা সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে থাকে এমন ভাবে, যেন তারা আজকে যে করেই হোক হাতের রেখা মুছে ফেলে তবেই ঘরে ফিরবেন বলে প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার আর্মির সাথে বেশি খাতির করে ভাবি-সাহেবা কেমন আছেন তাও জিজ্ঞেস করছেন। আমার অবশ্য বেশ লাগছিলো দেখতে। তখনো চোখ থেকে ঘুম পুরাপুরি যায়নি। হাই তুলতে তুলতে আর চোখ ডলতে ডলতে এই নখরা দেখছিলাম। এইদিকে , যেই লোকের কাছে আমাদের তথ্য ফর্ম সে তখনো এসে পৌছুয়নি। তাকে মুহুর্মুহু ফোন করা হচ্ছে ( এদের কি মোবাইল বিল ফ্রী নাকি ? )। সেই লোক সমানে বলে চলছে, সে এখন রাস্তায়, যে কোন মূহুর্তে এসে পৌছুবে। ২ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ঐ লোক তার একই বক্তব্য থেকে সরেনি। ভদ্রলোকের এক কথা যাকে বলে আর কি। কেন্দ্রে জিজ্ঞেস করে, ওই লোকের বাসা যে জায়গায় শুনলাম, সেখান থেকে কেন্দ্রে যদি কেউ হামাগুরি দিয়েও আসে, তবুও তার ৩০ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। স্থানীয় নেতারা অবশ্য একদমই বিব্রত বোধ করছেন না। কিন্তু আর্মির লোকজন কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন।লোকজন ভয়ের মাথা খেয়ে উচুঁ স্বরে কিছু বলছে না ঠিকই , কিন্তু চোখের ভাষাতে শাপ-শাপান্ত করে দিচ্ছে। আমার পাশের আঙ্কেল, যাকে আমি হাল্কা পাতলা চিনি, একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণে কর্মরত, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "দেখো আর্মি কত নিয়ম মেনে চলে, একদম সময়মত হাজির। আর ওই নর্মাল লোক এখন আসতে পারেনি। এইসব ব্লাডি সিভিলিয়ানদের দিয়ে কিছু হবে না ......হেন তেন" ।
আগে আর্মির লোকদের কাছ থেকে গালিটা শুনতাম। এখন দেখি, সিভিলিয়ান ই সিভিলিয়ানকে ব্লাডি বলা শুরু করেছে। আকাশের দিকে মুখ করে থুথু ফেললে কি হয় ? সেলুকাস !

কিছুক্ষণ পর, সি এন জি থেকে নামলেন, ফাইনাল লেভেলের বস। মানে যার অধীনে সমগ্র তথ্যসংগ্রহকারীরা কাজ করেছে। তখনো ওই লোকের খবর নেই। তা এই ফাইনাল বস একজন মধ্যবয়েসী মহিলা। কার কাছে যেন শুনলাম স্থানীয় একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তিনি। ভদ্রমহিলাকে কেউ আগে বলছে কিনা জানি না, তবে তিনি নিশ্চিন্তে খালেদা জিয়ার ডামি হিসাবে কাজ করতে পারবেন। এই মরা রোঁদের দিনেও তিনি একটি চমৎকার রোঁদ চশমা লাগিয়ে ঘুরছেন।এসে আমাদের কাছে জানতে চাইলেন , ঘটণা কি ? বলার পর, তিনি একটু আমতা আমতা করে বললেন, আপনারা প্লিজ কালকে আসুন। আমি তো ওই লোককে ঈদের ছুটি দিয়েছি, সে এখন মুক্তাগাছাতে। আজকে ঢাকা আসবে !

মাথায় পুরা আকাশ ভেঙ্গে পরলো বললেও একটু কম বলা হবে। তবে এতক্ষণ ধরে এই মিথ্যা নাটকের মানে কি ?


----------------------------------------------------------

জানের তো মায়া আছে, তাই উপস্থিত কতৃপক্ষকে গালি না দিয়ে, নিজের কপালকেই গালি দিতে দিতে বাসায় আসলাম, শালা ব্লাডি সিভিলিয়ান।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আমি গর্বিত - আমি জলপাই গোত্রভুক্ত নই। আমি ব্লাডি সিভিলিয়ানদের একজন।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

রায়হান আবীর এর ছবি

ভাল লাগল।
আমিও ব্লাডি সিভিলিয়ান হওয়ার জন্য গর্বিত।

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

অতিথি লেখক এর ছবি

কমরেড! সচলায়তন সংকলনে দেখলাম লেখাটা, লাল সালাম, ইউ ব্লাডি সিভিলিয়ান ! দেঁতো হাসি
- খেকশিয়াল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।